মহিয়ষী সুচেতা কৃপলানী (1908–1974) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নেত্রী, সমাজকর্মী এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। তিনি মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুচেতা কৃপলানী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে 1963 থেকে 1967 পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন, যা ছিল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলফলক।
বিপ্লবী সুচেতা কৃপলানী
| ঐতিহাসিক চরিত্র | সুচেতা কৃপলানী |
| জন্ম | ২৫ জুন, ১৯০৮ খ্রি |
| জন্মস্থান | আম্বালা, পাঞ্জাব (বর্তমান হরিয়ানা), ভারত |
| পেশা | স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিক, সমাজকর্মী |
| রাজনৈতিক দল | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
| গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা | ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এ অংশগ্রহণ, সংবিধান সভার সদস্য, স্বাধীন ভারতের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী (উত্তর প্রদেশ, ১৯৬৩–১৯৬৭) |
| উল্লেখযোগ্য অবদান | নারী অধিকার ও শিক্ষা উন্নয়ন, প্রশাসনিক সংস্কার, সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি |
| পুরস্কার ও সম্মাননা | সমাজসেবায় অবদানের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্মান |
| ঐতিহাসিক গুরুত্ব | ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও নারী নেতৃত্বের ইতিহাসে পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব |
| মৃত্যু | ১ ডিসেম্বর, ১৯৭৪ |
সুচেতা কৃপলানী
ভূমিকা :- বিপ্লবী সুচেতা কৃপলানী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম এবং নারী নেতৃত্বের প্রতীক। তিনি শুধু একজন সাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামীই নন, বরং স্বাধীন ভারতের প্রশাসনিক পরিসরে নারীর অগ্রযাত্রার পথিকৃৎও ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
সুচেতা কৃপলানীর জন্ম
১৯০৮ সালের ২৬শে জুন সুচেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রবাসী বাঙালী ডাক্তার সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার।
বিপ্লব সুচেতা কৃপলানীর শিক্ষা
তাঁরা ছিলেন পাঞ্জাবের স্থায়ী বাসিন্দা। সুচেতা দেবী লাহোরে লেখাপড়া শেখেন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. পাস করেন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। তারপর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনার কাজ গ্রহণ করেন।
রিলিফের কাজে সুচেতা কৃপলানী
১৯৩৪ সালে বিহারের ভূমিকম্পের সময় তিনি বিহারের গ্রামে মাসের পর মাস রিলিফের কাজ করেছেন।
সুচেতা কৃপলানীর বিবাহ
১৯৩৬ সালে আচার্য জে. বি. কৃপলানীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। আচার্য কৃপলানী সেই সময় নিখিল ভারত কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন এবং পরে ১৯৪৬-৪৭ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কংগ্রেসের সম্পাদিকা সুচেতা কৃপলানী
১৯৩৯ সালে সুচেতা কৃপলানী নিখিল ভারত কংগ্রেসের মহিলা সাব-কমিটির সম্পাদিকা নিযুক্ত হন। প্রায় বছর দেড়েক তিনি কংগ্রেসের বৈদেশিক বিভাগেরও সম্পাদিকার কাজ করেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সুচেতা কৃপলানী
১৯৪০ সালে গান্ধীজী পরিচালিত ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগদান করে তিনি কারাবরণ করেন। সেখান থেকে মুক্তি পাবার কিছুদিন পরই ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন আরম্ভ হয়। যদিও প্রায় সমস্ত নেতাদের তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় কিন্তু সুচেতা কৃপলানী প্রায় দুই বছর যাবৎ পুলিসের হাত এড়িয়ে পলাতক অবস্থায় থেকে অন্য়ান্য কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলন পরিচালনা করে যান। অবশেষে তিনিও গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৫ সালে তিনি মুক্তি পান।
সমাজসেবার কাজে সুচেতা কৃপলানী
বেরিয়ে এসে তিনি সমাজসেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কস্তুরবা গান্ধী মেমোরিয়াল ফান্ড-এর তিনি অর্গানাইজিং সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।
নোয়াখালিতে সুচেতা কৃপলানী
১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে দাঙ্গা হয়ে যায় একতরফা। সেখানকার সংখ্যালঘুদের অধিকাংশের বাড়ীঘর পেট্রলের আগুনে জ্বলিয়ে দেওয়া হয়, তাঁদের লাঞ্ছিত ও ধর্মান্তরিত করা হয়, হতাহতের সংখ্যাও হয় আতঙ্কজনক। দাঙ্গার পর সুচেতা দেবী ছুটে যান নোয়াখালিতে দাঙ্গাপীড়িত শিশু ও নারীকে উদ্ধার করতে ও অভয়দান করতে।
সুচেতা কৃপলানীর পিছনে অসৎ লোকের ভিড়
কতবার কত জায়গায় এমন হয়েছে-অসৎ প্রকৃতির বহু লোকের দল তাঁর পিছনে পিছনে চলেছে, তাঁকে ঘিরে ফেলবার উপক্রম করেছে, হাসি বিদ্রূপ করেছে-তিনি ফিরে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়েছেন, ভয়ে লোকগুলি সরে গেছে।
দুঃস্থা নারীদের উদ্ধারে সুচেতা কৃপলানী
যখনই খবর পেয়েছেন, কোনো বাড়ীতে অপহৃতা নারী লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তিনি সামান্য দু’একজন জনসেবক কর্মী সঙ্গে নিয়ে, বহু লোকের বাধা সত্ত্বেও বাড়ীতে ঢুকে পড়েছেন, দুঃস্থা নারীর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছেন। তাঁর অসীম সাহসিকতার কাজ নোয়াখালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। কখনো কোমর অবধি জল ভেঙে, কখনো-বা একাই চলে গেছেন তিনি অজানা গ্রামের অভ্যন্তরে অসহায় নারী ও শিশুদের উদ্ধারের প্রেরণায়।
সুচেতা কৃপলানীর হৃদয় নিঙড়ানো সেবা ও দান
নোয়াখালির দাঙ্গাপীড়িত, ভীত, আর্ত নারী বিনাবাক্যে নিঃশব্দে শুধু দূর থেকে তাঁকে দেখেই তাঁর পশ্চাতে পশ্চাতে চলে এসেছিল দলে দলে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের আশায়। বিভিন্ন ক্যাম্পে এনে তিনি তাদের আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছেন হাজারে হাজারো অবিভক্ত ভারতের সেই সংকটতম সন্ধিক্ষণে নির্ভীক নারী সুচেতা কৃপলানীর এই হৃদয় নিঙড়ানো সেবা ও দান কি ভুলবার?
পুনর্বাসনের কাজে সুচেতা কৃপলানী
তারপরেই মহাত্মা গান্ধী যখন নোয়াখালিতে প্রেম ও শান্তির বাণী প্রচার করতে চলে গেলেন, সুচেতা কৃপলানীও তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন শান্তি স্থাপন ও পুনর্বাসনের কাজে।
অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন সুচেতা কৃপলানী
বাংলা কংগ্রেসের এবং বাইরেরও অনেক মহিলা ও পুরুষ কর্মী নিয়ে সুচেতা দেবী নোয়াখালির বহু গ্রামে শিবির স্থাপন করেছিলেন গ্রামের লোকেদের মনে সাহস ও শান্তি ফিরিয়ে আনবার জন্য। কর্মীবৃন্দের সাহায্যে তিনি নোয়াখালির গ্রামগুলিতে একদিকে রিলিফের কাজ, অন্যদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা ও পুনর্বাসনের কাজ করে চলেছিলেন অক্লান্তভাবে দীর্ঘদিন।
গান্ধীজীর একনিষ্ঠ কর্মী সুচেতা কৃপলানী
সেদিন নোয়াখালিতে মহামানব গান্ধীজী চলেছেন খালি পায়ে গ্রামের পর গ্রাম পরিক্রমা করে, অহিংসা ও প্রেমের বাণী ছড়িয়ে। সেই মহাবাণী কেউ শুনেছে, কেউ শোনে নি। গান্ধীজীর আকাঙ্ক্ষিত প্রেম ও অহিংসাপূত বৃহত্তর সভ্যতা আনবার তিল তিল সাধনা একদিন সত্যই সফল হবে, এই বিশ্বাসই সেদিন জেগে উঠেছিল নোয়াখালির মাটিতে গান্ধীজীর কর্মীদের অন্তরে। সুচেতা দেবী সেই কর্মীদেরই একজন। তাঁর কর্মের প্রতিটি পদক্ষেপে এই সুরই বেজে উঠেছিল।
আর্তের সেবায় সুচেতা কৃপলানী
১৯৪৭ সালের প্রথম ভাগে যখন পাঞ্জাবে দাঙ্গা হয়, সুচেতা দেবী সেখানেও ছুটে যান আর্তের সেবা করতে। ভারত বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শরণার্থীগণ যখন দিল্লী, পূর্ব-পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানে কাতারে কাতারে চলে আসেন তখন সুচেতা দেবী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাঁদের সেবায় নিজেকে ডুবিয়ে দেন।
দরদী এবং কর্মদক্ষ সুচেতা কৃপলানী
যেখানেই আর্তের আর্তনাদ ও হাহাকার সেখানেই সুচেতা দেবী ত্রস্তপদে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধুভাবে। দরদী এবং কর্মদক্ষ সুচেতা দেবীর এই পরিচয় ভারতবাসী বার বার পেয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রীরূপে সুচেতা কৃপলানী
তিনি উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রীরূপেও তাঁর যোগ্যতার পরিচয় আমরা পাই। তিনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
সংবিধান সভায় সুচেতা কৃপলানীর ভূমিকা
তিনি ভারতের সংবিধান সভার সদস্য ছিলেন এবং সংবিধান প্রণয়নের কাজে অংশগ্রহণ করেন। সংবিধানে নারী অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতার বিষয়গুলোর গুরুত্ব তুলে ধরতে তিনি অবদান রাখেন।
নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে সুচেতা কৃপলানীর অবদান
তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী অধিকার রক্ষায় কাজ করেন। নারী নেতৃত্বের গুরুত্ব ও সামাজিক জীবনে নারীর অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তিনি সর্বদা জোর দিয়ে প্রচার করেন।
আদর্শ ও নৈতিকতার প্রতীক সুচেতা কৃপলানী
সুচেতা দেবী ছিলেন এক আদর্শবাদী নেতা, যিনি রাজনীতিতে সততা, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ দেশপ্রেম, মানবতা ও সমাজসেবার মিশেলে পরিপূর্ণ ছিল।
সুচেতা কৃপলানীর মৃত্যু
তিনি ১ ডিসেম্বর, ১৯৭৪ সালে পরলোকগমন করেন।
উপসংহার :- সুচেতা কৃপলানীর জীবন ছিল দেশপ্রেম, সাহস এবং নেতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যে দৃঢ়তা ও ত্যাগ প্রদর্শন করেছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছিল। ভারতের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে নারী নেতৃত্বও সমান দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে পারে। তিনি শুধু একজন রাজনীতিক নন—তিনি ছিলেন এক আদর্শ দেশপ্রেমিকা, যিনি ভারতের স্বাধীনতা ও উন্নয়নের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
(FAQ) সুচেতা কৃপলানী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
সুচেতা দেবী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজকর্মী এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। তিনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর জন্ম ২৫ জুন, ১৯০৮ সালে আম্বালা (বর্তমান হরিয়ানা রাজ্যে) হয়েছিল।
তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছিলেন।
তাঁর স্বামী ছিলেন আচার্য জে. বি. কৃপলানী, যিনি নিজেও একজন প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন।
তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন।
তিনি ১৯৬৩ সালে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ১৯৬৭ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন।
তিনি ১ ডিসেম্বর, ১৯৭৪ সালে পরলোকগমন করেন।
তিনি ভারতের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নারী নেতৃত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাষ্ট্রনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।