প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার কৃষি
ঐতিহাসিক বিষয় | হরপ্পা সভ্যতার কৃষি |
হরপ্পা সভ্যতার কৃষি
ভূমিকা :- আলোচ্য নগর-সভ্যতার অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক হারে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য নাগরিক জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধতর করেছিল। কৃবি অর্থনীতির আলোচনা প্রসঙ্গে দু-তিনটি বিষয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, হরপ্পা সভ্যতার মানুষ কোন কোন ফসল উৎপন্ন করত, কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জল কীভাবে সরবরাহ হত, কৃষিকার্যে ব্যবহৃত উপকরণগুলি কি ছিল প্রভৃতি। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে বৃহৎ শস্যাগারগুলি নির্দ্বিধায় প্রমাণ করে যে, সেযুগে উৎপাদনের প্রাচুর্যতা ছিল। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও কালিবঙ্গান থেকে গম ও যবের দানা প্রাপ্তির বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে ঐ শস্যগুলি সেযুগে উৎপাদিত হত। গুজরাটের রংপুর ও লোথালের প্রত্নকেন্দ্র থেকে ধানের তুষ পাওয়ার ফলে নিঃসংকোচে প্রমাণিত হয় যে হরপ্পীয়রা ধান চাষ করত। তবে অন্যান্য প্রত্নকেন্দ্র থেকে ধানচাষের তেমন প্রমাণ মেলে নি। এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে সমগ্র বিশ্বে আবাদী ধান ফলানোর প্রাচীনতম নজির পাওয়া গেছে উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের দক্ষিণে রিঙ্ক্যায়ন নদীর উপত্যকায় অবহিত কোলদিহাওয়াতে-এমন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নিয়েছিলেন জি. আর. শর্মা ও তার সহকর্মীরা। কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে কোলদিহাওয়ায় প্রাপ্ত চালের দানা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে তিনি এর সময় নির্দিষ্ট করেছিলেন ৬৭১৯ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৫০১০ খ্রিঃপূঃ-এর মধ্যে। কিন্তু ইরফান হাবিব পরবর্তীকালে তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে ধানের ঐ প্রাচীনত্ব সঠিক নয়। কারণ, কোলদিহাওয়ায় ধানের যে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ছিল আসলে কার্বন-সমৃদ্ধ স্তরের একটা ভুল পাঠ। তাঁর মতে কোলদিহাওয়ায় প্রাপ্ত ধানের প্রাচীনত্ব খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের আগে নয়। মহেঞ্জোদারোতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা কার্পাস উৎপাদনের নজির খুঁজে পেয়েছেন। এছাড়া,
বিভিন্ন প্রত্নকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত শস্যদানা প্রমাণ করে যে হরপ্পা সভ্যতায় ছোলা, নানা ধরনের কলাই ও সরষের চাষ হত। উন্নত ও ব্যাপক হারে ফসল উৎপাদনের পিছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল সিন্ধুনদের সংলগ্ন উর্বর ভূখণ্ড। জমিতে চাষ-আবাদের কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় জল কীভাবে সরবরাহ হত সে-বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে সেচখাল ব্যবস্থার প্রয়োগ হরপ্পা সভ্যতায় ছিল বলে মনে হয়। কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে বালুচিস্তান ও আফগানিস্তান-এ বাঁধ বেঁধে সংলগ্ন জলাশয় থেকে জমিতে জল সরবরাহ করা হত। কৃষিকার্যে ব্যবহৃত উপকরণের মধ্যে নিড়ানির উল্লেখ করেছেন ডি. ডি. কোসাম্বী। তাঁর মতে, এই উপকরণকেই কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হরপ্পীয়রা জমিকে চাষোপযোগী করে তুলত। কিন্তু নিড়ানি জাতীয় উপকরণের দ্বারা প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপন্ন করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাম্প্রতিককালে রাজস্থানের কালিবঙ্গান উৎখনন কেন্দ্রে একটি জমিচাষের পদ্ধতি (আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে লাঙলের দাগ) থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, হরপ্পা যুগের মানুষ লাঙলের মাধ্যমে চাষ-আবাদ করত। কালিবঙ্গানের ঐ নিদর্শন ছাড়াও ভাওয়ালপুর ওবানওয়ালিতে পোড়ামাটির (টেরাকোটা) লাঙলের নিদর্শন থেকে সে যুগে লাঙলের ব্যবহারের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। তবে এক্ষেত্রেও একটা অন্তরায় আছে। কারণ, লাঙল সাধারণত লৌহনির্মিত হয়। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় অর্থাৎ লৌহযুগের আগে লাঙল নির্মাণে কোন্ ধাতু ব্যবহৃত হত তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে যেহেতু লৌহনির্মিত লাঙল আবিষ্কৃত হয় নি, তাই খুব সম্ভবত লাঙলের ফলায় শক্ত কাঠ ব্যবহৃত হত বলে কেউ কেউ মনে করেন। সাম্প্রতিককালে অবশ্য ইরফান হাবিব তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, লোহার আগে লাঙলের ফলা তৈরি হত পাথরের টুকরো দিয়ে।
উপরিউক্ত কৃষিজাত পণ্যগুলি যথা – গম, যব, বার্লি, নানা ধরনের কলাই, তৈলবীজ প্রভৃতি হরপ্পীয়দের খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া ধান যে উৎপন্ন হত সেকথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং ভাতও তাদের খাদ্য তালিকায় পড়ে। তবে প্রধান খাদ্য ছিল যব ও গম। খেজুর, তরি-তরকারি, নানা ধরনের পশুর মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরিণত সিন্ধু অঞ্চলসমূহে খেজুর, আঙুর ও আনারস উৎপাদিত হত এমন প্রমাণ মিলেছে খননকার্যের ফলে। হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশ কিছু জীবজন্তুর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, শূকর ও উট। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, সিন্ধুবাসীরা এই সমস্ত জীবজন্তু পালন করত। হরপ্পায় যে অসংখ্য সীলমোহর পাওয়া গেছে সেগুলিতে অঙ্কিত বৃষ-র মূর্তি প্রমাণ করে যে এই গো-জাতীয় জন্তুটির অস্তিত্ব ছিল হরপ্পা সভ্যতায়। গোরু, মহিষ ও বৃষ-র অস্তিত্ব দেখে সংগত কারণেই মনে হয় যে, আর্য সভ্যতার ন্যায় এই সভ্যতায় গো-জাতীয় জীবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। গো- সম্পদের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ থেকে মনে হয় যে দৈনন্দিন জীবনে গরু, মহিষ, বৃষ-র বিশেষ ভূমিকা ছিল। জমি কর্ষণের কাজে মহিষ ও বৃষকে সম্ভবত ব্যবহার করা হত। এছাড়া বিভিন্ন প্রত্নকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত মাটির খেলনাগুলি থেকে গণ্ডার, বাঘ, বানর, কুকুর ও নানা ধরনের পাখির পরিচয় মেলে। হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্ব ছিল কিনা সে নিয়ে এক সময় প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে সংশয় ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দু’একটি প্রত্নকেন্দ্রের ওপরের স্তরে ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না যে, এই সভ্যতার শেষের দিকে ঘোড়ার অস্তিত্ব বজায় ছিল।