বিপ্লবী আন্দোলনকালে যুগান্তর দল পি মিত্র ও তরুণ নেতাদের বিরোধিতা, তরুণ নেতাদের নীতি, ইস্তাহার ও পুস্তিকা প্রকাশ, যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশ, পত্রিকার প্রভাব, পত্রিকার প্রচার সংখ্যা, বিপ্লবী ভাবধারা প্রচার, যুগান্তর দলের কর্মকেন্দ্র, অস্ত্রশস্ত্র ও বোমা তৈরি, প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান, সশস্ত্র উদ্দোগ, কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা, আলিপুর বোমা মামলা ও সরকারি দমন নীতি সম্পর্কে জানবো।
বিপ্লবী আন্দোলনকালে যুগান্তর দল
বিষয় | যুগান্তর দল |
যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশ | ১৮ মার্চ, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ |
প্রধান উদ্যোক্তা | বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত |
কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা | ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী |
আলিপুর বোমা মামলা | ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ |
সূচনা:- মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হলেও বাংলা ছিল তার প্রাণ কেন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দ -এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির উদ্দেশ্যে বাংলার তরুণ দল বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিপ্লববাদী আন্দোলনের সূচনা
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিপ্লববাদী আন্দোলন বাংলায় সুসংহত রূপ ধারণ করলেও, বাংলায় এর সূচনা হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই।
বিপ্লববাদী কার্যকলাপের প্রস্তুতি শুরু
জাতীয়তার পিতা মহারাজ নারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা এবং নবগোপাল মিত্র -এর হিন্দু মেলা -র উদ্যোগে ব্যায়াম ও শরীর চর্চার মাধ্যমে বাংলার যুব সমাজের মধ্যে বিপ্লববাদী কার্যকলাপের প্রস্তুতি শুরু হয়।
অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মার্চ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘অনুশীলন তত্ত্বের’ আদর্শে সতীশচন্দ্র বসু কলকাতায় বাংলার প্রথম বিপ্লবী-কেন্দ্র ‘অনুশীলন সমিতি‘ প্রতিষ্ঠা করেন।
পি. মিত্র ও তরুণ নেতাদের মধ্যে বিরোধ
বিপ্লবী আন্দোলনের কার্যপদ্ধতি নিয়ে অচিরেই অনুশীলন সমিতির সভাপতি পি. মিত্রের সঙ্গে অরবিন্দ-ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, দেবব্রত বসু, অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও অপরাপর তরুণ নেতাদের বিরোধ বাধে।
তরুণ নেতাদের নীতি
তরুণ নেতারা পি. মিত্রের নীরব শরীরচর্চার নীতির পরিবর্তে বিপ্লবী আদর্শ প্রচার ও বৈপ্লবিক কার্যাবলীর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই ব্যাপারে তাঁরা সুবোধচন্দ্র মল্লিক, চারুচন্দ্র দত্ত এবং অরবিন্দ ঘোষ -এর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা পান।
ইস্তাহার ও পুস্তিকা প্রকাশ
বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের জন্য তাঁরা ‘ভবানী মন্দির’, ‘সোনার বাংলা’, ‘No Compromise’, ‘রাজা কে?’ প্রভৃতি ইস্তাহার ও পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশ
অবশেষে অরবিন্দ ঘোষের পরামর্শ ও ভগিনী নিবেদিতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বারীন্দ্র ও ভূপেন্দ্রনাথের উৎসাহে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ ‘যুগান্তর পত্রিকা‘ প্রকাশিত হয়। এই নামটি শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘যুগান্তর’ উপন্যাস থেকে গ্রহণ করা হয়।
পত্রিকার প্রভাব
এই পত্রিকা সরাসরি সশস্ত্র পথে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ভারত -এর স্বাধীনতার বাণী প্রচার করত। জনমানসে এই পত্রিকার প্রভাব ছিল অপরিসীম।
সুপ্রকাশ রায়ের অভিমত
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন যে, “এই পত্রিকাখানি বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দেশব্যাপী, বিশেষ করিয়া বাংলাব্যাপী নূতন জাতীয়তাবাদী জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার যুব-সম্প্রদায়ের চেতনা জাগাইয়া তুলিবার কাজে এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।”
পত্রিকার প্রচার সংখ্যা
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ছিল সাত হাজার। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর বোমার মামলা চলাকালে যখন তা বন্ধ হয়ে যায় তখন এর প্রচারসংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজার।
যুগান্তর দল
এই গোষ্ঠী পত্রিকার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত বলে এর পূর্ব নামের স্মৃতি ক্রমশ জনমন থেকে মুছে যায় এবং এই গোষ্ঠী ‘যুগান্তর দল’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বিপ্লবী ভাবধারা প্রচার
এই সময় অরবিন্দ ঘোষ সম্পাদিত বন্দেমাতরম এবং ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় সম্পাদিত সন্ধ্যা পত্রিকাও সরাসরি বিপ্লবী ভাবধারা প্রচার করত।
যুগান্তর দলের কর্মকেন্দ্র
সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডে অরবিন্দের পৈতৃক বাগানবাড়িতে ‘যুগান্তর’ দলের বৈপ্লবিক কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মাতৃমুক্তিযজ্ঞে নিবেদিত-প্রাণ ত্যাগী বিপ্লবীরা এখানে কঠোর ব্রহ্মচর্য ও চরম কৃচ্ছ্রসাধনার মাধ্যমে আগামী দিনের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন।
অস্ত্রশস্ত্র ও বোমা তৈরি
- (১) দেশব্যাপী সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য এখানে অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ-এর নাম-কাটা ছাত্র উল্লাসকর দত্তের ওপর বোমা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- (২) বাংলায় ‘যুগান্তর সমিতি’-ই হল বোমা তৈরির কাজে পথপ্রদর্শক। বোমা তৈরি শিক্ষার জন্য মেদিনীপুরের হেমচন্দ্র দাস কানুনগো পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে প্যারিস যাত্রা করেন।
দলের পূর্ব লক্ষ্য ত্যাগ
পূর্বে এই দলে সন্ত্রাসবাদ বা গুপ্তহত্যার কোনও স্থান ছিল না। বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান, কিন্তু সরকারি দমননীতির ফলে তাঁরা সন্ত্রাসবাদের পথ ধরতে বাধ্য হন। তাঁরা জানতেন যে, দু-চারজন ইংরেজ হত্যা করে স্বাধীনতা আসবে না, কিন্তু জনমনে প্রবল উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার হবে।
প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান
বিপ্লবী সমিতিগুলি তাদের কার্য পরিচালনার জন্য প্রথমে দেশহিতৈষী ধনবান ব্যক্তিদের দানের ওপর নির্ভর করত। পরে বিপ্লবী কার্যাবলী বৃদ্ধি পেলে অধিক অর্থের প্রয়োজনে অর্থ সংগ্রহ বিপ্লবীরা ডাকাতির পথ গ্রহণে বাধ্য হন। পি. মিত্র ডাকাতির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। অরবিন্দ ঘোষ যুক্তি দেখান যে, দেশেরমুক্তির প্রয়োজনে কোনও কাজই নীতিবিরুদ্ধ নয়।
সশস্ত্র উদ্দোগ
- (১) ‘যুগান্তর’ দলের উদ্যোগে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসামের’ স্বৈরাচারী লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার এবং বাংলার গভর্নর স্যার এন্ড্রু ফ্রেজারকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়।
- (২) ঢাকার ভূতপূর্ব ম্যাজিস্ট্রেট অ্যালেন সাহেবের ওপর গুলি চলে (২৫শে ডিসেম্বর, ১৯০৭ খ্রিঃ), গুলি চলে কুষ্ঠিয়ার পাদরি হিকেনবথেমের ওপর। চন্দননগরের স্বৈরাচারী মেয়র তাদিভেলের গৃহে বোমা পড়ে (১১ই এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রিঃ)। এইভাবে সারা বাংলার নানাস্থানে রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিশ্বাসঘাতক নিধন চলতে থাকে।
কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা
- (১) বিপ্লবীদের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। বহু নির্দোষ স্বদেশী-কর্মীর ওপর কঠোর দণ্ডাজ্ঞা দেওয়ার ফলে বিপ্লবী সমিতি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রাণভয়ে তিনি বিহারের মজঃফরপুরে বদলি হয়ে যান।
- (২) মুরারিপুকুর বাগানবাড়ির দুই তরুণ বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু স্বৈরাচারী বিচারক কিংসফোর্ড-কে সেখানে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেন (৩০শে এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রিঃ)। ভুলক্রমে তাঁদের হাতে মিস ও মিসেস কেনেডি নামে দু’জন নিরপরাধ মহিলা নিহত হন।
- (৩) পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পূর্বেই ১লা মে প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন এবং বন্দি ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় (১১ই আগস্ট, ১৯০৮ খ্রিঃ)।
আলিপুর বোমার মামলা
এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে পুলিশ মুরারিপুকুর বাগানবাড়ি ও অন্যান্য কয়েকটি স্থানে তল্লাশি চালিয়ে অরবিন্দ, বারীন্দ্র সহ মোট সাতচল্লিশ জনকে গ্রেপ্তার করে বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলা শুরু করে (১৯০৮ খ্রিঃ)।
আসামিদের পক্ষে উকিল
- (১) আসামিদের পক্ষে উকিল ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ (পরবর্তীকালে ‘দেশবন্ধু’)। মামলা চলাকালে নরেনগোঁসাই নামে জনৈক দুর্বলচিত্ত বিপ্লবী পুলিশের কাছে দলের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে থাকলে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু নামে দুই বিপ্লবী জেলের মধ্যে গোপনে পিস্তল আনিয়ে নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন।
- (২) বিচারে তাঁদের ফাঁসি হলেও জেলের মধ্যে এই বিশ্বাসঘাতক নিধন—সমগ্র বিশ্বের বিপ্লববাদী ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
মামলার বিচার
আলিপুর বোমার মামলা প্রায় এক বছর চলে। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী নায়ক অরবিন্দ ঘোষ মুক্তিলাভ করলেও অধিকাংশ বিপ্লবীরই দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড বা দ্বীপান্তরের শাস্তি হয় (১৯০৯ খ্রিঃ)।
সরকারি দমননীতি
- (১) এরপর সরকার নানাভাবে বিপ্লবী আন্দোলন দমনে সচেষ্ট হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সুবোধচন্দ্র মল্লিক, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পুলিনবিহারী দাস, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রমুখ দেশপ্রেমিকদের নির্বাসিত করা হয়।
- (২) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ দল নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়। এ সময়েই ইংরেজ সেনাপতি কিচেনার সারা ভারতে সামরিক আইন জারির পরামর্শ দেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ‘বিদ্রোহমূলক জনসভা নিবারক’ আইন প্রবর্তিত হয়। বলা বাহুল্য, এতেও বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন দমন করা সহজসাধ্য হয় নি।
দারোগা নন্দলালকে হত্যা
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর বিপ্লবীরা দারোগা নন্দলাল ব্যানার্জীকে হত্যা করেন। ইনি প্রফুল্ল চাকীকে গ্রেপ্তার করেছিলেন।
মামলার সরকারি উকিলকে হত্যা
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি আলিপুর বোমা মামলার সরকারি উকিল আশুতোষ বিশ্বাস ও ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট সামসুল আলম হাইকোর্ট -এর অভ্যন্তরে বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হন।
আলিপুর বোমা মামলার পর
- (১) আলিপুর বোমা মামলার পর সরকারি দমননীতির চাপে পশ্চিমবঙ্গ-এ বিপ্লববাদ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময় ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী (মহারাজা), প্রতুল গাঙ্গুলী, অমৃতলাল হাজরা প্রমুখের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
- (২) তাদের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের নানা স্থানে রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিশ্বাসঘাতক নিধনযজ্ঞ চলতে থাকে। শুরু হয় ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০ খ্রিঃ), খুলনা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০ খ্রিঃ) এবং হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০ খ্রিঃ)।
উপসংহার:- ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে আবার বিপ্লববাদী কার্যকলাপের কেন্দ্র ঢাকা থেকে কলকাতায় সরে আসে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় রাজাবাজার বোমার মামলা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বিপ্লব আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে।
(FAQ) যুগান্তর দল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাদের সহযোগীরা ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে।
দারোগা নন্দলাল।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে।
চিত্তরঞ্জন দাশ।