ধ্রুব

প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের এক কিংবদন্তি চরিত্র ধ্রুব, যিনি অটল ভক্তি, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং অধ্যবসায়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ছোট বয়সেই তিনি অসীম তপস্যার মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভ করেন এবং আকাশে অমর স্থানে—ধ্রুবতারা—রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর কাহিনি ভক্তি, ন্যায়, পারিবারিক সম্পর্ক এবং আত্মশক্তি অর্জনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা আজও ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে অনুপ্রেরণার উৎস।

Table of Contents

পৌরাণিক চরিত্র ধ্রুব

ঐতিহাসিক চরিত্রধ্রুব
উত্সভাগবত পুরাণ
পিতামাতাউত্তানপাদ, সুনীতি
ভক্তির লক্ষ্যভগবান বিষ্ণু
তপস্যার কারণসৎমাতা সুরুচির অপমান — সিংহাসন ও পিতার স্নেহ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা
তপস্যার স্থায়িত্বপ্রায় ছয় মাস কঠোর তপস্যা
দেবতার বরঅমরত্ব ও ধ্রুবতারা হিসেবে আকাশে চিরস্থায়ী স্থান
প্রতীকী অর্থঅটল ভক্তি, দৃঢ়তা, অধ্যবসায়, আত্মনিবেদন
ধর্মীয় গুরুত্বভক্তদের জন্য শুদ্ধ ভক্তি ও নীতির আদর্শ
সাংস্কৃতিক প্রতিফলনসাহিত্য, লোককথা, শিশু-কাহিনি ও নৈতিক শিক্ষায় বহুল ব্যবহৃত

ধ্রুব

ভূমিকা :- ধ্রুব প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ, বিশেষত ভাগবত পুরাণের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ও অনুপ্রেরণাদায়ী চরিত্র। শিশু বয়সেই তিনি অটল সংকল্প, নিষ্ঠা এবং গভীর ভক্তির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে এক অনন্য স্থান অধিকার করে। পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার বেদনা তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হতে প্ররোচিত করে, এবং কঠোর তপস্যার মাধ্যমে তিনি দেবকৃপা অর্জন করেন। অসীম অধ্যবসায় ও ভক্তির পুরস্কারস্বরূপ ধ্রুব আকাশে ধ্রুবতারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন—যা চিরস্থায়ী, অচল ও দিশার প্রদর্শক। তাই ধ্রুব শুধু একটি পৌরাণিক চরিত্র নন; তিনি দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস ও অবিচল ভক্তির চিরন্তন প্রতীক।

ধ্রুবর জন্ম পরিচয়

পুরাকালে স্বায়ম্ভুর মনুর প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র জন্মে। এই উত্তানপাদের সুনীতি ও সুরুচি নারী দুই মহিষী ছিল। দুই জনের মধ্যে সুরুচিই রাজার অধিকতর প্রিয়া ছিল। তাঁরই প্ররোচনায় রাজা সুনীতিকে বনবাস দেন। এক দিন রাজা মৃগয়া করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে সুনীতির কুটীরে উপস্থিত হন। সেখানে রাজসহবাসে সুনীতির গর্ভ হয় এবং সেই গর্ভেই ধ্রুবর জন্ম হয়।

ধ্রুবর ইচ্ছা

তারপর এক দিন সুরুচির পুত্র রাজার কোলে বসে থাকতে দেখে ধ্রুবও পিতার কোলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

বিমাতার তিরস্কারে বিদ্ধ ধ্রুব

ধ্রুবর বিমাতা সুরুচি, ধ্রুবর অভিপ্রায় জানতে পেরে তিরস্কার করে বলেছিলেন, “বৎস! এই উচ্চাভিলাষ ত্যাগ কর। তুমি হীনা সুনীতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছ। এই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ স্থানের ভূমি উপযুক্ত নহ। মৎপুত্র উত্তমই এই স্থানের উপযুক্ত।”

মায়ের কাছে ধ্রুবর বৃত্তান্ত নিবেদন

ধ্রুব, বিমাতার এই কঠোর কথায় অত্যন্ত রেগে গিয়ে মায়ের কাছে এলেন। মা সুনীতি ছেলেকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে তোমার অবমাননা করিয়াছে?” ধ্রুব তখন মায়ের কাছে সকল বৃত্তান্ত নিবেদন করল।

পুত্র ধ্রুবর প্রতি মা সুনীতির উক্তি

সুনীতি সব শুনে পুত্রকে বললেন, “বৎস! সুরুচি যাহা বলিয়াছে, তাহা সত্য। তুমি অভাগিনীর জঠরে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, সুতরাং তুমিও অভাগা। সুরুচি অনেক পুণ্য করিয়াছে, এজন্য সে রাজার অতি প্রিয়। তুমি এখন যে অবস্থায় আছ, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাক। যদি সুরুচির বাক্যে তোমার ক্লেশ বোধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে তুমি পুণ্য কার্য্যের অনুষ্ঠান কর, তাহা হইলেই, তোমার সমস্ত অভিলাষ পূর্ণ হইবে।”

বিমাতার কথায় ধ্রুবর ক্লেশ

ধ্রুব সব শুনে মাকে বলল, “মাতঃ! বিমাতার বাক্য এখনও আমার হৃদয়ে শেলসম বিদ্ধ হইতেছে। আমি অন্য কোনো স্থান প্রার্থনা করি না; এরূপ স্থান আমি প্রার্থনা করি, যে স্থান আমার পিতারও দুর্লভ।”

ধ্রুবর গৃহ ত্যাগ

কথিত আছে, এরপর এক রজনীতে সুনীতি ঘুমিয়ে পড়লে ধ্রুব, হরি-পদ-প্রাপ্তির আশায় গৃহ ত্যাগ করে। ধ্রুব গৃহত্যাগী হয়ে অরণ্যপথে ক্রমাগত পূর্ব দিকে গমন করতে করতে, কুশাসনে উপবিষ্ট সাতজন মুনিকে দেখলেন।

ঋষিদের শরণাপন্ন ধ্রুব

মুনিদেরকে অভিবাদন করে বলল, “আমি উত্তানপাদ-তনয়, সাতিশয় নির্ব্বেদপ্রাপ্ত হইয়াই আপনাদিগের শরণাপন্ন হইলাম।”

ধ্রুবর প্রতি মুনিদের উক্তি

মুনিরা বললেন, “তোমার বয়ঃক্রম চারি অথবা পাঁচ বৎসর হইবে, তোমার শরীরও নির্ব্যাধি। অতএব এই নির্ব্বেদের কারণ ত কিছুই দেখিতে পাইতেছি না।”

ধ্রুবর অভিলাষ

মুনিরা তখন ধ্রুবর থেকে আদ্যোপান্ত সবিশেষ জেনে বললেন, “তোমার অভিলাষ কি আমাদিগকে বল।” ধ্রুব বলল, “আমি অর্থ, বা রাজ্যপ্রার্থী নহি। আমি এমন একটা স্থান প্রার্থনা করি, যে স্থান অপরের দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ। আপনারা আমাকে কৃপা করিয়া উপদেশ দিন, যাহাতে আমি শীঘ্র ঐ স্থান লাভ করিতে পারি।”

ধ্রুবকে বিষ্ণুর আরাধনার জন্য উপদেশ

যে সকল মুনির কাছে ধ্রুব উপদেশ প্রার্থনা করল, তাঁরা সপ্তর্ষি। অতঃপর মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা প্রমুখ সকলেই একবাক্যে ধ্রুবকে বিষ্ণুর আরাধনার জন্য উপদেশ দিলেন এবং নিম্নলিখিত মন্ত্র নির্দেশ করে দিলেন –

“হিরণ্যগর্ভপুরুষ-প্রধানাব্যক্তরূপিণে।

ওঁ নমো বাসুদেবায় শুদ্ধজ্ঞান-স্বভাবিনে।।”

ভগবানের আরাধনায় ধ্রুবর মনোনিবেশ

ধ্রুব এই মন্ত্র লাভ করে ঋষিদেরকে প্রণাম করে সর্ব্বপাপ-নাশক যমুনাতীরস্থ মধুনামে এক পুণ্য বনে গিয়ে অনন্যকৰ্ম্মা হয়ে, ভগবানের আরাধনায় মনোনিবেশ করল।

মথুরা নগরের প্রতিষ্ঠা

শত্রুঘ্ন মধু রাক্ষসের পুত্র লবণ রাক্ষসকে এইস্থানে বধ করে মথুরা নামে এক নগর স্থাপন করেছিলেন।

বালক ধ্রুবর তপস্যায় ভীত দেবগণ

ধ্রুবর কঠোর তপস্যার ফলে নদ, নদী, সমুদ্র ও সকল পৃথিবী বিচলিত হয়ে উঠল। এমন কি, ইন্দ্রাদি দেবগণ পর্যন্ত বালক ধ্রুবর এই কঠোর তপোনুষ্ঠান দর্শনে ভীত চিত্তে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন।

ভগবানের দর্শন পান ধ্রুব

তখন ভগবান তাঁদেরকে আশ্বস্ত করে ধ্রুবর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, “বৎস! তোমার তপস্যায় আমি প্রীত হইয়াছি, এক্ষণে অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।”

ইষ্টদেবের প্রতি ধ্রুবর উক্তি

ধ্রুব সম্মুখে ইষ্টদেবকে দেখে বলল, “ভগবন! আমি বালক, আপনার স্তবস্তুতির কিছুই জানি না, অথবা সামর্থ্যও নাই। আপনি এই বর দিন, যেন আমি আপনার স্তব করিতে পারি।”

ধ্রুবলোকে ধ্রুব

ভগবানকে দর্শন করে ধ্রুবর জ্ঞান পরিস্ফুট হল। তখন ভগবান বললেন, “বৎস! তুমি পূর্ব্বজন্মে ব্রাহ্মণ তনয় ছিলে ও অনন্যচিত্তে আমার আরাধনা করিয়াছিলে; তৎপরে জনৈক রাজপুত্রের সহিত তোমার মিত্রতা হওয়ায়, তাহার ঐশ্বর্য দেখিয়া, রাজার পুত্র হইতে বাসনা করিয়াছিলে, সেই হেতুই উত্তানপাদের গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছ। তুচ্ছ স্বর্গাদি ত সামান্য কথা, মানব আমার আরাধনা করিলে, অবিলম্বে মুক্তিলাভ পর্যন্ত করিয়া থাকে। অদ্যাবধি ত্রৈলোক্যের উপরে, সকল তারা ও গ্রহগণের উপরিভাগে তোমার স্থান হইল। তোমার স্থান ধ্রুবলোক বলিয়া প্রসিদ্ধ হইবে। তোমার মাতাও তারকারূপে তোমার নিকটে অবস্থিতি করিবে।”

ধ্রুবর রাজ্য লাভ

বর দিয়ে বিষ্ণু অন্তর্হিত হলে, ধ্রুব গৃহে এসে পিতার কাছ থেকে রাজ্যলাভ করে। ধ্রুবর দুই পত্নী ভ্রমি ও ইলা। ভ্রমির গর্ভে কল্প ও বৎসর এবং ইলার গর্ভে উৎকলের জন্ম হয়।

যক্ষদের সাথে ধ্রুবর যুদ্ধ

ধ্রুবর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা উত্তম মৃগয়ায় যক্ষকর্তৃক নিহত হয়। ধ্রুব এই জন্য যক্ষদের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলে, পিতামহ মনু ধ্রুবকে এই যুদ্ধ হতে নিরস্ত করেন।

কুবেরের বর লাভ করেন ধ্রুব

এরপর কুবের সন্তুষ্ট হয়ে ধ্রুবকে অভিলষিত বর প্রার্থনা করতে বলেন। তখন ধ্রুব, “বিষ্ণু পদে যেন মতি থাকে” এই বর প্রার্থনা করে। কুবের “তাহাই হউক” বলে প্রত্যাবৃত্ত হন।

ধ্রুবলোকে ধ্রুবর গমন

এরপর ধ্রুব ষটত্রিংশ সহস্র বছর রাজত্ব করে বিষ্ণুদত্ত স্বনামখ্যাত ধ্রুবলোকে গমন করেন।

উপসংহার :- ধ্রুবর কাহিনি ভারতীয় পুরাণে এক অনন্য শিক্ষা বহন করে—দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, ভক্তি ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। শিশু বয়সের মানসিক আঘাত ও অবহেলা তাঁকে হতাশ করেনি; বরং তা তাঁকে ঈশ্বরের আশ্রয়ে নিয়ে যায়, যেখানে তাঁর নিষ্ঠা সর্বোচ্চ স্বীকৃতি লাভ করে। ভগবান বিষ্ণুর বরপ্রাপ্ত হয়ে ধ্রুব আকাশে অচল নক্ষত্র—ধ্রুবতারা—হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, যা পথহারা নাবিকের দিশা দেখায় এবং প্রতীকীভাবে মানুষের জীবনেও স্থির লক্ষ্য ও নীতির অনুপ্রেরণা দেয়। তাই ধ্রুব শুধু পৌরাণিক ইতিহাসের চরিত্র নন; তিনি অনন্তকাল ধরে মানবসমাজে ধৈর্য, বিশ্বাস ও নৈতিকতার আলোকস্তম্ভ হয়ে আছেন।

(FAQ) ধ্রুব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. ধ্রুব কে ছিলেন?

তিনি ছিলেন ভাগবত পুরাণে উল্লেখিত এক কিংবদন্তি শিশু-তপস্বী, যিনি অসাধারণ ভক্তি ও অধ্যবসায়ের জন্য প্রসিদ্ধ।

২. ধ্রুব কেন তপস্যা করেছিলেন?

সৎমাতা সুরুচির অপমান এবং পিতার স্নেহ না পাওয়ার কষ্ট ধ্রুবকে ঈশ্বরের কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে তপস্যা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

৩. ধ্রুব কোন দেবতার উপাসনা করেছিলেন?

তিনি ভগবান বিষ্ণুর প্রতি তপস্যা ও ভক্তি নিবেদন করেন।

৪. ধ্রুব কত দিন তপস্যা করেছিলেন?

পুরাণ অনুসারে তিনি প্রায় ছয় মাস কঠোর তপস্যা করে ভগবান বিষ্ণুর দর্শন লাভ করেন।

৫. ধ্রুব কী বর পেয়েছিলেন?

ভগবান বিষ্ণু তাঁকে অমরত্ব এবং আকাশে চিরস্থায়ী স্থান—ধ্রুবতারা—হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন।

৬. ধ্রুবতারার অর্থ কী?

ধ্রুবতারা অচল, স্থির নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত, যা নাবিকদের দিক নির্দেশনা দেয় এবং প্রতীকীভাবে দৃঢ়তা ও নীতির প্রতীক।

৭. ধ্রুবর কাহিনির মূল শিক্ষা কী?

অটল ভক্তি, দৃঢ় সংকল্প ও নৈতিকতার মাধ্যমে যেকোনো প্রতিকূলতা জয় করা সম্ভব—ধ্রুবের গল্প এই মূল্যবোধগুলো শিক্ষা দেয়।

৮. ধ্রুবর মা ও পিতা কে ছিলেন?

তার মা ছিলেন সুনীতি এবং পিতা ছিলেন উত্তানপাদ, যিনি স্বয়ম্ভু মনুর বংশধর।

৯. ধ্রুবর গল্প কোন গ্রন্থে পাওয়া যায়?

মুখ্যত ভাগবত পুরাণের চতুর্থ স্কন্ধে ধ্রুব সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।

১০. ধ্রুব কি ইতিহাসের চরিত্র?

ধ্রুব ঐতিহাসিক নয়; তিনি একটি পৌরাণিক চরিত্র, যার কাহিনি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রচলিত।

Leave a Comment