বি. এ. জেনারেল (1st Semister) ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়: হরপ্পা সভ্যতা থেকে ১০ নাম্বারের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – হরপ্পা সংস্কৃতির অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
হরপ্পা সংস্কৃতির অর্থনৈতিক জীবন
প্রশ্ন:- হরপ্পা সংস্কৃতির অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে কি জানো?
সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা ছিল ভারতের প্রাচীনতম নগররাষ্ট্র। এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে তৎকালীন অর্থনৈতিক দিকগুলি সম্পর্কে জানতে পারা যায়।
সিন্ধুবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে গম, যব, ধান ও বার্লি ছিল প্রধান। সম্ভবত নদীর জল বাঁধ দিয়ে ধরে রেখে চাষের কাজে লাগানো হত। কৃষকদের কাছ থেকে উৎপন্ন ফসল কর হিসেবে নেওয়া হত। তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, চাল, বাদাম, খেজুর প্রভৃতি। আমিষখাদ্যের মধ্যে ভেড়া ও শূকরের মাংস এবং নদীর মাছ ছিল প্রধান। পশুপালন সিন্ধু অধিবাসীদের অজানা ছিল না। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গোরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন ঘোড়ার প্রচলন ছিল কিনা জানা যায় না।
সিন্ধু অঞ্চলে ধাতুশিল্প ও মৃৎশিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। সেই সময়ে লোহার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। ধাতুর মধ্যে তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার ছিল। ধাতু থেকে বর্শা, কুঠার, বড়শি, করাত, সূঁচ প্রভৃতি তৈরি করা হত। দক্ষিণ ভারত থেকে সোনা আমদানি করে নানা অলঙ্কার তৈরি করা হত। রূপার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। মৃৎশিল্পীরা পলিমাটি, বালি ও চুনের গুঁড়ো মিশিয়ে কলসী, জালা, থালা, নানারকমের খেলনা তৈরি করত। এগুলিকে আগুনে পুড়িয়ে মজবুত করে রং লাগানো হত। কাচের মতো চক্চকে ও মসৃণ চীনামাটির পাত্রনির্মাণে তারা খুবই দক্ষ ছিল। তবে হরপ্পা সংস্কৃতির লোকেরা শিল্প-রুচিসম্মত ছিল বলে মনে হয় না। ‘Art for Arts Sake’ – এই নীতিতে তারা আদৌ বিশ্বাসী ছিল না। তাদের শিল্পকর্ম বা নগর পরিকল্পনা সবই ছিল প্রয়োজনভিত্তিক। কঠোর আত্মসংযম ছিল তাদের স্থাপত্যকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য।
সিন্ধুবাসীরা ব্যবসাবাণিজ্যে যথেষ্ট দক্ষ ছিল। দেশে ও বহির্দেশে এই ব্যবসা চলত। চাকাবিশিষ্ট গাড়ি ও নৌকার সাহায্যে ব্যবসাবাণিজ্য চলত। ভারতের বাইরে মধ্য-এশিয়া ও পশ্চিম-এশিয়ার সঙ্গে হরপ্পার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। মিশর, ক্রীট এবং বিশেষভাবে মেসোপটেমিয়া ও সুমেরের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যিক লেনদেন চলত। কেবল স্থলপথে নয়, জলপথেও বাণিজ্য চলত। সম্প্রতি লোথালে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত তথ্যাদি ব্যাপক সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইঙ্গিত বহন করে। রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে প্রধান ছিল বিভিন্ন বিলাস-দ্রব্য যেমন – ময়ূর, হাতির দাঁত ও তা থেকে তৈরি নানা দ্রব্যাদি, মণিমুক্তা ও সূতিবস্ত্র ইত্যাদি। আমদানি দ্রব্য প্রধানত রূপা ও নীলকান্তমণি।
মেসোপটেমিয়ায় বহু ভারতীয় বণিক স্থায়ীভাবে বসবাস করত। শিল্পের প্রয়োজনে কাঁচামাল দেশ-বিদেশ থেকে আমদানি করা হত। যেমন – হিমালয় থেকে দেবদারু কাঠ, বেলুচিস্তান ও রাজস্থান থেকে তামা, পারস্য থেকে রূপা সৌরাষ্ট্র এবং দাক্ষিণাত্য থেকে শাঁখ ও নানা ধরনের পাথর প্রভৃতি। সিন্ধুর তুলাজাত দ্রব্য মেসোপটেমিয়ায় রপ্তানি করা হত।
তখন মুদ্রাব্যবস্থা চালু হয়নি, তাই বিনিময়ের মাধ্যমে কেনা-বেচা চলত। মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে যে সুদৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তা বোঝা যায় উভয় অঞ্চলে প্রাপ্ত পরস্পরের নিদর্শন থেকে। বস্তুত সিন্ধু-উপত্যকার অধিবাসীরা যে উন্নত ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন, সুসংগঠিত বাণিজ্য ছাড়া তা অবশ্যই সম্ভব হত না।