বাংলা ব্যাকরণ

ব্যাকরণ সংস্কৃত শব্দ। যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা। কোন ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে সেই ভাষার উপকরণ এবং উপাদানগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ভাষার অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।

বাংলা ব্যাকরণ

ভূমিকা:- ভাষার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের শাস্ত্র হল ব্যাকরণ। বিভিন্ন উপাদানে ভাষা গঠিত হয় এবং বিভিন্ন রীতিতে ভাষা ব্যবহৃত হয়। গঠন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে। এই সব নিয়ম-শৃঙ্খলা সম্পর্কে যথাযথ ও সুষ্ঠু জ্ঞান লাভ করতে হলে ভাষার যে বিভিন্ন উপাদান এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। আর ভাষার এই স্বরূপ বিশ্লেষণই ‘ব্যাকরণ’ নামে অভিহিত।

ব্যাকরণ শব্দের ব্যুৎপত্তি

আমরা ব্যাকরণ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাই বি (বিশেষ) + আ (সম্যক) + √কৃ+ অন = ব্যাকরণ। এই বিশ্লিষ্ট অর্থ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে ‘ব্যাকরণ’ হল শব্দ ব্যুৎপাদক ও ভাষা নিয়ামক শাস্ত্র বিশেষ।

ব্যাপকার্থে ব্যাকরণ

এদিক থেকে ‘ব্যাকরণ হল ভাষার উশৃঙ্খলা নিবারক, শব্দের ব্যুৎপত্তি ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নির্ধারক, পদ-সাধক এবং বাক্য রচনা প্রণালি নির্ধারক শাস্ত্র।’

ব্যাকরণের সংজ্ঞা

যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায়, সেই শাস্ত্রের নাম ব্যাকরণ।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ব্যাকরণ

‘যে বিদ্যার দ্বারা কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপটি আলোচিত হয় এবং সেই ভাষার গঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শুদ্ধ-রূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে’।

ড. সুকুমার সেনের মতে ব্যাকরণ

‘যে গ্ৰন্থে ভাষার বিচার ও বিশ্লেষণ আছে, তা-ই ব্যাকরণ’।

ব্যাকরণের কাজ

ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কার করাই ব্যাকরণের প্রধান কাজ। ভাষার গঠন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব কিছু নিয়মরীতি আছে। এসব নিয়মরীতি সম্পর্কে সম্যক বা যথার্থ জ্ঞানলাভ করতে হলে ভাষাকে ভেঙে তার উপাদানসমূহের বিচার-বিশ্লেষণ এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রণালি নির্ণয় করা প্রয়োজন।

ব্যাকরণের প্রকারভেদ

সাধারণ ভাবে ব্যাকরণ চার প্রকার –

  • বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ
  • ঐতিহাসিক ব্যাকরণ
  • তুলনামূলক ব্যাকরণ
  • দার্শনিক বিচারমূলক ব্যাকরণ

বাংলা ব্যাকরণ

বাংলা ভাষা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। এই ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক বা গঠনগত নিয়মশৃঙ্খলা রয়েছে। তাই বলা যায়, যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার নানা উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি সুশৃঙ্খল ভাবে আলোচনা করা হয়, তাই বাংলা ব্যাকরণ।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা ব্যাকরণ

তিনি বলেছেন, যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতি সব দিক দিয়ে আলোচনা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাকেই বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বা বাংলা ব্যাকরণ বলে।

জ্যোতিভূষণ চাকীর মতে বাংলা ব্যাকরণ

তার মতে যে ব্যাকরণ বাংলা ভাষার শব্দ, ধ্বনি, পদ ও বাক্য ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে ভাষার স্বরূপটিকে তুলে ধরতে সাহায্য করে, তাই বাংলা ব্যাকরণ।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে বাংলা ব্যাকরণ

তিনি বলেছেন, যে শাস্ত্র জানিলে বাংলা ভাষা শুদ্ধ রূপে পড়িতে, লিখিতে ও বলিতে পারা যায়, তাহার নাম বাংলা ব্যাকরণ’।

বাংলা ব্যাকরণের পরিধি

প্রত্যেক ভাষার মতো বাংলা ভাষারও চারটি মৌলিক অংশ বর্তমান। যথা – ধ্বনি, বাক্য, শব্দ এবং অর্থ।

বাংলা ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়

বাংলার মতো সব ভাষারই ব্যাকরণে মূলত চারটি বিষয়ের আলোচনা করা হয়। যথা –

(১) ধ্বনিতত্ত্ব

ধ্বনি উচ্চারণ প্রণালি, উচ্চারণের স্বান, ধ্বনির প্রতীক ও বর্ণের বিন্যাস, ধ্বনি পরিবর্তন, ণ-ত্ব এবং ষ-ত্ব বিধান ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

(২) শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব

শব্দ, শব্দের শ্রেণিবিভাগ, পদের পরিচয়, শব্দ গঠন, উপসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি, লিঙ্গ, বচন, ধাতু, শব্দরূপ, কারক, সমাস, ক্রিয়াপদ প্রভৃতি শব্দতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

(৩) বাক্যতত্ত্ব

বাক্য, বাক্যের শ্রেণিবিভাগ ও গঠন প্রণালী, বাক্যের রূপ পরিবর্তন প্রভৃতি বাক্যতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

(৪) অর্থতত্ত্ব

শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার অর্থতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

এছাড়াও অভিধানতত্ত্ব ও ছন্দ-অলংকার অংশে অভিধান ও ছন্দের প্রয়োগবিধি সম্পর্কে সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ থাকে।

ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা

ভাষাকে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখানোর চেষ্টা থেকেই ব্যাকরণের উদ্ভব। প্রথমে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, পরে ভাষা বিশ্লেষণ করে ব্যাকরণের উদ্ভব হয়েছে। তাই ভাষার সঙ্গে ব্যাকরণের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ভাষার এই মৌলিক উপাদান গুলির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কারের জন্যই ব্যাকরণের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাকরণকে বলা হয় ভাষার সংবিধান। ব্যাকরণ কোনো ভাবেই ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তবু ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –

  • ১। ব্যাকরণ শাস্ত্র ভাষাকে বিচার বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্যকে নিরূপণ করে।
  • ২। ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠন প্রকৃতি এবং তাদের সুষ্ঠু ব্যবহার বিধি সম্পর্কে জানতে ব্যাকরণ পাঠ একান্ত জরুরি।
  • ৩। লেখায় ও কথায় শুদ্ধ ভাষা প্রয়োগ করতে ব্যাকরণ পাঠ করা প্রয়োজন।
  • ৪। ব্যাকরণ পাঠের ফলে ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
  • ৫। সাহিত্যের রস-মাধুর্য্য আস্বাদনের ক্ষেত্রে আমাদের সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে ব্যাকরণ।
  • ৬। ছন্দ-অলংকার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে হলেও ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা আছে।
  • ৭। ভাষার বিভিন্ন পরিবর্তনের ধারা, নিয়ম শৃঙ্খলা ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে ব্যাকরণ শাস্ত্রের পাঠ খুবই জরুরি।

সুতরাং ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ এবং ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

উপসংহার:- ভাষা পরিবর্তনশীল বহমান নদীর মতোই। সেই কারণেই প্রতিনিয়ত সেখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। এর ফলে ব্যাকরণের বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ও বিস্তৃতি ঘটেছে এবং ঘটতে থাকবে।

বাংলা ব্যাকরণ হতে আরোও পড়ুন

Leave a Comment