শতদল সরকার

মহিয়ষী শতদল সরকার ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী মহিলা বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিকা। তিনি ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে নারী সমাজে দেশপ্রেমের চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন এমন এক নারী যিনি সমাজে নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

বিপ্লবী শতদল সরকার

ঐতিহাসিক চরিত্রশতদল সরকার
জন্ম১৯০৬ সালের ১৬শে এপ্রিল
জন্মস্থানবাঁকুড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
পরিচিতিভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহসী মহিলা বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিকা
কার্যক্ষেত্রস্বাধীনতা আন্দোলন, নারী জাগরণ, সমাজসেবা
আদর্শস্বদেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, নারী স্বাধীনতা ও শিক্ষার প্রসার
গুরুত্বনারী স্বাধীনতার অগ্রদূত ও দেশপ্রেমিক চেতনার প্রতীক
উত্তরাধিকারতাঁর জীবন ও সংগ্রাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে

শতদল সরকার

ভূমিকা :- বিপ্লবী শতদল সরকার ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও অনন্য বিপ্লবী নারী, যিনি দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এমন এক সময়ে সক্রিয় হন, যখন সমাজে নারীর অবস্থান ছিল সীমাবদ্ধ, কিন্তু তাঁর দৃঢ় মনোবল ও দেশপ্রেম নারীদের মধ্যে নতুন চেতনার সঞ্চার ঘটায়। স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা ও সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি নারীদের আত্মনির্ভর ও সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেন। শতদল সরকারের জীবনকাহিনি শুধু একটি বিপ্লবীর ইতিহাস নয়, বরং নারী শক্তির উদ্ভব ও জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর কর্মজীবন ভারতবর্ষ-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

শতদল সরকারের জন্ম

১৯০৬ সালের ১৬ শে এপ্রিল বাঁকুড়া জেলার গুমুট নামক গ্রামে শতদল সরকার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কেদারনাথ বিশ্বাস ও মাতা যুগল কিশোরী দেবী।

বিপ্লবী শতদল সরকারের বিবাহ

তাঁর অল্পবয়সেই বিবাহ হয়। কিছুদিন পরেই স্বামীর মৃত্যু হয়। তারপর সাধারণ গৃহস্থ বাড়ীর মতো শুধুই শ্বশুরবাড়ী ও বাপের বাড়ীর টানা পোড়েনের মধ্যে একঘেয়ে দিনগুলি গড়িয়ে চললো।

আইন অমান্য় আন্দোলনে শতদল সরকার

নানা প্রশ্ন এসে মনকে তাঁর তোলপাড় করে তোলে নারীরূপে জন্ম হয়েছে বলে কিছুই কি পৃথিবীতে করবার নেই। অত্যাচার যখন চরম অবস্থায় আসে তখনই হয় বিদ্রোহ। একদিন বিদ্রোহী হয়ে সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে লুকিয়ে যোগ দিলেন তিনি ১৯৩০ সালের আইন অমান্য় আন্দোলনে।

গোপালনগর ক্যাম্পে শতদল সরকার

বিদ্রোহী শতদল দেবী প্রথমে সরসীবালা দেবীর সঙ্গে বাঁকুড়া জেলার জয়পুর থানার অধীন গোপালনগর ক্যাম্পে যান। সেখানে রণজিৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন। এখানকার আন্দোলনে শতদল সরকার এবং পরে তাঁর ছোটবোন নীরজা বিশ্বাস যোগদান করেন।

কলকাতায় শতদল সরকার

১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন অনেক মহিলা কর্মীকেই গ্রেপ্তার করে তখন শতদল সরকার ও নীরজা বিশ্বাস টানাদীঘিতে একটা বাড়ীতে আত্ম-গোপন করে থাকেন। সেখান থেকে তাঁরা দুই বোন এবং লোকপুরের বীণাপাণি দেবী কলকাতায় এসে আন্দোলনে যোগদান করেন।

গ্রেপ্তার শতদল সরকার

এরপর পুলিস তাঁদের গ্রেপ্তার করে এবং তাঁরা চারমাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। নীরজার বয়স কম ছিল বলে অকে তখন ছেড়ে দেয়, কিন্তু ১৯৩১ সালের ২৬শে জানুয়ারি পুনরায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

সেবায় নিযুক্ত শতদল সরকার

জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শতদল সরকার যখন বাড়ী যান তখন তাঁদের নেতা রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কারাগারে। জেল থেকে বের হলেন তিনি মারাত্মক রোগ নিয়ে; শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত শতদল তাঁর সেবায় নিযুক্ত থাকেন।

শতদল সরকারের পথপ্রদর্শক

তারপর তাঁর পথ প্রদর্শক হয়ে দেখা দিলেন কংগ্রেস নেতা সুশীলচন্দ্র পালিত। শতদল দেবী তাঁর সংস্পর্শে এসে বাঁকুড়া জেলার প্রায় অধিকাংশ থানাতেই কাজ করেন।

শতদল সরকারের উদ্যোগে সম্মেলন

ক্রমে পরিচয় হয় তাঁর লাবণ্যলতা চন্দর সঙ্গে। তাঁরই প্রেরণায় তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে কর্মে প্রবৃত্ত হন। শতদল দেবী আহ্বান করেন ‘বাঁকুড়া জেলা মহিলা সম্মেলন’ ১৯৩৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি। তিনি ছিলেন অভ্যর্থনা-সমিতির সম্পাদিকা। সম্মেলনের সভানেত্রী ছিলেন লাবণ্যলতা চন্দ।

বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শতদল দেবী

১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে লাবণ্যলতা চন্দের নির্দেশ মতো তিনি গুমুটে একটি অবৈতনিক প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় গঠন করেন; তিনিই তার প্রধান শিক্ষয়িত্রী।

শতদল সরকারের বাড়িতে গোপনে প্রচারের কাজ

১৯৪২ সালের আন্দোলনের সময় গোপনে প্রচারের কাজ চলতে থাকে। শতদল সরকারের ঘরের মধ্যে ভাগবত মিশ্র ঐ প্রচারপত্র ছাপার কাজ করতেন। পুলিস সন্দেহ করেছে কিন্তু বার বার হানা দিয়েও হদিস করতে পারেনি।

বিপ্লবী শতদল সরকারের জীবনের সার্থকতা

বালবিধবা শতদল দেবী তাঁর জীবনকে স্বাধীনতা-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সার্থক করে তোলেন।

অনুপ্রেরণার নাম শতদল সরকার

তাঁর জীবন ও সংগ্রাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে

উপসংহার :- শতদল দেবী ছিলেন সেই সব মহীয়সী নারীদের অন্যতম, যাঁরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিবেদিত হয়ে জাতির ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি শুধু একজন বিপ্লবী নন, ছিলেন এক সমাজজাগরণকারিণী, যিনি নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, স্বাধীনতার লড়াই কেবল অস্ত্রের নয়, আদর্শ, শিক্ষা ও চেতনারও। শতদল সরকারের সংগ্রামী জীবন নারীদের মুক্তি ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

(FAQ) শতদল সরকার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. শতদল সরকার কে ছিলেন ?

শতদল দেবী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী মহিলা বিপ্লবী, যিনি নারীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে সমাজে নতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিলেন।

২. তিনি কোন সময়ে সক্রিয় ছিলেন?

তিনি বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

৩. শতদল সরকারের প্রধান অবদান কী ছিল?

তিনি নারী সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেন, গোপন বিপ্লবী কার্যক্রমে সহযোগিতা করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচার চালান।

৪. তাঁর আদর্শ কী ছিল?

স্বদেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার চেতনা ছিল তাঁর জীবনের মূল আদর্শ।

৫. শতদল সরকারের গুরুত্ব কীভাবে বিবেচিত হয়?

তিনি নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত এবং দেশপ্রেমিক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, যাঁর জীবন পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।

৬. তাঁর জীবন থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই?

শতদল সরকারের জীবন আমাদের শেখায় যে জাতির মুক্তি ও অগ্রগতির জন্য সাহস, আত্মত্যাগ ও শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

Leave a Comment