জিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক

বিজ্ঞানী জিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক

ঐতিহাসিক চরিত্রজিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক

জিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক

ভূমিকা :- জীববিজ্ঞানের অনন্ত সম্ভাবনার কাজটি বিশ্ববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যিনি প্রথম রোপন করেছিলেন তাঁর নাম জিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক। অতি বিচিত্র তাঁর জীবন- কাহিনী। জীবন শুরু করেছিলেন একজন সৈনিক হিসাবে এবং একজন দক্ষ সমর নায়ক হিসাবে হয়তো সারা জীবন তাঁর কেটে যেত রণাঙ্গনেই। কিন্তু নিয়তির এমনই বিচিত্র খেলা যে মর্মান্তিক এক ঘটনার মধ্যে দিয়ে চিরদিনের জন্য তাঁর সৈনিক জীবনে ছেদ পড়ে গেল। তার পরেই বিশ্ববিজ্ঞানের আলোয় অকস্মাৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ল্যামার্কের বিজ্ঞান প্রতিভা। আধুনিক জীববিজ্ঞানের জনকরূপে আবির্ভূত হলেন ল্যামার্ক। প্রাণী বিজ্ঞানের যে শাখাটির পরীক্ষায় নিয়োজিত হয়েছিলেন তিনি, তার বায়োলজি (Biology) নামকরণ তিনিই প্রথম করেছিলেন। বায়ো অর্থ সজীব পদার্থ, আর লজি হল বিদ্যা। দুয়ে মিলে যে বায়োলজি তাই হলো জীববিদ্যা।

জিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্কের জন্ম

ফ্রান্সের এক অখ্যাত শহরে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ল্যামার্কের জন্ম। স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনায় খুব উল্লেখযোগ্য ছাত্র না হলেও ছেলেবেলা থেকেই নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ ছিল তাঁর অসাধারণ। খোলা আকাশের তলায় ঝোপজঙ্গলে ঘুরে ফুল পাখি পাতা লতা দেখায় তাঁর উৎসাহ ছিল খুব বেশি।

এইভাবেই প্রকৃতির পাঠশালায় শিক্ষা নিয়ে আর নানান বিষয়ের বই পড়ে অতিবাহিত হয় তাঁর শৈশবকাল।

১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সীমান্তে জার্মান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ ঘটলে দুই দেশের মধ্যে আরম্ভ হয়ে যায় যুদ্ধ। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে দীর্ঘ দিন-টানা সাত বছর। তবুও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয় না।

এই দীর্ঘমেয়দী যুদ্ধের সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে ফ্রান্সের যুবকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করানো শুরু হয়। যুবক ল্যামার্কও বাদ গেলেন না। সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে নাম লিখিয়ে একদিন পুরোপুরি সৈনিক হয়ে গেলেন।

অল্প দিনের মধ্যেই সাহস, বুদ্ধি স্বাভাবিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের গুণে সৈন্যবাহিনীতে পদোন্নতি ঘটে ল্যামার্কের। ক্রমে এক কোম্পানি সৈন্যদলের সেনাপতির পদ পেলেন।

সেই সময়েই একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই পড়ে থাকেন। পরে সেই আহত শরীর নিয়ই প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে মূল বাহিনীতে ফিরে গেলেন তিনি।

মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই তাঁর নেতৃত্বে এক আকস্মিক ঝটিকা আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করল জার্মান বাহিনী।

সীমান্ত যুদ্ধে এই বিজয়ের পর ল্যামার্কের বুদ্ধি ও বীরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র ফ্রান্সে। সামরিক বাহিনীতেও পেলেন সম্মান ও পদোন্নতির পুরস্কার।

ল্যামার্কের জীবনের সৈনিকের ভূমিকার এর পরেই ঘটল রূপান্তর। নিতান্তই এক আকস্মিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই নতুনতর সংগ্রামী ভূমিকায় প্রবেশ করতে হল তাঁকে।

সেখানে তিনি যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তা হল প্রচলিত সংস্কার অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে যুক্তি ও বিজ্ঞান চিন্তার সংগ্রাম।

সামরিক ব্যারাকে খেলাধুলোর সময় একদিন ল্যামার্ক প্রচণ্ডভাবে আহত হলেন। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে স্থানান্তরিত করা হল হাসপাতালে। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন ল্যামার্কের লসিকা গ্রন্থি ছিঁড়ে গেছে। শারীরিক ভাবে অর্ধপঙ্গু অবস্থায় থাকতে হবে তাঁকে সারা জীবন।

এভাবেই সামরিক জীবনে চিরতরে ছেদ পড়ল ল্যামার্কের। তিনি ফিরে এলেন গ্রামের বাড়িতে।

বাড়িতে তখন সংসারি বাবা তাঁর দশটি সন্তানকে নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। নিত্য অভাবের তাড়না সংসারে, তার সঙ্গে এসে জুটলেন অক্ষম-প্রায় ল্যামার্ক।

মাইনে থেকে যা কিছু সঞ্চয় ছিল ল্যামার্কের, অল্পদিনের মধ্যেই তা উড়ে গেল। বাধ্য হয়েই তাঁকে কাজের সন্ধানে ছুটতে হল প্যারিসে। খুঁজে পেতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা ব্যাঙ্কে করণিকের কাজ জুটিয়ে নিলেন।

মাইনের সামান্য টাকার বেশির ভাগটাই পাঠাতে হত বাড়িতে বাবাকে ছোট ভাইবোনদের করুণ মুখগুলির কথা ভেবে। নামমাত্র ভাড়ায় নিজে আস্তান নিলেন প্যারিসের লাতিন কোয়ার্টারসে।

আলোবাতাসহীন নোংরা নরকসদৃশ পরিবেশে ছোট্ট একটা কুঠুরিতে থেকে দিন কাটতে থাকে ল্যামার্কের।

বাড়ি থেকে আরো টাকার তাগিদ আসতে লাগল ক্রমাগত। তাই বাধ্য হয়েই বেশি রোজগারের আশায় ব্যাঙ্কের কাজ ছেড়ে দিয়ে আরম্ভ করলেন ভাড়াটে সাংবাদিকের কাজ।

ছেলেবেলায় ভাল গাইতে পারতেন। এই সময় প্যারিসের রাস্তায় গান শুনিয়েও রোজগার করতে হয়েছে তাঁকে কিছুদিন।

এত কিছুর মধ্যেও স্বপ্ন দেখতেন ল্যামার্ক। জীবনে বড় হবার স্বপ্ন-দুঃখী মানুষদের দুঃখ দূর করার স্বপ্ন।

সেই উচ্চাকাঙক্ষার তাড়নাতেই একদিন সবকিছু ছেড়ে ভর্তি হয়ে গেলেন ডাক্তারি ক্লাশে।

এই সময়েই যেন ভাগ্যের চাকা অকস্মাৎ মোড় ঘুরল ল্যামার্কের জীবনে। ডাক্তারি পড়ার সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ফরাসী দার্শনিক ও জীববিজ্ঞানী জ্যাকুইশ রুশোর। তাঁর প্রভাবেই ধীরে ধীরে ল্যামার্কের সুপ্ত প্রতিভার জাগরণ ঘটল। ল্যামার্ক আকৃষ্ট হলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রতি এবং তিনি উপলব্ধি করতে পারেন এতদিনে জীবনের সঠিক পথে পা দিতে পেরেছেন। এতদিনের লক্ষাহীন জীবনে এভাবেই পেলেন তিনি স্থিতি ও আত্মবিশ্বাস।

রুশোর প্রেরণায় উদ্ভিদ জগতের বিষয়ে যতই পড়াশুনা করেন ল্যামার্ক বুঝতে পারেন, এক অন্তহীন প্রকৃতি, সুন্দর অরণ্য-পথ তাঁর সম্মুখে বিস্তৃত। সেই পথের মোড়ে মোড়ে রহস্যের হাতছানি। আনন্দ তৃপ্তিতে এই নতুন পথেই পদচারণা শুরু করেন ল্যামার্ক।

তাঁকে পথ দেখাতে থাকে রুশোর উপদেশ ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পূর্বসূরী মহাবিজ্ঞানীদের সাধনা।

উদ্ভিদ জগতের নানা গাছপালা, লতাপাতা ফুলফলের একটা বৈজ্ঞানিক ছক তৈরি করেছিলেন কার্ল লিনিয়াস। তাদের নতুন নামকরণও তিনিই করেছিলেন। কিন্তু অসংখ্য উদ্ভিদের মধ্যে কোনো শ্রেণীবিভাগ তিনি করে যেতে পারেন নি। প্রথমে লিনিয়াসের সেই অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার সংকল্প নিলেন ল্যামার্ক।

এই কাজ সম্পূর্ণ করতে হলে উদ্ভিদ জগতের অন্তঃসঞ্চারী জীবন-স্পন্দনটির সঙ্গে পরিচয় হওয়া প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে ল্যামার্ক উদ্ভিদ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র নিয়ে ডুবে গেলেন।

কিন্তু কেবল কেতাবি অভিজ্ঞতা হলেই তো চলবে না। চাই প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতা।

ইতিপূর্বে অরণ্য পর্বত ঘুরে দেখার সুযোগ তাঁর জীবনে ঘটে নি। তখনও যে পর্যটনে বেরিয়ে পর্যবেক্ষণে নামবেন তেমন অর্থ তাঁর কোথায়? তাই ভেবে ভেবে এক উপায় বার করলেন।

তিনি দেশের ও বিদেশের পর্যটকদের সঙ্গে মিশে দেশ-বিদেশের গাছপালা ফুলফল ও উদ্ভিদ ইতিহাস সম্বন্ধে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে নানা বিষয় জানার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এভাবে খুব একটা সুবিধা যে হল তা নয়। বেশির ভাগ পর্যটকই তাঁর সব উদ্ভট প্রশ্ন শুনে মুখ ফিরিয়ে নিত, অনেকে তাঁকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করতে লাগল।

বাধ্য হয়ে ল্যামার্ক নিজেই এবারে প্যারিসের উপকন্ঠে বনজঙ্গলে ঘোরা আরম্ভ করলেন। নদীর ধারে, বনে বাদাড়ে গাছপালার নমুনা দেখে দেখে দিন কাটতে লাগল তাঁর। খুঁজে খুঁজে তিনি সংগ্রহ করতে লাগলেন বিচিত্র সব নমুনা।

অনেক সময়, যাঁরা প্যারিসের বাইরে বেড়াতে যেত ল্যামার্ক তাদের বিশেষ উদ্ভিদের নমুনা নিয়ে আসার অনুরোধ জানাতেন। এভাবে সংগৃহীত নমুনা জড়ো করা হতে লাগল তাঁর চিলেকোঠায়। দিনে দিনে সংগৃহীত হয়ে চলল দেশ বিদেশের নানা জানা-অজানা বিচিত্র উদ্ভিদের সঞ্চয়।

ক্রমে ব্যাপক অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ওপর নিজস্ব একটা অভিজ্ঞতা গড়ে উঠল ল্যামার্কের। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এরপরে তিনি লিখে ফেললেন একটি বই। নাম দিলেন Flare francaise বা উদ্ভিদের কথা।

বইটি প্রকাশিত হবার পরে সমাদৃতও হল। বিক্রি হতে লাগল হু হু করে। বই বিক্রির টাকা থেকে লেখকের প্রাপ্তিযোগও মন্দ হল না।

অনেকদিন পরে ইচ্ছে মতো খরচ করার উপযুক্ত বেশ কিছু টাকা পেয়ে উল্লসিত হন ল্যামার্ক। সবার আগে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। অবশিষ্ট টাকায় নিজের গবেষণার কাজ চালাতে লাগলেন।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে বইটির সুবাদে প্যারিসের বিদগ্ধ মহলেও পরিচিতি লাভ করলেন ল্যামার্ক। এবারে সুযোগও আর অধরা থাকল না। সৌভাগ্যগুণে যেন নিজে থেকেই ধরা দিতে লাগল।

প্যরিসের এক বিশিষ্ট অভিজাত হলেন কাউন্ট বাফুন। প্রকৃতি বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহের কথাও সুবিদিত। ল্যামার্কের বইটির প্রশংসা শুনে তিনি একদিন লেখককে ডেকে পাঠালেন প্রাসাদে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ল্যামার্ক জানতে পারেন, বাফুন তাঁর ছেলেকে পাঠাতে চান ইউরোপ-এর অরণ্য পর্বত ঘুরে দেখে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে। তাঁর ইচ্ছা, ল্যামার্ক গাইড হিসাবে সহযাত্রী হন তাঁর ছেলের।

বাফুনের প্রস্তাবে ল্যামার্ক যেন হাতে স্বর্গ পান। মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ধনীর দুলালকে ইউরোপের নানা দেশ ঘুরিয়ে দেখাবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বিশাল উদ্ভিদ জগতের প্রত্যক্ষ পরিচয় লাভের এমন রথ দেখা ও কলাবেচার মতো মওকা কি সহজে পাওয়া যায়? এককথায় রাজি হয়ে গেলেন ল্যামার্ক।

যথাসময়ে বাফুনের ছেলেকে নিয়ে ইউরোপ পর্যটনে বেরিয়ে পড়লেন এবং একদিন তাঁরা ফিরেও এলেন প্যারিসে।

ততদিনে ল্যামার্কের সান্নিধ্যে নিসর্গ বিষয়ে বাফুনের ছেলে যথেষ্ট সচেতনা লাভ করেছে। সন্তুষ্ট হন বাফুন। খুশি হয়ে তিনি মোটা অঙ্কের ফ্রাঙ্ক পুরস্কার হিসাবে তুলে দেন ল্যামার্কের হাতে।

এখানেই ক্ষান্ত হলেন না বাফুন। ততদিনে তিনি ল্যামার্কের গুণমুগ্ধ সহযোগীতে পরিণত হয়েছেন। নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে প্যারিসের বিজ্ঞান আকাদেমিতে ল্যামার্ককে জুটিয়ে দিলেন সদস্যপদ।

বাফুনের চেষ্টায় উৎসাহে অভিজাত মহলেও ল্যামার্কের নাম ছড়িয়ে পড়তে বিলম্ব হল না।

ক্রমে ল্যামার্কের উদ্ভিদ বিষয়ে প্রতিভার খ্যাতি এতটাই বিস্তৃত হল যে সম্রাট ষোড়শ লুই স্বয়ং তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর প্রিয় পুষ্পোদ্যান জার্ডিন ডুবয়-এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ল্যামার্কের হাতে তুলে দিলেন।

তাঁর প্রত্যক্ষ তদারকিতে অল্প দিনেই ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠল রাজকীয় উদ্যান। শোভায় সৌন্দর্যে অতুলনীয় জার্ডিন ডুবয় উদ্যানের খ্যাতি প্যারিসের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল।

ল্যামার্ক যেই সময়ে সম্রাটের বাগানের দায়িত্বে কর্মরত সেই সময়েই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল মুক্তিকামী ফরাসী জনগণের বজ্রকন্ঠ।

সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে উদ্ভূত গণজাগরণের পরিণতিতে সংঘটিত হল ফরাসী বিপ্লব। দেশে প্রতিষ্ঠিত হল ফরাসী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।

এই বিধ্বংসী বিপ্লব পর্বে সর্বহারাদের নতুন মারণাস্ত্র গিলোটিনে প্রাণ দিতে হল বহু অভিজাত, রাজপুরুষ ও নির্দোষ নাগরিকদের। দেশের বহু প্রতিভাবান পুরুষকেও গিলোটিনের বলি হতে হল।

বেগতিক বুঝতে পেরে জার্ডিনের রাজোদ্যান ছেড়ে সর্বহারাদের দলে সামিল হলেন ল্যামার্ক। ফরাসী প্রজাতন্ত্রী সরকার ইতিমধ্যে জার্ডিন ডুবয় উদ্যানের নাম বদল করে নতুন নামকরণ করলেন জার্ডিন দেৎপ্লান্টেস।

সেই সঙ্গে ল্যামার্ককেও নতুন সরকারের অধীনে নতুন কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত করে প্রতিভার স্বীকৃতি জানানো হল। তিনি হলেন জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণশালার প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক।

এই প্রতিষ্ঠানে সেই সময়ে স্বমহিমায় বিরাজ করছিলেন প্রাণিবিদ্যার অন্যতম প্রতিভাবান গবেষক জিওফ্রে সেৎ হিলারী। ল্যামার্ক নিলেন কীটপতঙ্গ ও আণুবীক্ষণিক প্রাণীদের দায়িত্ব। এই সময়েই ল্যামার্ক তাঁর গবেষণার নিজস্ব শাখাটির নামকরণ করলেন Biology।

এখানে ইতিহাস সংরক্ষণশালার প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারেই ল্যামার্ক তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের সন্ধান পান। তাঁর উদ্ভিদ বিজ্ঞানের সংগৃহীত তথ্যকে কাজে লাগিয়ে এই সময়ে তিনি যাবতীয় জীবকুলকে শ্রেণীবদ্ধ করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করলেন।

জীবজন্তুদের বৈজ্ঞানিক নাম নির্দিষ্ট করতে বসে তিনি জীবজন্তু পশুপাখীদের জীবনের পারস্পরিক সম্পর্কের চরম সত্যের সন্ধান লাভ করেন। এই সূত্রেই মানবসৃষ্টির প্রাকৃতিক রহস্যটির উৎস-মুখ তথা বিবর্তনকে প্রাণিবিদ্যার এক সম্পূর্ণ মৌলিক তত্ত্ব হিসাবে তিনিই সর্বপ্রথম প্রচার করেন।

তাঁর এই বিবর্তন তত্ত্বেরই ব্যাখ্যাকার হিসাবে পরবর্তীকালে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন চার্লস ডারউইন

ল্যামার্ক দেখলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত পরিবেশে জীবনের ভারসাম্য অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে জীবদেহ ও স্বভাবে ঘটে রূপান্তর। জীবদেহের নির্দিষ্ট কোন অঙ্গের বহুল ব্যবহার সেই অঙ্গটিকে করে তোলে সবল, দেয় প্রায়োজনানুগ গঠন। এই ভাবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে নির্দিষ্ট সেই অঙ্গের রূপান্তরক্রিয়া চলতে থাকে।

একইভাবে নির্দিষ্ট কোন অঙ্গের দীর্ঘদিনের অব্যবহার বা কম ব্যবহারের ফলে ক্রমে অঙ্গটি হয়ে পড়ে নিস্তেজ এবং সর্বশেষে ঘটে অবলুপ্তি। পরিবর্তনের এই ধারাটিই হল জীবদেহের বিবর্তন যা অব্যাহত গতিতে বহমান থাকে বংশ পরম্পরায়।

ল্যামার্ক আরও বলেছেন, জীবদেহের পরিবেশানুগ এই পরিবর্তনের গতি কিন্তু ধীর-অতি ধীরে তা সঞ্চারিত হয় বংশ পরম্পরায় এবং অঙ্গের আকার ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই নিরূপিত হয় দেহের গঠন ও অভ্যাস।

বস্তুতঃ জীবজন্তু পশুপাখির শরীর ও অঙ্গের আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই প্রকাশ পায় তাদের পূর্বপুরুষের অভ্যস্ত জীবনধারা, অভ্যাস ও পরিবেশের পরিচয়।

ল্যামার্ক তাঁর এই মৌলিক তত্ত্বের নামকরণ করেছেন Theory of Acquered characteristics। এই তত্ত্বের স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি প্রমাণ ও ব্যাখ্যাসহ রচনা করলেন তাঁর জগদ্বিখ্যাত বই Philosophic Zoologique। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে।

এই বইতে তাঁর সম্পূর্ণ তত্ত্বটিকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন ল্যামার্ক। প্রথমভাগে তিনি বলেছেন, পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা থেকেই উদ্ভিদ ও পশুপাখির দেহের গঠনের বংশানুক্রমে পরিবর্তন ঘটে যায়। উদাহরণ হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন, নির্দিষ্ট অভিমুখে ধাবিত বাতাস যদি কোন গাছকে ক্রমাগত অবনমিত করতে থাকে তবে কালক্রমে বায়ুর গতি সামাল দেবার প্রয়োজনে গাছটি বেঁকে যাবে।

একইভাবে, বরফ ঢাকা সুমেরু অঞ্চলে বসবাসকারী জন্তুজানোয়ার প্রত্যেকের দেহেই দেখা যায় ঘন লোমের চাদর। বরফাচ্ছন্ন অঞ্চলের হিমশীতল পরিবেশে এই লোমের চাদরই প্রাণীদের শরীরের উত্তাপ ধরে রেখে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখে।

দ্বিতীয় ভাগে তিনি বলেছেন, জীবের কোনও নির্দিষ্ট অঙ্গগঠনের রূপান্তর বা পরিবর্তন নির্ভর করে সেই অঙ্গের ব্যবহার বা অব্যবহারের ওপরে। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে দেখা যায় ব্যালে নর্তক-নর্তকীদের পায়ের পেশী যথেষ্ট উন্নত ও বলিষ্ঠ। পেশার কারণেই কামারদের হাতের পেশী এমন শক্ত ও সুগঠিত হয়ে থাকে।

ল্যামার্ক তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় ভাগে বলেছেন, অভ্যাস ব্যবহারের ধারায় প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য জীবদেহে অতি ধীর গতিতে দীর্ঘ সময় ধরে বংশধারায় আত্মপ্রকাশ করে। গাছের উঁচু ডালের কচিপাতা খাবার ক্রমাগত প্রচেষ্টা প্রবণতা রূপে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে জিরাফকে অস্বাভাবিক লম্বা গলাওয়ালা প্রাণীতে রূপান্তরিত করেছে।

ল্যামার্কের উপস্থাপিত প্রথম দুইটি তত্ত্ব সম্পর্কে সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কোন প্রশ্ন তোলেন নি। তাঁরা মেনে নিয়েছেন, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজন্তু ও উদ্ভিদ জীবনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।

কিন্তু, পরিবেশের অনুবর্তী হয়ে চলায় প্রাপ্ত প্রবণতা যে বৈশিষ্ট্য রূপে বংশ ধারায় প্রবাহিত হয় এই তত্ত্বটিকে তাঁরা অবৈজ্ঞানিক ও ভুল সিদ্ধান্ত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁদের যুক্তির স্বপক্ষে ইঁদুরের ওপরে একটি পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরলেন।

কিছু স্ত্রী ও পুরুষ ইঁদুর ধরে তাদের লম্বা লেজ কেটে দেওয়া হয়েছিল।

স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বসবাস করার কিছুদিন পরে স্ত্রী ইঁদুরদের যেসব শাবক জন্মাল তাদের লেজের গঠনে কোনও পরিবর্তনই ঘটে নি।

এই পরীক্ষার ফলাফল থেকে সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করলেন, ল্যামার্কের তত্ত্ব যদি নির্ভুল হত তাহলে মুষিক শাবকদের সেজহীন হয়ে জন্মাতে দেখা যেত। পিতামাতার কর্তিত লেজের বৈশিষ্ট্য লাভ করে নি বলেই স্বাভাবিক দীর্ঘ লেজ তারা জন্ম থেকেই লাভ করেছে।

সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কিন্তু কেউই লক্ষ্য করেন নি যে ল্যামার্ক স্পষ্টই তাঁর তৃতীয় তত্ত্বাংশে বলেছেন, অভ্যাস ব্যবহারে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য বংশধারায় বহু ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উত্তর পুরুষের স্বভাবে প্রকটিত হয়। আকস্মিক অঙ্গহানি স্বভাবের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে না।

সমসাময়িক জীববিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হলেও ল্যামার্কের Theory of Adaptation বা অভিযোজন তত্ত্ব আবিষ্কার ব্যর্থ হয় নি।

বর্তমান জীব প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির মূলে জীবতাত্ত্বিকদের পথ প্রদর্শক বলে যদি স্বীকার করতে হয় ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিশিষ্ট ভাবনা, তাহলে স্বীকার করতেই হয়, ল্যামার্কের তত্ত্বই ছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদের মহৎ ভাবনার পথপ্রদর্শক।

প্রকৃত প্রস্তাবে, ল্যামার্কই সর্বপ্রথম তাঁর জীবদেহে প্রাপ্ত-বৈশিষ্ট্যের বিশিষ্ট ভাবনাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও বিশ্লেষণের পথে সঞ্চারিত করেছিলেন উত্তরকালের জীববিজ্ঞানে। সংশোধিত হয়েছিল তাঁর অভিযোজনবাদের ভুল-ত্রুটি সমূহও।

জীববিজ্ঞানের গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ ল্যামার্কের ব্যক্তিগত জীবন ছিল দুঃখময়, একের পর এক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত। দারিদ্র্যের দুঃসহ যন্ত্রণা ও স্বজন হারানোর বেদনা তাঁকে পীড়িত করেছে জীবনভোর।

বার বার পত্নীবিয়োগের কারণে জীবনে চারবার বিবাহ করতে হয়েছে তাঁকে। ফলে মাতৃহারা সন্তানদের ক্রমবর্ধমান চাপ তাঁকে সামলাতে হয়েছে সীমিত উপার্জন থেকেই। একারণে গবেষণার কাজেও বিঘ্ন ঘটেছে। দুই দিকের সমতা বিধান করতে গিয়ে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছেন। তবুও ভেঙ্গে পড়েন নি। অসামান্য মনোবল ও প্রতিভার সাহায্যে সমস্ত প্রতিকূলতা তুচ্ছ করে নতুন নতুন ভাবনা ও আবিষ্কারের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানী, তারপর জীববিজ্ঞানী।

অন্নহীন বস্ত্রহীন জীর্ণদেহ বিজ্ঞানীর সম্বল বলতে ছিল কাউন্ট বাফুনের বদান্যতা। এছাড়া দেশের অভিজাত মহলের সামান্য স্বীকৃতিও জোটে নি তাঁর ভাগ্যে। আর শেষ জীবন পর্যন্ত একমাত্র কন্যা কর্নেলির সেবা-যত্নই ছিল তাঁর বাঁচার অবলম্বন। গীর্জার কাজে সামান্য উপার্জন কর্ণেল অকাতরে পিতার সেবায় ব্যয় করেছেন। অন্যান্য সন্তানেরা ডানা গজাবার পরেই ডানা মেলে ত্যাগ করেছিল তাদের হতভাগ্য পিতাকে।

পিতৃভক্ত কর্নেলির সাহায্যেই ল্যামার্ক শেষ করতে পেরেছিলেন তাঁর প্রাণিবিদ্যার ওপরে ষষ্ঠ বইটি লেখার কাজ এবং তার পরে পরেই ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ছেদ পড়ে তাঁর ইহ জীবনের।

উপসংহার :-

(FAQ) জিন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

Leave a Comment