এই শীতেও কীভাবে হবেন সকালবেলার পাখি
সুয্যিমাম্য সবে আড়মোড়া ভেঙেছে। আলো ছড়িয়ে বলছে, ‘ইশ! আমি উঠলাম ভাগ্যিস, তাই রাত্তির হলো ভোর।’ আর ঠিক তখনই মুঠোফোনের অ্যালার্মটা বেজে উঠেছে। কিন্তু গায়ের বোনা নকশিকাঁথার উষ্ণতা থেকে হাত বের করে অ্যালার্মটা বন্ধ করা যে কঠিন। আরও কঠিন শীতের ভোরে ঘুমের জগৎ থেকে নিদারুণ কর্মময় জগতে ফেরা। ফিরব বললেই ফেরা যায় নাকি।
মন ও শরীরের বিদ্রোহ
শরীর, মন বিদ্রোহ করে। দোষ কি শুধু শরীর-মনের? প্রকৃতিও যে তখন আড়মোড়র ভাঙেনি। বারান্দার টবে ফোটা ফুলগুলো শিশিরে ভিজে জবুথবু, সামনের ডাবগাছের লম্বা পাতাগুলোও যে কুয়াশা মেখে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। পায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছে আদুরে বিড়ালছানা। মন বলে ওঠে, আহা যদি ফুল, পাতা নিদেন বিড়ালছানাটাও হতাম।
হতে তো হবে সকালবেলার পাখি
কিন্তু হতে তো হবে সকালবেলার পাখি। সবার আগে কুসুমবাগে উঠতে হবে জাগি। তবে চলুক সে প্রস্তুতি। দিনপঞ্জিকার পাতা বলছে, এখন হেমন্তের মাঝবয়স। পৌষ ডাকাডাকি করছে। যান্ত্রিক নগরে অবশ্য শীতের আমেজ টের পাওয়া যায় সকাল-সাঁঝে। শহরের বাইরে বিশেষ করে উত্তরের দিকে কিন্তু সেই চিরচেনা কুয়াশাভেজা গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে রোদ্দুর উকি দিচ্ছে। সবুজ ঘাসগুলো শিশিরে ভিজেছে। আলমারি আর দেরাজ থেকে বেরিয়ে পড়েছে উলের টুপি, সোয়েটার, শাল। ভোরের দিকে সেগুলো গায়ে চাপাতেই হচ্ছে। হাতে এসেছে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। সকালে সুয্যিমামার আলস্য ভাঙতেই টানা বারান্দার রেলিং বা খোলা ছাদে ভারী লেপ, কম্বলগুলো গা এলিয়ে দিয়েছে।
দেহঘড়ির অ্যালার্ম লাগে না
শীত কম হোক বা বেশি, ভোর আর সকালজুড়ে আলসেমির পারদ কিন্তু একই। রবিঠাকুরের ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন, আমলকীর এই ডালে ডালে/ পাতাগুলি শিরশিরিয়ে, ঝরিয়ে দিল তালে তালে’ গান যতই গুনগুন করি না কেন, ঘড়ির কাঁটার তালে তালে হাত-পা যেন চলে না। তবে জীবনের তাল মেলাতে গেলে তো বসে থাকলে চলবে না। তাই নকশিকাঁথাটা সরাতেই হবে। বারান্দায় বেরিয়ে উত্তরে হাওয়ায় একটু কেঁপে না উঠলে শরীরটা যে আড়মোড়া ভাঙবে না। আর একটু পর মিষ্টি রোদটা যখন হেসে উঠবে, তখন ঠিক মেনে নেওয়া যাবে ‘কর্মেই মুক্তি’।
(১) এক নারীর গল্প
শীতের সকালের এমন আলসেমিকে কীভাবে জয় করা যায়, কীভাবেই-বা ভোর হলেই দোর খুলে দেওয়া যায়? শীত-গ্রীষ্ম সারা বছর সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন, এমন এক কর্মমুখর নারীর কাছে জানতে চাইলাম সে কথা। ৭০ বছরের এই নারী নাম জানাতে চাইলেন না। তবে বলে দিলেন তাঁর সূত্রটা। জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভোরে ঘুম ভাঙত। সকালে উঠেই চুলায় বসিয়ে দিতেন চায়ের কেটলি। হাত-মুখ ধুয়ে একসঙ্গে চা পান করতেন বাবা আর মেয়ে। বাবার জন্যই উঠতেন তখন। তাঁর মা অত সকালে উঠতে পারতেন না। আজও রয়ে গেছে সেই অভ্যাস। তিনি বললেন, ‘অ্যালার্ম লাগে না।’ দেহঘড়িই জাগিয়ে দেয়। সকাল সকাল যেমন ওঠেন, তেমনি ঘুমাতেও যান আগে আগে। রাত ১১ টার সধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুম ভাঙার পর আর বিছানায় থাকতে নেই, এটাই মেনে এসেছেন এতগুলো বছর। আর একটা কথা জীবনের মূলমন্ত্র বলে মানেন, ‘যে শুয়ে থাকে, অর ভাগ্যও শুয়ে থাকে।’ এভাবেই সংসার, শিক্ষকতা, জীবনের যত ঝড় সামলেছেন শক্ত হাতে। শরীর এখন ক্ষীণ হয়েছে, কিন্তু তেমনই কর্মচঞ্চলতায় কেটে যায় দিন।
(২) ছোট্ট এক শিশুর গল্প
শহরের বাসিন্দা আট বছরের এক শিশু শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতে চায় না। তাকে জাগাতে হিমশিম খান মা-বাবা। ‘পউষ এলো গো, পউষ এলো, অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে’ বাবার মুখে নজরুল-এর এই কবিতা শুনে পৌষ বা হেমন্তের ভোরে অশ্রুতে ভেসে যায় ছোট্ট শিশুটি। মা-বাবার ডাকাডাকিতে ঘুমটা ভাঙে বটে, তবে হিম সকালে কানটুপি আর মোজা পরে রিকশায় বসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মা জানালেন, ছেলের ঘুম ভাঙাতে তার এক মজার খেলা বেছে নিয়েছেন। তিনজন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ঠিক করে ফেলেন সকালে অ্যালার্ম বাজার পর কে আগে বিছানা ছাড়বে। অ্যালার্ম বাজতেই যে প্রথম বিছানা ছেড়ে কাজ শুরু করতে পারে, সে পায় পুরস্কার। খেলায় জিততে তাই অ্যালার্ম বাজলে ছোট্ট শিশুটিও হুটোপুটি শুরু করে।
অ্যালার্ম যখন অ্যালার্মিং
এসব তো নিজের মতো করে শীতের সকালের লড়াইয়ের কৌশল। এবার শোনা যাক বিশেষজ্ঞরা কী বলেন। বৃদ্ধা সেই নারীর দেহঘড়ি পদ্ধতির কথাই বলছেন যুক্তরাজ্যের জিপিহেড ক্লিনিকের পরিচালক ও ঘুম বিষয়ক মনোবিদ স্টেফানি রমিসজিওয়েস্কিও। এক প্রতিবেদনে তিনি বলছেন, সপ্তাহের প্রতিদিন একই সময়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে। এমনকি রাতে ভালো ঘুম না হলেও সকালে একই সময়ে জাগতে বলছেন তিনি। এতে প্রতিদিন সকালে একই সময়ে সক্রিয় হতে শিখবে শরীর। একই সময়ে সজাগ হবে মস্তিষ্ক।
শেষ কথা
আলোচনা খটমট মনে হলেও কৌশল কিন্তু মন্দ নয়। বেশি কঠিনও নয়। জানালার ভারী পর্দাটা ঘুমানোর আগেই সরিয়ে দিন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামকে দিন ছুটি। ঘড়ির কাঁটা মেনে গায়ের বোনা নকশিকাঁথার উষ্ণতায় চলে যান ঘুমের জগতে। আর শুভমিতার ‘যেভাবেই তুমি সকাল দেখ সূর্য কিন্তু একটাই’ সুর ভাঁজতে ভাঁজতেই না হয় সকালটা শুরু করলেন। তাতে শীতের সকালে ঘুম ভাঙার কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।