বিশিষ্ট নারী সংগ্রামী মোহিনী দেবী ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবিকা ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী, যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ও বিধবা নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেন। ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি সামাজিক কুসংস্কার ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। মোহিনী দেবীর কাজ বাংলা সমাজে নারী-পুরুষের সাম্যের ধারাকে শক্তিশালী করে তোলে।
সমাজসেবিকা মোহিনী দেবী
ঐতিহাসিক চরিত্র | মোহিনী দেবী |
জন্ম | ১৮৬৩ খ্রি |
জন্মস্থান | বঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত |
পরিচিতি | সমাজসেবিকা, নারী জাগরণ ও ব্রাহ্ম আন্দোলন-এর কর্মী |
প্রধান অবদান | নারী শিক্ষা, বিধবা পুনর্বাসন, কুসংস্কার বিরোধিতা |
সংশ্লিষ্ট সংগঠন | ব্রাহ্ম সমাজ |
প্রভাব | বাংলার নারী সমাজে শিক্ষার প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধি |
মৃত্যু | ২৫ মার্চ ১৯৫৫ খ্রি |
মোহিনী দেবী
ভূমিকা :- ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় যখন সমাজ নানা রকম কুসংস্কার ও নারীর প্রতি বৈষম্যে আচ্ছন্ন ছিল, তখন কিছু প্রগতিশীল মনীষী ও সমাজকর্মী সমাজ পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে মোহিনী দেবী একজন অন্যতম নারী যিনি নারী শিক্ষার প্রসার, বিধবা নারীদের পুনর্বাসন এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। মোহিনী দেবী ছিলেন একাধারে সংগ্রামী, সচেতন ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, যাঁর প্রচেষ্টায় বাংলার নারী সমাজ ধীরে ধীরে জাগ্রত ও সচেতন হয়ে ওঠে। তাঁর জীবন ও কর্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীমুক্তি আন্দোলনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সমাজসেবিকা মোহিনী দেবীর জন্ম
মোহিনী দেবী ১৮৬৩ সালের (বাংলা ১২৭০ সাল) ২০শে ফাল্গুন ঢাকা জেলার মাণিকগঞ্জের বেউথা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
মোহিনী দেবীর পিতৃপরিচয়
তার পিতা রামশঙ্কর সেন এবং মাতা উমাসুন্দরী দেবী। সেই যুগে বাংলাদেশ-এর প্রগতিমূলক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই পরিবার বিশেষ জড়িত ছিল।
নারী সংগ্রামী মোহিনী দেবীর শিক্ষা
ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রথম হিন্দু ছাত্রী ছিলেন মোহিনী দেবী। রামতনু লাহিড়ী, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের নিকট তার শিক্ষালাভ হয়েছিল। পরে ইউনাইটেড মিশনের শিক্ষয়িত্রীগণ তাঁকে ইংরাজি শিক্ষা দেন।
মোহিনী দেবীর বিবাহ
বারো বছর বয়সে মোহিনী দেবীব বিবাহ হয় তারকচন্দ্র দাশগুপ্তের সঙ্গে। তারকচন্দ্র দাশগুপ্ত দর্শন বিষয়ে বই লিখে বিদ্বৎসমাজে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ১৯২০ সালের ১৪ই জানুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।
সেবিকা মোহিনী দেবীর খ্যাতিসম্পন্না কন্যা
মোহিনী দেবীর কন্যা ডাক্তার প্রভাবতী দাশগুপ্তা উত্তব-পূর্ব ভারতের প্রথম আমলের মহিলা গ্র্য়াজুয়েটদের অন্যতম। তিনি কলকাতা ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাস করেন। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ডক্টরেট ডিগ্রী পান। বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের তিনি একজন প্রতিষ্ঠাত্রী। মোহিনী দেবীর অন্যান্য সন্তানগণও কৃতী।
মোহিনী দেবীর সমাজকল্যাণমূলক কাজ
স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রী স্বাধীনতা ও বাল্যবিবাহে বাধাদান প্রভৃতি ব্যাপারে মোহিনী দেবী সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। নিজ অন্তরের প্রেরণায় তিনি একদিকে সমাজ কল্যাণমূলক কাজে এবং অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি নিজে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে কখনো দ্বিধা বোধ করতেন না।
অসহযোগ আন্দোলনে মোহিনী দেবীর যোগদান
১৯২১-২২ সালে তিনি গান্ধীজি-র অসহযোগ আন্দোলন-এর মধ্যে বিরাট এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেখতে পান। সেই সময়ে ঐ আন্দোলনে যোগদান করে তিনি গ্রেপ্তার হন।
মোহিনী দেবীর কারাদণ্ড
১৯৩০-৩১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি কলকাতার রাজপথে পিকেটিং, খদ্দর ফেরী প্রভৃতি সরকার-বিরোধী কাজে নেতৃত্ব দেন এবং তাঁর ছয়মাস কারাদণ্ড হয়। পরে আরো ছয়মাস তিনি স্বগৃহে অন্তরীণ থাকেন।
নিখিল ভারত মহিলা সম্মিলনীর সভানেত্রী মোহিনী দেবী
‘নিখিল ভারত মহিলা সম্মিলনী’র সভানেত্রী হিসাবে অগ্নিগর্ভ ভাষায় তিনি যে সুচিন্তিত অভিভাষণ পাঠ করেছিলেন সে যুগে সকলেই তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।
হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের বাণী প্রচারে মোহিনী দেবী
গান্ধীজীর আদর্শে তার অবিচলিত নিষ্ঠা ছিল। কলকাতায় ১৯৭৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি নিজের জীবন তুচ্ছ করেও দাঙ্গা অধ্যুষিত মুসলমান প্রধান অঞ্চল এটনিবাগানে তার নিজের বাড়ীতে অবস্থান করে হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের বাণী প্রচার করতেন। সেই সময় তাঁব বন্ধুবান্ধব সকলেই তাকে ঐ স্থান পরিত্যাগ করতে অনুবোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের সংকল্পে দৃঢ় থাকেন।
মোহিনী দেবীর অসাধারণ মানসিক শক্তি
তার মধ্যে কোনো দলীয় সংকীর্ণতা ছিল না। সেজন্য দলমত নির্বিশেষে সকলেরই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা তিনি আহরণ করেছিলেন। তার ছিল অসাধারণ মানসিক শক্তি ও গভীর আত্মবিশ্বাস।
নারী সংগ্রামী মোহিনী দেবীর মৃত্যু
১৯৫৫ সালের ২৫শে মার্চ এই বরেণ্য নেত্রীর দেহাবসান হয়।
উপসংহার :- মোহিনী দেবী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর এক সাহসী ও মানবিক চিন্তাধারার নারী, যিনি বাংলার নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোয় এনে দেওয়ার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। নারী শিক্ষা, বিধবার অধিকার ও সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। তাঁর কাজ শুধু তৎকালীন সমাজেই নয়, আজকের নারীবাদের ভিত গঠনের পথেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সমাজের প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি যে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। মোহিনী দেবীর জীবন আমাদের দেখিয়ে দেয়—একজন নারী, যদি সমাজ পরিবর্তনের সংকল্পে অটল থাকেন, তবে তিনি যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতেও সক্ষম হন।
(FAQ) মোহিনী দেবী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
মোহিনী দেবী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট সমাজসেবিকা এবং নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃত, যিনি ব্রাহ্ম সমাজের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি নারী শিক্ষা, বিধবা নারীদের পুনর্বাসন এবং কুসংস্কার বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত।
তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সেই সংগঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন।
নারীদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, বিধবাদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা, এবং সমাজে নারীর অবস্থান উন্নীত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।
১৯৫৫ সালের ২৫শে মার্চ এই বরেণ্য নেত্রীর দেহাবসান হয়।
নারীর অধিকার, শিক্ষা ও সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে মোহিনী দেবীর আদর্শ ও অবদান আজও প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রেরণাদায়ী।