বি. এ. জেনারেল (1st Semister) ইতিহাস প্রথম অধ্যায়: প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগে ভারতের ইতিহাসের উপাদান থেকে ৫ নাম্বারের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে দেশীয় সাহিত্যের মূল্যায়ণ করা হল।
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে দেশীয় সাহিত্যের মূল্যায়ণ কর
প্রশ্ন:- ইতিহাসের উপাদান কাকে বলে? প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে দেশীয় সাহিত্যের মূল্যায়ণ কর।
উত্তর:- যে সমস্ত তথ্যসূত্রকে বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে ইতিহাস রচিত হয়, সেগুলিকে ইতিহাসের উপাদান বলে।
প্রাচীন যুগে রচিত বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ, রাজপ্রশস্তি ও বিভিন্ন ফলকে এবং স্তম্ভে খোদিত নির্দেশাবলী থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার বহু উপাদান পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগের ভারত-ইতিহাসের উপাদানগুলিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় – (১) ধর্মশাস্ত্র ও সাহিত্য (২) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এবং (৩) বৈদেশিক বিবরণ।
ধর্মশাস্ত্র ও সাহিত্য থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বহু উপাদান পাওয়া যায়। বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্য, যথা – চারটি বেদ, সূত্রসাহিত্য, বেদাঙ্গ প্রভৃতি থেকে আর্যদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া আর্য-অনার্যের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত বা সমকালীন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বহু কাহিনীও এই গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধার করা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব যুগের ভারত-ইতিহাস রচনার একটি প্রধান উপাদান হল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসাহিত্যগুলি। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। ‘জাতক’-এর কাহিনীগুলি থেকে বুদ্ধের জীবন ও সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার কথা জানা যায়। এখনো পর্যন্ত প্রায় ৫৪৯টি জাতকের কাহিনী সংগৃহীত হয়েছে। উইন্টারনিৎসের মতে, “কেবল সাহিত্য হিসেবেই নয়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অব্দের সভ্যতার ইতিহাসে ‘জাতক কাহিনীগুলি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে।” সিংহলীয় বৌদ্ধ সাহিত্য ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ থেকে বুদ্ধের জীবনী ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশপরিচয় সম্বন্ধে বহু তথ্য পাওয়া যায়। ‘ললিত-বিস্তার’ ও ‘বৈপুল্য-সূত্র’ থেকেও বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। জৈন গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘ভগবতী সূত্র’ ও আচারঙ্গ সূত্র থেকেও বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পুরাণ সমূহের অবদান অনন্য। এজন্য একে ইতিহাস-পুরাণ বলা হয়। অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে পাঁচটির ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। অবশ্য ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পুরাণের গুরুত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ভিনসেন্ট স্মিথ ও এফ. পার্টিজার প্রমুখের মতে, পুরাণে কিংবদন্তী ও ঐতিহাসিক তথ্য এমনভাবে মিশে আছে যে, খুব সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ না করলে ভুল তথ্য এসে যেতে পারে। তাছাড়া পুরাণে বর্ণিত সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী বা তারও পূর্বের। অথচ পুরাণ সংকলিত হয়েছে সম্ভবত গুপ্তযুগে। তাই এতে কল্পনার প্রাবল্য থাকা স্বাভাবিক। অন্যদিকে আর. সি. হাজরা গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনায় পুরাণের সাহায্য নিশ্চিন্তে গ্রহণ করা যেতে পারে।
ভারতের দুই জনপ্রিয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ থেকেও বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। এগুলি থেকে প্রাচীন রাজবংশগুলির কীর্তিকলাপ, সভ্যতার বিস্তার ইত্যাদি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য রামায়ণের ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে মহাভারতের ইতিহাসমূল্য স্বীকৃত। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলেই মনে করা হয়।
প্রাচীন যুগে রচিত জীবনচরিতগুলি ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে মূল্যবান। এগুলির মধ্যে বাণভট্টের হর্ষচরিত’, বিলহন-এর ‘বিক্রমাঙ্কদেবচরিত’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষণ, সন্ধ্যাকর নদীর ‘রামচরিত’, বাকপতির ‘গৌড়বহো’, পদ্মগুপ্তের ‘নবশাহশাঙ্ক-চরিত’, ন্যায়চন্দ্রের ‘হাম্মীর কাব্য’, বল্লাল রচিত ‘ভোজ প্রবন্ধ’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইসব রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য রাজাদের গুণকীর্তন হলেও, সমসাময়িক বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এগুলি থেকে আহরণ করা যায়।
প্রাচীন যুগে কোনো কোনো রাজা ধারাবাহিক ইতিহাস রচনারও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই প্রসঙ্গে কলহন বিরচিত ‘রাজতরঙ্গিণী’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থ রচনায় কলহন সমসামরিক বহু গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। এই গ্রন্থ থেকে কাশ্মীরের ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়।
সমসাময়িক কালে রচিত বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্য ও নাটকাবলী থেকেও প্রাচীন যুগের বহু তথ্য পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এতে রাষ্ট্রপরিচালনা ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বহু তথ্য আছে। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’, ‘গার্গী সংহিতা’ প্রভৃতি গ্রন্থও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সমন্বয়ে প্রাচীন ভারতের ধারাবাহিক যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়েছে। তবে সাহিত্যিক উপাদানগুলি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জনের হাতে পড়ে নানা সময়ে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। তাই সাহিত্যিক উপাদানগুলি ব্যবহারের সময় খুবই সচেতন থাকতে হয়।