রাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ

রাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ প্রসঙ্গে পূর্ব ইউরোপে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার প্রাধান্য, পূর্ব ইউরোপে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, পূর্ব ইউরোপে রুশীকরণ পদ্ধতি বা বৈশিষ্ট্য, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানবো।

সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ প্রসঙ্গে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার আধিপত্য, পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রুশ প্রাধান্য, পূর্ব ইউরোপে রুশ প্রাধান্যের বৈশিষ্ট্য ও পূর্ব ইউরোপে রুশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানব।

Table of Contents

রাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ

ঐতিহাসিক ঘটনারাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ
অন্তর্ভুক্ত দেশলাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া
সামরিক সংহতি কমিটি১৯৫২ খ্রি
কমিটির চেয়ারম্যানবুলগানিন
স্ট্যালিনের মৃত্যু১৯৫৩ খ্রি
রাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ

ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এ অক্ষশক্তি পরাজিত হলেও ইউরোপ-এর বিজয়ী দেশগুলির অবস্থাও খুবই করুণ হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের লোকবল, জাতীয় সম্পদ, শিল্প-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কায় তাদের অর্থনীতি একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। ফলে তাদের অধীনস্থ বিভিন্ন উপনিবেশ একে একে হাতছাড়া হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ আঘাত তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাশিয়ারও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপক। তবে যুদ্ধের পর রাশিয়ার হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো স্থলবাহিনী ছিল।

পূর্ব ইউরোপে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে সোভিয়েত রাশিয়ার লালফৌজ পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চল জার্মানির হাত থেকে মুক্ত করে সেখানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া এই সব অঞ্চলে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসার ও রাশিয়ার অনুগত কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার প্রাধান্য

রাশিয়া তার ভূখণ্ড সংলগ্ন লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি ছোটো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে সরাসরি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে। এ ছাড়া পূর্ব ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, পোল্যান্ড ও পূর্ব জার্মানি – এই আটটি দেশে রুশ-অনুগত কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

পূর্ব ইউরোপে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে

সমগ্ৰ পূর্ব ইউরোপে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পিছনে রাশিয়ার যেসব উদ্দেশ্যগুলি ছিল তা হল –

(১) সাম্যবাদী আদর্শের প্রসার

স্ট্যালিন মনে করতেন যে, সকল বিজেতাই বিজিত অঞ্চলের ওপর নিজেদের মতাদর্শ ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই পূর্ব ইউরোপের বিজিত অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যুক্তিসংগত। এজন্য সাম্যবাদী ভাবধারার ধারাবাহিক প্রসারের জন্য এই অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল।

(২) শক্তিশূন্যতা

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের আর্থিক ও সামরিক শক্তি নিঃশেষ হওয়ার ফলে ইউরোপে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় রাশিয়া তা কাজে লাগাতে পূর্ব ইউরোপে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।

(৩) নিরাপত্তা বলয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব ইউরোপের ওপর দিয়ে জার্মানির হিটলার কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের ঘটনা রুশ নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেছিল। পূর্ব ইউরোপে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়া নিজের জন্য একটি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল।

(৪) অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন

যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য পূর্ব ইউরোপের সম্পদের ব্যবহার এবং এখানকার বাজার দখল রাশিয়ার কাছে খুবই প্রয়োজন ছিল।

(৫) কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রাশিয়া কূটনৈতিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজস্ব প্রভাব-বলয় তৈরি করে রাশিয়া সেই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে চেয়েছিল।

পূর্ব ইউরোপের রূশীকরণের পদ্ধতি বা বৈশিষ্ট্য

মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের মৃত্যুর পর থেকে রাশিয়া তার দখলে থাকা পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশগুলিতে নিজের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই সব দেশে রাশিয়ার কার্যাবলির যে সব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় সেগুলি হল –

(১) নির্বাসিত সরকারগুলিকে উচ্ছেদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব সরকারের অস্তিত্ব ছিল তাদের অনেকেই যুদ্ধকালে জার্মানির আক্রমণের ফলে বিদেশে নির্বাসিত হয়ে সরকার চালাতে থাকে। যুদ্ধের পর রুশ লালফৌজ সেই সব নির্বাসিত সরকারকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে।

(২) সাম্যবাদী সরকার

রুশ লালফৌজ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে পপুলার ফ্রন্ট নামে এক ধরনের সরকার চাপিয়ে দেয়। অকমিউনিস্টদের বিতাড়িত করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এই সব একনায়কতান্ত্রিক সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সব সরকারের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, যুদ্ধমন্ত্রী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতাদের বসানো হয়।

(৩) রুশ মডেলের সংবিধান

পূর্ব ইউরোপের এই সব দেশের তাঁবেদার কমিউনিস্ট সরকারগুলি রাশিয়ার নির্দেশে নিজ নিজ দেশে আইন বা সংস্কার চালু করত। সেই সব দেশে রুশ সংবিধানের অনুকরণে নতুন সংবিধান চালু হয়। রাশিয়ার রক্তচক্ষুর ভয়ে এই সব তাঁবেদার সরকারগুলি একপ্রকার পরাধীন হয়ে পড়েছিল।

(৪) প্রচার

জনমতকে নিজেদের অনুকূলে আনার উদ্দেশ্যে ক্লাব, লজ, ক্রীড়া সংগঠন প্রভৃতিকে কমিউনিস্ট প্রচারের আওতায় আনা হয়। কমিউনিস্টপন্থী সংবাদ প্রচারে অনাগ্রহী সাংবাদিক ও বেতার ঘোষকদের পদচ্যুত করা হয়।

(৫) কমিউনিস্টকরণ

স্বাধীনতাকামী ও নিরপেক্ষ বিচারকদের পদচ্যুত করে বিচারব্যবস্থায় কমিউনিস্টকরণ করা হয়। আদালত থেকে অকমিউনিস্ট আইনজীবী এবং বিদ্যালয় থেকে অকমিউনিস্ট শিক্ষকদের বিতাড়িত করা হয়। পশ্চিমি লেখক আর্নেস্ট হেনরি পূর্ব ইউরোপে স্ট্যালিন-প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে ‘সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।

পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

পূর্ব ইউরোপে অনুগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয়, এই অঞ্চলে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছিল। এই কাঠামোর দুটি দিক ছিল – অর্থনৈতিক ও সামরিক।

(১) আর্থিক অগ্রগতির উদ্যোগ

কমিকনের মাধমে আর্থিক সহযোগিতা এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে দ্রুত শিল্পায়ন, কৃষিক্ষেত্রে যৌথ খামার ব্যবস্থার প্রবর্তন প্রভৃতি নীতি গ্রহণ করে দেশগুলিতে আর্থিক অগ্রগতির উদ্যোগ নেওয়া হয়।

(২) সামরিক সংহতি কমিটি

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং রাশিয়ার ওপর তাদের নির্ভরশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ‘সামরিক সংহতি কমিটি’ (Military Coordination Committee) গঠিত হয়। এই সংস্থার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বুলগানিন।

পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া

সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট আধিপত্যের প্রসারের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবাদ ও সমালোচনা দেখা গিয়েছিল। পাশ্চাত্য প্রতিক্রিয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয় পূর্ব ইউরোপের ক্ষোভ।

উপসংহার :- সোভিয়েত আধিপত্যের ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সার্বভৌমিকতা নষ্ট হলে সেসব দেশের অধিবাসী এবং কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এজন্য ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও অন্যান্য দেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। এর ফলে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত রাশিয়ার একাধিপত্য নষ্ট হতে শুরু করে।

(FAQ) রাশিয়ার অধীনে পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পূর্ব ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্রকে রাশিয়া তার অন্তর্ভুক্ত করে?

লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি।

২. পূর্ব ইউরোপে টেলিন প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে কি বলা হয়?

সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র।

৩. রাশিয়ার নেতৃত্বে সামরিক সংহতি কমিটি গঠিত হয় কখন?

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. সামরিক সংহতি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন কে?

রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বুলগানিন।

৫. রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিন এর মৃত্যু হয় কখন?

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment