নূরজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব প্রসঙ্গে সমকালীন ইতিহাস কে প্রভাবিত করা, নূরজাহানের আনুগত্য ও বুদ্ধির প্রশংসা, প্রধানা মহীষী, গুণাবলী, দরবারের হাল ধরা, নূরজাহানের ক্ষমতা ও খেতাব তার যোগ্যতার পুরস্কার ছিল, রাজনীতিতে প্রাধান্য, নুরজাহানের ত্রুটি ও তার পতন সম্পর্কে জানবো।
নুরজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | নূরজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব |
পূর্ব নাম | মেহেরুন্নেসা |
পরিচিতি | জাহাঙ্গীর পত্নী |
মর্যাদা | পাদশা বেগম |
সমাধি | লাহোর |
ভূমিকা :- মধ্যযুগে রাষ্ট্র বা সমাজে ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবকে স্থাপন করতে পারেন এমন খুব বেশী সংখ্যক প্রতিভাময়ী নারীর কথা জানা যায় নি। ইলতুৎমিস-এর কন্যা সুলতান রাজিয়া উল্কার মত ক্ষণকাল রাজনীতির আকাশে উদিত হয়ে বিলীন হন।
নূরজাহানের দ্বারা সমকালীন ইতিহাস প্রভাবিত
মুঘল যুগে জাহাঙ্গীর পত্নী বেগম নূরজাহান ছিলেন অন্যতমা। প্রতিভা যিনি তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা সমকালীন ইতিহাসকে প্রভাবিত করেন।
নূরজাহানের দুর্ভাগ্য
জাহাঙ্গীর পত্নী নূরজাহানের দুর্ভাগ্য যে তার সম্পর্কে সমকালীন কোনো ঐতিহাসিক নিরপেক্ষ ভাবে কলম ধরেন নি। এই যুগের রক্ষণশীল লেখকেরা নূরজাহানের যোগ্যতার প্রকৃত মূল্যায়ণে অক্ষম ছিলেন।
নূরজাহানের আনুগত্য ও বুদ্ধির প্রশংসা
সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রচলিত রীতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তার আত্মজীবনীতে তার নিজ পত্নী সম্পর্কে খোলাখুলি প্রশংসা করা থেকে বিরত থেকেছেন। তবে তাঁর সংযত লেখনী থেকেও মাঝে মাঝে এই বেগমের আনুগত্য ও বুদ্ধির প্রশংসা ধ্বনিত হয়েছে।
পরবর্তী যুগের কাছে ন্যায় বিচারের দাবিদর নূরজাহান
নূরজাহানের প্রতি উদাসীন বা বিরোধী ঐতিহাসিকরাও তার উপস্থিত বুদ্ধি, সুরুচি, আভিজাত্য, সংস্কৃতি চেতনা ও সর্বোপরি তাঁর অসাধারণ রূপের প্রশংসা করেছেন। স্বভাবতই নূরজাহান পরবর্তী যুগের কাছে ন্যায় বিচার দাবী করতে পারেন।
প্রধানা মহীষী নূরজাহান
মির্জা গিয়াস বেগ বা ইতিমাদউদদৌলার এই রূপ ও গুণে অসামান্য কন্যা ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের অন্তরের লোক। তিনি নিজগুণেই ‘পাদশা বেগম’ বা হারেমের প্রধানা মহীষীর মর্যাদা পান।
নূরজাহানের গুণাবলী
- (১) সাহিত্য, শিল্প, কলা, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অবাধ ও অকুণ্ঠ বিচরণ। তিনি যেমন মুখে মুখে ফার্সী কবিতার চরণ রচনা করেন, তেমনই তার হৃদয় ছিল কোমল ও দয়ালু। দরিদ্র লোকেদের তিনি সর্বদাই সাহায্য করতেন। অবিবাহিতা কন্যাদের বিবাহে অর্থ সাহায্য করতেন।
- (২) তাঁর শিল্প চেতনা ছিল মৌলিক। তসবীর বা চিত্রাঙ্কন থেকে সুচীশিল্প, জরীর কাজের শিল্পভাবনা সর্বদা তাঁর মাথায় খেলত। তিনি পোষাক ও অলঙ্কারের নিত্য নতুন শৈলী বা ষ্টাইল রচনা করতেন। তাঁর বাকধারা ছিল মধুর ও শিল্পগুণান্বিত।
নূরজাহান কর্তৃক বীর রসের চর্চা
বীর রসের চর্চাও তিনি করতেন। স্বামীর সঙ্গে শিকারযাত্রা, ব্যাঘ্র নিধন, দক্ষ তীরন্দাজী, যুদ্ধক্ষেত্রে হাতীর পিঠে বসে যুদ্ধ পরিচালনা অবলোকন ছিল তাঁর ব্যাসন।
নূরজাহান কর্তৃক দরবারের হাল গ্রহণ
রাজনীতির জটিল সমস্যাগুলি তিনি দ্রুত বুঝে ফেলতেন এবং সম্রাটের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে তিনি দরবারে হাল ধরার চেষ্টা করেন।
নূরজাহানের ক্ষমতা ও খেতাব তার যোগ্যতার পুরস্কার ছিল
- (১) স্বভাবতই জাহাঙ্গীর তার এই রূপবতী ও গুণবতী পত্নীকে বহু সম্মান ও ক্ষমতায় ভূষিত করেন। এই সম্মান ও ক্ষমতা নূরজাহানের যোগ্যতার পুরস্কার ছিল। মুদ্রায় সম্রাটের সঙ্গে তার নামাঙ্কন, অথবা অসুস্থ সম্রাটের স্থলে সম্রাজ্ঞীর ‘ঝরোখা দর্শন’ দেওয়া যুক্তি দিয়ে বিচার করলে কোনো অন্যায় কাজ ছিল না।
- (২) কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের চোখে এই ব্যবস্থা অন্যায় বলে মনে হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীর যদি দরবারের অভিজাত ও যুবরাজদের বিভিন্ন পদ ও খেতাব দেন তবে নূরজাহানকে তাঁর যোগ্যতার জন্য পুরস্কারে ভূষিত করলে কেন তিনি তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান বলে বলা হয়, তার কারণ বোঝা যায় না।
- (৩) নূরজাহান এই খেতাব ও সম্মানের জন্য সম্রাটকে অনুরোধ করেন একথা কোনো ঐতিহাসিক বলেন নি। এগুলি অযাচিতভাবে তার ওপর বর্ষিত হয়।
নূরজাহান ক্ষমতার অপব্যবহার করেন নি
নূরজাহান তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করেন কিনা এটি হল মূল প্রশ্ন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে,
- (১) তাঁর পিতা ও ভ্রাতা যে উচ্চপদ লাভ করেন তা তাদের নিজ যোগ্যতার জোরেই পান। নূরজাহানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিবাহের আগেই নূরজাহানের পিতা ও ভ্রাতা উচ্চপদে আসীন ছিলেন। নূরজাহানের ভ্রাতা আসফ খাঁ কালক্রমে দরবারের এক বিখ্যাত অভিজাত ও সেনাপতিতে পরিণত হন এবং মুঘল রাষ্ট্রের সেবা করেন।
- (২) সুতরাং নূরজাহানের চক্রান্তেই তারা বিভিন্ন পদ ও মর্যাদা পান এমন কথা বলা যায় না। নূরজাহান হারেমের অন্য কোনো মহিলা বা সাধারণ লোকের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অত্যাচার করেন নি।
- (৩) জাহাঙ্গীরের ওপর তার অশুভ প্রভাব সম্পর্কে ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদের অভিমত ডাঃ বেণীপ্রসাদ স্বীকার করেন নি। ডাঃ বেণীপ্রসাদের মতে, ১৬১১-১৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যখন জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য ভাল ছিল তখন নূরজাহানের কোনোই প্রভাব ছিল না।
- (৪) ১৬২২ খ্রিস্টাব্দের পর জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য খারাপ হলে নূরজাহান দরবারের বহু দায়িত্ব নিজ হাতে নেন। কিন্তু মূল নীতিগুলির বিষয়ে সম্রাট তখনও তাঁর অভিমতে স্থির থাকতেন। খুররমকে বঞ্চিত করে শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে জাহাঙ্গীর রাজী হন নি। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, নূরজাহানের প্রভাব ছিল সীমাবদ্ধ।
নূরজাহানের কৃতিত্ব সম্পর্কে ত্রিপাঠীর অভিমত
ডঃ ত্রিপাঠীর মতে, জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব ছিল “নৈতিক, আর্বেগ-জাত, মনস্তাত্ত্বিক এবং সম্ভবত বৌদ্ধিক” (Moral, emotional spiritual and possibly intellectual)।
রাজনীতিতে নূরজাহানের প্রাধান্য
- (১) ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, রাজনীতিতেও বেগম প্রভাবশালী ছিলেন। তার পিতার মৃত্যুর পর নূরজাহান রাজনীতিতে সম্পূর্ণ জড়িয়ে পড়েন। ডঃ ত্রিপাঠী এই মত স্বীকার করেন না। নূরজাহানের মত বুদ্ধিমতী তার স্বামী ও ভ্রাতার স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা না করে নিশ্চেষ্ট থাকবেন এটা আশা করা যায় না।
- (২) জাহাঙ্গীরের প্রতি নূরজাহানের ভালবাসা ছিল সকলের ঊর্ধে। একথা তাঁর সমালোচকরাও স্বীকার করেন। নূরজাহান মনে করতেন যে, অসুস্থ জাহাঙ্গীরের স্বার্থ তার দেখা কর্তব্য। দরবারে বহু অভিজাত ছিল চক্রান্তকারি। এমন কি খুররমও ক্ষমতার জন্য লোভাতুর ছিলেন।
- (৩) এমতাবস্থায় সম্রাটের নামে তিনি শক্ত হাতে দরবারের হাল ধরার চেষ্টা করেন। নূরজাহানের যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তারই চেষ্টায় খুররমের বিদ্রোহ দমিত হয় এবং সম্রাট মহাবত খাঁর হাতে বন্দী দশা হতে মুক্ত হন।
জাহাঙ্গীরের পশ্চাতে নূরজাহান অশুভ শক্তি নয়
ডঃ ত্রিপাঠী বলেছেন যে, যুক্তি দিয়ে বিচার করলে “নুরজাহানকে জাহাঙ্গীরের পশ্চাতে অশুভ শক্তি না বলে সৌভাগ্যসূচক শক্তি বলা যায়।” (Far from an evil genius hovering over Jahangir, she was his guardian angel)
নূরজাহান চক্রের অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দেহ
ডঃ নুরুল হাসানও বলেছেন যে ‘নূরজাহান চক্র‘ নামে কোনো কিছুই ছিল না। ফার্সী লেখকরা এই চক্রের কথা উল্লেখ করেন নি। একমাত্র ইউরোপীয় লেখক টমাস রো ও টেরি নূরজাহানের অতিরিক্ত প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের সাক্ষ্য সন্দেহের উর্দ্ধে নয়। তারিখ-ই-জাহাঙ্গীরশাহী জাহাঙ্গীরের রাজত্বের ১৪ বছরে লেখা হয়। তাতে নূরজাহানের অতিরিক্ত প্রভাবের কথা নেই।
নূরজাহানের ত্রুটি
ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ প্রমুখ ঐতিহাসিক অবশ্য নূরজাহানকে অশুভ শক্তি বলে অভিহিত করেছেন। তাদের যুক্তি হল –
- (১) তিনি দরবারের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন। সভাসদরা তার খেয়াল খুশিমত চলতে বাধ্য হয়।
- (২) তিনি তার পিতা, ভ্রাতাকে বহু উচ্চপদ ও ক্ষমতা দিয়ে নিজ গোষ্ঠী তৈরি করেন।
- (৩) তিনি খুররমকে প্রথমে নিজ পক্ষে আনার জন্য ভ্রাতুষ্পুত্রী মমতাজের সঙ্গে বিবাহ দেন।
- (৪) খুররমকে বশ করা না গেলে, তিনি নিজ কন্যা ‘লাডলী বেগমের সঙ্গে যুবরাজ শাহরিয়ারের বিবাহ দেন। পরে তিনি খুররমকে সিংহাসনের অধিকারচ্যুত করে শাহরিয়ারকে বসাবার চেষ্টা করেন।
- (৫) তার দুর্ব্যবহারে খুররম ও মহাবত খাঁ বিদ্রোহ করেন।
নূরজাহানের পতন
- (১) নূরজাহানের প্রধান দোষ ছিল যে, তিনি তার পিতৃ-পরিবারের লোকেদের সর্বদাই উচ্চপদে রাখতে চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর ভ্রাতা আসফ খাঁর ওপর অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে তাকে বহু ক্ষমতা দেন। আসফ খাঁ তাঁর ভগিনীর বিশ্বাসের পূর্ণ সুযোগ নেন।
- (২) তিনি নিজের ও নিজ জামাতা খুররমের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ম্যাকিয়ভেলীর নীতি গ্রহণ করেন। নূরজাহান, আসফ খাঁর ছল-চাতুরী ধরতে পারেন নি। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর আসফ খাঁর চক্রান্তে খুররম, শাহজাহান রূপে সিংহাসনে বসেন।
উপসংহার :- রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর নূরজাহান আরও ১৮ বছর জীবিতা ছিলেন। তিনি এই সময় শাহজাহানের বৃত্তিভোগী হয়ে জীবন-যাপন করেন। শাহজাহান তাঁর বিমাতাকে বার্ষিক ২ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিতেন। লাহোরে স্বামীর কবরের পাশেই নূরজাহান ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তার শেষ শয্যা পাতেন।
(FAQ) নূরজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মেহেরুন্নেসা।
জাহাঙ্গীর পত্নী নূরজাহান।
খুররম ও মহাবৎ খাঁ।
লাহোর।