ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড

একজন প্রখ্যাত জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড (Philip Edward Anton von Lenard)। তিনি ১৮৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যাথোড রশ্মি এবং ইলেকট্রনের ওপর গবেষণার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তার পরীক্ষাগুলো ক্যাথোড রশ্মির প্রকৃতি এবং এর গতি বোঝার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯০৫ সালে লেনার্ড তার কাজের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তবে, তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে বিতর্কিত হয়ে ওঠেন, কারণ তিনি পরবর্তীতে নাৎসি মতাদর্শে জড়িয়ে পড়েন এবং “আর্য বিজ্ঞান” ধারণা প্রচার করতেন।

Table of Contents

বিজ্ঞানী ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড

ঐতিহাসিক চরিত্রফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড
জন্ম৭ জুন, ১৮৬২, ব্রাতিস্লাভা (তৎকালীন হাঙ্গেরির অংশ)
প্রধান অবদানক্যাথোড রশ্মির ওপর গবেষণা, ইলেকট্রনের ধর্ম সম্পর্কে আবিষ্কার
পুরস্কারপদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার, ১৯০৫ খ্রি
রাজনৈতিক বিশ্বাসনাৎসি সমর্থক, “আর্য বিজ্ঞান” ধারণার প্রবক্তা
বিতর্কিত বিষয়নাৎসি মতাদর্শ এবং বিজ্ঞানকে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করা
গবেষণার ক্ষেত্রপদার্থবিজ্ঞান, বিশেষত ইলেকট্রন এবং ক্যাথোড রশ্মির গবেষণা
মৃত্যু২০ মে, ১৯৪৭, মেসেলকার, জার্মানি
ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড

ভূমিকা :- বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান মনীষী লেনার্ড। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে তাঁর নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড ছিলেন একজন প্রভাবশালী জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি ক্যাথোড রশ্মি ও ইলেকট্রনের ওপর গবেষণার জন্য বিখ্যাত। লেনার্ড, পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন এবং তার গবেষণা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়। ১৯০৫ সালে তিনি তার গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। যদিও তার বৈজ্ঞানিক অবদান অনেক প্রশংসিত, তার রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং নাৎসি মতাদর্শে সমর্থন তাকে বিতর্কিত করে তোলে। তিনি “আর্য বিজ্ঞান” ধারণার প্রবক্তা ছিলেন, যা বিজ্ঞান ও জাতিগত বিশুদ্ধতার সাথে জড়িত বিভ্রান্তিকর ধারণাগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছিল।

ফিলিপ লেনার্ডের জন্ম

হাঙ্গেরির প্রেসবার্গ রাজ্যের মফস্সল শহর পজসোনিতে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন এক সাধারণ পরিবারে লেনার্ডের জন্ম।

লেনার্ডের ছেলেবেলা

অসাধারণ মেধা আর কৌতূহলের অধিকারী লেনার্ডের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ হয়েছিল প্রকৃতির পাঠশালায়। নিজের চারপাশে যা দেখতেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন। প্রকৃতি রাজ্যের বৈচিত্র্যের পরিচয় লাভ করতে গিয়ে বৃহত্তর ও মহত্তর কিছু জানার আগ্রহটি তাঁর মনে অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে। এভাবেই বড় হয়ে উঠতে থাকেন তিনি।

ফিলিপ লেনার্ডের

একসময় পজসোনির স্কুলের গন্ডি সসম্মানে উত্তীর্ণ হন তিনি। উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন রাজধানী শহর বুদাপেস্টে। এখানে বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন এবং যথাসময়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

লেনার্ডের কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতি

এবারে চলতে থাকে কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতি। ঘুরতে ঘুরতে তরুণ লেনার্ড উপস্থিত হলেন ভিয়েনা শহরে। এখান থেকে আবার বুদাপেস্টে। এখানে সান্নিধ্য লাভ করলেন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী বুনসেনের। সেই সময়ে এই সব্যসাচী বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে গবেষণায় মগ্ন। কিছুদিন তাঁর সঙ্গে সহকারীর কাজ করলেন লেনার্ড। তাঁর মনেও অঙ্কুরিত হল গবেষণার বীজ।

ভিয়েনায় ফিলিপ লেনার্ড

বুনসেনের পরামর্শে লেনার্ড উপস্থিত হলেন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়। পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতির সন্ধান নিলেন স্বনামখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হেলমজের কাছে। ভিয়েনা থেকে লেনার্ড এলেন জার্মানিতে। এখানেও স্থায়ী হতে পারলেন না। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কলিনবার্গের তত্ত্বাবধানে কিছুদিন পদার্থবিদ্যার গবেষণা করে চলে গেলেন হাইডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ডঃ কুইনিকের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে লেনার্ড পি-এইচ ডি হলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪ বছর।

ক্যাথোড রশ্মি সম্পর্কে ফিলিপ লেনার্ডের আগ্রহ

  • (১) এরপর নতুনতর গবেষণার কাজে হাইডেনবার্গেই কাটিয়ে দিলেন টানা ছয়টি বছর। এতদিনে তাঁর মনে জমে উঠেছে ক্রুকশের মোক্ষণ নলের ক্যাথোড রশ্মি সম্পর্কে অপার কৌতূহল। একপ্রকার বায়ুশূন্য নলে বিদ্যুৎপ্রবাহ সঞ্চালিত করার পর দেখা যায় একধরনের রশ্মি তীব্রভাবে নলের ক্যাথোড বা ঋণাত্মক বিদ্যুৎদ্বার থেকে বেরিয়ে আসে, তাই হল ক্যাথোড রশ্মি।
  • (২) এই রহস্যময় রশ্মির প্রকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এটি কি সত্যই কোন অসাধারণ রশ্মি না আলোকেরই ভিন্নরূপ এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে বিতর্ক। এই প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন, এই রশ্মি সম্পূর্ণরূপেই কি নল-আশ্রয়ী, না বাইরের আবহাওয়াতেও তা বর্তমান?
  • (৩) বাইরের জগতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যখন ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে এমনি আলোড়ন তুলেছে, ঠিক সেই সময়েই হাইডেনবাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে লেনার্ড স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেন ক্যাথোড রশ্মি সম্পর্কে। এ সময়ের অবস্থা জানিয়ে একসময়ে লেনার্ড নিজেই বলেছেন যে আটের দশকে, ছাত্রজীবনে তিনি নতুন কিছু একটা করার তীব্র তাগিদ অনুভব করতেন।
  • (৪) কিন্তু ক্রুকশের কাজ নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহই সেই সময়ে ছিল না। কেন না, তিনি লক্ষ্য করেছেন, যেসকল গবেষক-বিজ্ঞানী ক্রুকশের নল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, হতাশা ছাড়া তাঁদের গবেষণার নিট ফল কিছু লাভ হয় নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো সেই রহস্যময় অন্ধকারের আকর্ষণেই তিনি ক্রুকশের মোক্ষণ নল নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন।

ফিলিপ লেনার্ডের ক্যাথোড রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণা

  • (১) হাইডেনবার্গে ডঃ কুইনিনের সহকারী হিসেবে গবেষণা করছিলেন সেসময়ে লেনার্ড। গবেষণায় থাকাকালীনই হঠাৎই বলতে গেলে আলোর সন্ধান পেয়ে গেলেন তিনি। ক্রুকশের প্রায় বায়ুহীন পরিবেশকে আরও হালকা করবার উদ্দেশ্যে লেনার্ড তৈরি করলেন পারদ বায়ুকল। ক্যাথোড রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণায় এটিই তাঁর প্রথম পদক্ষেপ।
  • (২) যেই সময়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা নিজেদের ভাবনাচিন্তাকে গণ্ডিবদ্ধ করে রেখেছিলেন ক্যাথোড রশ্মির নলের বাইরে অবস্থানের সম্ভাবনার চুলচেরা বিচার নিয়ে, সেইসময় লেনার্ড ভাবলেন অনা কথা। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন রহস্যময় রশ্মিটিকে মোক্ষণ নলের বাইরে অর্থাৎ খোলা বাতাসে কোনো ভাবে আনা সম্ভব কিনা, সেই পন্থা নিয়ে।
  • (৩) এই উদ্দেশ্যে পারদ বায়ুকলের সাহায্যে তিনি ক্রুকশের নলকে প্রায় বায়ুহীন করে ফেললেন। তারপর নলে পাঠালেন বিদ্যুৎপ্রবাহ। উপস্থিত করলেন ক্যাথোড রশ্মির পরিক্রমণ পথে ধাতব বাধাকেও। কিন্তু রশ্মি বাইরে এল না। চিন্তিত হয়ে পড়লেন লেনার্ড। আবার নতুন উপায় উদ্ভাবন করলেন। সিলিকার স্ফটিক নিয়ে কাজ করার কথা মনে হল তাঁর। কারণ সিলিকার স্ফটিক বা কোয়ার্জের ভেতর দিয়ে পরিচিত সব বিকিরণই সহজভাবে যাতায়াত করতে পারে।
  • (৪) নতুন বুদ্ধি মাথায় খেলতেই নতুনভাবে প্রস্তুতি নিলেন লেনার্ড। মোক্ষণ নল গড়ে তার ঋণ বিদ্যুৎদ্বারের ঠিক ওপরে একখন্ড কোয়ার্জ পাত বসিয়ে দিলেন। পাতটি ছিল ২.৪ মি.মি পুরু। অধীর আগ্রহ নিয়ে এবারে তিনি এই নতুন নলে বিদ্যুৎপ্রবাহ পাঠালেন। না, এই উপায়ও কোনো ফল প্রসব করল না। নল একই রকম দীপ্তিহীন রইল। নৈরাশ্যে ভেঙ্গে পড়লেন না লেনার্ড। আবার বসলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে। এভাবে কাটল ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টানা ছয় বছর।

বিজ্ঞানী হার্ৎজের সহকারী ফিলিপ লেনার্ড

  • (১) এই সময় অভাবিত একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন অপ্রত্যাশিত ভাবে। বিশ্ববিখ্যাত জার্মান পদার্থবিদ হার্ৎজ তখন একজন যোগ্য সহযোগীর সন্ধান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়তেই লেনার্ড যথারীতি আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিলেন। হার্ৎজ নিজেও ছিলেন ক্যাথোড রশ্মি সম্পর্কে আগ্রহী। লেনার্ডের পরীক্ষার গতি-প্রকৃতিও তাঁর অজানা ছিল না। কাজেই তাঁর সহযোগীর কাজে লেনার্ডকেই সাগ্রহে বহাল করলেন হার্ৎজ। এবারে ক্যাথোড রশ্মির রহস্য উদঘাটনে দুজনেই কোমর বেঁধে গবেষণায় নামলেন।
  • (২) হার্ৎজ তাঁর গবেষণায় লক্ষ্য করলেন, খুব পাতলা ধাতব পাতও ক্যাথোড রশ্মিকে যাতায়াতের পথ করে দেয়। ব্যাপারটা নজরে আসার পরেই তিনি সোনা, রূপা ও অ্যালুমিনিয়ম দিয়ে তিনটি খুব পাতলা সছিদ্র পাত তৈরি করলেন। এই পাতগুলি পৃথকভাবে ক্রুকশের নলে ব্যবহার করার ফলে দেখা গেল, ক্যাথোড রশ্মি অতি সহজেই ওই সূক্ষ্ম ছিদ্র অতিক্রম করে যাচ্ছে। কেবল তাই নয় ওই ধাতুর নিশ্ছিদ্র অংশটিও তার গতিপথে কোন বাধার সৃষ্টি করে না।
  • (৩) এই পরীক্ষা নিয়েই হার্ৎজ ও লেনার্ড কাজে ডুবে রইলেন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। একদিন, তখন সবে সন্ধ্যা উৎরেছে, হার্ৎজ সছিদ্র অ্যালুমিনিয়াম পাত মোক্ষণ নলের বিদ্যুৎদ্বার নিয়ে ক্যাথোড রশ্মির প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করছিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে লেনার্ড তা দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, সছিদ্র পাতলা ধাতুর পাতের ওপরে কিছু ক্ষারীয় ফসফরাস চূর্ণ ছড়িয়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে ক্যাথোড রশ্মি নল থেকে বাইরে আসে কিনা। সঙ্গে সঙ্গে তাই করলেন এবং সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন ঈপ্সিত সাফল্য।
  • (৪) এই সাফল্যের বিষয়ে তিনি পরে লিখেছেন “Lo and behold, the grains (of phosphor) glowed brightly there as well! Thus not only had the cathode rays passed out the interior of the discharge tube to which they had been hitherto confined, in addition and nobody could have predicdted this-they could pass through air of normal density. It thus became clear that a vast new field of investigation had opened up in front of me, a field that not only embraced hitherto unseen-phenomena but also gave promise of a break through into the unknown, Cathode rays, which had hitherto stubbornly cluded explana- tion, had yielded their secret and, more important, now for the first time tests of maximum purity could be carried out.”

ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে লেনার্ডের নাম

ক্যাথোড রশ্মিকে নলের বাইরে আনার চিন্তা মাথায় নিয়ে একের পর এক পরীক্ষার পর এভাবেই বৈজ্ঞানিক সাফলা পেয়েছিলেন লেনার্ড। এই কাজের সূত্রেই ইউরোপ-এর বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়ল লেনার্ডের নাম। তাঁর এই পরীক্ষার সাফল্যের ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তীকালে বেকেরেল ও কুরি দম্পতি তাঁদের তেজস্ক্রিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাফল্য পেয়েছিলেন লেনার্ডের এই পরীক্ষার সাফল্যের পথ ধরেই।

অধ্যাপক ফিলিপ লেনার্ড

এই একটি মাত্র গবেষণার সাফল্যের সুবাদেই লেনার্ড ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রেসলু বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপকের চাকরি পেয়ে গেলেন। ব্রেসলু বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির দুবছরের মাথায়ই, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আহ্বান এল হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছাত্র ও গবেষক জীবনের একটা বড় অংশ এককালে তাঁর কেটেছিল সেই শিক্ষায়তনেই। লেনার্ড তাই সাড়া না দিয়ে পারলেন না। অবিলম্বেই তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন তাত্ত্বিক পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপকের পদে। সেখানে কাজ করার পরেই তিনি যোগ দিলেন বিশ্ববিখ্যাত কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবারে পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক পদ। চাকরির সঙ্গে এখানে লেনার্ড পেলেন পদার্থবিদ্যায় গবেষণার উপযোগী পরিবেশও।

ইলেকট্রনের উৎস সম্পর্কিত গবেষণায় ফিলিপ লেনার্ড

  • (১) পদার্থ বিদ্যার গবেষণার জন্য বিশেষ করে ক্যাথোড রশ্মি সংক্রান্ত কাজের জন্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লেনার্ডকে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। তখন তাঁর বয়স ৪৩ বছর। এই ভাবেই বিশ্বখ্যাতি লাভ করলেন তিনি। কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইলেকট্রনের উৎস সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু করলেন লেনার্ড।
  • (২) তিনি লক্ষ্য করলেন কোনও এক গ্যাসের আবহে ইলেকট্রনের স্রোত পাঠালে গ্যাসীয় কণা তড়িৎবাহী হয়ে ওঠে। কেবল তাই নয়, এই অবস্থায় ইলেকট্রনের নিজস্ব শক্তি অপরিবর্তিতই থেকে যায়। আর সেই শক্তি ওই গ্যাসের মধ্যে নিজস্ব শক্তি প্রভাবে গড়ে তোলে তড়িৎবাহী বা আয়নিত গ্যাসীয় অঞ্চল।
  • (৩) লেনার্ড এই সমীক্ষা প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপের আধুনিক পদার্থবিদদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে গেল। পরের বছরেই এক চমকপ্রদ প্রবন্ধ প্রকাশ করে লেনার্ড তুলে ধরলেন যে কোনও পদার্থের পরমাণুর ভেতরকার বিচিত্র চিত্র।
  • (৪) সেই প্রবন্ধে তিনি জানালেন যে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে পরমাণু সম্পর্কে যা অনুমান করতে পেরেছেন, তা হল, পদার্থের অতি ক্ষুদ্র কণার সমবায়ই হল পরমাণু। প্রতিটি কণাই শক্তিসমৃদ্ধ-এগুলোর নাম হতে পারে dynamide। এই ডিনামাইডগুলো প্রত্যেকেই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে এক নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে।
  • (৫) কিন্তু প্রত্যেকটি কণার মধ্যেই রয়েছে সমসংখ্যার দুই ভিন্ন তড়িৎ-ধর্মিতা। এমন তড়িৎ-শক্তি সমৃদ্ধ পরমাণুগুলোর বাইরের চেহারাটি একেবারেই সাদামাটা। লেনার্ড আরও লিখেছেন যে, পরমাণুর ভেতরের ১০০,০০০০০০০ ভাগের এক ভাগ বাদে বাকি সম্পূর্ণ অংশই মহাশূন্য।
  • (৬) পরমাণু সম্পর্কে লেনার্ডের এই তত্ত্ব নতুনভাবে আলোকিত করে তুলল আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রকে। সেই আলোক ধরেই পরবর্তীকালে ইলেকট্রনের তত্ত্ব নিরূপণে লরেনৎর্জ সাফল্যের দুয়ারে পৌঁচেছেন। এর পরেই লেনার্ডের গবেষণা এক নতুন পথে দিক পরিবর্তন করে।

বর্ণালী সংক্রান্ত গবেষণায় ফিলিপ লেনার্ড

  • (১) এরপর তাঁর ধ্যানজ্ঞান নিবিষ্ট হয় বর্ণালী সংক্রান্ত গবেষণায়। তিনি খুঁজে ফিরতে থাকেন বর্ণালীর নানা রেখা, তার প্রকৃতি ও উৎস। এই গবেষণায় লেনার্ডের সামনে ছিল তাঁর পূর্বসূরী বিজ্ঞানী, রাইডবার্গ, কেসার ও রুঙ্গে-এর গবেষণার প্রদীপ। পদার্থবিদ্যার এই তিন দিকপাল বিজ্ঞানী বর্ণালী সংক্রান্ত গবেষণায় জানতে পেরেছিলেন যে সত্য তা হল, কোনও ধাতু নির্গত বর্ণালী রেখাগুলিকে দুই বা তারও বেশি শ্রেণীতে সাজানো যায়। দ্বিতীয়তঃ, বর্ণালীরেখার সকল শ্রেণীর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যগুলির মধ্যে থাকে এক আশ্চর্য গাণিতিক সম্পর্ক।
  • (২) পূর্বসূরীদের এই প্রদীপ সামনে রেখে লেনার্ড খুঁজে পেয়ে গেলেন এক নতুন পথ। তিনি জানতে পারলেন, বর্ণালীরেখার এক এক শ্রেণীতে রয়েছে পরমাণুর এক এক পরিবর্তিত অবস্থা। আর এই পরিবর্তিত পারমাণবিক অবস্থাই নির্দিষ্ট শ্রেণীর পরিচয় নির্দেশ করে। লেনার্ড এ-ও জানতে পারলেন, পরিবর্তিত পারমাণবিক অবস্থাগুলি হৃত উলেকট্রনের সংখ্যা ধরে আলাদা আলাদা করা যায়।

লেনার্ডের প্রতি সম্মাননা

আলোকের দূত লেনার্ড তাঁর কৃতিত্বের জন্য স্বাকৃতি পেয়েছেন তাঁর দেশে ও বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানজনক ডি. এস-সি উপাধি। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পেয়েছেন পদার্থ বিদ্যার নোবেল। একই বছরে ফ্রাঙ্কলিন পদক। জার্মান রেইখের ঈগল পান ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে।

ফিলিপ লেনার্ডের মৃত্যু

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী লেনার্ডের জীবনাবসান ঘটে।

উপসংহার :- ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড ছিলেন এমন এক বিজ্ঞানী, যিনি তার সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী পদার্থবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ক্যাথোড রশ্মি ও ইলেকট্রনের ওপর তার গবেষণা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করতে সাহায্য করে এবং তাকে ১৯০৫ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। তবে তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিশ্বাস, বিশেষত নাৎসি মতাদর্শের প্রতি তার সমর্থন এবং “আর্য বিজ্ঞান” ধারণা প্রচার, তার বৈজ্ঞানিক সাফল্যের ছায়া ফেলেছিল। যদিও তার বৈজ্ঞানিক অবদান অনস্বীকার্য, তার বিশ্বাস ও কাজের রাজনৈতিক প্রভাব তাকে বিতর্কিত করে তোলে।

(FAQ) ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফিলিপ এডওয়ার্ড অ্যান্টন ভন লেনার্ডের প্রধান বৈজ্ঞানিক অবদান কী ছিল?

তার প্রধান বৈজ্ঞানিক অবদান ছিল ক্যাথোড রশ্মি এবং ইলেকট্রনের ধর্ম বোঝার জন্য গবেষণা, যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. ফিলিপ ভন লেনার্ড নোবেল পুরস্কার কবে পেয়েছিলেন এবং কোন ক্ষেত্রে?

তিনি ১৯০৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে তার গবেষণার জন্য।

৩. ফিলিপ ভন লেনার্ড কেন বিতর্কিত ছিলেন?

তিনি তার বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য খ্যাত হলেও, নাৎসি মতাদর্শে জড়িয়ে পড়া এবং “আর্য বিজ্ঞান” ধারণা প্রচারের কারণে তিনি বিতর্কিত ছিলেন।

৪. “আর্য বিজ্ঞান” ধারণা কী ছিল?

“আর্য বিজ্ঞান” ধারণা ছিল একটি জাতিগত বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে লেনার্ড বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞানকে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের সাথে যুক্ত করা উচিত, যা বিজ্ঞানী সমাজে গভীর বিরোধ সৃষ্টি করেছিল।

৫. লেনার্ডের গবেষণা কীভাবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে প্রভাব ফেলেছে? 

লেনার্ডের ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা ইলেকট্রনের ধর্ম ও গতি সম্পর্কে গভীরতর বোঝাপড়া প্রদান করেছে, যা পরে ইলেকট্রনিক্স এবং পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

Leave a Comment