বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা -র প্রতিষ্ঠা, প্রথম সম্পাদক ও সভাপতি, প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি, বিলুপ্তি, কৃতিত্ব, ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণ, ঈশ্বর গুপ্তের উক্তি ও সভার স্বদেশ ভাবনার পরিচয় সম্পর্কে জানবো।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রসঙ্গে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রতিষ্ঠাকাল, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম সভাপতি, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম সম্পাদক, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উদ্দেশ্য, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রেক্ষাপট, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার বৈশিষ্ট্য , বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কর্মসূচি, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার বিলুপ্তি ও বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কৃতিত্ব।
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা
বিষয় | বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ |
প্রতিষ্ঠাতা | কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্রথম সভাপতি | গৌরীশংকর তর্কবাগীশ |
প্রথম সম্পাদক | পন্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন |
ভূমিকা :- উনিশ শতকে ভারত -এ একাধিক সভা সমিতি গড়ে উঠেছিল। এই সব সভা সমিতি গুলির মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক সভা বা প্রতিষ্ঠান ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রতিষ্ঠা
৮ ই ডিসেম্বর ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, হরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং রামমোহন রায় -এর অন্যান্য শিষ্যদের উদ্যোগে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম সভাপতি
এই সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন গৌরিশংকর তর্কবাগীশ/ভট্টাচার্য।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম সম্পাদক
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম সম্পাদক ছিলেন পন্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার অন্যতম উদ্দেশ্য
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার নাম থেকেই বোঝা যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও তার স্বার্থ রক্ষা করা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রেক্ষাপট
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জড়িত ছিল। যেমন –
(১) ইংরেজি ভাষার স্বীকৃতি
প্রাচ্য পাশ্চাত্য বিতর্কের পর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে মেকলের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে ভারতীয় ভাষার গুরুত্ব উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বেন্টিঙ্ক মেকলের প্রতিবেদনকে সরকারি স্বীকৃতি জানান এবং ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দানের ওপর সরকারি ঘোষনা করেন।
(২) বাংলা ভাষার চর্চা
১৯৩৫ খ্রিঃ সরকারি স্তরে ইংরেজি ভাষায় গুরুত্ব আরোপে বাংলাভাষীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ইংরেজী ভাষার প্রাবল্যে যাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কোনো মতেই উপেক্ষিত না হয়ে পড়ে সেই জন্যই ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(৩) সংবাদপত্রের ভূমিকা
উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলাতে বেশ কিছু সংবাদপত্রও প্রকাশিত হচ্ছিল। এই সব বাংলা সংবাদপত্র গুলির অস্তিত্ব, উৎকর্ষতা এবং জনপ্রিয়তা বাংলা ভাষার চর্চা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরেই নির্ভরশীল ছিল।
(৪) সাংবাদিকদের অবদান
ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার স্বার্থ রক্ষার্থে যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা গঠিত হয় তার প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংবাদপত্রের সম্পাদক। এক্ষেত্রে সংবাদ পূর্নচন্দ্রোদয় পত্রিকার সম্পাদক হরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং সংবাদ ভাস্কর পত্রিকার সম্পাদক গৌরিশংকর তর্কবাগীশের কথা বলা যায়।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উদ্দেশ্য
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল –
- (১) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করা এবং তার স্বার্থ বজায় রাখা।
- (২) দেশের পক্ষে হিতকর বিষয় গুলিকে নিয়ে আলাপ আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করা।
- (৩) সরকারি নীতি ও কাজকর্মের সমালোচনা করা।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার বৈশিষ্ট্য
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল নিম্নরূপ –
- (১) প্রত্যেক বৃহস্পতিবার এই সভার অধিবেশন বসত। পরের অবশ্য এই দিন পরিবর্তিত হয়েছিল।
- (২) এই সভায় ধর্ম নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল।
- (৩) প্রধানত ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনার জন্যই এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
- (৪) শেষের দিকে এই সভা সরকারের দেশবিরোধী নীতি ও কাজের সমালোচনা করেছিল।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কর্মসূচি
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা তার সীমিত সময়ে দুটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল –
(১) নিষ্কর ভূমির উপর করের প্রতিবাদ
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় শুরু করলে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা তার তীব্র প্রতিবাদ করে।
(২) বাংলা ভাষা চর্চার উদ্দোগ
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষার প্রসারের সাথে সাথে বাংলা ভাষা শিক্ষা যাতে কোনরকম ভাবে উপেক্ষিত না হয়ে পড়ে তার জন্য বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা রাজনৈতিক সচেতনতা বোধের জাগরন ঘটায়।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার বিলুপ্তি
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই সভা ভেঙ্গে পড়েছিল। এর প্রধান কারন দুটি হল –
- (১) সদস্যদের মধ্যে ঐক্যের অভাব।
- (২) সরকারি নীতি ও সভার সিদ্ধান্তের বিষয় গুলি নিয়ে সদস্যদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কৃতিত্ব
কোনো উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্মারক বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা নির্মান করতে না পারলেও, ইতিহাসে এর কৃতিত্বের দুটি দিক ছিল।
- (১) ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনার জাগরনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
- (২) এটিই ছিল ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ছিল ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কারণ,
- (১) রাজনৈতিক সচেতনতা বোধের জাগরন থেকে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ১৮৩৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) ব্রিটিশদের রাজনৈতিক সংগঠন গুলিতে যেমন রাজনৈতিক বিষয় গুলি নিয়ে যুক্তিতর্ক চলত তেমনি বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতেও যুক্তি তর্কের মধ্য দিয়ে নানা আলোচনা হত।
- (৩) ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের যে সমস্ত বিষয় গুলির সঙ্গে ভারতীয়দের স্বার্থ জড়িত ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সেই সব বিষয় গুলি নিয়ে আলোচনা করত।
- (৪) পূর্বোক্ত সভা সমিতি গুলিতে ধর্মীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল।
- (৫) ব্রিটিশ শাসনে ভারতবাসীর স্বার্থের অনুকূল বিষয় গুলির আলাপ আলোচনার উদ্দেশ্যেই এই সভা প্রতিষ্ঠিত
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে ঈশ্বর গুপ্তের বক্তব্য
সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত লেখেন “রাজকীয় বিষয় বিবেচনার জন্য অপর যে সভা হইয়াছিল তন্মধ্যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে প্রথম বলিতে হইবে”।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার স্বদেশ ভাবনার পরিচয়
লর্ড বেন্টিঙ্কের পাশ্চাত্য ভাষানীতির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রসারের জন্য এই সভার উদ্ভব হলেও সভার আলোচনা ও বিতর্কে স্বদেশ ভাবনা বা রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
উপসংহার :- বেশিদিন স্থায়ী না হলেও ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠন ‘জমিদার সভা‘ -র অগ্রদূত ছিল এই বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে।
জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরি, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় পত্রিকার সম্পাদক হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখরা বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
গৌরীশংকর তর্কবাগীশ বা ভট্টাচার্য।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করা এবং তার স্বার্থ বজায় রাখা। এছাড়াও সরকারি নীতি ও কাজকর্মের সমালোচনা করা।
গৌরীশংকর তর্কবাগীশ বা ভট্টাচার্য।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার আলোচনা ও বিতর্কে স্বদেশ ভাবনা বা রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
পন্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন।
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরি, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় পত্রিকার সম্পাদক হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখরা বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠা করেন।