দশম শ্রেণী (তৃতীয় অধ্যায়): প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ-বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ হতে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

দশম শ্রেণী (তৃতীয় অধ্যায়): প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ-বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ হতে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

দশম শ্রেণী (তৃতীয় অধ্যায়): প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ-বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ হতে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

১. কোন্ যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম ভারতে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং কোন্ যুদ্ধের মাধ্যমে তারা শাসনক্ষমতা পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা করে?

উত্তর:- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭ খ্রি.) নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাকে পরাজিত করে ভারতে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রি.) নবাব মীরকাশিমকে পরাজিত করে প্রথম বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে পাকাপাকিভাবে শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।

২. সন্ন্যাসী ও ফকিরদের পরিচয় দাও।

উত্তর:- মুঘল আমলে উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অংশে তীর্থভ্রমণে আসতেন। তাঁদের অনেকেই বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং কৃষিকাজের দ্বারা জীবিকানির্বাহ করেন। ব্রিটিশদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করেন।

৩. ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির প্রধান কারণ কী ছিল?

উত্তর:- ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল কৃষক ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের ক্ষেত্রে ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি, বিভিন্ন নতুন কর আরোপ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী শোষণ, খাজনা আদায়ে অত্যাচার, নীল, পাট, তুলো প্রভৃতি চাষে চাষিদের বাধ্য করা, মহাজনদের শোষণ, কুটিরশিল্প ধ্বংস প্রভৃতি।

৪. ব্রিটিশ শাসনের আগে অরণ্য কীভাবে আদিবাসীদের জীবিকানির্বাহে সাহায্য করত?

উত্তর:- ব্রিটিশ শাসনের আগে অরণ্য আদিবাসীদের জীবিকানির্বাহে নানাভাবে সাহায্য করত। আদিবাসীরা অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার প্রভৃতির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করত। তারা অরণ্যের সম্পদ ভোগ এবং বিক্রি দুই-ই করতে পারত।

৫. ঔপনিবেশিক শাসনকালে মহাজনরা কৃষকদের কীভাবে শোষণ করত?

উত্তর:- ঔপনিবেশিক শাসনকালে মহাজনরা নানাভাবে কৃষকদের শোষণ করত। যেমন – কৃষকরা নগদে জমিদারদের রাজস্ব পরিশোধের জন্য মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিত। ঋণের জন্য কৃষকরা উচ্চাহারে সুদ দিতে বাধ্য হত। কৃষকরা ঋণের বিপুল পরিমাণ সুদের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে মহাজন সেই কৃষকের জমিজমা দখল করে নিত।

৬. কী উদ্দেশ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়েছিল?

উত্তর:- ইসলাম ধর্মের সংস্কারসাধন, জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া প্রভৃতি উদ্দেশ্যে অষ্টাদশ শতকে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়।

৭. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর:- ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৮৬৫ ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যগুলি ছিল অরণ্য থেকে অরণ্যবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে সুকৌশলে বিচ্ছিন্ন করা। এদেশে নতুন নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করা। রেলগাড়ি, রেলপথ, জাহাজ প্রভৃতি তৈরির প্রয়োজনে অরণ্যের কাষ্ঠসম্পদ হস্তগত করার উদ্যোগ নেওয়া। অরণ্যের অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করা।

৮. কোন প্রেক্ষাপটে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ঘটেছিল?

উত্তর:- মুঘল আমল থেকে উত্তর ভারতে তীর্থ করতে আসা বহু সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস এবং কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন। তাদের ওপর ইংরেজ কোম্পানি এবং তাদের সহযোগী জমিদাররা শোষণ ও নির্যাতন শুরু করে। এর বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ঘটেছিল।

৯. অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ সরকার কী উদ্দেশ্যে অরণ্যের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে?

উত্তর:- অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারতে নতুন শহরের নির্মাণকার্য, জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির প্রয়োজনে অরণ্যের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

১০. ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আইনকে কটি স্তরে ভাগ করা হয় এবং ভাগগুলি কী?

উত্তর:- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আইনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। এগুলি হল সংরক্ষিত, সুরক্ষিত এবং অ-শ্রেণিবিভক্ত।

১১. ব্রিটিশ সরকার ‘অরণ্য সনদ’ (১৮৫৫ খ্রি.)-এর দ্বারা কী পদক্ষেপ নেয়?

উত্তর:- ব্রিটিশ সরকার ‘অরণ্য সনদ’ (১৮৫৫ খ্রি.)-এর দ্বারা ভারতীয় অরণ্যের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। জনগণ কর্তৃক অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। অরণ্যের শাল, সেগুন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত করে।

১২. ব্রিটিশ সরকার কবে, কোথায় ইম্পিরিয়াল ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করে?

উত্তর:- ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে দেরাদুনে ব্রিটিশ সরকার ‘ইম্পিরিয়াল ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করে।

১৩. কবে দ্বিতীয় ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস হয়? এই আইনের দ্বারা কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়?

উত্তর:- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস হয়।

দ্বিতীয় ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’-এর দ্বারা সরকার অরণ্যের ওপর নিজের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে। আদিবাসীদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

১৪. আদিবাসীদের কৃষিজমিতে সরকার রাজস্ব আরোপ করলে আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ হয় কেন?

উত্তর:- আদিবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে বনভূমি পরিষ্কার করে, অনুর্বর পতিত জমি উদ্ধার করে সেখানে চাষবাস শুরু করে। তাদের পরিশ্রমে উদ্ধার হওয়া এই জমিতে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব আরোপ করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়।

১৫. অরণ্যের অধিকার হারিয়ে জীবিকানির্বাহে ব্যর্থ বহু আদিবাসী কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে?

উত্তর:- অরণ্যের অধিকার হারিয়ে জীবিকানির্বাহে ব্যর্থ হয়ে বহু আদিবাসী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। অনেকে চুরি, ডাকাতি শুরু করে। অনেকে বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।

১৬. কবে প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস হয়? এই আইনের দ্বারা কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়?

উত্তর:- ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস হয়।

প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’-এর দ্বারা ভারতের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করা হয়। সরকার অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় এনে নিজের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যে ঘেরা যে-কোনো ভূমিই হল সরকারের সম্পত্তি।

১৭. ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’-এর দ্বারা সরকার কী কী পদক্ষেপ নেয়?

উত্তর:- ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’-এর দ্বারা সরকার অরণ্যকে সংরক্ষিত অরণ্য, সুরক্ষিত অরণ্য ও গ্রামীণ অরণ্য-এই তিন ভাগে বিভক্ত করে। কোন কোন বিষয়গুলি ‘অরণ্য-বিষয়ক অপরাধ’, অরণ্যের অভ্যন্তরে কোন কোন কাজ নিষিদ্ধ, অরণ্য আইন লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে তা ঘোষণা করে।

১৮. বাংলায় ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত কয়েকটি কৃষকবিদ্রোহের নাম লেখো।

উত্তর:- বাংলায় ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত কয়েকটি কৃষকবিদ্রোহ হল চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৭ ও ১৭৯৮-৯৯ খ্রি.), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.), ভিল বিদ্রোহ (১৮১৯ খ্রি.), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২ খ্রি.), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০ খ্রি.), মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) প্রভৃতি।

১৯. বিদ্রোহ কাকে বলে? বিদ্রোহের একটি উদাহরণ দাও।

উত্তর:- কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন সাধারণভাবে বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বিদ্রোহের একটি উদাহরণ হল নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের পরিচালনায় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘঠিত নীল বিদ্রোহ।

২০. দেবী সিংহ কে ছিলেন?

উত্তর:- দেবী সিংহ ছিলেন দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার একজন ইজারাদার। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের ইজারা নিয়ে এখানকার জমিদার ও প্রজাদের ওপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করলে তাঁর বিরুদ্ধে রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) শুরু হয়।

২১. বিপ্লব বলতে কী বোঝায়?

উত্তর:- কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা হয়। বিপ্লবের একটি উদাহরণ হল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব। কারণ, এই বিপ্লবের দ্বারা ফরাসি সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন ঘটে।

২২. রংপুরের কৃষকদের ওপর কীরূপ শোষণ চলত? অথবা, রংপুর বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

উত্তর:- রংপুরের কৃষকদের ওপর নানাভাবে শোষণ চলত। ইজারাদার দেবী সিংহ রংপুরের ভূমিরাজস্বের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। তাদের ওপর বিভিন্ন নতুন কর বসানো হয়। এসব অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চলতে থাকে। কৃষকরা রাজস্ব পরিশোধের নগদ অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে তীব্র ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষককে ঘরবাড়ি ও জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এসব কারণে শেষপর্যন্ত রংপুর বিদ্রোহ শুরু হয়।

২৩. ঔপনিবেশিক বাংলায় কয়েকটি উপজাতি কৃষক বিদ্রোহের নাম লেখো।

উত্তর:- ঔপনিবেশিক বাংলায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপজাতি বিদ্রোহ হল চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৭ ও ১৭৯৮-৯৯ খ্রি.), ভিল বিদ্রোহ (১৮১৯ খ্রি.), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২ খ্রি.), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.), মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) প্রভৃতি।

২৪. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

উত্তর:- ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল এই বিদ্রোহগুলি ছিল মূলত উপজাতি বিদ্রোহ, বিদ্রোহীরা অরণ্যের ওপর তাদের চিরাচরিত অধিকার রক্ষা করতে প্রাণপাত করে। বিদ্রোহে ব্রিটিশ-বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট ও তীব্র। বিদ্রোহগুলি অধিকাংশ সময়ই ছিল সশস্ত্র।

২৫. বনাঞ্চলগুলির ওপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির দুটি কারণ উল্লেখ করো।

উত্তর:- বনাঞ্চলগুলির ওপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির দুটি কারণ হল সরকার ভারতে নতুন নতুন শহরের নির্মাণকার্য করতে গিয়ে বনাঞ্চলের কাঠের প্রয়োজন বোধ করে। জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রয়োজনে সরকার বনাঞ্চলের কাঠের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

২৬. অভ্যুত্থান বলতে কী বোঝ? অভ্যুত্থানের একটি উদাহরণ দাও।

উত্তর:- কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম সাধারণভাবে অভ্যুত্থান নামে পরিচিত।

অভ্যুত্থানের একটি উদাহরণ হল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে সরকারের বিরুদ্ধে সেনাদের একাংশের বিদ্রোহ ঘোষণা।

২৭. দেবী সিংহ জমিদার ও কৃষকদের ওপর কী ধরনের অত্যাচার চালাতেন?

উত্তর:- দিনাজপুর, রংপুর জেলা এবং এদ্রাকপুর পরগনার ইজারাদার দেবী সিংহ সেই অঞ্চলের জমিদার ও প্রজাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালান। তিনি তাদের ওপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। বিভিন্ন নতুন কর আরোপ করেন। এই অর্থ আদায়ে তাদের ওপর চরম অত্যাচার চালানো হয়। কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চলতে থাকে।

২৮. সরকার কোন কোন বছর ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট পাস করে? কী উদ্দেশ্যে এই আইন পাস হয়?

উত্তর:- সরকার ১৮৭১, ১৯১১ ও ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পৃথক পৃথক ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট পাস করে।

ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট পাসের উদ্দেশ্য ছিল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আদিবাসীদের শায়েস্তা করা।

২৯. রংপুর বিদ্রোহের স্বাধীন সরকার সম্পর্কে কী জান?

উত্তর:- ইজারাদার দেবী সিংহ ও ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা একটি ‘স্থানীয় স্বাধীন সরকার’ গঠন করে নুরুলউদ্দিন-কে নেতা বা নবাব এবং দয়ারাম শীলকে সহকারী নেতা বলে ঘোষণা করে।

৩০. দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান?

উত্তর:- দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়। জমিদারদের ওপর ইংরেজদের নির্যাতন, চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করা, চুয়াড়দের পাইকের পেশা থেকে বিতাড়ন প্রভৃতির ফলে জমিদাররা বিদ্রোহ শুরু করে এবং জমিদারদের পক্ষ নিয়ে চুয়াড়রা বিদ্রোহে অংশ নেয়। রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং এবং মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি এই বিদ্রোহে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন।

৩১. চুয়াড় কারা ছিল? অথবা, কোন বিদ্রোহ চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত?

উত্তর:- চুয়াড় বা চোয়াড় ছিল বাংলার একটি আদিবাসী সম্প্রদায়। তারা বর্তমান মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে বসবাস করত। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চুয়াড়রা ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

৩২. কোন অঞ্চলকে জঙ্গলমহল বলা হয়?

উত্তর:- ধলভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার কিছুটা অঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল গঠিত ছিল। এটি ছিল কৃষিজীবী চুয়াড় জাতি-অধ্যুষিত অঞ্চল। চুয়াড় বিদ্রোহের পর ইংরেজরা বিষ্ণুপুর শহরকে কেন্দ্র করে এই দুর্গম বনাঞ্চলটিকে ‘জঙ্গলমহল’ (১৮০০ খ্রি.) নামে একটি বিশেষ জেলা গঠন করে।

৩৩. প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান?

উত্তর:- প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়। ইংরেজ কোম্পানি মেদিনীপুরের জমিদারের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দিলে ঘাটশিলার ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। জমিদারদের পক্ষ নিয়ে চুয়াড়রা বিদ্রোহে অংশ নেয়।

৩৪. রংপুর বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা কী কী পদক্ষেপ নেয়?

উত্তর:- রংপুর বিদ্রোহে বিদ্রোহী কৃষকরা একটি ‘স্থানীয় স্বাধীন সরকার’ গঠন করে। এই সরকারের প্রধান নেতা বা নবাব হন নুরুলউদ্দিন এবং তাঁর সহকারী হন দয়ারাম শীল। বিদ্রোহী কৃষকরা দেবী সিংহকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। তারা রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। বহু কর্মচারী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়।

৩৫. দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি কী ছিল?

উত্তর:- দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। এগুলি হল ইংরেজ কোম্পানি জমিদারদের ওপর রাজস্ব বাড়িয়ে তা আদায়ের ক্ষেত্রে অত্যাচার শুরু করে। ইংরেজরা আদিবাসী কৃষক চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করে। বহু চুয়াড়কে পাইকের পেশা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এইসব কারণে জমিদার ও কৃষকরা ক্ষুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করে।

৩৬. চুয়াড়দের পেশা কী ছিল?

উত্তর:- চুয়াড়রা কেউ কেউ কৃষিকাজ করত। কেউ কেউ পশুশিকারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেউ কেউ স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত।

৩৭. দুর্জন সিং কে ছিলেন?

উত্তর:- দুর্জন সিং ছিলেন বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার ও চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম নেতা। তিনি প্রায় ১৫০০ জন অনুগামী নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং প্রায় ৩০টি গ্রামে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।

৩৮. ভিল কারা?

উত্তর:- ভিল হল ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়। পশ্চিম ভারতের বর্তমান গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের খান্দেশ ও তার সংলগ্ন সুবিস্তৃত অঞ্চলে ভিল জাতির একটি অংশ বসবাস করত।

৩৯. চুয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর:- চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন – নিরক্ষর চুয়াড়দের বিদ্রোহ ভারতের শিক্ষিত সমাজের চোখ খুলে দেয়। এই বিদ্রোহে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়। বিদ্রোহের পর সরকার দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি জেলা গঠন করে।

৪০. ‘বেচারাম’ কী?

উত্তর:- ছোটোনাগপুরের সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চলে বহিরাগত ব্যবসায়ীরা প্রকৃত যা ওজন হওয়া উচিত তার থেকে কম ওজনের বাটখারা দিয়ে ওজন করে সাঁওতালদের কাছে লবণ, চিনি প্রভৃতি পণ্য বিক্রি করত। এই বাটখারা ‘বেচারাম’ নামে পরিচিত।

৪১. কোল বিদ্রোহীদের পদক্ষেপগুলি কী ছিল?

উত্তর:- কোল বিদ্রোহীদের প্রধান পদক্ষেপগুলি ছিল বিদ্রোহীরা বহিরাগতদের ছোটোনাগপুর ছাড়ার দাবি জানায়। বিদ্রোহীরা ইংরেজ কর্মচারী, জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিদ্রোহীদের আক্রমণে বহ লোক নিহত হয়।

৪২. ‘দিকু’ কাদের বলা হত?

উত্তর:- ছোটোনাগপুরে সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চলে আগত বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের ‘দিকু’ বলা হত।

৪৩. কোল বিদ্রোহের প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল?

উত্তর:- কোল বিদ্রোহের প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলি ছিল এই বিদ্রোহে সুযোগ্য নেতার অভাব ছিল। আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতার ফলে এই বিদ্রোহ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শিক্ষিত সমাজ কোল বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করেনি। বিদ্রোহীদের মধ্যে যোগাযোগের যথেষ্ট অভাব ছিল।

৪৪. রানি শিরোমণি কে ছিলেন?

উত্তর:- রানি শিরোমণি ছিলেন মেদিনীপুরের রানি এবং চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী। বিদ্রোহে অসামান্য অবদানের জন্য রানি শিরোমণি ‘মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই’ নামে পরিচিত হন।

৪৫. ‘কেনারাম’ কী?

উত্তর:- ছোটোনাগপুরের সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চলে বহিরাগত ব্যবসায়ীরা প্রকৃত যা ওজন হওয়া উচিত তার থেকে বেশি ওজনের বাটখারা দিয়ে ওজন করে সাঁওতালদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনত। এই বাটখারা ‘কেনারাম’ নামে পরিচিত।

৪৬. কবে, কাদের মধ্যে ‘চাইবাসার যুদ্ধ’ হয়েছিল? এই যুদ্ধে কারা পরাজিত হয়?

উত্তর:- ১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দে কোল উপজাতি এবং পোড়াহাটের জমিদার ও সেনাপতি রোগসেস-এর নেতৃত্বাধীন ইংরেজবাহিনীর মধ্যে ‘চাইবাসার যুদ্ধ’ হয়েছিল।

চাইবাসার যুদ্ধে কোলরা পরাজিত হয়।

৪৭. ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের কীভাবে শোষণ করত?

উত্তর:- ব্যবসায়ীরা ‘কেনারাম’ নামে কম ওজনের বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনার সময় এবং ‘বেচারাম’ নামে বেশি ওজনের বাটখারা ব্যবহার করে নিজেদের পণ্যগুলি সাঁওতালদের কাছে বিক্রির সময় ঠকাত।

৪৮. কীভাবে কোল বিদ্রোহ দমন করা হয়?

উত্তর:- কোল বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করলে ক্যাপটেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবাহিনী কোল বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন শুরু করে এবং হাজার হাজার আদিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে।

৪৯. সিধু ও কানু কবে, কোথায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন?

উত্তর:- সিধু ও কানুর নেতৃত্বে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয়। সেখানে সিধু ও কানু শোষণমুক্ত স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।

৫০. বিরসা মুন্ডা কে ছিলেন?

উত্তর:- বিরসা মুন্ডা ছিলেন মুন্ডা বিদ্রোহের (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) প্রধান নেতা। তিনি এক নতুন ধর্ম প্রচার করে মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করে মুন্ডাদের খাজনা দেওয়া বন্ধ এবং বিদেশিদের বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। তিনি স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ প্রবল আকার নেয়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশবাহিনী বিদ্রোহ দমন করে এবং বিরসার কারাদণ্ড হয়।

৫১. মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি কী?

উত্তর:- মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল ব্রিটিশরা মুন্ডা অঞ্চলে কৃষিজমিতে মুন্ডাদের যৌথ মালিকানা প্রথা (খুঁৎকাঠি প্রথা) বাতিল করে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রথা চালু করে। মুন্ডাদের চিরাচরিত আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে ব্রিটিশ ব্যবস্থা চালু করা হয়। মুন্ডাদের ওপর নানা ধরনের কর আরোপ করা হয়। তাদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। বহিরাগত ‘দিকু’রা কৌশলে মুন্ডাদের জমিজমা দখল করে নিতে থাকে। খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। এসব কারণে মুন্ডারা ক্ষুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করে।

৫২. বিদ্রোহ শুরু করার জন্য বিরসা কী ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নেন?

উত্তর:- বিদ্রোহ শুরু করার জন্য বিরসা মুন্ডাদের নিয়ে একটি সেনাদল গঠন করেন। তিনি খুঁটি, রাঁচি, চক্রধরপুর, কুন্দু, তামার, তোরপা, কারা, বাসিয়া প্রভৃতি স্থানে গোপন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন।

৫৩. মুন্ডা বিদ্রোহের ফলাফলগুলি উল্লেখ করো।

উত্তর:- মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান ফলাফলগুলি হল বিদ্রোহে অংশ নিয়ে মুন্ডাদের ঐক্য বৃদ্ধি পায়। বিদ্রোহের চাপে সরকার ছোটোনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট (১৯০৮ খ্রি.)-এর দ্বারা মুন্ডাদের খুঁৎকাঠি প্রথা মেনে নেয়। মুন্ডাদের দিয়ে বিনা বেতনে বেগার খাটানো নিষিদ্ধ হয়।

৫৪. সাঁওতাল বিদ্রোহীরা বিদ্রোহে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়?

উত্তর:- সাঁওতাল বিদ্রোহীরা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রেলস্টেশন, থানা, ডাকঘর, ইউরোপীয়দের বাসস্থান, দেশীয় জমিদারদের বাসস্থান, মহাজনদের গদি প্রভৃতি আক্রমণ করতে থাকে। তারা সাধারণ তিরধনুক, বর্শা, বল্লম প্রভৃতি নিয়ে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়।

৫৫. বিরসা মুন্ডার নতুন ধর্মমত সম্পর্কে কী জান?

উত্তর:- বিরসা মুন্ডা এক নতুন ধর্মমত প্রচার করে মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁর ধর্মের মূল কথা ছিল ভালোবাসা, আত্মশুদ্ধি ও সমবেত প্রার্থনা। তিনি ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেয়েছেন বলে দাবি করেন এবং নিজেকে আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ‘ধরতি আবা’ অর্থাৎ ‘পৃথিবীর পিতা’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁর উপাস্য দেবতা ছিলেন ‘সিং বোঙ্গা’ অর্থাৎ সূর্য দেবতা।

৫৬. মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?

উত্তর:- মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা বাতিল করে দেওয়া মুন্ডা সমাজের চিরাচরিত আইন, বিচার ও সামাজিক বিধিব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। ‘দিকু’ নামে বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের মুন্ডা-অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা।

৫৭. মুন্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য লেখো।

উত্তর:- মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল এই বিদ্রোহ ছিল মূলত আদিবাসী মুন্ডাদের দ্বারা পরিচালিত। বিদ্রোহী মুন্ডারা নিজেদের চাষের জমিতে মালিকানা প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এই বিদ্রোহের মূল প্রয়াস ছিল ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতা করা এবং সরকারের অফিস, থানা প্রভৃতি আক্রমণ করা। বহিরাগত ‘দিকু’ বা জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের মুন্ডা অঞ্চল থেকে বিতাড়নও বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল।

৫৮. অরণ্য আইন কী?

উত্তর:- ভারতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের অরণ্য সনদ এবং পরবর্তী আরও কয়েকটি আইনের দ্বারা এদেশের অরণ্য সম্পদের ওপর প্রজাদের অধিকার খর্ব করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত বৃদ্ধি করে। এই আইনগুলি ‘অরণ্য আইন’ নামে পরিচিত।

৫৯. ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন কী?

উত্তর:- মুন্ডা বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার মুন্ডা উপজাতিদের কিছুটা সন্তুষ্ট করার নীতি নেয়। এই উদ্দেশ্যে মুন্ডাদের অভাব-অভিযোগের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সরকার ‘ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন’ (১৯০৮ খ্রি.) পাস করে। এই আইনের দ্বারা মুন্ডাদের খুঁৎকাঠি প্রথা কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করে। মুন্ডাদের ওপর ‘বেট বেগারি’ প্রথা নিষিদ্ধ হয়।

৬০. ভাগনাডিহির মাঠে কোন বিদ্রোহের সূচনা হয়? সেই বিদ্রোহ কোন বছর হয়?

উত্তর:- ভাগনাডিহির মাঠে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়।

১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়।

৬১. বাংলায় ধর্মের ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়েকটি কৃষক- বিদ্রোহর নাম লেখো।

উত্তর:- বাংলায় ধর্মের ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়েকটি কৃষকবিদ্রোহ হল সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.), ওয়াহাবি আন্দোলন (১৮৩১ খ্রি.), ফরাজি আন্দোলন (১৮২০-৬২ খ্রি.), পাগলপন্থী আন্দোলন (১৮২৫-৩৩ খ্রি.) প্রভৃতি।

৬২. ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির নাম লেখো।

উত্তর:- ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলি হল সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ, ভিল বিদ্রোহ, ফরাজি আন্দোলন, পাগলপন্থী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ প্রভৃতি।

৬৩. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন?

উত্তর:- সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.) ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণগুলি ছিল এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন। তাই বাংলায় তাদের জনভিত্তি ছিল দুর্বল। এই বিদ্রোহ শুরু থেকেই ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এই বিদ্রোহ জনপ্রিয় হতে পারেনি। শুরু থেকেই তা দুর্বল ছিল।

৬৪. ঔপনিবেশিক শাসনকালে জমিদাররা কৃষকদের ওপর কীভাবে অত্যাচার চালাত?

উত্তর:- ঔপনিবেশিক শাসনকালে জমিদাররা কৃষকদের ওপর উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব আরোপ করত, ভূমিরাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু নতুন কর আরোপ করত, রাজস্ব ও অন্যান্য কর আদায়ে কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালাত, কর দিতে ব্যর্থ হলে কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করত।

৬৫. কোন আন্দোলন ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামে পরিচিত?

উত্তর:- আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৯২ খ্রি.) নামে জনৈক ব্যক্তি অষ্টাদশ শতকে আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা সাধারণভাবে ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

৬৬. ঔপনিবেশিক শাসনকালে নীলকররা কৃষকদের ওপর কীভাবে শোষণ ও অত্যাচার চালাত?

উত্তর:- নীলকররা কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনের পরিবর্তে জোর করে নীলচাষে বাধ্য করত। নীলচাষে রাজি না হলে নীলকররা কৃষকদের নীলকুঠিতে আটকে রাখত, শারীরিক নির্যাতন চালাত। কৃষকদের গোরুবাছুর ধরে নিয়ে যেত এবং কৃষক পরিবারের মহিলাদের সম্মানহানি করত। নীলকররা কৃষকের ঘরবাড়িতে আগুনও লাগিয়ে দিত।

৬৭. তিতুমির কে ছিলেন?

উত্তর:- তিতুমির ছিলেন বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা। তিনি দরিদ্র ও নির্যাতিত মুসলিমদের নিয়ে অত্যাচারী জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন এবং বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

৬৮. কোন ব্রিটিশ শাসক কবে তিতুমিরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন? এর ফল কী হয়েছিল?

উত্তর:- ভারতের ব্রিটিশ বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমিরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন।

ব্রিটিশ ও জমিদারদের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিতুমিরের বাহিনী পরাজিত হয়। ইংরেজদের কামানের আঘাতে তাঁর বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় এবং তিতুমির যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান।

৬৯. তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন কতদূর প্রসারিত হয়?

উত্তর:- তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন ২৪ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, মালদহ, রাজশাহি, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় প্রসারিত হয়।

৭০. তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর:- তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়। বিদ্রোহের তীব্রতায় জমিদার ও মহাজনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আন্দোলনে পবিত্র কোরানের আদর্শে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলে হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

৭১. কোন ঘটনা ‘বারাসাত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত? অথবা, তিতুমিরের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কী জান?

উত্তর:- ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমির বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। তিনি নিজেকে ‘বাদশাহ’ ঘোষণা করেন এবং মৈনুদ্দিন-কে প্রধানমন্ত্রী ও গোলাম মাসুম-কে সেনাপতি নিয়োগ করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে তাঁর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন স্থানের জমিদারদের কাছে কর দাবি করেন। এই ঘটনা বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

৭২. তিতুমিরের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির নাম কী?

উত্তর:- তিতুমিরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাঁর বিশিষ্ট অনুগামী মৈনুদ্দিন। তিতুমিরের সেনাপতি ছিলেন গোলাম মাসুম।

৭৩. ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তিতুমিরের যুদ্ধের কী পরিণাম হয়?

উত্তর:- ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিতুমিরের বাহিনী পরাজিত হয়। তিতুমির ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী প্রকাশ্য যুদ্ধে প্রাণ দেন (১৮৩১ খ্রি.)। তাঁর বাঁশের কেল্লা কামানের গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়। বহু বিদ্রোহীর ফাঁসি বা দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড হয়।

৭৪. কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের ওপর কীভাবে অত্যাচার চালান? এর পরিণতি কী হয়েছিল? অথবা, জমিদার কৃষ্ণদেব রায় সম্পর্কে কী জান?

উত্তর:- পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে। যারা তিতুমিরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

অত্যাচারে ক্ষুদ্ধ হয়ে তিতুমির ৩০০ জন অনুগামী নিয়ে কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করেন। সংঘর্ষে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হন, মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং ঘরবাড়ি লুণ্ঠিত হয়।

৭৫. হাজি শরিয়ত উল্লাহর ধর্মীয় আদর্শ কী ছিল?

উত্তর:- হাজি শরিয়ত উল্লাহর ধর্মীয় আদর্শ ছিল ইসলাম-বিরোধী বিভিন্ন কুসংস্কার ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করে ধর্মকে অপবিত্র করেছে। একেশ্বরবাদ, সামাজিক সাম্য-সহ কোরানের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করে ধর্মকে পবিত্র করতে হবে।

৭৬. বালাকোটের যুদ্ধ কবে, কাদের মধ্যে হয়েছিল? এই যুদ্ধের কী পরিণতি হয়?

উত্তর:- ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের শিখ জাতি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমেদের মধ্যে বালাকোটের যুদ্ধ হয়েছিল।

বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমেদ পরাজিত ও নিহত হন।

৭৭. পাগলপন্থী বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

উত্তর:- পাগলপন্থী বিদ্রোহের কারণ ছিল ময়মনসিংহ জেলার গারোদের ওপর রাজস্ববৃদ্ধি, কোম্পানি কর্তৃক ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের ব্যয়ের অর্থ আদায়ের জন্য গারোদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি, জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার প্রভৃতি।

৭৮. ফরাজি আন্দোলন কি ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন?

উত্তর:- বাংলায় ইসলামের শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হওয়া ফরাজি আন্দোলনে মুসলিমদেরই সর্বাধিক অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। তাই একে মুসলিমদের ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন বলে উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে আন্দোলনে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজদের বিরোধিতার বিষয়টি আন্দোলনের রাজনৈতিক রূপটিকেও স্পষ্ট করে তোলে।

৭৯. সৈয়দ আহমেদের আদর্শ কী ছিল?

উত্তর:- সৈয়দ আহমেদ ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ অর্থাৎ ‘বিধর্মীর দেশ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে এদেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা পবিত্র ইসলামের দেশে পরিণত করার নির্দেশ দেন।

৮০. পাগলপন্থী কাদের বলা হয়?

উত্তর:- উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ফকির করিম শাহ (বা চাঁদ গাজী) ময়মনসিংহ জেলার সুসঙ্গপুর-শেরপুর অঞ্চলে গারোদের মধ্যে এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। এই ধর্মের অনুরাগীরা ‘পাগলপন্থী’ নামে পরিচিত।

৮১. ফরাজি ও ওয়াহাবি কথার অর্থ কী?

উত্তর:- ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ‘ইসলাম নির্ধারিত বাধ্যতামূলক কর্তব্য’ বা ‘আল্লাহর আদেশ’।

‘ওয়াহাবি’ কথার অর্থ হল ‘নবজাগরণ’।

৮২. কারা ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন এবং কারা এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন?

উত্তর:- দিল্লির মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-৬২ খ্রি.) এবং তাঁর পুত্র আজিজ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন। সৈয়দ আহমেদ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

৮৩. দুদু মিঞা স্মরণীয় কেন?

উত্তর:- দুদু মিঞা নানা কারণে স্মরণীয়। তিনি ছিলেন বাংলার ফরাজি আন্দোলনের প্রধান প্রবর্তক শরিয়ত উল্লাহর পুত্র এবং ফরাজি আন্দোলনের নেতা। তাঁর নেতৃত্বে উনবিংশ শতকে ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়।

৮৪. ‘এলাকা চাষ’ বা ‘নিজ-আবাদি’ চাষ বলতে কী বোঝ?

উত্তর:- নীলকররা জমিদারদের কাছ থেকে জমি কিনে বা ভাড়া দিয়ে তাতে ভাড়াটিয়া চাষিদের দিয়ে নীলচাষ করাত। এই পদ্ধতি ‘এলাকা চাষ’ বা ‘নিজ-আবাদি’ নামে পরিচিত।

৮৫. ফরাজি আন্দোলনে শরিয়ত উল্লাহর মতাদর্শ কী ছিল?

উত্তর:- ফরাজি আন্দোলনে শরিয়ত উল্লাহর মতাদর্শ ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হারব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে। এই বিধর্মীর দেশ মুসলিমদের বাসযোগ্য নয়। তিনি সব মুসলিমকে ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শগুলি মেনে চলার আহ্বান জানান। তিনি মুসলিমদের নির্দেশ দেন কোরানের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে কলমা, রোজা, হজ প্রভৃতি ধর্মাচরণ করতে।

৮৬. নীলকর কারা?

উত্তর:- উনিশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে আগত কিছু নীল ব্যবসায়ী বাংলা-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের চাষিদের ওপর তীব্র অত্যাচার চালায় এবং তাদের নীলচাষে বাধ্য করে। অত্যাচারী এই নীল ব্যবসায়ীরা নীলকর নামে পরিচিত।

৮৭. ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় প্রধানত কয়টি উপায়ে নীলচাষ হত?

উত্তর:- ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় প্রধানত দুটি উপায়ে নীলচাষ হত। ‘এলাকা চাষ’ বা ‘নিজ-আবাদি’ চাষ এবং ‘বে-এলাকা’ বা ‘রায়তি’ বা ‘দাদনী’ চাষ।

৮৮. ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত কার উদ্যোগে, কেন হয়েছিল?

উত্তর:- ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল হাজি শরিয়তের উদ্যোগে। ফরাজি আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণ হল আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশ-ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ বা ‘বিধর্মীর দেশ’ থেকে ‘দার-উল- ইসলাম’ বা ‘ইসলামের পবিত্রভূমি’-তে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। জমিদার ও নীলকরদের শোষণের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল।

৮৯. দাদনী বা বে-এলাকা চাষ বলতে কী বোঝ?

উত্তর:- উনিশ শতকে বাংলার নীলকর সাহেবরা বেশিরভাগ সময় দরিদ্র চাষিদের অগ্রিম টাকা দাদন দিয়ে চাষির নিজের জমিতে তাকে নীলচাষে বাধ্য করত। চাষের এই পদ্ধতি ‘দাদনী’ বা ‘বে-এলাকা চাষ’ বা ‘রায়তি’ নামে পরিচিত ছিল।

৯০. নীল বিদ্রোহের কয়েকজন বিখ্যাত নেতার নাম লেখো।

উত্তর:- নীল বিদ্রোহের কয়েকজন বিখ্যাত নেতা ছিলেন কৃষ্ণনগরের দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, আসাননগরের মেঘাই সর্দার, পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, খুলনার কাদের মোল্লা, মালদহের রফিক মণ্ডল, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার, বিশ্বনাথ সর্দার (‘বিশে ডাকাত’ নামে পরিচিত) প্রমুখ।

৯১. নীলকররা নীলচাষিদের ওপর কীভাবে অত্যাচার করত তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তর:- নীলকররা চাষিদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার করত। যেমন – তারা চাষিদের অন্যান্য শস্যের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করত। নীলচাষে রাজি না হলে চাষিদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার শুরু হত। চাষিকে হত্যা, বেঁধে রাখা, প্রহার করা, বাড়িতে আগুন লাগানো, গোরুবাছুর ছিনিয়ে নেওয়া, স্ত্রী-কন্যাকে লাঞ্ছনা প্রভৃতি শাস্তি দেওয়া হত।

৯২. নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা কীরূপ ছিল?

উত্তর:- বাংলায় সংঘটিত নীল বিদ্রোহে ইউরোপ থেকে ভারতে আগত খ্রিস্টান মিশনারিদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই বিদ্রোহের সময় তারা নীলচাষিদের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানায়। তারা নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও শোষণের চিত্র স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে তুলে ধরে। তারা উপলব্ধি করে যে, নীলচাষিদের দুর্দশা দূর করার জন্য তাদের মধ্যে উন্নত ‘খ্রিস্টান শিক্ষা’ ও গণশিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিশনারি জেমস লঙ নীলকরদের তীব্র সমালোচক ছিলেন।

৯৩. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কে ছিলেন?

উত্তর:- হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক। তিনি তাঁর পত্রিকায় বাংলার চাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। তিনি দরিদ্র নীলচাষিদের নানাভাবে সহায়তা করেন।

৯৪. দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস কে ছিলেন?

উত্তর:- কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী চৌগাছা গ্রামের বাসিন্দা দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিলেন বাংলার নীল বিদ্রোহের অন্যতম দুজন নেতা। তাঁরাই নীলচাষ বয়কট করে বিদ্রোহের সূচনা করেন। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ‘বাংলার ওয়াট টাইলার’ নামে পরিচিত হন।

৯৫. নীলচাষিদের আন্দোলনের পদক্ষেপগুলি কী ছিল?

উত্তর:- নীলচাষিদের আন্দোলনের বিভিন্ন পদক্ষেপ ছিল। প্রথমে চাষিরা তাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানায়। পরে চাষিরা নীলচাষ বয়কট করে। তারা তরবারি, বর্শা, লাঠি প্রভৃতি নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। চাষিরা নীলকুঠিগুলি আক্রমণ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে নীলকরদের আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়।

৯৬. কোন কোন পত্রিকায় নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশিত হত?

উত্তর:- ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, ‘সমাচার দর্পণ’, ‘তত্ত্ববোধিনী’ প্রভৃতি পত্রিকায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত।

৯৭. কৃষকদের পক্ষ নিয়ে কোন কোন জমিদার নীল বিদ্রোহে অংশ নেন?

উত্তর:- কৃষকদের পক্ষ নিয়ে নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়, সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য, রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চন্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায় প্রমুখ নীল বিদ্রোহে অংশ নেন।

৯৮. ‘তিন কাঠিয়া প্রথা’ বলতে কী বোঝ?

উত্তর:- নীলকর সাহেবরা বিহারের চম্পারণ জেলার কৃষকদের প্রতি বিঘা জমির ৩/২০ অংশে অর্থাৎ ৩ কাঠায় নীলচাষ করতে বাধ্য করত। প্রতি বিঘায় ৩ কাঠা জমিতে বাধ্যতামূলক এই চাষের প্রথা ‘তিন কাঠিয়া প্রথা’ নামে পরিচিত।

৯৯. বাংলায় নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে কোন নাটকটি রচিত হয়? এই নাটকটি কে রচনা করেন?

উত্তর:- বাংলায় নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০ খ্রি.) নাটকটি রচিত হয়।

এই নাটকটি রচনা করেন দীনবন্ধু মিত্র।

১০০. কারা, কী উদ্দেশ্যে ‘দি পাবনা রায়ত লিগ’ গঠন করে?

উত্তর:- পাবনা জেলায় অত্যাচারিত কৃষকরা ‘দি পাবনা রায়ত লিগ’ গঠন করে। ‘দি পাবনা রায়ত লিগ’ গঠন করার উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলাগুলি চালানো এবং জমিদারকে বেআইনি খাজনা দান বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

১০১. পাবনা বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

উত্তর:- পাবনা বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। কৃষকদের ওপর রাজস্বের বোঝা যথেষ্ট বাড়ানো হয়। কৃষকদের ওপর বিভিন্ন নতুন উপকর বসানো হয়। জমিদাররা জমি থেকে কৃষকদের ঘনঘন উচ্ছেদ করতে থাকে। বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কৃষকদের হয়রানি করা হয়।

১০২. নীলদর্পণ নাটক কে রচনা করেন? কে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন?

উত্তর:- নীলদর্পণ নাটকটি রচনা করেন খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র।

মাইকেল মধুসুদন দত্ত নীলদর্পণ নাটকটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment