একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক এবং খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত সমাজসংস্কারক ছিলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫)। তিনি হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কৃষ্ণমোহন ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, যা তখনকার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তার অবদান আজও স্মরণীয়।
শিক্ষাবিদ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক চরিত্র | রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় |
জন্ম | ২৪ মে ১৮১৩ খ্রি |
জন্মস্থান | কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | শিক্ষাবিদ, ধর্ম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক |
প্রধান অবদান | ব্রাহ্ম সমাজ-এর কর্মী, খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার |
লেখালেখি | খ্রিস্ট ধর্ম ও সমাজ সংস্কার সম্পর্কে |
ধর্ম | হিন্দু ধর্ম থেকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত |
মৃত্যু | ১১ মে ১৮৮৫ খ্রি |
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
ভূমিকা :- ডিরোজিওর প্রতিষ্ঠিত সভায় তাঁর সেরা ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ। ডিরোজিওর অকাল প্রয়াণের পর শিক্ষকের প্রজ্বলিত মশাল বহন করেছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র-শিষ্যের দল। আর এই দলের অন্যতম প্রধান ছিলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। সমাজের প্রচলিত নানা কুসংস্কার, অসার ধর্মীয় আচার নীতির বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। এই জন্য তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিল গৃহ, স্বধর্ম। তবুও আপন কর্মধারায় অবিচলিত থেকে মহান শিক্ষা গুরুর প্রবর্তিত সংস্কার আন্দোলনকে প্রজ্বলিত রেখেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, খ্রিস্টধর্মপ্রচারক ও বহুভাষাবিদ দেশহিতব্রতী মনীষীরূপে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
নব্যবঙ্গে দীক্ষাগুরু ডিরোজিও
এদেশে নতুন যুগের প্রবর্তন করেছিলেন তৎকালীন পটলডাঙা হিন্দু কলেজের সতেরো বছর বয়সী তরুণ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। মাত্র পাঁচ বছর শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তার মধ্যেই তিনি ছাত্রসমাজকে জাতীয়তাবাদ, সমাজ চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির উন্মেষের দীক্ষায় দীক্ষিত করেছিলেন। ছাত্রদের হৃদয়ে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন স্বাদেশিকতার প্রেরণা, বিশ্বতোমুখী দৃষ্টিভঙ্গী, যাবতীয় অন্ধ ও পশ্চাৎমুখী সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিন্যাস। ডিরোজিও ছিলেন সত্য ও যুক্তিবাদের পূজারী এক মহান সংস্কারক। আমাদের দেশের ইতিহাসে নব্যবঙ্গে দীক্ষাগুরু রূপেই তাঁকে স্মরণ করা হয়ে থাকে।
দেশের প্রথম ছাত্রসংগঠন
ডিরোজিওর শিক্ষাচর্চা কেবল হিন্দু কলেজের চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের জন্য বিতর্কে যোগ দেওয়া, আবৃত্তি করা, কবিতা লেখা ছাড়াও আলোচনা সভার গুরুত্ব বুঝে তিনি গঠন করেছিলেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। এই সভাই আমাদের দেশের প্রথম আলোচনা সভা। এক অর্থে এদেশের প্রথম ছাত্রসংগঠনও এটি।
কৃষ্ণমোহনের জন্ম
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণমোহন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুর অঞ্চলে নবগ্রাম পল্লীতে।
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের পিতামাতা
নব্যদলের অন্যতম কৃষ্ণমোহনের পিতা জীবনকৃষ্ণ ছিলেন নিষ্ঠাবান দরিদ্র ব্রাহ্মণ। কৌলিক যজমানি বৃত্তিতে তাঁর পরিবারের ভরণপোষণ সম্ভব হত না। সামান্য জমিজমা যা ছিল, তার আয়ের ওপরেই তাঁকে নির্ভর করতে হত। কৃষ্ণমোহনের মাতার নাম শ্রীমতী দেবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও দয়াবতী মহিলা।
কৃষ্ণমোহনের শৈশব
পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে কৃষ্ণমোহন ছিলেন দ্বিতীয়। দরিদ্র পরিবারে জন্মে শৈশব থেকেই সর্ববিষয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁরা। জীবনকৃষ্ণ ঠনঠনের কাছে গুরুপ্রসাদ লেনে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। শ্বশুরবাড়ির বাস উঠিয়ে সেই বাড়িতেই সপরিবারে বসবাস করতেন।
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের শিক্ষা
- (১) কৃষ্ণমোহনের পড়াশুনা শুরু হয়েছিল গৃহেই। পরে তাঁকে মহাত্মা ডেভিড হেয়ারের ঠনঠনের পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। লেখাপড়ায় কৃষ্ণমোহনের ছিল গভীর আগ্রহ। সব বিষয়ই খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করতেন। ক্লাশের পড়াও করতেন মনোযোগ সহকারে। এ সকল কারণে ডেভিড হেয়ারের স্নেহ ভালবাসা লাভ করেছিলেন তিনি।
- (২) কৃতিত্বের সঙ্গে পাঠশালার পড়া সাঙ্গ করে কৃষ্ণমোহন পটলডাঙ্গা হিন্দু স্কুলে প্রবেশ করেন। তাঁর স্কুলের কৃতিত্ব দেখে বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না কতটা পরিশ্রম ও ক্লেশ স্বীকার করে কৃষ্ণমোহনকে লেখাপড়া করতে হত। দরিদ্রের সংসার। তাই মায়ের সঙ্গে গৃহকর্মের অনেক কাজই তাঁকে নিয়মিত করতে হত। সংসারের একবেলার রান্নার দায়িত্বও তাঁর ওপরেই ছিল।
- (৩) এতসব কিছু সামলে অধিক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতে হত কৃষ্ণমোহনকে। ক্লাশের পরীক্ষায় বরাবরই কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতেন। স্কুলের বৃত্তিভোগী ছাত্রহিসেবে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজে প্রবেশ করেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণমোহন কলেজের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হয়ে মাসিক ১৬ টাকা বৃত্তি লাভ করেন।
শিক্ষক কৃষ্ণমোহন
এই সময়েই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। ফলে সাংসারিক অভাব অনটনের চাপে পড়াশুনা ছেড়ে কৃষ্ণমোহনকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার তাঁকে তাঁর পটলডাঙ্গা স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে নিযুক্ত করেন।
ডিরোজিওর শিষ্য কৃষ্ণমোহন
তরুণ শিক্ষক ডিরোজিওর সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে কৃষ্ণমোহনের অন্তরে প্রজ্বলিত ছিল গুরুর মন্ত্রদীক্ষা। মানুষের জীবনের সবচেয়ে মহৎ শিক্ষা কৃষ্ণমোহন লাভ করেছিলেন ডিরোজিওর কাছ থেকে। সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা-এই শিক্ষার বশবর্তী থেকে ডিরোজিওর শিষ্যবর্গ সমাজের সকল প্রকার কুসংস্কার কুপ্রথা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, জাতিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে নির্ভীক সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিলেন।
কৃষ্ণমোহনের Enquirer পত্রিকা
গোঁড়া হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধাচরণ করা সে যুগে ছিল এক অসম্ভব দুঃসাহসী কাজ। কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরে কৃষ্ণমোহন প্রকাশ্যে সেই কঠিন কাজে অগ্রসর হলেন। মাত্র ১৮ বছর তখন তাঁর বয়স। তিনি প্রকাশ করলেন Enquirer পত্রিকা। জ্বালাময়ী ভাষায় সমাজ-সংস্কৃতির অচলায়তনে হানতে লাগলেন কঠিন আঘাত। আলোড়ন উঠল দেশময়। গোঁড়া হিন্দু সমাজপতির দল সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মাধ্যমে নব্য শিক্ষিত তরুণদের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ বর্ষণ আরম্ভ করল। এভাবে প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের মধ্যে বাদানুবাদের আসর ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল।
সামাজিক প্রথা ভাঙ্গার আন্দোলনে অগ্রণী কৃষ্ণমোহন
আলেকজান্ডার ডাফ খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কলকাতায় আসেন ১৮৩০ খিস্টাব্দে। কিছুদিন পরেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনসটিটিউশন। দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইংরাজি শিক্ষার প্রসারের জন্য মহাত্মা রামমোহনও এই কাজে ডাফকে প্রভূত সহায়তা করেছিলেন। ডাফ সাহেব বাস করতেন হিন্দু কলেজের সংলগ্ন একটি বাড়িতে। সেই বাড়ির একতলার একটি প্রশস্ত হলঘরে ডাফ সাহেব ধর্ম ও সমাজ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা করতেন। ডাফ সাহেবের বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়ে ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল দলের ছাত্ররা সমবেত হতে লাগলেন এবং হিন্দু সমাজের সংকীর্ণ দিকগুলি তুলে ধরে সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন। কৃষ্ণমোহন এই সময় অগ্রণী হলেন সামাজিক প্রথা ভাঙ্গার আন্দোলনে। তিনি সদলে নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ, মদ্যপান ইত্যাদি করতে লাগলেন প্রকাশ্যে।
ডিরোজিওর পদত্যাগ
গোঁড়ার দল ক্ষিপ্ত হয়ে সমাজের তরুণদের এভাবে বিপথে চালিত করবার জন্য শিক্ষক ডিরোজিওকেই সর্বাংশে দায়ি করলেন। তাঁদের চাপে পড়ে হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে তাঁর বক্তব্য বলার অবকাশ না দিয়েই শিক্ষক পদ থেকে অপসারণ করলেন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল ডিরোজিও পদত্যাগ করলেন। এরপর আর মাত্র আট মাস জীবিত ছিলেন তিনি।
কৃষ্ণমোহনের গৃহে তরুণদের সমাবেশ
হিন্দু সমাজের গোঁড়া সমাজপতিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কৌশল নির্ধারণের জন্য তরুণেরা কৃষমোহনের গৃহে সমবেত হতেন। সভায় আলোচনার মধ্যে স্থির হত আক্রমণের পথ। ডিরোজিওর অপসারণের অপমান ও জ্বালা প্রকাশিত হত তরুণদের ভাষণে, লেখায়। সমস্ত বিরণ প্রকাশিত হত প্রতি সপ্তাহে Enquirer ও জ্ঞানান্বেষণের পাতায়। ডিরোজিও-শিষ্য দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হত জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা। এই সময়ে অনেক তরুণ টিকিধারী ফোঁটাকাটা ব্রাহ্মণ পথে দেখলে টিটকিরি বিদ্রূপে তাদের অতিষ্ঠ করে তুলত। ‘আমরা গরু খাই গো’ বলে তাদের ছুঁয়ে দিতে উদ্যত হত।
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের গৃহত্যাগ
- (১) কৃষ্ণমোহনের অগ্রবর্তীতায় গোঁড়া হিন্দু সমাজের প্রতি তরুণদের আক্রমণ এমনই উগ্র হয়ে উঠতে লাগল যে পরিবারের সঙ্গে বাস করাই তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ল। সেই অনিবার্য কাজটি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এক নাটকীয় ঘটনার দ্বারা তরান্বিত হল।
- (২) এই বছর অগাস্ট মাসের ২৫ তারিখে কৃষ্ণমোহন কোনও কাজে বাড়িতে অনুপস্থিত ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর বন্ধুরা বাড়ির বারান্দায় একত্র হয়ে হিন্দুসমাজের কুসংস্কার গোঁড়ামি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চারে আলোচনা করতে লাগলেন। হিন্দু পাড়ার মধ্যে স্বভাবতঃই এ কাজে তাঁদের উৎসাহ ছিল বেশি। উল্লাসে উত্তেজনায় তারা টগবগ করছিলেন।
- (৩) এই সময় কয়েকজন গিয়ে কাছেই মেছুয়া বাজার থেকে গোমাংস ও রুটি কিনে নিয়ে এল। উল্লাসধ্বনি সহকারে সেই নিষিদ্ধ মাংস খেয়ে হাড়গুলো ছুঁড়ে ফেললেন পাশের চক্রবর্তীদের বাড়িতে। সেই সঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে গো-হাড় গো গো-হাড় ধ্বনি।
- (৪) বাড়ির লোকজন ছুটে বেরিয়ে এসে কৃষ্ণমোহনের বন্ধুদের কীর্তিকলাপ দেখে উত্তেজনায় ক্রোধে মারমুখী হয়ে ছুটে আসে। মার খেতে খেতে কোনও ক্রমে আত্মরক্ষা করে তরুণের দল পালিয়ে যান। উত্তেজিত প্রতিবেশীরা কৃষ্ণমোহনের বড় ভাই ভুবনমোহনের নিকট গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা সমস্বরে দাবি জানাল, কৃষ্ণমোহনকে বাড়িতে রাখা চলবে না।
- (৫) কৃষ্ণমোহন বাড়ি ফিরে এসে সব ঘটনা শুনে দুঃখিত হলেন। তিনি উত্তেজিত প্রতিবেশীদের বুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। সকলে একবাক্যে আদেশ জারি করলেন, সেই মুহূর্তে একবস্ত্রে তাঁকে পাড়া ছেড়ে যেতে হবে। বাধ্য হয়েই সেদিন কৃষ্ণমোহনকে গৃহত্যাগ করতে হল।
বন্ধুর কাছে কৃষ্ণমোহনের আশ্রয়
বৃহত্তর সমাজ তথা জাতিকে কুশিক্ষা, কুপ্রথা, কুসংস্কারের কবল থেকে উদ্ধার করার সংস্কার আন্দোলনে নেমে পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে পথে নামলেন কৃষ্ণমোহন। কিন্তু কোথায় যাবেন? কোনও হিন্দুপল্লীতে আশ্রয় পাওয়া যে অসম্ভব তা তিনি জানতেন। তবুও বন্ধু দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে দেখা করলেন। সব শুনে দক্ষিণারঞ্জন বন্ধুকে সাহস করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু ঘটনাটা জানাজানি হতে, মাসখানেকের মধ্যেই পাড়ার পিতৃস্থানীয় প্রতিবেশীরা আপত্তি জানালেন। কৃষ্ণমোহন বন্ধুর আশ্রয়চ্যুত হলেন।
সাহেবের আশ্রয়ে কৃষ্ণমোহন
এরপর তিনি চলে এলেন চৌরঙ্গি অঞ্চলে ফিরিঙ্গিপাড়ায়। এক সাহেব দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে নিজগৃহে আশ্রয় দিলেন। হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের ব্যক্তিদের নির্যাতনে গৃহচ্যুত কৃষ্ণমোহন তাঁর মানসিক অবস্থার বর্ণনা করে Enquirer পত্রিকায় লিখে জানিয়েছিলেন ডিরোজিওর শিষ্য-অনুরাগীদের কী নিদারুণ লাঞ্ছনাগঞ্জনার মধ্যে দিয়ে চলতে হত। তিনি লিখেছিলেন “We left the home where we passed our infant days. We left our mother that nourished us in our childhood, we left our brother with whom we associated in our earliest days. We left our sisters with whom we sympathised since they were born.”
কৃষ্ণমোহনের মত তরুণদের বিরোধিতা
সমাজ সংস্কারের ব্রত গ্রহণ করে ইয়ং বেঙ্গল দলভুক্ত তরুণদের দুর্ভোগ সামাজিক নিষ্ঠুর নির্যাতন উৎপীড়নের মধ্যেই শেষ হত না, আপনজনদের কাছ থেকে, গৃহের আশ্রয়টুকু থেকেও তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দিত। এর পরও নিজেদের পরিচালিত সম্পাদিত কাগজে কাগজে তরুণদের বিরুদ্ধে চলত বিষোদগার। এমনকি মিথ্যা কলঙ্ক রটিয়ে তাঁদের চরিত্রে কালিমা লেপন করা হত।
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের মত তরুণদের প্রতি নির্মমতা
তরুণদের ধর্মীয় আচরণের প্রতি বিতশ্রদ্ধভাব, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নিন্দাবাদ এবং তাদের চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপের কাজে সেইকালে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের রিফর্মার পত্রিকা অপ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিল। এই গোঁড়ার দলের হৃদয়ে মমত্ব উদারতা বলে কিছু ছিল না। তারা যথার্থই ছিল নির্মম, হৃদয়হীন। অনাথ অসহায়ের চোখের জল, করুণ আকুতি এদের হহৃদয়কে স্পর্শ করতে পারত না। ডিরোজিওর অনুগামী প্রতিবাদী তরুণদের প্রতিও তারা ছিল নির্মম, নির্দয়। সমাজ-সংস্কৃতির পিচ্ছিল সোপান যাঁরা আবর্জনামুক্ত করে জ্ঞানের আলোকে সিঞ্চিত পরিশুদ্ধ করতে চায় যুগে যুগে দেশে দেশে তাঁদের এমনি লাঞ্ছনা নির্যাতনই ভোগ করতে হয়।
সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ মহান পুরুষ
মহামতি সক্রেটিসকে বিষ পান করে প্রাণ দিতে হয়েছিল, পরিত্রাতা যিশুকে হতে হয়েছিল ক্রুশবিদ্ধ। আরবভূমিতে ঈশ্বর-দূত হজরত মহম্মদকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। জাতিকে সংস্কারমুক্ত উন্নত জীবনের অনুসারী করার কাজে সমাজ সংস্কারক রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরকেও গোঁড়াসমাজের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। এই মহান পুরুষেরা সকল লাঞ্ছনা নির্যাতন হেলায় তুচ্ছ করে সত্যের জয় ঘোষণা করে গেছেন। তাঁরা অন্যায়কে করেছেন ঘৃণা, সত্যের প্রতি থেকেছেন একনিষ্ঠ।
গুরু ডিরোজিওর শিক্ষার প্রেরণা
বাংলার নব্যশিক্ষিত তরুণরা এই একই শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁদের শিক্ষাগুরু ডিরোজিওর কাছে। তাঁর শিক্ষার প্রেরণা বলেই সমাজের সকল প্রকার বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে তাঁরা দৃঢ়পদক্ষেপে আপন লক্ষ্যে অগ্রসর হবার শক্তি পেয়েছিলেন। দু পক্ষের বাদপ্রতিবাদে নবীনদের শাণিত যুক্তির অস্ত্রে ক্রমেই কোনঠাসা হতে লাগল গোঁড়া সমাজপতির দল।
চাকরী থেকে বরখাস্ত কৃষ্ণমোহন
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র কয়েক দিনের রোগ ভোগের পর আকস্মিক মৃত্যু হল ডিরোজিওর। কৃষ্ণমোহন শেষ সময় পর্যন্ত অক্লান্তভাবে গুরুর সেবা শুশ্রূষায় নিরত ছিলেন। ডিরোজিওর মৃত্যুর অল্পকিছুকাল পরেই কৃষ্ণমোহন ডাফ সাহেবের কাছে ক্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর ধর্মান্তরের কথা প্রচারিত হলে হিন্দুসমাজে প্রচন্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। এই অপকর্মের শাস্তি স্বরূপ অবিলম্বে পটলডাঙ্গা স্কুলের চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
সুযোগ্য ধর্মপ্রচারক কৃষ্ণমোহন
চাকরি খুইয়ে সাময়িকভাবে অসহায় বোধ করলেও কৃষ্ণমোহন নিশ্চেষ্ট থাকেন নি। অর্থোপার্জনের একটা উপায়ও হয়ে গেল অবিলম্বে। চার্চ মিশনারী স্কুলে সুপারিনটেনডেন্টের পদে নিযুক্ত হলেন তিনি। এই সময়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করেন এবং কিছুকাল বিশপস কলেজে অধ্যয়ন করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ধর্মশিক্ষার সঙ্গে ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু প্রভৃতি প্রাচীন ভাষাও তিনি আয়ত্ত করেন। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজে তাঁকে অনেকবারই উত্তর-পশ্চিম ভারত ভ্রমণে যেতে হয়েছে। সুযোগ্য ধর্মপ্রচারক রূপেও তিনি খ্যাতি লাভ করেন।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কৃষ্ণমোহনের তিক্ত সম্পর্ক
খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবার পর থেকে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছিল। ধর্মান্তরিত জামাতা তাঁর শ্বশুরমশায়ের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাই স্ত্রী বিন্দুবাসিনীকে তাঁর পিত্রালয়েই অবস্থান করতে হচ্ছিল। এই পরিস্থিতি চলেছিল বছর কয়েক। পরে কৃষ্ণমোহন আইনের সাহায্য নিয়ে স্ত্রীকে তাঁর বাবার কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিছুদিনের মধ্যে স্ত্রীকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন।
যাজক কৃষ্ণমোহন
১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে শিবপুর বিশপস কলেজের সংলগ্ন বেগম সমরু গির্জায় কৃষ্ণমোহন যাজকত্ব লাভ করেন। এদেশে বাঙালী যাজকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম। এই সময় থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে রেভারেন্ড শব্দটি যুক্ত হয়। দুবছর পরে তিনি ভ্রাতা কালীমোহনকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। গির্জায় প্রতি রবিবারে তিনি বাইবেলের উপদেশ বিষয়ে ভাষণ দিতেন। পরে এই বক্তৃতাগুলি পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয় এবং গির্জার স্কুলে ছাত্রদের পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়। কৃষ্ণমোহন এই সময় দরিদ্র ছাত্রদের বৃত্তির জন্য আট হাজার টাকা দান করেন।
মধুসূদনের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষায় কৃষ্ণমোহনের সহায়তা
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে মাইকেল মধুসূদন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মান্তর গ্রহণের ব্যাপারে কৃষ্ণমোহনের সহায়তা ছিল।
সুপারিনটেনডেন্ট কৃষ্ণমোহন
১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রাইস্ট চার্চ প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুর স্কুলে তিনি সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন। এখানে দীর্ঘ তেরো বৎসর কর্মরত ছিলেন। ১৮৫২ খ্রি বিশপস কলেজে অধ্যাপক হন এবং শিবপুরেই বসবাস করতে থাকেন।
পত্রিকা সম্পাদক কৃষ্ণমোহন
একই সময়ে বহুবিধ কাজের সঙ্গে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন কৃষ্ণমোহন। কলেজের শিক্ষাদান, ধর্মপ্রচার ইত্যাদির সঙ্গে লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতেন। নব্যদলের মুখপত্র দি অ্যানক্যোয়ারার, দি ইউথ, গভর্নমেন্ট গেজেট, সংবাদ সুধাংশু পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত।
বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত কৃষ্ণমোহন
তাছাড়াও জ্ঞানোপার্জিকা সভা, এশিয়াটিক সোসাইটি, বেথুন সোসাইটি, ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব, বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা, ভারত সংস্কার সভা প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
সম্মানিত কৃষ্ণমোহন
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডক্টর অব ল ও সরকার কর্তৃক সি-আই-ই উপাধিতে ভূষিত হন। দুবার তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিশনার হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটিরও সভ্য নিযুক্ত হন।
শিক্ষার প্রসারে কৃষ্ণমোহনের অবদান
দেশে শিক্ষার প্রসারের জন্য কৃষ্ণমোহন বিভিন্ন সারস্বত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করেছেন। সমসাময়িক ছাত্রসমাজে কৃষ্ণমোহনের প্রভাব ছিল গভীর। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় বিশপ উইলসন কৃষ্ণমোহন সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “বিগত পাঁচ ছয় বৎসর যাবৎ হিন্দু কলেজের ছাত্ররা দর্শন শাস্ত্র, ইংরাজি সাহিত্য এবং খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে যে প্রগাঢ় জ্ঞান অর্জন করেছে তার জন্য কৃষ্ণমোহনের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে।”
পৌরসভার সদস্য কৃষ্ণমোহন
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইণ্ডিয়া লিগের আন্দোলনের ফলে নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে কৃষ্ণমোহন পৌরসভার সদস্য হন।
কৃষ্ণমোহন রচিত গ্রন্থ
তিনি বাংলা, সংস্কৃত ইংরাজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। বাংলায় বিশ্বকোষ রচনায় তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনি তেরো খণ্ডে ইংরাজি বাংলা সংকলন গ্রন্থ বিদ্যাকল্পদ্রুম প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ দি পারসিকিউটেড (নাটক), উপদেশকথা, ডায়ালগস অন দি হিন্দু ফিলসফি, ষড়দর্শন সংবাদ, দি এরিয়ান উইটনেস, টু অ্যাসেজ অ্যাজ সাপ্লিমেন্টস, দি এরিয়ান উইটনেস প্রভৃতি।
বাংলা ভাষার প্রতি কৃষ্ণমোহনের গভীর অনুরাগ
কৃষ্ণমোহন ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। বিশপস কলেজে উপাসনা মঞ্চে তিনি বাংলায় উপাসনা প্রচলন করেছিলেন।
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের মৃত্যু
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে কৃষ্ণমোহনের কর্মময় মহান জীবনের অবসান হয়।
উপসংহার :- রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম প্রভাবশালী সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও ধর্ম প্রচারক। তার জীবন ও কর্মের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্বাধীনতা, যুক্তিবাদ এবং সমাজের কল্যাণে আত্মনিবেদনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করেছেন। হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থী থেকে ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য এবং পরবর্তীতে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রগতির পথ দেখিয়েছেন। তার শিক্ষা ও ধর্মচর্চা বাংলার নবজাগরণ-এর ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ব্যক্তিগত জীবনে এবং সমাজে সত্য ও ধর্মের সন্ধানী এই মনীষী আজও স্মরণীয়।
(FAQ) রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক এবং পরে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত সমাজসংস্কারক ছিলেন।
তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন।
ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, যা তৎকালীন সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
শিক্ষা, ধর্ম প্রচার এবং সমাজ সংস্কারে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
১৮৮৫ সালে।
তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর খ্রিস্টান মিশনারি কার্যক্রমে যুক্ত হন।