অগ্নিকন্যা পারুল মুখার্জী ছিলেন এক সাহসী ও নির্ভীক বিপ্লবী নারী, যিনি নারীদের মধ্যে আত্মরক্ষা ও সংগঠনের দৃঢ় চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র অস্ত্রনির্ভর সংগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং প্রসারিত সামাজিক ও শিক্ষামূলক কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
বিপ্লবী পারুল মুখার্জী
ঐতিহাসিক চরিত্র | পারুল মুখার্জী |
পুরো নাম | পারুলবালা মুখোপাধ্যায় |
জন্ম | ১৯১৫, কলকাতা |
পিতামাতা | গুরুপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, মনোরমা দেবী |
পরিবার | বড় ভাই: অমূল্য মুখার্জী; বোন: ঊষা মুখার্জী |
সংগঠন | অনুশীলন সমিতি–র সক্রিয় সদস্য; নারীদের স্বচেষ্ট বাহিনী গঠন ও আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ দান |
বিরোধী কর্মসূচি | গোপন অস্ত্র ও বোমা তৈরির ঘাঁটিতে সক্রিয়; টিটাগড় ষড়যন্ত্র (১৯৩৫)–এ গ্রেপ্তার |
গ্রেপ্তার ও সাজা | ২০ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে বন্দি; চার বছরের সাজা (১ বছর অস্ত্র আইন + ৩ বছর ষড়যন্ত্র) |
বিশেষ নাম | পারুল পিসি |
মৃত্যু | ২০ এপ্রিল ১৯৯০ খ্রি |
পারুল মুখার্জী
ভূমিকা :- ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক অজানা, অবহেলিত কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ নাম রয়েছে—তাঁদের একজন হলেন পারুল মুখার্জী। সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মত্যাগে ভরপুর এই বিপ্লবী নারী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দৃপ্ত কণ্ঠে লড়াই করেছিলেন। পারুল মুখার্জীর জীবন কেবল একটি বিপ্লবীর বর্ণনা নয়, এটি একটি যুগান্তকারী নারীর আত্মত্যাগ, সাহস এবং দায়িত্ববোধের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কর্মকাণ্ড আজও অনুপ্রেরণা দেয় আত্মনির্ভর ও সংগ্রামী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষকে।
পারুল মুখার্জীর জন্ম
মহান বিপ্লবী পারুল মুখার্জী জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায় ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে। পিতৃভূমি তাঁর ঢাকা বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে। কিন্তু মানুষ হন কুমিল্লায়।
বিপ্লবী পারুল মুখার্জীর পিতৃপরিচয়
তাঁর পিতা গুরুপ্রসন্ন মুখার্জী, মাতা মনোরমা দেবী। অনুশীলন দলের বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা অমূল্য মুখার্জী ছিলেন বড় ভাই এবং ঊষা মুখার্জী ছোট বোন।
দাদার অনুগামী পারুল মুখার্জী
তার দাদা অমূল্য মুখার্জীর গভীর প্রভাব ছিল এই পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের উপর। দুই ভগ্নী পারুল ও ঊষা ছোটবেলা থেকে দেখেছেন বাড়ীতে দাদার জন্য পুলিসের অত্যাচার ও হামলা এবং বিপ্লবী ভাইয়ের অনমনীয় দৃঢ় মনোভাব। এই পারিপার্শ্বিকে মানুষ হবার ফলে একটু বড় হয়েই তিনি দাদার অনুগামী হন।
পারুল মুখার্জী কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠন
১৯২৯ সালে কুমিল্লায় একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পারুল ১৪ বছর বয়সে এই সম্মেলনে মেয়েদের নিয়ে কলকাতা কংগ্রেসের অনুকরণে একটি স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠন করেন। ঊষা ছিলেন এই বাহিনীর একটি উৎসাহী কর্মী।
অনুশীলন সমিতিতে পারুল মুখার্জী
এরপর পারুল ও ঊষা দুই ভগ্নীই ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগদান করেন।
পারুল মুখার্জীর নামে ওয়ারেন্ট
সংগ্রামী পারুল মুখার্জী ১৯৩২ সালে কুমিল্লায় স্বগৃহে অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৩৩ সালে আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে পুলিস তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বার করে খোঁজ করতে থাকে। সেই সময়ে তিনি পলাতক হন।
অনুশীলন দলের সংগঠনে পারুল মুখার্জী
তিনি রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি স্থানে অনুশীলন দলের সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করছিলেন।।
টিটাগড়ের বাসায় পারুল মুখার্জী
ঠিক এই সময়ে টিটাগড়ের একটি পল্লীর মধ্যে বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক কাজের এক বিরাট আয়োজন চলছিল। তাঁদের এখানকার বাসাটিকে সন্দেহমুক্ত রাখবার জন্য পলাতক পারুল মুখার্জীকে খুলনা থেকে টিটাগড়ের বাসায় নিয়ে আসা হয়। তার উপস্থিতিতে বাসাটি সাধারণ গৃহস্থের বাসার রূপ ধারণ করে। সেখানে থেকে অনুশীলন দলের বিপ্লবীরা বোমা বারুদ প্রভৃতি তৈরীর ব্যবস্থা করছিলেন। ডিনামাইট এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থাও চলেছিল।
টিটাগড়ের বাসায় পুলিস
১৯৩৫ সালের ২০শে জানুয়ারি ভোর চারটায় অসংখ্য পুলিস টিটাগড়ের বাসাটা ঘিরে ফেলে। টের পেয়েই বিপ্লবী পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত ও শ্যামবিনোদ পাল ভোরের আবছা অন্ধকারের মধ্যে একতলার ছাদ থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়লেন। লাফিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
গ্রেপ্তার পারুল মুখার্জী
বিপ্লবী পারুল মুখার্জীও তাঁদের সঙ্গে ছাদে উঠেছিলেন। কিন্তু কি যেন মনে করে তিনি উল্টোদিকে লাফ দিয়ে উঠোনে পড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পুলিস দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে এক অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পারুল মুখার্জী। তিনি কাগজপত্রগুলি নিশ্চিহ্ন করবার আশায় তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিস অর্ধদগ্ধ কাগজপত্রগুলি হস্তগত করে। সেই বাসাতে পুলিস পায় পিস্তল, বিস্ফোরক পদার্থ, বোমা তৈরীর ফরমুলা প্রভৃতি। পারুল মুখার্জী গ্রেপ্তার হলেন।
উৎপীড়নের স্বীকার পারুল মুখার্জী
পারুল মুখার্জীকে পুলিস হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে গিয়ে ইতর ভাষার গালাগালি করেও যখন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি তখন গোয়েন্দা অফিসার উৎপীড়নের জন্য় ক্ষিপ্ত হয়ে পারুল মুখার্জীর দিকে ছুটে যায়। পারুল চীৎকার করে জুতো ছুঁড়তে থাকেন, কিন্তু রুখতে পারছিলেন না। এমন সময় চীৎকারে আকৃষ্ট হয়ে আর একজন গোয়েন্দা অফিসার ছুটে এসে এই অফিসারকে ধমকাতে থাকেন, “আপনি আপনার পরিণাম বুঝতে পারছেন না -আপনার সর্বনাশ হযে যাবে।”-পশুটা নিরস্ত হল।
সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত পারুল মুখার্জী
রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধোদ্দমের প্রচেষ্টার মামলা আলিপুর কোর্টে একটি ট্রাইবুনালের অধীনে আরম্ভ হয়। এর নাম ছিল ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে এই মামলার রায় বেরোয়। মোট ১৭ জনের সাজা হয়। পূর্ণানন্দ দাশগুপ্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, প্রফুল্ল সেনের চৌদ্দ বৎসর, শ্যামবিনোদ পালের দশ বৎসর এবং অন্যান্য় অনেকেরই কঠিন শাস্তি হয়। পারুল মুখার্জীর তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
প্রেসিডেন্সি জেলের একটি ঘটনার বিবরক পারুল মুখার্জী
- (১) তাঁকে নানা জেলে স্থানান্তরিত করা হত। ১৯৩৬ সালে তিনি যখন প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। জেলের নিয়ম হল সন্ধ্যাবেলায় বন্দীদের ওয়ার্ডের ভিতরে তালাবন্ধ হতে হবে। একদিন তিনি বিকালবেলা প্রেসিডেন্সি জেলের ক্ষুদ্র ফিমেল ইয়ার্ডের চত্বরে পায়চারি করছিলেন। তখনো লক-আপ হবার প্রায় আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকী ছিল।
- (২) এমন সময় মেট্রন তার ডিউটি তাড়াতাড়ি সমাধা করতে গিয়ে পারুল মুখার্জীকে তখনই লক-আপ হতে বলে। পারুল মুখার্জী অসময়ে ওয়ার্ডে ঢুকতে অস্বীকার করাতে মেট্রন জোর করে তাঁকে ওয়ার্ডে ঢোকাতে চেষ্টা করে। তৎক্ষণাৎ পারুল মেট্রনকে করলেন এক চপোটাঘাত। মেট্রন মাটিতে পড়ে গেল।
- (৩) মেট্রনকে মারা? জেলের জমাদারনী ও লাল-কালো-বিল্লাধারী কয়েদীরা ছুটে এসে পারুল মুখার্জীকে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়ে মারতে উদ্যত হল। গোলমাল শুনে অন্যান্য রাজবন্দী মেয়েরা তখনি এসে পড়লেন। তাঁকে আর মারা হল না। মেট্রনের গায়ে আঘাত করার অপরাধে পারুল মুখার্জীর শাস্তি হল জেল-কোড অনুসারে। বেপরোয়া পারুল এসব শাস্তি হেসেই উড়িয়ে দিতেন।
গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় পারুল মুখার্জীর মুক্তি
১৯৩৯ সালে গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় পারুল মুখার্জী অন্যান্য মহিলা রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে মুক্তি পান।
পারুল মুখার্জীর মৃত্যু
২০ এপ্রিল ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে মহান বিপ্লবী পারুল মুখার্জী পরলোক গমন করেন।
উপসংহার :- পারুল মুখার্জী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসিনী, যিনি নিঃশব্দে কিন্তু গভীর ছাপ রেখে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অবিচল লড়াই, অনুশীলন সমিতির নারী সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ, এবং টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে তাঁর অংশগ্রহণ তাঁকে এক ব্যতিক্রমী সংগ্রামী নারীতে পরিণত করেছে। আজকের প্রজন্মের কাছে পারুল মুখার্জীর সংগ্রামী জীবন এক মহৎ অনুপ্রেরণা—যেখানে দেশপ্রেম, আদর্শ ও মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। এই নিঃশব্দ নায়িকার অবদান আমাদের জাতীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
(FAQ) পারুল মুখার্জীসম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
পারুল মুখার্জী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বাঙালি নারী বিপ্লবী। তিনি অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে অস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ এবং নারী সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
পারুল মুখার্জী ছিলেন অনুশীলন সমিতি-র সদস্য। এছাড়া তিনি কমিল্লায় নারী বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি সক্রিয় শাখা সংগঠন।
পারুল মুখার্জী ২০ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন এবং চার বছরের সাজা ভোগ করেন।
পারুল মুখার্জীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কঠোরভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনো তথ্য ফাঁস করেননি। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এবং বন্দিত্বের সময়েও তিনি অবিচল ছিলেন।
স্বাধীনতার পর পারুল মুখার্জী সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে কলকাতায় শরণার্থী শিবিরে সেবামূলক কাজ করেন। “পারুল পিসি” নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং স্থানীয়ভাবে শিক্ষাদান ও সমাজসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
পারুল মুখার্জীর জীবন থেকে সাহস, আত্মত্যাগ, নেতৃত্বগুণ ও নিঃস্বার্থ সমাজসেবার শিক্ষা পাওয়া যায়। তিনি নারী সমাজকে সংগ্রামের পথ দেখিয়ে গেছেন।