তুলসী পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্বন্ধে তুলসী পাতা উপকারী একথা প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু তুলসী পাতা খেলে কোন কোন উপকারগুলো পাওয়া যায় সেকথা অনেকেরই অজানা।
তুলসী গাছের পাতার উপকারিতা
ভূমিকা:- এমন অনেক পাতা আছে যেগুলি স্বাস্থ্যের উপর অসাধারণ প্রভাব দেখায়। এর মধ্যে একটি হল সবুজ রং-এর তুলসি পাতা। আসলে, লোকেরা এই তুলসি পাতা তাদের বাড়িতেও খুব উৎসাহের সাথে লাগায়। তুলসি গাছের মিরাক্যাল সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহল। তুলসির উপকারিতা এবং ঔষুধি গুণ সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি। তবে তুলসির ব্যাবহারেও আছে কিছু নিয়ম।
সর্দিকাশি দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
ঠান্ডা লাগলে বা সর্দি-কাশি হলে তুলসি পাতা ওষুধ হিসেবে খাওয়া হয়। সর্দি ও কাশি খুব দ্রুত নিরাময় করে তুলসি পাতা। বুকে কফ বসে গেলে প্রতিদিন সকালে তুলসি পাতা, আদা ও চা পাতা ভালোভাবে ফুটিয়ে তাতে মধু ও লেবু মিশিয়ে খেলে খুব দ্রুত উপশম মিলবে।
গলা ব্যথা দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
গলা ব্যথার সমস্যায় আমরা আস্থা রাখি তুলসি পাতায়। কারণ গলা ব্যথা দূর করতে তুলসি পাতা অদ্বিতীয়। শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমাতেও তুলসি পাতা বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কয়েকটি তুলসি পাতা ফুটিয়ে সেই জল দিয়ে গার্গল করলে গলা ব্যথা দ্রুত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
ব্রণর সমস্যায় তুলসী পাতার উপকারিতা
তুলসি গাছের পাতা রক্তের বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ দূর করে রক্তকে বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে। এর কারণ তুলসি পাতায় রয়েছে Anti-Bacterial ও Anti-Fungal উপাদান। তুলসি পাতা বেটে তা চন্দন বা গোলাপ জলের সাথে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর্যন্ত রেখে দিতে হবে। এরপর জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। তাছাড়া তুলসি গাছের পাতা দিয়ে চা তৈরী করে পান করলেও ব্রণর সমস্যায় কার্যকরী ফল পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় Blackheads, ব্রণর কালো ছোপ, দাগ, ব্রণ সবকিছুর সমস্যা দূর করা যায়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় তুলসির গুণাগুণ প্রমাণিত হয়েছে।
ত্বকের সংক্রমণ দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
তুলসি গাছের পাতায় আছে Anti Biotic উপাদান। তুলসির এই উপাদান ত্বকের নানারকম সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে। তুলসি পাতার সাহায্যে ত্বকের ব্যাকটিরিয়া বা Arthritis সহজে মিটে যায়। ২৫০ গ্রাম তুলসি পাতা জলে ভালো করে ফুটিয়ে তা তিলের তেলের সাথে মিশিয়ে মুখে লাগালে তা ত্বকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে দারুণ কার্যকরী ফল পাওয়া যায়। এছাড়া তুলসি পাতা বেটে কয়েক ফোঁটা লেবুর রসের সাথে মিশিয়ে ত্বকে লাগালেও সংক্রমণ অনায়াসে কমে আসে। তুলসি পাতার Anti-Microbial ও Anti-Fungal উপাদান ত্বকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হয়। এই কারণে অনেক রকম আয়ুর্বেদিক ওষুধ তুলসি পাতা দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। তবে ত্বকে তুলসি পাতা লাগানোর পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নেওয়া উচিত।
ক্যান্সার প্রতিরোধে তুলসির উপকারিতামরণঘাতি অসুখ ক্যান্সার দূরে রাখতেও সাহায্য করে তুলসি পাতা। তুলসি গাছের পাতায় আছে রেডিওপ্রটেকটিভ উপাদান যা টিউমারের কোষগুলিকে মেরে ফেলে। তুলসি পাতায় উপস্থিত ফাইটোকেমিক্যাল যেমন – রোসমারিনিক এসিড, মাইরেটিনাল, লিউটিউলিন এবং এপিজেনিন উপাদান আছে। এইসব উপাদান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। মানব শরীরে অগ্নাশয়ে যে টিউমার কোষ দেখা দেয় তা দূর করার ক্ষেত্রেও তুলসি পাতা দারুণ উপকারী। এছাড়াও তুলসি পাতা দূরে রাখে ব্রেস্ট ক্যান্সার।
শ্বেতী ও এক্সিমা দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
নিয়ম করে প্রতিদিন তুলসি পাতা খাওয়া হলে শ্বেতী রোগের মত সমস্যা অনায়াসে দূর হয়। এছাড়া তুলসি পাতার দ্বারা এক্সিমার মত রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত যে তুলসি পাতায় থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান এক্সিমার বিরুদ্ধে অসাধারণ ভাবে লড়াই করে।
ডায়াবেটিস দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
তুলসি গাছের পাতা ইনসুলিন উৎপাদনের কাজ করে থাকে। প্রতিদিন খাওয়ার আগে নিয়ম করে তুলসি পাতা খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে যাবে। অর্থাৎ তুলসি অ্যান্টি ডায়াবেটিক ওষুধের কাজ করে। তুলসি গাছে থাকা স্যাপোনিন, ত্রিতারপিনিন ও ফ্ল্যাবোনয়েড ডায়বেটিস রোধ করতে বিশেষ ভাবে কার্যকরী।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তুলসী পাতার উপকারিতা
মানব শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তুলসি পাতা। অ্যাজমা, ফুসফুসের সমস্যা, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি মোকাবিলায় তুলসি পাতা বেশ কার্যকী। জ্বর থেকে মুক্তি পেতেও তুলসি পাতা সমান উপকারী। তুলসি পাতা ও এলাচ জলে ফুটিয়ে সেই জল পান করলে খুব সহজেই বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ক্ষতস্থানে তুলসি পাতা বেটে লাগালেও তা দ্রুত নিরাময় হয়।
চুল পড়া রোধে তুলসী পাতার উপকারিতা
ত্বক ও স্বাস্থ্য ছাড়াও তুলসি পাতার উপকারিতা চুলের ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তুলসি গাছের পাতা চুলের গোড়া মজবুত করে এবং চুলের বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে। তুলসি গাছের পাতা চুলের গোড়া মজবুত করে চুল পড়ার মত সমস্যা দূর করে। এর প্রধান কারণ হল তুলসি পাতায় উপস্থিত থাকা এন্টি মাইক্রোবিয়াল উপাদান। কয়েক ফোঁটা নারকেল তেলে কিছুটা তুলসি গাছের পাতা বেটে মিশিয়ে মাথার স্ক্যাল্পে লাগাতে হবে। এভাবে ৩০ মিনিট রেখে চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় চুলের গোড়া মজবুত হবে, স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে এবং চুল পড়ার সমস্যা ধীরে ধীরে সমাধান হবে। তুলসি পাতার এই সব গুণাগুণের কারণে এটিকে আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে চুলের ওষুধ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
খুশকি দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
তুলসি পাতায় এমন কিছু বিশেষ উপাদান আছে যা চুলের বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করে। এরকমই একটি সমস্যা হল চুলে খুশকি। চুলে খুশকির সমস্যা হয়ে থাকলে অবশ্যই তুলসি গাছের পাতা ব্যবহার করা ভালো। প্রতিদিনের ব্যবহৃত চুলের তেলের সাথে অল্প পরিমাণে তুলসি পাতার রস মিশিয়ে ভালো করে মাথার স্ক্যাল্পে লাগালে স্ক্যাল্পের শুষ্কতা দূর হয় এবং খুশকির সম্ভাবনা রোধ করা যায়। তাছাড়া এই প্রক্রিয়ায় মাথায় চুলকানিও কমে যায়। এছাড়াও তুলসি গাছের পাতা চুলের খুশকি দূর করে, চুলকে নতুন করে উজ্জ্বলতা প্রদান করে ও রুক্ষভাব দূর করতে সাহায্য করে।
পাকা চুলের সমস্যা দূরীকরণে তুলসী পাতার উপকারিতা
মাথায় পাকা চুলের সমস্যা দূরীকরণেও দারুণ কার্যকর এই তুলসি পাতা। এক পাত্র জলে কয়েকটি তুলসি পাতা ভিজিয়ে সারারাত রেখে দিতে হবে। তারপর সেটি বেটে তার মধ্যে আমলকির গুঁড়ো মিশিয়ে সেটি চুলে ভালো করে গোড়া থেকে লাগিয়ে দিন। সকালে উঠে ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় খুব সহজেই পাকা চুলের সমস্যা দূর হবে। তাই নানা রকমের চুলের তেল ও শ্যাম্পুতে তুলসি পাতার ব্যবহার দেখা যায়।
ওজন কমাতে তুলসী পাতার উপকারিতা
নিয়ম করে তুলসি পাতা খেলে তা রক্তে সুগারের মাত্রা ও কোলেস্টরল রোধ করে। এর ফলে খুব সহজেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। সাম্প্রতিক কালে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, তুলসি পাতা দিয়ে তৈরি ২৫০ মিলিগ্রামের একটি ক্যাপসুল প্রতিদিন খাওয়ার ফলে ওবেসিটি ও লিপিড প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অবশ্যই যে কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তুলসী পাতা খাওয়ার অভ্যাস
তুলসি গাছের পাতা ব্যবহার করা খুবই সহজ। তবে তুলসি গাছের পাতা ব্যবহার করার আগে দেখে নিতে হবে যেন সেই পাতায় কালো দাগ ছোপ না থাকে। বিভিন্ন উপায়ে এই তুলসি পাতা ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন –
- (ক) প্রতিদিন খালি পেটে কয়েকটি তুলসি পাতা চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করতে পারলে নানারকমের অসুস্থতা দূরীভূত হয়।
- (খ) তুলসি গাছের পাতা দিয়ে দারুণ এক রকমের চা তৈরী করা সম্ভব। এক পাত্র জলে তুলসী পাতা, আদা ও চা পাতা ফুটিয়ে অল্প পরিমাণ মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
- (গ) পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো খাদ্যে তুলসি গাছের পাতা কুচি কুচি করে কেটে মিশিয়ে খেলেও উপকার পাওয়া যায়।
- (ঘ) তুলসি গাছের পাতা রোদে শুকিয়ে প্রতিদিন অল্প অল্প করে খাওয়া যেতে পারে।
- (ঙ) তুলসি গাছের পাতা চার দিন পর্যন্ত ফ্রিজে রেখে টাটকা অবস্থায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
তুলসি পাতার অপকারিতা
এই তুলসি পাতার কিছু ক্ষতিকারক দিকও অবশ্য আছে। তুলসি পাতা খুব উপকারী হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি এড়িয়ে চলাই ভালো। যেমন –
গর্ভবতী অবস্থায় বা স্তন্যপান করানোর সময় অপকারিতা
মহিলাদের গর্ভাবস্থার সময় বা সন্তান প্রসবের পর স্তন্যপান করানোর সময় সামান্য তুলসি পাতা খেলে কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু অতিরিক্ত তুলসী পাতা খেলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এই সময় তুলসি পাতা না খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া অতিরিক্ত তুলসি পাতার ব্যবহার মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণে তুলসি পাতার ব্যবহার করা ভালো।
রক্তপাতের সমস্যা
অতিরিক্ত পরিমাণে তুলসি পাতা খেলে শরীরে রক্তের প্রবাহ খুবই বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শরীরের স্বাভাবিক রক্ত জমাট হওয়ার প্রবণতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অতিরিক্ত রক্তপাতের সমস্যা দেখা দিতেই পারে। তাছাড়া কোনোরকম Surgery হলে বা কাটা ছেঁড়া থাকলে ওই সময় তুলসি পাতা ব্যবহার করা উচিত নয়। এমনকি সার্জারির দু সপ্তাহ আগে থেকেই তুলসী পাতা খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা
তুলসি গাছের পাতায় অতিরিক্ত পটাসিয়াম থাকার ফলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। তাই যদি নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা থাকলে তুলসি পাতা না খাওয়াই উচিত।
উপসংহার :- তুলসি গাছের পাতার গুণাগুণ হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্থ থাকতে চাইলে প্রতিদিন একটি করে তুলসি পাতা চিবিয়ে খাওয়া খুবই উপকারী। তাই বারান্দায় যেখানে আলো-বাতাস চলাচল করে সেখানে লাগিয়ে রাখুন উপকারী তুলসি গাছ।