স্বাধীনতা সংগ্রামী বেলা মিত্র ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সাহসী নারী স্বাধীনতা সেনানি। বেলা মিত্রকে ভারতের নারী বিপ্লবীদের অগ্রগণ্য এক প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয় — যিনি দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সাহসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বেলা মিত্র শুধুমাত্র একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন—তিনি ভারতের ইতিহাসে এক অমর প্রেরণার উৎস, যিনি নারীশক্তি ও দেশভক্তির এক অবিচল প্রতীক হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সংগ্রামী বেলা মিত্র
| ঐতিহাসিক চরিত্র | বেলা মিত্র |
| জন্ম | নভেম্বর ১৯২০ খ্রি |
| পরিচিতি | নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য |
| সংগঠন | আজাদ হিন্দ ফৌজ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে |
| গুরুত্বপূর্ণ অবদান | আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয় ও অর্থ সহায়তা প্রদান |
| স্বাধীনতার পর কর্মক্ষেত্র | সমাজসেবা, নারীশিক্ষা ও সামাজিক পুনর্গঠন |
| স্মরণীয় অবদান | ভারতের নারী বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম সাহসিনী যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন |
| মৃত্যু | ৩১ জুলাই ১৯৫২ খ্রি |
বেলা মিত্র
ভূমিকা :- স্বাধীনতা সংগ্রামী বেলা মিত্র ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী ও ত্যাগী নারী বিপ্লবী, যিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের (Indian National Army) সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন। দেশপ্রেম তাঁর পরিবারে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া, এবং সেই দেশপ্রেম তাঁকে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোদ্ধায় পরিণত করেছিল। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সাহস একত্রে থাকলে সমাজ ও জাতি উভয়েরই উন্নতি সম্ভব।
বেলা মিত্রর জন্ম
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্রী বেলা বসু জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে।
সংগ্রামী বেলা মিত্রর পরিবার
পৈতৃক দেশ তাঁর ২৪ পরগনা জেলার কোদালিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেশচন্দ্র বসু।
বেলা মিত্রর উপর পরিবারের প্রভাব
তাঁর পিতার বাড়ীর আবহাওয়া, এবং বিশেষ করে নেতাজীর প্রভাব গড়ে তুলেছিল তাঁর চরিত্রকে। দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীরে।
সংগ্রামী বেলা মিত্রর বিবাহ
যশোহরের হরিদাস মিত্রের সঙ্গে ১৯৩৬ সালে তাঁর বিবাহ হয়। শ্বশুরালয় যশোহরে তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি মহিলা-সমিতি ১৯৩৮ সালে।
নারী বাহিনীর কমান্ডার বেলা মিত্র
১৯৪০ সালে রামগড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কংগ্রেস অধিবেশন। নেতাজী তখন মূল কংগ্রেস পরিত্যাগ করেছিলেন। রামগড়ে ঐ কংগ্রেস অধিবেশনের পাশাপাশি নেতাজী আহ্বান করেন এক আপোষ-বিরোধী সম্মেলন। সেই সম্মেলনে নারীবাহিনীর কমাণ্ডার নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯ বছরের মেয়ে বেলা মিত্র।
সংবাদ আদানপ্রদানে বেলা মিত্রর অবদান
- (১) ১৯৪১ সালের ১৫ই জানুয়ারি রাত্রি ১২টার পর নেতাজী স্বগৃহে অন্তরীণ থাকাকালে বাড়ি থেকে অন্তর্ধান করেন। নেতাজী যখন পূর্ব-এশিয়ায় তখন তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর কয়েকটি দলকে বিভিন্ন পথে ভাবতবর্ষে প্রেরণ করেন। তারই একটি দল সাবমেরিনে এসে উডিষ্যার উপকূলে কোনারক মন্দিরের কাছে নিরাপদে নামেন।
- (২) এই দলের লোকেরা পূর্ব নির্দেশমতো বেলার স্বামী হরিদাস মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। হরিদাস মিত্র যখন আপন কর্তব্য সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত এবং চিন্তায় নিমগ্ন তখন নির্ভীক বেলা তাঁর সকল সংশয় ঝড়ের বেগে মুহূর্তে উড়িয়ে দিলেন। হরিদাস মিত্র কর্তব্য স্থির করে নিলেন।
- (৩) বেলা মিত্রের তত্ত্বাবধানে তাঁদের (হরিদাস মিত্রের) কলকাতার বাসভবন থেকে হরিদাস মিত্র ও গুপ্ত-বিভাগের লোকেরা সিঙ্গাপুরে নেতাজীর কাছে ভারতবর্ষ থেকে সর্বপ্রথম ট্রান্সমিটার যোগে সংবাদ আদান প্রদানের ব্যবস্থা করেন ১৯৪৪ সালের ৭ই জানুয়ারি। তাঁদের সংবাদ আদানপ্রদান চলে সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুনের সঙ্গে।
রেডিও-স্টেশনের কাজে বেলা মিত্র
এরপর বেহালার জঙ্গলের মধ্যে একটি বাড়ী ভাড়া নিয়ে এই রেডিও-স্টেশনের কাজ চালিয়ে যাওয়া হয় ১৯৪৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত, যতক্ষণ না তাঁরা সেখান থেকে গ্রেপ্তার হন। হরিদাস মিত্র প্রমুখ আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্ত-বিভাগের লোকেরা এই স্থানেই বাস করতেন।
অলঙ্কার বিক্রি করে দেশের কাজে সহায়তায় বেলা মিত্র
- (১) ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে হরিদাস মিত্র ও অন্যান্য কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। সেই সময় তাঁদের গোপন রেডিওতে খবর এসে পৌঁছায় যে, আরেকটি সাবমেরিনে আরো কিছু আজাদ হিন্দ ফৌজের লোক আসছেন, তাঁদের সঙ্গে আছে প্রভূত অর্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র।
- (২) তাঁদের উড়িষ্যার উপকূলে কোনারক মন্দিরের কাছ থেকে নামিয়ে আনতে হবে। হরিদাস মিত্রের গ্রেপ্তারের ফলে গুপ্ত বিভাগের অন্যান্য লোকেরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সমস্ত ভারতবর্ষে তাঁরা বিক্ষিপ্ত, সহায়সম্বলহীন।
- (৩) বেলা মিত্র এগিয়ে এলেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি তাঁর সমস্ত অলঙ্কার বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে শত বাধাবিঘ্নের মধ্যে লোক পাঁঠিয়ে উড়িষ্যার উপকূলে আজাদ হিন্দ ফৌজকে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
- (৪) কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ অবতরণের দুদিন পরে সকলেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। সংবাদ আদানপ্রদানের সমস্ত যন্ত্রপাতি, দলিলপত্র ইত্যাদি নিরাপদে রাখবার দায়িত্ব এসে পড়ে বেলা মিত্রের উপর। তার মধ্যে কতকগুলি শেষ পর্যন্ত নিরাপদে রাখা সম্ভব হয়েছিল।
আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দীদের ফাঁসির আদেশ
১৯৪৫ সালে কলকাতা আলিপুর জেলে আবদ্ধ হরিদাস মিত্রের ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন কারাগারে আজাদ হিন্দ ফৌজের আরো ২১ জন বন্দীর ফাঁসীর আদেশ হয়। ১৯৪৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর হরিদাস মিত্র এবং তাঁর ভারতের অন্য়ান্য কারাগারে বাকী কয়েকজন সাথীর ফাঁসীর দিন ধার্য হয়। বন্দীরা ফাঁসীর অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন।
গান্ধীজীর নিকট বেলা মিত্র
৭ই সেপ্টেম্বর বেলা মিত্র ছুটে গেলেন পুনায় মহাত্মা গান্ধীর কাছে এই ২২ জনের জীবনরক্ষার প্রার্থনা নিয়ে। গান্ধীজীর চেষ্টার ফলে ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখের ফাঁসী স্থগিত রইল। বেলাকে তিনি তিনমাস পুনাতে রেখে দিলেন।
বড়লাট ওয়াভেলকে গান্ধীর পত্র
তিনমাস ধরে গান্ধীজী এবং ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের মধ্যে বহু পত্র বিনিময় ও বাদানুবাদ চলে এই বন্দীদের জীবনরক্ষার প্রশ্ন নিয়ে। গান্ধীজী হরিদাস মিত্র সম্বন্ধে ১৯৪৫ সালে ১৪ই সেপ্টেম্বর একখানি চিঠিতে লর্ড ওযাভেলকে লিখেছিলেন –
“I have perused the petition for mercy by the unlce of the condemned as also of Advocate Carden Noad. I suggest that thoy furnish cogent grounds for the exercise of mercy. In any event the case for mercy becomes irresistible in that the War with Japan is over. It will be a political error of the first magnitude if this sentence of death is carried into effect.”
গান্ধীজীর দ্বিতীয় পত্র
আজাদ হিন্দ ফৌজের আরও ২১ জন ফাঁসীর আদেশপ্রাপ্ত বন্দীর মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্য গান্ধীজী লর্ড ওয়াভেলকে ১৯৪৫ সালের ১৯শে অক্টোবর লিখেছিলেন –
“I see from legal papers that there are others of the batch awaiting execution. The times when the sentences were pronounced were those of war when calmness was at a discount. Now they are changed. The war is over. The condemned men have, no matter what the cause of delay was, survived the war. Will it be too much if I suggest a reconsideration of all such cases in the shape of commutation of death sentences ? In my opinion, justice to he real justice requires extention of mercy to temper it.”
২২ জন বন্দীর মৃত্যুদণ্ড রদ
কয়েকমাস ধরে এমনি সব জোরালো যুক্তিতর্ক দিয়ে বহু চিঠিপত্র আদান প্রদানের পর অবশেষে গান্ধীজী জয়যুক্ত হলেন। ২২ জন বন্দীরই মৃত্যুদণ্ড রদ হয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডের আদেশ হল। গান্ধীজীর আশীর্বাদ নিয়ে বেলা হাসিমুখে ফিরে এলেন কলিকাতায়।
ঝাঁসীর রাণী বাহিনী গঠন করেন বেলা মিত্র
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেলা মিত্র গঠন করেন ঝাঁসীর রাণী বাহিনী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতাজীর ঝাঁসী রেজিমেন্ট-এর আদর্শে। তিনি ছিলেন তার সর্বাধিনায়িকা। বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
শরণার্থীদের পুনর্বাসনে বেলা মিত্রর অবদান
তিনি যখন পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের মধ্যে শিয়ালদা স্টেশনে কাজ করছিলেন তখন তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য কিছুসংখ্যক পরিবারকে বালি এবং ডানকুনি স্টেশনের মধ্যবর্তী অভয়নগর নামক স্থানে পুনর্বসতির ব্যবস্থায় সাহায্য করেণন।
স্বাধীনতা সংগ্রামী বেলা মিত্রর নামে রেলওয়ে স্টেশন
বেলা মিত্রের মৃত্যুর পর ১৯৫৩ সালে ঐ অভয়নগর স্থানের নামকরণ হয় ‘বেলানগর’। পরে ১৯৫৮ সালে তাঁর জন্মদিনে ‘বেলানগর’ নামে একটি নতুন রেলওয়ে স্টেশন ঐ স্থানেই নির্মিত হয়। ভারতবর্ষে ভারতীয় নারীর নামে রেলওয়ে স্টেশন এই প্রথম।
বেলা মিত্রর মৃত্যু
১৯৫০ সালে শিয়ালদা স্টেশনে এবং অন্যান্য কেন্দ্রে রিফিউজিদের মধ্যে রিলিফের কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। ১৯৫২ সালের ৩১শে জুলাই স্বাধীনতা-সংগ্রামের বীর সৈনিক বেলা মিত্র অকালে ইহলোক ত্যাগ করেন।
উপসংহার :- বেলা মিত্র ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম, যিনি নারী শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় দেশপ্রেম, সাহস এবং আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহযোগিতা করেননি, বরং নিজের জীবনকেও বিপদের মুখে ফেলে জাতির মুক্তির জন্য কাজ করেছেন।
(FAQ) বেলা মিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
বেলা মিত্র ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সাহসী নারী বিপ্লবী, যিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যুক্ত থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কাজ করেছিলেন।
তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ (Indian National Army)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
হ্যাঁ, তাঁর পিতা হেমচন্দ্র মিত্র ছিলেন একজন বিপ্লবী, এবং স্বামী সুবোধচন্দ্র মিত্রও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।
তিনি গোপন বার্তাবাহক, বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা ও অর্থসংগ্রাহক হিসেবে আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বেলা মিত্র ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি সমাজসেবা, নারীশিক্ষা ও সামাজিক পুনর্গঠনের কাজে নিজেকে নিবেদিত করেন।
বেলা মিত্রকে স্মরণ করা হয় তাঁর অদম্য দেশপ্রেম, সাহসিকতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য।