মহীয়সী বিমলপ্রতিভা দেবী কেবল এক রাজনীতিবিদ বা বিপ্লবী নন, তিনি ছিলেন নারী নেতৃত্বের এক কিংবদন্তি, যিনি সমাজের শোষিত শিখরধারীদের নিয়ে চিন্তা করেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছাড়িয়ে সরাসরি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে শ্রমজীবীদের অধিকার আদায় ও জীবনমান উন্নয়নে উৎসর্গ করেছেন। তার জীবন আজও আমাদের নারী-শক্তি, সংগ্রাম ও ন্যায়পরায়ণতার জীবন্ত আলোকচিত্র।
নারী সংগ্রামী বিমলপ্রতিভা দেবী
ঐতিহাসিক চরিত্র | বিমলপ্রতিভা দেবী |
জন্ম | ডিসেম্বর ১৯০১, কটক, ওড়িশা |
পিতা | সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জী |
মাতা | ইন্দুমতী দেবী |
পরিচিতি | স্বাধীনতা সংগ্রামী, শ্রমিক নেতা, লেখিকা |
রাজনৈতিক সংগঠন | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, পরবর্তীতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি |
উল্লেখযোগ্য আন্দোলন | অসহযোগ আন্দোলন (১৯২১), লবণ আইন অমান্য (১৯৩০), শ্রমিক আন্দোলন |
গ্রেফতার ও কারাবাস | ১৯৩০ সালে (৬ মাস), ১৯৪১ সালে (প্রায় ৪ বছর) |
নারী সংগঠনের ভূমিকা | ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র যুগ্ম-সম্পাদক |
সাহিত্যে অবদান | উপন্যাস “নতুন দিনের আলো” (১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ও বাজেয়াপ্ত) |
বিশেষ উপাধি | “হান্টারওয়ালি” — ঘোড়ায় চড়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে |
সমাজসেবা | শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চিকিৎসায় সহযোগিতা |
স্মৃতি ও সম্মান | আসানসোল-এ নামাঙ্কিত রাস্তা ও স্মৃতিসৌধ (বর্তমানে অপ্রতিষ্ঠ বা অবহেলিত) |
মৃত্যু | আগস্ট ১৯৭৮ |
বিমলপ্রতিভা দেবী
ভূমিকা :- বিমলপ্রতিভা দেবী ছিলেন ব্রিটিশ ভারত-এর এক নির্ভীক স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং নারী নেতৃত্ব, সাহিত্যচর্চা ও শ্রমিক অধিকারের আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিমলপ্রতিভা দেবী শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামী ছিলেন না — তিনি ছিলেন শ্রমিকের অধিকার রক্ষার এক দৃঢ় কণ্ঠস্বর। আসানসোল, রাণীগঞ্জ, বার্ণপুর প্রভৃতি অঞ্চলে কয়লাখনি শ্রমিকদের জীবনের উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল অসামান্য। ঘোড়ায় চড়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি স্থানীয়দের কাছে ‘হান্টারওয়ালি’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তার জীবন ছিল সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিমলপ্রতিভা দেবীর জন্ম
১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে কটকে বিমলপ্রতিভা দেবী জন্মগ্রহণ করেন।
নারী সংগ্রামী বিমলপ্রতিভা দেবীর পিতামাতা
পৈতৃক দেশ তাঁদের নদীয়া জেলার কাঁচড়াপাড়া গ্রামে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জী, মাতা ইন্দুমতী দেবী।
স্বদেশী কাজে অনুপ্রাণিত বিমলপ্রতিভা দেবী
বিমলপ্রতিভা দেবী ধনী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যা ও বধূ। পিতা প্রবর্তক সংঘের কর্মী ছিলেন। তাঁব প্রভাবে তিনি শৈশবেই স্বদেশী কাজে অনুপ্রাণিত হন।
বিমলপ্রতিভা দেবীর বিবাহ
তাঁর বিবাহ হয়েছিল বিখ্যাত ধনী পরিবার জে. সি. ব্যানার্জীদের বাড়ীর ডাক্তার চারুচন্দ্র ব্যানার্জীর সঙ্গে। এই গোঁড়া পরিবারকে চারদিক থেকে জড়িয়ে রেখেছিল সংস্কারের কঠিন শৃঙ্খল।
নারী বিপ্লবী বিমলপ্রতিভা দেবী
পিতার স্নেহভাজন একজন বিপ্লবী কর্মীর প্রভাবে ১৯১৮ সাল থেকে বিমলপ্রতিভা দেবী ক্রমেই বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হবার প্রেরণা লাভ করেন।
নারী কর্মমন্দিরে বিমলপ্রতিভা দেবী
১৯২১ সালে উমিলা দেবীর ‘নারী কর্মমন্দির’-এ যোগদান করে তিনি বাড়ীর অজ্ঞাতসারে অসহযোগ আন্দোলনের কাজ করতে থাকেন। বাড়ীর প্রচণ্ড বাধা তাঁকে রুদ্ধ ঘরে বন্ধ করে রাখতে পারে নি।
প্রেসিডেন্ট বিমলপ্রতিভা দেবী
১৯২৭ সালে তিনি ‘ভারত নওজোয়ান সভা’-র বাংলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ‘নওজোয়ান সভা’-র নিখিল ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভগৎ সিং। এই সূত্রে বাংলার বাইরের বিপ্লবীদের সঙ্গে বিমলপ্রতিভা দেবীর যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল।
কংগ্রেসে বিমলপ্রতিভা দেবীর যোগদান
১৯২৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি যা কিছু কাজ করেছেন সবই গোপনে। কিন্তু ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসের সময় তিনি খোলাখুলিভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে কাজ করতে থাকেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে বিমলপ্রতিভা দেবী
১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি, শান্তি দাস (কবীর) প্রভৃতি কংগ্রেস নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ সংগঠন করেন এবং আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। বিমলপ্রতিভা দেবী ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র যুগ্ম সম্পাদিকা।
বিমলপ্রতিভা দেবীর কারাদণ্ড
১৯৩০ সালের ২১শে জুন দেশবন্ধুর বার্ষিক শ্রাদ্ধতিথি দিবস পালন উপলক্ষ্যে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন কলেজ স্ট্রীট থেকে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত। বিমলপ্রতিভা দেবী এই বে-আইনী শোভাযাত্রা ও সভায় অংশগ্রহণ করাতে তাঁর ছয়মাস কারাদণ্ড হয় ২৬শে জুন।
সশস্ত্র বিপ্লবী দলে বিমলপ্রতিভা দেবী
এই সময় তিনি বিপ্লবী দলেও কাজ করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার বন্দীদের মামলা পরিচালনার জন্য তিনি জালালাবাদ খণ্ডযুদ্ধে নিহত বিপ্লবীদের ছবি বিক্রীর ব্যবস্থা করে বহু অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেই অর্থ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার ব্যযনির্বাহের জন্য দিয়েছিলেন।
বিনাবিচারে বন্দী বিমলপ্রতিভা দেবী
১৯৩১ সালের ২রা অক্টোবর তিনি মাণিকতলার ডাকাতি সম্পর্কে গ্রেপ্তার হন। এ সম্পর্কে আরো গ্রেপ্তার হন ধীরেন চৌধুরী, কালিপদ রায়, নরহরি সেন প্রমুখ। বিমলপ্রতিভা দেবী পরে মামলা থেকে মুক্তি পান এবং সেদিনই তাঁকে ডেটিনিউ অর্থাৎ বিনাবিচারে বন্দী করে আটক রাখে। সিউডি, হিজলী ও প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন তিনি প্রায় ছয়বছর। ১৯৩৮ সালে তিনি মুক্তি পান।
বিমলপ্রতিভা দেবীর কংগ্রেস ত্যাগ
১৯৩৮ সালে তিনি কংগ্রেসের ‘নিখিল ভারত বন্দীমুক্তি আন্দোলন কমিটি’-র সম্পাদিকা নিযুক্ত হন। ১৯৪০ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসে তিনি কংগ্রেস ছাড়বার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঐ বছরের এ আই সি.সি মিটিং-এর পর তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
নিরাপত্তা বন্দীরূপে আটক বিমলপ্রতিভা দেবী
১৯৪১ সালের ২৭শে জানুয়ারি রাজদ্রোহমূলক ইস্তাহার রাখার অভিযোগে তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং দুইবছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। কারাদণ্ড ভোগ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে নিরাপত্তা বন্দীরূপে আটক রাখা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে।
শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিমলপ্রতিভা দেবী
১৯৪৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। এরপর তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
বিমলপ্রতিভা দেবীর মৃত্যু
তিনি আগস্ট ১৯৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার :- বিমলপ্রতিভা দেবীর জীবন ও কর্মকাণ্ড ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অনন্য অধ্যায়। তিনি ছিলেন সেই বিরল নারীদের একজন, যিনি রাজনৈতিক সংগ্রাম, সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চাকে একত্রে ধারণ করেছিলেন। কংগ্রেসের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে শুরু করে বিপ্লবী কার্যকলাপ, নারী সংগঠনের নেতৃত্ব, শ্রমিক অধিকার রক্ষা — সবক্ষেত্রেই তার সাহসিকতা, নেতৃত্বগুণ ও মানবিকতা অসাধারণভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। আজ যখন স্বাধীনতার ইতিহাসের মূল্যায়ন হয়, তখন বিমলপ্রতিভা দেবীর মতো সংগ্রামী নারীদের স্মরণ করা ও তাঁদের অবদানকে সম্মান জানানো আমাদের দায়িত্ব। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, সাহস, সংগ্রাম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে একটি মানুষ কিভাবে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে।
(FAQ) বিমলপ্রতিভা দেবী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
বিমলপ্রতিভা দেবী ছিলেন এক বিশিষ্ট ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, নারী সংগঠক, সাহিত্যিক ও শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী। তিনি কংগ্রেস ও পরবর্তীতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর জন্ম হয় ডিসেম্বর ১৯০১ সালে, ওড়িশার কটকে।
তিনি অসহযোগ আন্দোলন (১৯২১), লবণ আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০), এবং পরবর্তীকালে শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি অন্তত দুইবার গ্রেফতার হন — প্রথমবার ১৯৩০ সালে (৬ মাসের জন্য), এবং দ্বিতীয়বার ১৯৪১ সালে (প্রায় ৪ বছর কারাবাস)।
শ্রমিক আন্দোলনে ঘোড়ায় চড়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে স্থানীয় মানুষ তাকে “হান্টারওয়ালি” নামে ডাকত, যা তার সাহসিকতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, তার লেখা উপন্যাস “নতুন দিনের আলো” ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এটি মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে বাজেয়াপ্ত করে।
তিনি আগস্ট ১৯৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আসানসোলে তাঁর নামে একটি রাস্তা ও স্মৃতিসৌধ গড়া হয়েছিল, তবে বর্তমানে তা অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে।