ফিটকিরির ব্যবহার সম্পর্কে অজানা তথ্য জানুন

Table of Contents

ফিটকিরির ব্যবহারে

ভূমিকা :- আমাদের অনেকেরই বাড়িতে সাদা রঙের পাথর রাখা থাকে। বিশেষ করে রান্নাঘর বা বাথরুমের আশেপাশে আপনি খুঁজে পাওয়া যায় এই পাথর। এই শ্বেতপাথরটি আমাদের কাছে ফিটকিরি নামেই পরিচিত।

ফিটকিরির প্রকৃতি

একপ্রকার অর্ধস্বচ্ছ কাচ সদৃশ কঠিন পদার্থ হল ফিটকিরি, যার স্বাদ মিষ্টি ও কষা। এটি অত্যন্ত শুষ্ক প্রকৃতির। এটি একটি ব্যাকটেরিওস্ট্যাটিক উপাদান, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।

ফিটকারির রাসায়নিক নাম

ফিটকিরি সোডিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামের একটি যৌগ লবণ। একপ্রকার অর্ধ স্বচ্ছ কাচের মতো কঠিন পদার্থ। ফিটকারির রাসায়নিক নাম হল পটাশ অ্যালাম।

ফিটকিরির ব্যবহার

এই শ্বেতপাথর ফিটকিরির ব্যবহার আজকের নয়, প্রাচীনকাল থেকেই। এই শ্বেতপাথরের অনেক উপকারিতা আছে। বিশেষ করে এর অনেক ঔষধি গুণ আছে যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ করে। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসার বক্সেও ফিটকিরি  রাখেন। যখনই পরিবারের শিশু বা বৃদ্ধরা আঘাত পায় বা কোনো অংশ কেটে-ছড়ে যায়, লোকেরা সেই অংশ ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করে।

ফিটকিরির উপকারিতা

আগেকার দিনে বেশির ভাগ বাঙালি তথা ভারতীয় বাড়িতেই ফিটকিরি ব্যবহারের চল ছিল। তার একমাত্র কারণ, এর উপকারিতা অনেক। এর বিভিন্ন উপকার গুলি হল নিম্নরূপ। –

জল পরিশুদ্ধ করতে ফিটকিরির ব্যবহার

খাবার জলে এক টুকরো ফিটকিরি ফেলে রাখলে জলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো বিভিন্ন ক্ষতিকর কণা ধীরে ধীরে নীচে থিতিয়ে পড়েবে। তারপর অবশিষ্ট পরিষ্কার জল ছেঁকে খেয়ে ফেলুন।

বেকিং পাউডারের বিকল্প রূপে ফিটকিরির ব্যবহার

সবসময়ে নিরাপদ না হলেও এই পদ্ধতিতে কেউ কেউ রুটি, পাঁউরুটি বা কেক বেকিংয়ের ব্যাকারে ফিটকিরি গুঁড়ো মিশিয়ে দেন। তাতে ভাল বেক হয়।

গলা ব্যথা কমাতে ফিটকিরির ব্যবহার

আগেকার দিনে ফিটকিরির গুঁড়োর সঙ্গে মধু ও আদা মিশিয়ে খাওয়া হত। এই ঘরোয়া টোটকায় গলার ব্যথা উপশম হয়ে যেত।

প্রাকৃতিক সংরক্ষক রূপে ফিটকিরির ব্যবহার

টক জাতীয় খাবার আচারে ফিটকিরি মেশালে অনেক দিন রেখে দিলেও তা নষ্ট হয়ে যায় না বলেই মনে করা হয়। আগে এই ভাবে অনেকেই ঘরে আচার বানাতেন।

গন্ধ দূর করতে ফিটকিরির ব্যবহার

সব্জি এবং খাবার রাখার কারণে ফ্রিজের ভিতর ভ্যাপসা, বোঁটকা গন্ধ তৈরি হয়। ফ্রিজের ভিতর এক টুকরো ফিটকিরি রেখে দিলে তা থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

ত্বকের পরিচর্যায় ফিটকিরির ব্যবহার

অল্প একটু গোলাপজলের মধ্যে ফিটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়ে তা ত্বকে মাখলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। ত্বকের ব্রণ দূর করতে পারে, কোঁচকানো ত্বক এমনকি, মুখের দাগ কমাতেও ফটকিরি ব্যবহার করা হয়।

ফুল তাজা রাখতে ফিটকিরির ব্যবহার

ফুলদানিতে ফিটকিরি গুঁড়ো ঢেলে দিলেই অনেক দিন পর্যন্ত ফুল তাজা রাখতে পারে। এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি ফুলের রং নষ্ট বা মুহ্যমান হয়ে পড়ে না।

রান্নাঘর পরিষ্কার রাখতে ফিটকিরির ব্যবহার

খানিকটা জল গরম করে তাতে ফিটকিরির টুকরো মিশিয়ে দিয়ে ৫-১০ মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর ফিটকিরি তুলে নিয়ে সেই জলে কাপড় ভিজিয়ে রান্নঘরের তাক পরিষ্কার করলে বেশ ভাল সাফাই করা যায়।

ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে ফিটকিরির ব্যবহার

ফিটকিরিতে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল গুণাগুণপাওয়া যায়, যা ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে সহায়ক। এছাড়াও গোপনাঙ্গ ফিটকিরির জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়, যা সংক্রমণ কমায়।

ছোট খাটো চোটে ফিটকিরির ব্যবহার

ছোট শিশু এবং বৃদ্ধরা অনেক সময় আঘাত পায়, যার কারণে তাদের রক্ত বের হতে থাকে। আঘাতের স্থান ফিটকিরির জল দিয়ে পরিষ্কার করলে রক্তপাত বন্ধ হয়। এছাড়াও, এটিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য আছে যা সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। বাড়িতে মায়েরা সন্তানের আঘাতে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে এটি ব্যবহার করেন।

মুখ পরিষ্কার করতে ফিটকিরির ব্যবহার

ফিটকিরির জল দিয়ে মুখে হালকা ভাবে ম্যাসাজ করলে মুখ পরিষ্কার হয়। এছাড়াও এটি মুখের জন্য ন্যাচরাল ক্লিনজারের কাজ করে এবং ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।

ওরাল হেল্থের জন্য ফিটকিরির ব্যবহার

ফিটকিরি দাঁতের জন্য প্রাকৃতিক মাউথওয়াশ হিসেবে কাজ করে। জলে ফিটকিরি রেখে গার্গেল করলে দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এর সাথে সাথেই নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধের সমস্যাও দূর হয়।

মাথার ময়লা দূর করতে ফিটকিরির ব্যবহার

অনেক সময়েই শ্যাম্পু মাথার ত্বকের ময়লা দূর করতে পারে না ফলে মাথায় উকুন দেখা দিতে শুরু করে। ফিটকিরির জল  দিয়ে মাথা ধুলে তা মাথার ত্বক ও চুলের গোড়ায় গিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে। মাথায় উপস্থিত উকুনও এই জলে মারা যায়।

অ্যান্টিসেপ্টিক হিসাবে ফিটকিরির ব্যবহার

দাড়ি কাটার সময় মুখের কোনো জায়গায় কেটে গেলে সেখানে ফটকিরি লাগানো হয়। ক্ষতস্থানে ফটকিরি লাগালে তা অ্যান্টিসেপ্টিক হিসাবে কাজ করে এবং রক্তক্ষরণ থামাতে সাহায্য করে।

‘আফটার শেভ প্রোডাক্ট’ হিসাবে ফিটকিরির ব্যবহার

বাজারে ‘আফটার শেভ প্রোডাক্ট’-এর প্রচলন বেশ ভালোই রয়েছে। তবে কেউ চাইলে ‘আফটার শেভ প্রোডাক্ট’ হিসাবে দামি প্রসাধনী ব্যবহার না করে সহজলভ্য ফিটকিরিও ব্যবহার করতে পারে।

মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ফিটকিরির ব্যবহার

মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ফিটকিরির উপকারিতা অনস্বীকার্য। গরম জলের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে ফিটকিরি মিশিয়ে কুলকুচা করলে মুখের দুর্গন্ধ কমে।

আলসার নিরাময়ে ফিটকিরির ব্যবহার

মুখের ভিতর আলসার বা মাড়ি থেকে রক্ত বেরোলেও ফিটকিরির ব্যবহারে তা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আলসারের উপর ফিটকিরি গুঁড়ো ৩০-৪০ সেকেন্ড লাগিয়ে রাখলে মুখের আলসারগুলি কমতে শুরু করে।

চুলের সমস্যা দূরীকরণে ফিটকিরির ব্যবহার

বালতির জলে সারা রাত ফিটকিরি মিশিয়ে রেখে সেই জল দিয়ে সকালে স্নান করলে চুলের প্রচুর সমস্যা কমে যেতে পারে। শ্যাম্পুর বদলে ফিটকিরি দেওয়া জল দিয়ে চুল ধুলে চুল পরিষ্কার হয়। এমনকি, উকুন দমনেও ফিটকিরি দেওয়া জল সাহায্য করে।

ছোট খাটো চোট সারাতে ফিটকিরির ব্যবহার

প্রায়ই শিশু ও বৃদ্ধরা আঘাত পায় এবং ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বের হতেই থাকে। এই সময় আঘাতপ্রাপ্ত স্থান ফিটকিরির জল দিয়ে পরিষ্কার করলে রক্তপাত বন্ধ হবে। ফিটকিরির অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। সেজন্যই আঘাত পেলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে এটি ব্যবহার করুন।

ডিওড্র্যান্ট হিসেবে ফিটকিরর ব্যবহার

এক ধরনের গাছের আঠা বিশেষ গন্ধরস বা মস্তকির সঙ্গে ফিটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণ দিয়ে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে নিজের ডিওড্র্যান্ট।

টনসিলের আরামে ফিটকিরির ব্যবহার

ঠান্ডা লেগে গলায় ব্যথা হলে বা গ্ল্যান্ড ফুলে গেলে, গরম জলে এক চিমটে নুন ও ফিটকিরি চূর্ণ মিশিয়ে, দিনে কয়েকবার গার্গেল করলে স্বস্তি পাওয়া যায়।

আঙুলের হাজা নিরাময়ে ফিটকিরির ব্যবহার

অতিরিক্ত জল ঘাঁটার কারণে হাতে হাজা হলে, বা পায়ের পাতা ফুলে গেলে, এক টুকরো ফিটকিরি জলে ফেলে, জলটা ভালো করে গরম করে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে হাজা থেকে মুক্তি লাভ হয়।

গোড়ালি ফাটলে ফিটকিরির ব্যবহার

ফাটা গোড়ালির সমস্যার জন্য ফিটকিরি খুবই উপকারী। একটি খালি পাত্রে ফিটকিরি গরম করতে নিতে হবে। এরপর ফিটকিরি গলে ফেনার মতো হলে ঠান্ডা করে নারকেল তেল মিশিয়ে ফাটা গোড়ালিতে কয়েকদিন লাগালেই ফাটা গোড়ালি থেকে মুক্তি মিলবে।

ঘামের গন্ধ দূর করতে ফিটকিরির ব্যবহার

কারও কারও শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ খুব বেশি হয়। এর থেকে মুক্তি পেতে  জলে ফিটকিরি মিশিয়ে স্নান করতে হবে। এর ফলে ঘামের দুর্গন্ধের সাথে সাথেই শরীরের ময়লাও শেষ হবে। যাঁরা বেশি ঘামে তাদের ফিটরির জল দিয়ে অবশ্যই স্নান করা উচিত।

মাথা ব্যথা সারাতে ফিটকিরির ব্যবহার

কাচা ফিটকিরি ১ গ্রাম ও ছোট এলাচি বীজ ৬ গ্রাম উভয় উপাদানকে পৃথক পৃথক ভাবে পিষে কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে অল্প কিছু জলসহ পান করলে মাথা ব্যথা দ্রুত সেরে যায়।

কান ব্যথা সারাতে ফিটকিরির ব্যবহার

ফিটকিরিকে ভেজে গুঁড়ো করে সামান্য গুঁড়ো কানে দিতে হয়। তারপর কয়েক ফোঁটা লেবুর রস বা পেঁয়াজের রস কানে দিলে কান ব্যথা সেরে যায়।

ক্রিড়াবিদের পায়ের যত্নে ফিটকিরির ব্যবহার

অ্যান্টিমাইক্রোবাইরাল উপাদান রয়েছে ফিটকিরিতে। ফিটকিরির এই উপাদান ক্রিড়াবিদের পায়ের ফাঙ্গাসকে মেরে ফেলে। এই কারণে ক্রিড়াবিদের পায়ের যত্নে ফিটকিরি ব্যবহার করা যেতে পারে। গোলাপজলের সাথে ফিটকিরির গুঁড়া মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে তা পা ও পায়ের পাতাতে লাগিয়ে রেখে সকালে কুসুম গরম জলে ধুয়ে ফেলতে হবে। অথবা হালকা গরম জলে ফিটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে পা কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তারপর ধুয়ে, মুছে নিন।

সংসারে সুখ শান্তি বজায় রাখতে ফিটকিরির ব্যবহার

জ্যোতিষ উপায়ের জন্যও ফিটকিরি অত্যন্ত উপকারী একটি বস্তু। সংসারে সুখ শান্তি বজায় রাখার জন্য একটি পানপাতার ওপর অল্প ফিটকিরি ও সিঁদুর নিয়ে মুড়িয়ে তা অশ্বত্থ গাছের নীচে পুঁতে দিলে খুব উপকার পাওয়া যায়।

উপসংহার :- ফিটকিরির সঠিক ব্যবহার জানলে দৈনন্দিন জীবনের প্রসাধনীর খরচ অনেক কমে যাবে। তবে এখন ফিটকিরি শুধু রাস্তার পাশের আদি, অকৃত্রিম সেলুন গুলিতেই দেখা যায়। বর্তমানে পার্লারের ভিড়ে এই সেলুনের সংখ্যাও ক্রমশ কমে আসছে। আর এরই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ফিটকিরির ব্যবহারও।

Leave a Comment