2nd Semister: ভারতে মুসলমান শক্তির উত্থান : আরব ও তুর্কি আক্রমণ

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (মান – ২)

১। ভারতের কোন রাজাকে পরাজিত করে কে আরবীয় শাসন প্রবর্তন করেন?

উত্তর:- ভারতের সিন্ধুদেশের রাজা দাহিরকে পরাজিত করে আরবের শাসক হজ্জাজ-এর সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিম খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে সিন্ধুদেশে আরবীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

২। গজনীর সুলতান মামুদ কতবার ভারত আক্রমণ করেন?

উত্তর:- গজনীর সুলতান মামুদ ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন।

৩। সুলতান মামুদ ‘বাতশিকান’ উপাধি কেন গ্রহণ করেন?

উত্তর:- ভারত অভিযানে ধনসম্পদ লুণ্ঠনের সাথে সাথে সুলতান মামুদ বহু হিন্দু-মন্দির ও দেব-দেবীর মূর্তি ধ্বংস করেন এবং মূর্তিপূজা বিরোধী আদর্শ স্থাপন করেন। তাই তিনি ‘বাতশিকান’ বা ‘ধ্বংসকারী’ উপাধি গ্রহণ করেন।

৪। সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের নীতিগত পার্থক্য কি ছিল?

উত্তর:- সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের অতুল ধনসম্পদ লুণ্ঠন, হিন্দু মন্দির ও দেব-দেবীর মূর্তি ধ্বংস এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করা। স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার কোনরূপ ইচ্ছা তাঁর ছিল না। পক্ষান্তরে, মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করে নিজ শাসন প্রবর্তন করা।

৫। তরাইনের প্রথম যুদ্ধ কত সালে কাদের মধ্যে হয়েছিল?

উত্তর:- তরাইনের প্রথম যুদ্ধ হয় ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল চৌহানরাজ পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে উত্তর-ভারতের রাজপুত রাজাগণ এবং অপরদিকে ছিল মহম্মদ ঘোরীর মুসলমান বাহিনী। এই যুদ্ধে ঘোরী পরাজিত হন।

৬। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফল কি হয়েছিল?

উত্তর:- তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে চৌহানরাজ পৃথ্বীরাজ মহম্মদ ঘোরীর কাছে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে উত্তর-ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুসলিম শাসন কায়েম হয়।

৭। মহম্মদ ঘোরীর প্রধান অনুচর কে ছিলেন?

উত্তর:- মহম্মদ ঘোরীর প্রধান অনুচর ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবক। পরে ঘোরীর মৃত্যু হলে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন নিজেকে ‘স্বাধীন সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন এবং ভারতে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন।

৮। ভারতের সাথে যুক্ত মহম্মদ ঘোরীর প্রধান দুজন অনুচরের নাম উল্লেখ কর।

উত্তর:- ভারতের সাথে যুক্ত ঘোরীর প্রধান দু’জন অনুচর ছিলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এবং কুতুবউদ্দিন আইবক।

৯। ইয়ামিনি বংশ কিভাবে নাম হয়?

উত্তর:- গজনির শাসক মামুদকে তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ খলিফা আল-কাদির বিল্লাহ ‘ইয়ামিনউদ্দৌলা’ উপাধি দিয়েছিলেন। এরপর গজনির তুর্কি রাজবংশ ‘ইয়ামিনি বংশ’ নামে অভিহিত হতে থাকে।

১০। ভারতের বিরুদ্ধে সুলতান মামুদের প্রথম ও শেষ অভিযান কোনগুলি ছিল?

উত্তর:- সুলতান মামুদ ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান চালায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে শাহীরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে তার শেষ অভিযান ছিল সিন্ধুর জাঠ উপজাতির বিরুদ্ধে।

১১। ওয়েইহিন্দ-এর যুদ্ধ কী?

উত্তর:- গজনির সুলতান মামুদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে শাহীরাজ্যের রাজা আনন্দপাল গোয়ালিয়র, আজমির, কনৌজ, দিল্লী, কালিঞ্জর প্রভৃতি রাজপুত রাজ্যগুলির সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ওয়েইহিন্দ’-এর যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রজোট মামুদের কাছে পরাজিত হয়।

১২। সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের মৌলিক লক্ষ্য কী ছিল?

উত্তর:- ভারতের বিপুল সম্পদ সম্পর্কে সুলতান মামুদ অবহিত ছিলেন। তাই ভারত-অভিযান করে এদেশ থেকে অর্থ-সম্পদ সংগ্রহ করে মধ্য-এশিয়ায় গজনীর শক্তিবৃদ্ধি করাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।

১৩। ‘… a bandit operating on a large scale’-কার সম্পর্কে, কে এই উক্তি করেছেন?

উত্তর:- গজনির সুলতান মামুদের ভারত-অভিযান ও লুণ্ঠনের প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ এই উক্তি করেছেন।

১৪। কোন খলিফার আমলে আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করেছিল? খলিফা কোন বংশের মানুষ ছিলেন?

উত্তর:- খলিফা ওয়ালিদ মালিকের অনুমতিক্রমে আরবরা সিন্ধু অভিযান চালায়। খলিফা ওয়ালিদ মালিক উমায়েদ বংশোদ্ভূত ছিলেন।

১৫। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ আছে এমন দুটি গ্রন্থের নাম লেখ।

উত্তর:- বিলাদুরির গ্রন্থ ‘অল-বিলাদুরি’ এবং সিন্ধুর রাজা চাচের নামাঙ্কিত ‘চাচনামা’ গ্রন্থ দুটি থেকে আরবদের সিন্ধু অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায়।

১৬। ভারতে আরব শাসনের স্বল্প স্থায়িত্বের দু’টি কারণ উল্লেখ কর।

উত্তর:- সিন্ধুদেশেই আরবদের শাসন সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সেখানেও তারা দীর্ঘকাল শাসন কায়েম রাখতে পারেনি। এর দু’টি কারণ হল – (১) আরবদেশে ওমায়েদ ও আব্বাসিদ খলিফা বংশের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং (২) ভারতে রাজপুত জাতির ক্ষমতাবৃদ্ধি ও বিরোধীতা।

১৭। আরব শিক্ষার্থীরা ভারত থেকে কোন দু’টি গ্রন্থ স্বদেশে নিয়ে গিয়ে আরবিতে ভাষান্তরিত করেন?

উত্তর:- আরব শিক্ষার্থীরা ভারত থেকে ব্রহ্মগুপ্ত রচিত ‘ব্রহ্মসিদ্ধান্ত’ ও ‘খণ্ড-খাদ্যক’ গ্রন্থদুটি আরবে নিয়ে গিয়ে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।

১৮। ‘গাজী’ কাদের বলা হত ?

উত্তর:- তুর্কীদের মধ্যে একদল মানুষ একই সাথে ধর্ম-প্রচার ও ইসলামের রক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। এই সকল যোদ্ধা ধর্মপ্রচারকগণ ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হন। ইসলাম ধর্ম রক্ষায় এঁদের অবদান অসীম।

১৯। ‘অনহিলবারার যুদ্ধ’ সম্পর্কে কী জানো?

গজনির শাসক মহম্মদ ঘোরী ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। মাউন্ট আবুর নিকট অনহিলবারা নামক স্থানে সংঘটিত এই যুদ্ধে গুজরাট-রাজ ভীমদেব মহম্মদ ঘোরীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।

২০। তরাইনের কোন যুদ্ধকে ‘জলবিভাজিকা’ বলা হয় এবং কেন?

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি নেতা মহম্মদ ঘোরী এবং দিল্লীর রাজপুত শাসক পৃথ্বীরাজের মধ্যে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধকে ভারত ইতিহাসের জলবিভাজিকা বলা হয়।

তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধকে ‘জলবিভাজিকা’ বলার কারণ হল এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ঘোরী ভারতে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। এর ফলে ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আসে।

২১। কোন্ তুর্কীযোদ্ধা, কাকে পরাজিত করে বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিলেন?

মহম্মদ ঘোরীর অনুচর ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে (১২০৩-৪ খ্রিঃ) বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন।

২২। কোন দুটি গ্রন্থ থেকে ইতিয়ারউদ্দিনের নদীয়া বিজয়ের কাহিনী জানা যায়?

মিনহাজউদ্দিন সিরাজ-এর ‘তবকৎ-ই-নাসিরী’ এবং মহম্মদ ইসামীর ‘ফুতুহ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থ থেকে ইতিয়ারউদ্দিনের নদীয়া বিজয়ের কাহিনী জানা যায়। তবে গ্রন্থ দুটি ঘটনার পঞ্চাশ ও একশো বছর পরে লেখা হয়েছে। তাই বিবরণের সত্যতা সন্দেহাতীত নয়।

২৩। অলবেরুণী কখন ভারতে আসেন? তার রচিত গ্ৰন্থের নাম কি?

সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণকালে তাঁর সঙ্গী হয়ে অলবেরুণী ভারতে আসেন।

অলবেরুণী রচিত গ্ৰন্থটি হল ‘তহকিক-ই-হিন্দ’।

২৪। কে ‘ভারতের তোতাপাখি’ নামে পরিচিত? তার দুটি গ্ৰন্থের নাম লেখ।

আমীর খসরু ‘ভারতের তোতাপাখি’ নামে পরিচিত।

আমীর খসরু রচিত দুটি গ্ৰন্থ হল ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’ ও ‘তুঘলকনামা’।

২৫। ‘তারিখ-ই-ফিরোজসাহী’ গ্রন্থ কে রচনা করেন?

‘তারিখ-ই-ফিরোজসাহী’ গ্রন্থ রচনা করেন জিয়াউদ্দিন বরণী।

২৬। আরবরা কত খ্ৰিস্টাব্দে সিন্ধু জয় করেন? সিন্ধুরাজ দাহির কোন আরব সেনাপতির কাছে পরাজিত হন?

আরবরা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু জয় করেন।

সিন্ধুরাজ দাহির আরব সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিমের কাছে পরাজিত হন।

২৭। তুর্কি উপজাতির আদি বাসস্থান কোথায়? কোন যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তুর্কিরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখে?

তুর্কি উপজাতির আদি বাসস্থান ছিল মধ্য প্রাচ্যের জঙ্গলাকীর্ণ আনাতোলিয়া অঞ্চল।

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তুর্কিরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখে

২৮। কোন খলিফা বংশের আমলে তুর্কিরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে? ভারতে কোন রাজ্যের বিরুদ্ধে তুর্কিরা প্রথম অভিযান চালায়?

আব্বাসিদ খলিফা বংশের আমলে তুর্কিরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত শাহী রাজ্যের বিরুদ্ধে তুর্কিরা প্রথম অভিযান চালায়।

২৯। স্বাধীন গজনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে? কোন তুর্কি সেনাপতি সর্বপ্রথম ভারতে অভিযান করেন?

স্বাধীন গজনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন তুর্কি ক্রীতদাস আলপ্তগীন।

আলগুগিনের বংশধর পিরাই সর্বপ্রথম ভারতে অভিযান করেন।

৩০। গুজরাটের কোন বিখ্যাত মন্দির গজনীর মামুদ ধ্বংস করেন? এই সময় গুজরাটের রাজা কে ছিলেন?

গুজরাটের বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেন গজনীর সুলতান মামুদ।

সুলতান মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠনের সময় গুজরাটের রাজা ছিলেন সোলাঙ্কি বংশের প্রথম ভীম।

৩১। সুলতান মামুদ কোন দুটি ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করেছিল?

হিন্দুশাহী বংশকে পরাজিত করে পাঞ্জাব অঞ্চল এবং কার্মাথীয় শাসক ফতে দাউদকে পরাজিত করে মুলতান রাজ্য – এই দুই ভারতীয় ভূখণ্ড মামুদ অধিকার করেছিলেন।

                 সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (মান)

১‌। জিয়াউদ্দিন বরণী কে ছিলেন? তার সম্পর্কে কি জান?

তুর্কো-আফগান যুগে ভারতের ইতিহাস রচনার অন্যতম প্রধান সূত্র ছিল ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ নামক একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী।

তুর্কীস্তানের এক অভিজাত পরিবারে জিয়াউদ্দিন বরণীর জন্ম হয়। তিনি তুঘলকবংশীয় সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক ও ফিরোজশাহ তুঘলকের আমলে উচ্চ রাজপদে আসীন ছিলেন। ফলে সকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্বন্ধে তাঁর রচিত গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। তাঁর সৎ ও নির্ভীক ইতিহাস-চেতনা সম্বন্ধে সামসুল হক মন্তব্য করেন যে, “মধ্যযুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে বরণী ছিলেন সর্বাপেক্ষা সৎ, নিরপেক্ষ ও সাহসী লেখক, যিনি সত্য প্রকাশের কাজে ছিলেন নির্ভীক এবং ক্ষমতাবানের সমালোচনাতেও সোচ্চার।”

বরণীর বিবরণ থেকে মূলত তুঘলক বংশের ইতিহাস ও সমকালীন পরিস্থিতি জানা যায়। তার প্রয়োজনীয় ঘটনাবলী প্রাধান্য পায় নি। সমালোচক হিসেবে তিনি ছিলেন স্পষ্ট ও নির্ভীক। উপযুক্ত শ্লেষাত্মক বাক্যের প্রয়োগে তিনি বিরূপ সমালোচনাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়, সে যুগে চাষীদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। রাজকর্মচারীরা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী। ধর্মনিরপেক্ষতা বা প্রজাহিতৈষণা সুলতানদের আকাঙ্ক্ষিত হলেও, স্বার্থান্ধ কর্মচারীদের জন্য তা সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হতে পারে নি। মহম্মদ তুঘলকের ব্যর্থতার নিন্দা বা ফিরোজের সংস্কার কার্যাদির প্রশংসা তিনি খোলা মনে লিপিবদ্ধ করেছেন।

২। অলবেরুণী সম্পর্কে কি জানো?

৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য-এশিয়ার অন্তর্গত খারাজিম রাজ্যের রাজধানী খিবাতে অলবেরুণীর জন্ম হয়। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে গজনীর সুলতান মামুদ তাঁকে সভাসদরূপে বরণ করেন। মামুদের ভারত আক্রমণকালে অলবেরুণী ভারতে আসেন। অন্যান্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী অলবেরুণী এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করে প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্য ও দর্শন পাঠ করেন এবং গভীর জ্ঞানলাভ করেন। ভারতবর্ষের ওপর লিখিত তাঁর গ্রন্থ ‘তহকিক-ই-হিন্দ’ থেকে এদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস রচনায় এটি একটি অমূল্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। লেখক হিসেবে তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও বলিষ্ঠ মানসিকতার পরিচয় এই গ্রন্থে পাওয়া যায়।

অলবেরুণী সুস্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করেছেন যে, সুলতান মামুদের আক্রমণের ফলে ভারতের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘Mahmud utterly ruined the prosperity of the country…..’ তাঁর বিবরণ থেকে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কথা জানা যায়। সারা উত্তর-ভারত জুড়ে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। এরা সর্বদাই ছিল বিবাদমান। ফলে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো পরিকল্পনা তারা নিতে পারে নি। উপরন্তু বহির্জগত থেকে এরা ছিল বিচ্ছিন্ন এবং নিজেদের সম্পর্কে ছিল অনর্থক উচ্চ ধারণা।

ভারতীয় সমাজ ছিল অসাম্য ও বৈষম্যে ভরা। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি নানান কুসংস্কারে জনজীবন ছিল জর্জরিত। নারীরা ছিলেন অবহেলিত। ব্রাহ্মণদের দাপট ছিল অপ্রতিরোধ্য। ধর্মভাবনা ছিল গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে বহিড়াম্বর ও আচার-অনুষ্ঠানের কঠোরতা ধর্মকে গ্রাস করেছিল। বহু ঈশ্বরবাদ ছিল সাধারণভাবে প্রচলিত, তবে পণ্ডিতেরা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।

অলবেরুণী ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বিচারে সমতার নীতি অনুসৃত হত না। ব্রাহ্মণশ্রেণি বিচারের ক্ষেত্রেও অধিক সুবিধা ভোগ করত। তাই কোনো কারণেই তাদের প্রাণদণ্ড দেওয়া যেত না, যদিও প্রাণদণ্ডের শাস্তি স্বীকৃত ছিল। ফৌজদারী বিচারব্যবস্থা ছিল মানবোচিত। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হত। অবশ্য মৌখিক অভিযোগও বিচারের জন্য গৃহীত হত। প্রাণদণ্ড ছাড়া জরিমানা, বেত্রাঘাত, অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি শাস্তিস্বরূপ দেওয়া হত।

                 রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর (মান১০)

১। ভারতে মুসলমান অভিযানের প্রাক্কালে উত্তর-ভারতের সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও।

ভারতবর্ষে মুসলমানদের আক্রমণ এবং ক্ষমতাদখলের ফলে এ দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু প্রাক-মুসলমান পর্ব এবং মুসলমান-শাসন পর্বের সূচনাকালে এদেশের প্রচলিত সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মবিশ্বাস স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর ছিল। আলোচ্য পর্বকে মোটামুটিভাবে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক (৮০০-১২০০ খ্রিঃ) পর্যন্ত সময়কালে নির্দিষ্ট করা যায়। তবে ইতিহাসের গতি যুগ থেকে যুগান্তরে এগিয়ে চলে একটা ন্যূনতম ধারাবাহিকতার মাধ্যমে। কখনোই দুটো অধ্যায়কে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। দুটো পর্বের মধ্যে যেমন নতুন ও পুরাতন ভাবধারার সংমিশ্রণ থাকে, তেমনি প্রতিটি পর্বের প্রকৃতির মধ্যে স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যও লক্ষ্য করা যায়।

আলোচ্য সময়ে উত্তর ভারত তথা ভারতীয় সমাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অভ্যুদয়। সামন্ত, উপসামন্ত, রানক, রাউণ্ডা ইত্যাদি নামে পরিচিত শ্রেণি সমাজ ও রাজনীতিতে ছিল প্রভূত ক্ষমতার ও প্রতিপত্তির অধিকারী। এই শ্রেণির উৎপত্তি হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। যেমন – উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, বশ্যতা স্বীকার করে স্বপদে বহাল থাকা কিছু রাজা, বংশগতভাবে প্রতিষ্ঠিত কিছু পরিবার বা দক্ষ সামরিক নেতা এবং উপজাতীয় গোষ্ঠী বা নায়কদল ইত্যাদি। এঁদের প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী ছিলেন। তবে এইসব সামন্ত-প্রভুর অবস্থা এক ধরনের ছিল না। তবে একটি বিষয়ে এদের মিল ছিল। অর্থাৎ এঁরা কেউই উৎপাদনে কায়িক শ্রম দিতেন না, কিন্তু জমির উৎপাদনজনিত আয় থেকেই এঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন।

দীর্ঘকাল প্রচলিত বর্ণবিভাগ ছিল সমাজের ভিত্তি। নিম্নবর্ণের পক্ষে প্রযোজ্য বিধিনিষেধ এই যুগে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমসাময়িক লেখকদের বিবরণে কামার, কুমোর, তাঁতি, স্বর্ণকার, গায়ক, শিকারী, জেলে, নাপিত প্রভৃতি বহুজাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে, “এদের কয়েকটি ছিল কর্মীসংঘ। এই কর্মীসংঘই এখন জাতি শ্রেণিভুক্ত হয়েছে।” এই সময়ে রাজপুত নামে একটি নতুন জাতি উত্তর ভারতে প্রাধান্যলাভ করেছিল। রাজপুতদের উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মতভেদ আছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, বিভিন্ন রাজপুত গোষ্ঠী বিভিন্ন বংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বহিরাগত সিথিয়ান বা হুনদের কিছু বংশধর রাজপুত নামে পরিচিত হয়েছে। স্থানীয় উপজাতি থেকেও এদের উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়। কালক্রমে এরা ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা অর্জন করেছে।

সম্ভবত তখন বর্ণভেদ থাকলেও, জাতিভেদের কঠোরতা ছিল না। যে-কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উচ্চবর্ণে উন্নীত হতে পারত। অবশ্য তাদের পতনের সম্ভাবনাও ছিল। এই যুগেই নতুন বর্ণ হিসেবে কায়স্থদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত ব্রাহ্মণ ও শূদ্রসহ বিভিন্ন জাতির যে সকল লোক রাজকীয় সংস্থায় কাজ করত তাদের কায়স্থ বলা হত। পরে একটি পৃথক জাতি হিসেবে কায়স্থদের পৃথকীকরণ হয়। এই যুগে হিন্দুধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ভারতীয় ধর্ম-সম্প্রদায় ও দেশীয় উপজাতি সহ বহু বিদেশী আশ্রয় লাভ করে। এদের সংমিশ্রণে বহু নতুন জাতি ও শাখাজাতি গড়ে ওঠে।

সমাজে আর্থিক বৈষম্য তখনও বজায় ছিল। হস্তশিল্পীদের নীচু বর্ণভুক্ত বলা হলেও সেকালে হস্তশিল্পের মান ছিল খুব উন্নত। বিদেশী পর্যটকদের বিবরণী থেকে বোঝা যায়, জমি ছিল উর্বর এবং কৃষকেরা ছিল খুবই দক্ষ। তথাপি হস্তশিল্পী ও কৃষকদের আর্থিক সাচ্ছল্য ছিল না। দেশের অধিকাংশ সম্পদ সঞ্চিত ছিল উচ্চপদস্থ আমলা, সামন্ত-প্রভু ও ব্যবসায়ীদের হাতে। সাধারণ মানুষ কোনরকমে গ্রাসাচ্ছাদন করত।

আগের মতোই পুরুষ ও নারী যথাক্রমে ধুতি ও শাড়ী পরত। তবে উত্তর-ভারতের পুরুষেরা ছোট এক ধরনের কোর্ট (জ্যাকেট) এবং মেয়েরা কাঁচুলি ব্যবহার করত। ধনী ব্যক্তিরা লম্বা কোট, পায়জামা ও জুতা ব্যবহার করত। সাধারণ মানুষ প্রধানত সুতীর বস্ত্র ব্যবহার করত। ধনীরা সিন্ধু ও সূক্ষ্ম মসলিন ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। স্ত্রী-পুরুষ সবাই সোনার বালা ও কানের দুল পরত। চীনা লেখক চৌ-জু-কুয়া লিখেছেন যে, গুজরাটের স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই আঁটসাঁট পোশাক, দুল, টুপি ও জুতা ব্যবহার করত।

সাধারণভাবে নিরামিষ খাদ্যগ্রহণ করা হত। তবে বছরের নির্দিষ্ট দিনে আমিষ ভক্ষণ স্বীকৃত ছিল। তবে তখন খাদ্য হিসেবে গমের প্রচলন ছিল না এবং থাকলেও তা নীচু জাতির খাদ্য হিসেবে গৃহীত হত। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল। আমোদ-প্রমোদের মাধ্যম হিসাবে দলবদ্ধ সাঁতার, পশু-পাখীর লড়াই, মুষ্টিযুদ্ধ, পাশাখেলা, শিকার যাত্রা ইত্যাদি প্রচলিত ছিল।

শিক্ষাদানের মূল দায়িত্ব ছিল পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের ওপর। তবে শিক্ষা গণমুখী ছিল না। শিক্ষাদানের বিনিময়ে গুরুমশায়রা বেতন বা দান গ্রহণ করতেন। কারিগরি শিক্ষাদানের দায়িত্ব ছিল বণিক সংঘ বা কারিগর পরিবারের হাতে। শিক্ষাদানের কেন্দ্র হিসেবে বৌদ্ধবিহারগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নালন্দা, বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী মহাবিহার শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে এক অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল। দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষার্থী এই সকল কেন্দ্রে সমবেত হয়ে বৌদ্ধ দর্শন, অঙ্ক, জ্যোতিষ-শাস্ত্র, তর্কবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতেন।

মধ্য-এশিয়া থেকে আগত পণ্ডিত অলবেরুণী ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতদের বিজ্ঞান-বিমুখতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “ভারতীয় পণ্ডিতেরা ছিলেন উদ্ধত, নির্বোধ, দাম্ভিক, আত্মাভিমানী ও অবিচলিত। তাদের স্বভাব হল যে, তাঁরা তাদের অর্জিত জ্ঞান সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চাইতেন না, এই ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন কৃপণ । ”

২। ভারতে মুসলমান বিজয়ের প্রাক্কালে উত্তর-ভারতের অর্থনৈতিক ও ধর্মনৈতিক অবস্থার বিবরণ দাও ।

অষ্টম শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত সময়ে উত্তর-ভারতের অর্থনীতিতে গতিশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র একে ‘গতিরুদ্ধ জড়ত্বের আবেগ ও অবক্ষয়ের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থনীতির এহেন পশ্চাৎপদতার প্রধান কারণ হল ভারতীয় ব্যবসাবাণিজ্যের ক্রমাবনতি এবং জমির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা। জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পেলেও, উৎপাদন বৃদ্ধি পায় নি। একই সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার ফলে উত্তর ভারত শ্রীহীন হয়ে পড়ে।

ইতিপূর্বে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের সাথে ভারতের যথেষ্ট উন্নত ও লাভজনক ব্যবসা চালু ছিল। অনুকূল বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারতে আমদানি হত প্রভূত সোনা ও রূপা। ইসলামের ক্রমপ্রসারের ফলে পারস্যের সাথে ভারতের স্থলপথে চালু বাণিজ্যও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহির্বাণিজ্যে মুনাফার মাধ্যমে সোনা-রূপার আমদানি কমে যাওয়ায় ভারতে স্বর্ণমুদ্রার ঘাটতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। তবে দশম শতক থেকে আরবের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে উত্তর ভারতের অর্থব্যবস্থা নতুন জীবন লাভ করে। ভারতীয় বস্ত্র, সুগন্ধি দ্রব্য ও মশলা ধনী আরবদের বিক্রি করে প্রভৃত মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়।

আলোচ্যপর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এবং চীনে ভারতের বাণিজ্যধারা অব্যাহত ছিল। ভারত-চীন বাণিজ্যের প্রধান সমুদ্রবন্দর ছিল ক্যান্টন। একটি সমসাময়িক চৈনিক বিবরণী থেকে জানা যায় যে, তখন ক্যান্টন ভারতীয়, পারসিক ও আরবীয় জাহাজে পূর্ণ থাকত। 

তৎকালীন ভূমি ব্যবস্থার প্রকৃতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক। সামন্ত, রানক, রাউণ্ডা ইত্যাদি নামে পরিচিত এই সব সামন্ত নায়কদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সমান ছিল না। এদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ সর্বদা লেগে থাকত। ভূমির ওপর এঁদের ছিল সর্বময় অধিকার। ভূমি-রাজস্ব নিরূপণ ও সংগ্রহের সাথে সাথে সামন্তবর্গ নিজ নিজ এলাকার গুপ্ত ধনভাণ্ডার ও খনিজ সম্পদের অধিকারও দাবি করতেন। ভূস্বামীরা বংশ পরম্পরায় ভূমিস্বত্ব ভোগ করতেন এবং নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী নিজ ভূমির অংশ ইজারা দিতে পারতেন।

জনগণের জীবনযাত্রার মান সমান ছিল না। রাজপরিবার, উচ্চ-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সামন্ত-প্রভুদের জীবনযাত্রার মান ছিল যথেষ্ট উন্নত। এঁরা অত্যন্ত জাঁকজমক ও সমারোহের মধ্যে বাস করতেন। এঁরা প্রশস্ত ও সুনির্মিত প্রসাদসদৃশ গৃহে বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বাস করতেন। কিন্তু সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থা ছিল ঠিক বিপরীত। ছোট-ছোট কুঁড়েঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এদের থাকতে হত। খাদ্যদ্রব্য সস্তা হলেও বহু লোক দু’বেলা পেট ভরে খাদ্যগ্রহণ করতে পারত না। কৃষকদের ভূমিরাজস্ব ছাড়াও গোচারণ কর, পুষ্করিণী কর ইত্যাদি দিতে হত। সামন্ত-প্রভুদের গৃহে বেগার শ্রমদান ছিল বাধ্যতামূলক। এর ফলে দেশে প্রায়ই দুর্ভিক্ষ লেগে থাকত।

অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে উত্তর ভারতের ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পর্বে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ক্রমাবনতি লক্ষ্য করা যায়। এরই পাশাপাশি হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটে। তবে হিন্দুধর্মের দেব-দেবীর গুরুত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইতিমধ্যে বৌদ্ধধর্ম মূলত পূর্ব-ভারতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল এবং তার প্রধান তথা শেষ আশ্রয়স্থল ছিল পাল শাসনাধীন বাংলা। দশম শতকে পাল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধধর্মও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রেও বহু পরিবর্তন আনা হয়। হিন্দুধর্মের ‘পুরোহিতবাদ’ বা ‘দেবত্ববাদ’ এবং আচার-অনুষ্ঠানের প্রাবল্য ঘটে। ফলে প্রবল প্রতাপশালী হিন্দুধর্মের সামনে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে জৈনধর্মের প্রধান এলাকা ছিল পশ্চিম-ভারত। নবম ও দশম শতকে দক্ষিণ ভারতেও জৈনধর্ম বিশেষ প্রসারলাভ করে। এই সময়েই শ্রবণবেলগোলার বিখ্যাত জৈন-সাধুর বিশাল মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। কালক্রমে জৈন মতবাদের কঠোরতা, অত্যধিক কৃচ্ছসাধনের নির্দেশ এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের জন্য জৈন ধর্মমতের অবনতি ঘটে। হিন্দুধর্মের প্রসার লাভ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদের গুরুত্বের তারতম্য ঘটে। ব্রহ্মা, সূর্য প্রমুখ দেবতার পরিবর্তে শিব, বিষ্ণু প্রমুখ দেবতার পূজা প্রাধান্য পায়। একই সঙ্গে সৃষ্টির উৎস হিসেবে নারীশক্তির পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হিন্দুধর্মে কালী, দুর্গা, সরস্বতী এবং বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্বের সঙ্গিনী তারা দেবীর পূজা আরম্ভ হয়।

আলোচ্যকালে শংকরাচার্য হিন্দুদর্শনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সম্ভবত নবম শতকে কেরলে শংকরাচার্যের জন্ম হয়। কিন্তু জৈনদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি উত্তর-ভারতে চলে আসেন এবং নিজ মত প্রচার করেন। বহু হিন্দু-পণ্ডিতকে তিনি তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন। শংকরাচার্যের মতে, ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্ট জগৎ এক। মানুষ তার অজ্ঞানতার জন্যই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ লক্ষ্য করে। তাঁর মতে, মুক্তির প্রধান উপায় হল জ্ঞান। ‘বেদ’ই হল চরম জ্ঞানের প্রধান উৎস। শংকরাচার্যের এই মত ‘অদ্বৈতবাদ’ বা ‘দ্বিতীয় রহিতবাদ’ নামে পরিচিত।

সমকালীন ভারতবর্ষের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে দুই ধারায় হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটে। একদল বেদ ও বৈদিক পূজা-পদ্ধতির ওপর নতুনভাবে জোর দছন, অপর দল উত্তর ভারতে তন্ত্রসাধনা ও দক্ষিণ-ভারতে ভক্তিবাদের কথা বলেন। প্রথম দলের আন্দোলন ছিল গণমুখী। তত্ত্ব ও ভক্তি দুইই বর্ণবৈষম্য উপেক্ষা করে সকলের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রেখে দেয়।”

৩। আরবদের সিন্ধু আক্রমণ সম্বন্ধে বর্ণনা কর।

আরবদের সিন্ধু আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর ভারতে একাধিক ক্ষুদ্র ও অসংহত রাজ্য গড়ে উঠেছিল। অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে হিমালয়ের পাদদেশে বৃহৎ রাজ্য বলতে ছিল আফগানিস্তান, নেপাল ও কাশ্মীর। এদের মধ্যে কাশ্মীর রাজ্য ললিতাদিত্যের রাজত্বকালে (৭২২-‘৫৫ খ্রিঃ) যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। প্রায় একই সময়ে যশোধর্মনের নেতৃত্বে কনৌজও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও সামরিক শক্তিতে যথেষ্ট বলীয়ান হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ‘মাৎস্যন্যায়’ (অরাজকতা) অব্যাহত ছিল। পরে পালবংশের নেতৃত্বে ঐ অঞ্চলে কিছুটা সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের কামরূপ রাজ্য ছিল খুবই দুর্বল ও গুরুত্বহীন। উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধুরাজ্য ছিল দাহির নামক জনৈক রাজার শাসনাধীন।

উত্তর-ভারতের মতো দক্ষিণ ভারতেও একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল। এদের মধ্যে চোল, চের, পাণ্ড্য, পল্লব, রাষ্ট্রকূট, চালুক্য প্রভৃতি রাজ্য ছিল উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যেও কোনো সদ্ভাব ছিল না এবং পারস্পরিক সংঘাত ছিল নিত্যকার ঘটনা। এইভাবে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতাবাদের প্রাবল্যের অনিবার্য ফলস্বরূপ ভারতে কেন্দ্রীয় শক্তি বলে কিছুই ছিল না। এইরূপ বিচ্ছিন্নতার মুহূর্তে আরবদেশ সিন্ধু আক্রমণ করে খুব সহজেই কর্তৃত্বস্থাপনে সক্ষম হয়।

আরবদেশ সিন্ধু আক্রমণের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরা একাধিক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এ. এল. শ্রীবাস্তবের মতে, আরবদের সিন্ধু-আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের বিস্তার। আবার ঐতিহাসিক আর্নল্ড (Arnold) প্রমুখের মতে, ভারতের সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল আরব-আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য। পরে ভারতে তারা রাজ্যস্থাপনে উদ্যোগী হয়।

যাই হোক, অষ্টম শতকের প্রারম্ভে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিন্ধুর বিরুদ্ধে আরবদের আক্রমণ ঘটে। সিংহলের রাজা পারস্যের শাসনকর্তা হজ্জাজের কাছে উপঢৌকন স্বরূপ কিছু দ্রব্য ও রমণী একটি জাহাজে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সিন্ধুদেশের ‘দেবল’ বন্দরে জাহাজটি জলদস্যুদের দ্বারা লুন্ঠিত হয়। ফলে হজ্জাজ সিন্ধুরাজের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু দাহির তা দিতে অস্বীকার করলে ক্ষুব্ধ হজ্জাজ সিন্ধু আক্রমণ করেন।

প্রথমে ‘ওবেদুল্লা’ পরে ‘বুদাইল’ নামক দুই সেনাপতির নেতৃত্বে প্রেরিত আরবদের দুই অভিযানই ব্যর্থ হয়। এরপর ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ-বিম-কাশিমের নেতৃত্বে তৃতীয় অভিযান প্রেরিত হয়। কাশিম বিনা বাধায় দেবল বন্দর দখল করে বহু সিন্ধুবাসীকে হত্যা করেন। অতঃপর আরবরা নিপুণ ও সেওয়ান দখল করে। এই সময়ে রাজা দাহিরের অযোগ্যতা ও আরবদের মিত্রতাপূর্ণ ব্যবহারের ফলে বহু দেশীয় সামন্ত ও সাধারণ মানুষ আরবদের পক্ষ অবলম্বন করে। ইতিমধ্যে দাহির রাওর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরববাহিনী রাওর আক্রমণ করলে দাহির যুদ্ধ শুরু করেন এবং নিহত হন। এরপর তাঁর পুত্র জয়সিংহ বিক্রমের সাথে আরবদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। কিন্তু তিনিও পরাজিত হয়ে রাওর ত্যাগ করে পলায়ন করেন। এরপর কাশিম ব্রাহ্মণাবাদ ও মুলতান দখল করে বিজিত অঞ্চলে স্বশাসন প্রবর্তন করেন।

৪। ভারতে আরব আক্রমণের ফলাফল উল্লেখ কর।

ভারতের সিন্ধু প্রদেশ দখল করে আরবরা ইসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। অবশ্য প্রচলিত কিছু ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করে। আরব শাসনাধীনে সিন্ধুদেশকে কয়েকটি জেলা বা ইকতায় বিভক্ত করা হয়। প্রতি জেলায় একজন করে আরবীয় শাসক নিযুক্ত ছিলেন। স্থানীয় শাসনভার সিন্ধুবাসীদের হাতেই ন্যস্ত ছিল। সরকারি কর্মচারী ও সৈন্যরা নগদ অর্থের পরিবর্তে জায়গির ভোগ করত। হিন্দু শাসনকালের বহু আইন আরব শাসনকালেও প্রচলিত ছিল। রাজস্ব নির্ধারণে কোরানের নির্দেশ পালিত হত। ভূমিকর ও অ-মুসলমানদের কাছ থেকে আদায়ীকৃত জিজিয়া কর ছিল রাজস্বের প্রধান উৎস। বিচারকার্য পরিচালনা করতেন বিভিন্ন স্তরের প্রশাসকরা। তবে বড় বড় শহরে কাজী বিচার করতেন।

এই সময়ে অন্য ধর্মাবলম্বী বহু ব্যক্তি ইসলামধর্ম অবলম্বন করলেও তখন ধর্মপালনের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। অ-মুসলমান নাগরিকদের নানাপ্রকার বোঝা বহন করতে হত। বহিরাগত মুসলমানদের তিনদিন ভরণপোষণ, জিজিয়া কর প্রদান ইত্যাদি তাদের মেনে নিতে হয়েছিল। বিচারের ক্ষেত্রেও মুসলিম আইন অনুসৃত হত। আইনের সাম্য স্বীকৃত ছিল না। জিজিয়া কর আদায় প্রসঙ্গে ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন, “The Jizya was always exacted with rigour and punctuality and frequently with insult.”

সিন্ধুদেশে আরব-আক্রমণের ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঐতিহাসিক স্টেনলী লেন্‌পুল একে ‘সম্পূর্ণ ফলবিহীন এক ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর ভাষায়, “It (Arab invasion) was an episode in the history of India and of Islam, a triumph without result.

ভারতে আরব কর্তৃত্ব মূলত সিন্ধুদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল। মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে হিন্দু-শাসিত রাজ্যগুলি থেকে সিন্ধু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কুচ, রাজস্থান, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে অভিযান চালালেও শেষ পর্যন্ত আরবরা ঐসব অঞ্চল দখলে ব্যর্থ হয়েছিল। সীমিত অঞ্চলে বিস্তৃত এবং স্বল্পস্থায়ী হওয়ার ফলে ভারতে আরব-আক্রমণের রাজনৈতিক ফল ছিল শূন্য।

তবে উভয় দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরব আক্রমণের কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন, “A great many elements of Arabian culture which afterwards had such a profound effect upon European civilisation, were borrowed from India.” ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে আরবরা প্রভাবিত হয়। হিন্দুদর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র, শিল্পরীতি, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি বহু বিষয়ে আরবরা জ্ঞান লাভ করে এবং নিজ দেশে তা প্রচার করে। খলিফা মনসুরের আগ্রহে ‘ব্রহ্মসিদ্ধান্ত’ ও ‘খণ্ডখাদ্যক’ নামে সংস্কৃত গ্রন্থদ্বয় আরবী ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। খলিফা হারুনের আমন্ত্রণে বহু ভারতীয় পণ্ডিত আরবদেশে গমন করেছিলেন।

৫। সুলতান মামুদ-এর ভারত অভিযান সম্পর্কে আলোচনা কর।

সুলতান মামুদ ছিলেন গজনী রাজ্যের শাসক। ১০০০-১০২৭ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে সুলতান মামুদ সতেরো বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ভারতে মুসলমান আধিপত্য বিস্তারে সুলতান মামুদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মামুদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সামানিদ বংশীয় শাসকদের ক্রীতদাস ও কর্মচারী। ট্রান্স-অক্সিয়ানা, খোরাসান ও পারস্যের খানিকটা অঞ্চলে সামানিদ বংশের শাসন প্রচলিত ছিল। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তুর্কী ক্রীতদাস আলপ্তগীন সামানিদ বংশের দুর্বলতার সুযোগে আফগানিস্তানের অন্তর্গত গজনীতে স্বাধীন তুর্ক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। গজনীর পরবর্তী শাসক সবুক্তগীন একাধিকবার ভারত আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। পরবর্তী শাসক মামুদ পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন।

পিতা সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হত্যা করে মামুদ গজনীর সিংহাসন দখল করেন। সিংহাসনলাভের অল্পকালের মধ্যে তিনি নিজ দক্ষতার পরিচয় দেন। মামুদের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে খালিফা তাকে ‘আমিনুলমিলাত’ ও ‘ইয়ামিনউল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এইজন্য তাঁর বংশ ‘ইয়ামিন’ বংশ নামেও পরিচিতি লাভ করে। মামুদ ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা ও উচ্চাভিলাষী। সামরিক দক্ষতা ও ধর্মান্ধতা তাঁকে করে তুলেছিল দুর্ধর্ষ। সীমান্তদেশ ভারতের অতুল ধনসম্পদ লাভের ইচ্ছা এবং বিধর্মী হিন্দুদের ধ্বংস সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি বারবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ভারতের ওপর।

সুলতান মামুদ কতবার ভারত-আক্রমণ করেছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে অধিকাংশের মতে, ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি মোট সতেরো বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে মামুদ প্রথম ভারত আক্রমণ করেন। তবে ঐ বছর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী কয়েকটি দুর্গ দখল করে তিনি ফিরে যান। কিন্তু পরের বছর শাহীরাজ্য আক্রমণ করে জয়পালকে পরাজিত ও বন্দী করেন। জয়পাল প্রচুর অর্থ ও রাজ্যের কিয়দংশ দান করে মামুদের নিকট বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু পরাজয়ের এই গ্লানি সহ্য করতে না পেরে পুত্র আনন্দ পালের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি আত্মহত্যা করেন।

মামুদের তৃতীয় আক্রমণ ঘটে ১০০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে। প্রথমে তিনি ঝিলম নদীর তীরস্থ ভীর রাজ্য দখল করেন। তারপর মুলতান আক্রমণ করেন। মুলতানের শাসক দাউদ বাৎসরিক কর প্রদানের শর্তে মামুদের সাথে সন্ধি স্বাক্ষর করেন। মামুদের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য আক্রমণ ঘটে আনন্দ পালের বিরুদ্ধে (১০০৮-০৯ খ্রিঃ)। মামুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে আনন্দ পাল উত্তর ভারতের হিন্দু-রাজাদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। কনৌজ, দিল্লী, আজমীর, গোয়ালিয়র প্রভৃতি রাজ্য আনন্দ পালের সাহায্যে অগ্রসর হলেও, শেষ পর্যন্ত মামুদ জয়লাভ করেন। ফলে সিন্ধুনদ থেকে নগরকোট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল মামুদের হস্তগত হয়। এই সময় ‘কাংড়া দুর্গ’ লুণ্ঠন করে মামুদ প্রচুর ধনরত্ন স্বদেশে নিয়ে যান।

১০১৪ খ্রিস্টাব্দে মামুদ থানেশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং জয়লাভ করে এখান থেকেও প্রচুর ধনরত্ন লুণ্ঠন করে গজনীতে নিয়ে যান। আনন্দ পালের পুত্র ত্রিলোচন পাল মুসলিম ভীতি ত্যাগ করে হিন্দুদের শক্তিবিস্তারে অগ্রসর হলে মামুদ ১০১৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শাহীরাজ্য আক্রমণ করেন। তবে মামুদ জয়লাভ করলেও তাঁর প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোচন নিজ কর্তৃত্ব বিস্তার করেন। ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে মামুদ আবার আক্রমণ ঘটিয়ে পাঞ্জাবকে পদানত করতে ব্যর্থ হন। অবশেষে ত্রিলোচন পালের মৃত্যুর পর ১০২১ খ্রিস্টাব্দে মামুদ পাঞ্জাব অধিকার করতে সমর্থ হন।

অতঃপর মামুদ গঙ্গা-যমুনার উপত্যকা অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনে অগ্রসর হন। প্রথমে তিনি মথুরা ও পরে কনৌজ আক্রমণ করেন। এই দুই স্থানেই প্রায় বিনা বাধায় তিনি অপরিমিত ধনৈশ্বর্য লুণ্ঠন করেন। পরের বছর সুলতান মামুদ চান্দেল্লরাজ গণ্ডাকে পরাজিত করে প্রভূত পরিমাণ ধনরত্ন লাভ করেন।

সুলতান মামুদের ভারতীয় অভিযানসমূহের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল কাথিয়াবাড়ে অবস্থিত সোমনাথ মন্দির আক্রমণ ও লুণ্ঠন। এই মন্দির বিধ্বস্ত ও লুণ্ঠন করে তিনি প্রায় দুই কোটি স্বর্ণমুদ্রা ও প্রভূত স্বর্ণালংকার দখল করেছিলেন। ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে মামুদের সর্বশেষ অভিযান ছিল জাঠদের বিরুদ্ধে। অবশেষে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে গজনীতে মামুদ মারা যান।

৬। সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের ফলাফল বর্ণনা কর।

সুলতান মামুদ বারবার ভারত আক্রমণ করলেও, ভারত-ইতিহাসে এই আক্রমণের কোনো স্থায়ী প্রভাব ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না। একমাত্র মুলতান ও পাঞ্জাব ছাড়া অন্য কোনো ভারতীয় অঞ্চল তিনি গজনীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন নি। ইরফান হাবিবের মতে, দুর্ধর্ষ রাজপুত জাতিকে পদানত করা অসম্ভব বিবেচনা করেই মামুদ স্থায়ী রাজ্যগঠনে উদ্যোগী হন নি। তাছাড়া, মধ্য-এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য তিনি এত বেশি বিচলিত ছিলেন যে, ভারতে স্থায়ী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করার উৎসাহ পান নি।

কেউ কেউ মনে করেন, ইসলামধর্ম প্রচার করাই ছিল মামুদের ভারত অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য। একথা সত্য, কোনো কোনো বিজিত অঞ্চলে অন্য ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। এমনকি ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপরেও ইসলামের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নি।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, ভারতের অতুল ধনসম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল মামুদের ভারত-অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। ড. স্মিথ মামুদকে ‘লুণ্ঠনকারী দস্যু’ বলে বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের ভাষায়, “All that Mahmud wanted was the vast wealth which India possessed, and when it was obtained, he returned to Ghazni, unmindful of annexation or permanent conquest.”

মামুদের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফল অকিঞ্চিৎকর হলেও, কিছু পরোক্ষ প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্রের মতে, মামুদ বারবার ভারত আক্রমণ করে এদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাকে চুরমার করে দিয়েছিলেন। ফলে পরবর্তীকালে ঐ পথ ধরেই বিদেশী আক্রমণকারীরা ভারতে ঢুকতে পেরেছে।

দ্বিতীয়ত, মামুদ ভারতবর্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লুণ্ঠন করার ফলে ভারতের আর্থিক ভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত, মামুদের আক্রমণের ফলে ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতা ও সামরিক ত্রুটি বিদেশীদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। একদিকে ভারতের সম্পদের লোভ, অন্যদিকে ভারতীয়দের প্রতিরোধ ক্ষমতার দৈন্যতা পরবর্তীকালে অন্যান্য শক্তিকে ভারত অভিযানে প্রলুব্ধ করেছিল।

৭। মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের বিবরণ দাও।

মহম্মদ ঘোরী ছিলেন ঘুর রাজ্যের শাসক। মহম্মদ ঘোরীর প্রকৃত নাম শিহাবউদ্দিন বা মুইজউদ্দিন মহম্মদ। ভারতে মুসলমান আধিপত্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহম্মদ ঘোরী। আরবদের সিন্ধু আক্রমণের ফল ছিল শূন্য। সুলতান মামুদের কর্তৃত্ব সামান্য সময়ের জন্য কেবল পাঞ্জাব অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মহম্মদ ঘোরী কার্যকরী ভাবেই ভারতে মুসলমান কর্তৃত্বের সূচনা করে যান।

গজনী ও হিরাটের মধ্যবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে ঘুর রাজ্য অবস্থিত ছিল। সাসানী বংশোদ্ভূত রাজাগণ এখানে শাসন পরিচালনা করতেন। আলাউদ্দিনের সময় থেকেই ঘুর রাজ্যের উত্থান শুরু হয়। একই সময়ে খিবা অঞ্চলে খারিজম ছিল খুব শক্তিশালী রাজ্য। ঘুর রাজ গিয়াসুদ্দিনের রাজত্বকালে তাঁর ভ্রাতা শিহাবউদ্দিন গজনী দখল করে নিজ শাসন শুরু করেন। শিহাবউদ্দিনই ইতিহাসে মহম্মদ ঘোরী নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন কর্মক্ষম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি। রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার করা ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। মধ্য-এশিয়ার শক্তিশালী খারিজম রাজ্যের সাথে যুদ্ধের পরিবর্তে ভারতে রাজ্যজয়কেই তিনি সহজতর মনে করেন এবং ভারত আক্রমণ করেন।

মহম্মদ ঘোরী ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারত আক্রমণ করে মুলতান ও সিন্ধু জয় করেন। তারপর তিনি উচ দুর্গ আক্রমণ করেন। কথিত আছে, উচের রাজপুত মহিষীর সাথে ষড়যন্ত্র করে ঘোরী এই দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় দুই বছর পর ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি গুজরাট আক্রমণ করেন। কিন্তু সেখানকার রাজপুত রাজা ভীমদেবের হাতে পরাজিত হয়ে ঘোরী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১১৭৯ থেকে ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ঘোরী লাহোর এবং পাঞ্জাবের গজনী বংশীয় শাসকদের পরাজিত করে ঐ অঞ্চল দখল করেন।

পাঞ্জাব দখল করার পর ঘোরী মধ্য-ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন। ভারতের ঐশ্বর্য এবং ভারতীয় রাজাদের অন্তর্কলহ ও তজ্জনিত দুর্বলতার কথা ঘোরীর অজানা ছিল না। তাই ধনসম্পদ লাভ ও রাজ্যবিস্তার – এই দুই উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোরী আক্রমণ রচনা করেন। ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লী ও আজমীরের চৌহান-বংশীয় রাজা পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ফেরিস্তার বিবরণ থেকে ঘোরী-চৌহান সংঘর্ষের কাহিনী জানা যায়। এই যুদ্ধে একমাত্র কনৌজ রাজ জয়চাঁদ ব্যতীত সমস্ত রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজের পক্ষে যোগদান করেন। প্রথম আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ঘোরী ভাতিন্দা নামক স্থান দখল করে নেন। অতঃপর পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে মিলিত রাজপুত বাহিনীর সাথে তরাইনের প্রান্তরে ঘোরীর তরাইনের প্রথম যুদ্ধ হয়। রাজপুতদের আক্রমণে ঘোরীর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় কোনক্রমে ঘোরী গজনীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে ঘোরী পরের বছরেই (১১৯২) পুনরায় তরাইনের প্রান্তরে উপস্থিত হন। এবারেও কনৌজ ব্যতীত অন্যান্য রাজপুত রাজারা পৃথ্বীরাজের সাথে মিলিতভাবে মহম্মদ ঘোরীকে বাধা দেন। কিন্তু সুশৃঙ্খল ও সুগঠিত তুর্কী-অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে রাজপুত বাহিনী পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ নামে খ্যাত। এখানে জয়ী হবার পর তুর্কীবাহিনী হান্সী, সমান, খুরাম প্রভৃতি দুর্গ দখল করে। তারপর আজমীর নগরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাৎসরিক করদানের শর্তে আজমীর পৃথ্বীরাজের এক পুত্রের শাসনাধীনে রাখা হয়। অতঃপর কুতুবউদ্দিন নামক জনৈক বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে ভারতীয় সাম্রাজ্যের শাসন-দায়িত্ব অর্পণ করে ঘোরী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

এরপর কুতুবউদ্দিনের নেতৃত্বে, মীরাট, দিল্লী, রণথম্ভোর প্রভৃতি স্থানে তুর্কী অধিকার বিস্তৃত হয়। ১১৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ভারতে এসে ঘোরী কনৌজরাজ জয়চাঁদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এই যুদ্ধে জয়চাঁদ পরাজিত ও নিহত হলে দোয়াব অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সময়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি নামক জনৈক ভাগ্যান্বেষী তুর্কী-সৈনিক পূর্ব-ভারতে মুসলমান কর্তৃত্ব বিস্তৃত করেন। তিনি প্রথমে বিহার দখল করেন। ঐ সময়ে তিনি বাংলার ঐশ্বর্যের সংবাদ পান। তারপরে সসৈন্যে নদীয়াতে উপস্থিত হন। তৎকালীন বাংলার রাজা সেনবংশীয় লক্ষ্মণ সেন তুর্কীদের আকস্মিক আক্রমণে বিভ্রান্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। বখতিয়ার বিনা বাধায় নদীয়া দখল করেন।

৮। মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের ফলাফল উল্লেখ কর।

মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ভারতে একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করে নিজের শাসন প্রবর্তন করা এবং এই কাজে তিনি সফল হন। ভারতে মহম্মদ ঘোরী ও তাঁর অনুগামীদের আক্রমণ ও জয়লাভ এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে।

ঘোরীই প্রথম এদেশে স্থায়ী মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। ফলে এদেশে সুদীর্ঘকালের হিন্দু-শাসনের ক্রম-অবসান ঘটে। একইভাবে ফিরে আসে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য। মুসলমান শাসকদের আক্রমণে এদেশের ছোট-বড় বহু আঞ্চলিক রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরিবর্তে গড়ে ওঠে কেন্দ্রীয় বৃহৎ রাজ্য। তাছাড়া মুসলমান শাসনে সারাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটার ফলে ভারতের প্রশাসনিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়।

তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। স্যার যদুনাথ সরকারের ভাষায়, “বৈদিক যুগে বৃহত্তম এশিয়ার সাথে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল, পরবর্তী যুগে নতুন হিন্দুসমাজের পুনর্গঠনের ফলে তার অবনতি ঘটেছিল। ফলে ভারত নিজ প্রাকৃতিক বেষ্টনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তুর্কীদের আক্রমণ ও তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বহির্বিশ্বের সাথে পুনরায় ভারতের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।”

নাগরিক জীবনের সুখ-সুবিধার ক্ষেত্রে তুর্কী-শাসন জাতিগত ও বর্ণগত বৈষম্যের অবসান ঘটায়। রাজকার্যে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে উচ্চ-নীচ সব শ্রেণির মানুষের সম-অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। একইভাবে সেনাবাহিনীতেও সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।

হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে ইসলাম সংস্কৃতির মিলনে ভারতের শিল্প, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। প্রাথমিক দ্বন্দ্ব ও বিরূপতা সত্ত্বেও কালক্রমে উভয় সংস্কৃতির যুগলবন্ধনে ভারতীয় সংস্কৃতি নবতর মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিল।

আপাতদৃষ্টিতে ভারতের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার উপর তুর্কি আক্রমণের বিশেষ প্রভাব ছিল না। কিন্তু তুর্কি জাতির সাফল্য হিন্দু সমাজব্যবস্থায় নীরব প্রভাব ফেলেছিল। ইসলামের প্রভাব থেকে হিন্দু ধর্ম ও সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য রক্ষনশীল গোষ্ঠী সামাজিক নিয়মবিধি কঠোর থেকে কঠোরতর করে তোলেন। অন্যদিকে উদারপন্থী সংস্কারকরা ইসলামের সুফী আদর্শের আদলে হিন্দুদের মধ্যে ভক্তিবাদ প্রচারে জোর দেন। ফলে উভয় ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সহনশীলতার পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে।

তুর্কি যোদ্ধাদের অশ্বারোহী বাহিনীর কার্যকারিতা ভারতের প্রচলিত সামরিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। সেনাবাহিনীতে কেবল ক্ষত্রিয়দের প্রাধান্যের পরিবর্তে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে দক্ষ ব্যক্তিদের নেতৃত্বে এগিয়ে আসার পথ খুলে যায়। পদাতিক ও হস্তি বাহিনীর পরিবর্তে অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনী গঠনের কাজে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়।

তুর্কি শক্তির আগমন ও শাসনের ফলে ভারতের প্রাচীন বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ভাঙন আসে। সর্বজনীন শহর গড়ে উঠতে শুরু করে। জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে গড়ে ওঠা নতুন শহরগুলিতে অর্থনৈতিক শ্রেণী সংগঠন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। মানুষের কৃষি-নির্ভরতা কমতে থাকে। ডঃ ইরফান হাবিব এই ঘটনাকে নগর-বিপ্লব নামে অভিহিত করেছেন।

৯। সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের তুলনামূলক আলোচনা কর।

সুলতান মামুদ এবং মহম্মদ ঘোরী দুজনেই ছিলেন তুর্কি শাসক ও যোদ্ধা। দু’জনেই একাধিকবার ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তাই দু’জনের ভারত অভিযানের প্রকৃতি, ফলাফল ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে এঁদের ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য ও সাফল্যের বিচারে সাদৃশ্য অপেক্ষা বৈসাদৃশ্যই ছিল বেশি। তাছাড়া মামুদ ও ঘোরীর ভারত আক্রমণের মধ্যে প্রায় ১৭৫ বছরের ব্যবধান ছিল। স্বভাবতই দু’জনের আক্রমণকালে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমির বিস্তর ফারাক ছিল। যাই হোক, পণ্ডিতেরা এঁদের আক্রমণের তুলনামূলক বিচার করে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

সাদৃশ্য :- মামুদ ও ঘোরী কেউই নিছক ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ভারত আক্রমণ করেন নি। তাছাড়া, দু’জনেই ছিলেন তুর্কী মুসলমান এবং দুজনেই পাঞ্জাবকে কেন্দ্র করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। এঁরা দুজনেই নিজ নিজ সেনাবাহিনীতে দক্ষ ভারতীয় সৈনিকদের নিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি দুজনেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে জয়লাভের পর অর্থের বিনিময়ে এবং অধীনতার শর্তে ভারতীয় রাজাদের স্ব স্ব রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

বৈসাদৃশ্য :- উল্লিখিত সাদৃশ্যের তুলনায় এঁদের আক্রমণে বৈসাদৃশ্য ছিল অনেক বেশি। যেমন –

প্রথমত, সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের মূল প্রেরণা ছিল এদেশের অতুল ধনসম্পদ লুণ্ঠনের বাসনা। ভারতে সঞ্চিত ধনরত্নের প্রাচুর্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তিনি অভিযানে লিপ্ত হন। সব অভিযানেই তিনি সফল হন। দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন ভারতবর্ষে তার পক্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের সম্পূর্ণ অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। কিন্তু মামুদ এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেন নি। পক্ষান্তরে, মহম্মদ ঘোরী এদেশের সম্পদে প্রলুব্ধ হলেও তা একমাত্র বাসনা ছিল না। একাধিকবার পরাজিত হলেও তিনি নতুন উদ্যমে আবার ভারত আক্রমণ করেছেন এবং এদেশে নিজ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করছেন। মামুদের কোনো গঠনমূলক পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু ঘোরীর ছিল। তাই মামুদ ভারত-ইতিহাসে নিছক ‘লুণ্ঠনকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, কিন্তু মহম্মদ ঘোরী পেয়েছেন সাম্রাজ্য-সংগঠকের কৃতিত্ব।

দ্বিতীয়ত, সুলতান মামুদ ছিলেন অনন্য সামরিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি বহুবার ভারত আক্রমণ করে প্রতিবারেই সাফল্য লাভ করেন। তুলনামূলকভাবে মহম্মদ ঘোরী ছিলেন অনেক নিষ্প্রভ। তিনি কমবার আক্রমণ করেও অন্তত তিনটি যুদ্ধে পরাজয় বহন করেন।

তৃতীয়ত, সুলতান মামুদের সামরিক প্রতিভা থাকলেও প্রশাসনিক প্রতিভা ছিল খুবই কম। তাই মধ্য-এশিয়ার বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও, তার দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু ঘোরী ব্যক্তিগত সাংগঠনিক প্রতিভা ও প্রশাসনিক উদ্ভাবনী শক্তির দ্বারা নিজের বিজয় ও সাম্রাজ্যকে স্থায়িত্ব দিতে পেরেছিলেন।

চতুর্থত, ভারতে একজন নিষ্ঠুর সেনাপতি ও লুণ্ঠনকারী রূপে প্রতিভাত হলেও সুলতান মামুদ বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিদ্বান ব্যক্তিদের সমাদর করতেন। উতবী, ফারবী, উজাবী, ফারুকী, ফিরদৌসী প্রমুখ সেকালের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি মামুদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তিনি গজনীকে একটি সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত করেন। তাঁর চেষ্টায় গজনী ইসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিন্তু মহম্মদ ঘোরীর চরিত্রে সংস্কৃতি-প্রীতির এই প্রাবল্য ছিল না।

১০। ভারতবর্ষে মুসলমানদের সাফল্যের কারণ বা মুসলমান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ব্যর্থতার কারণ আলোচনা কর।

অষ্টাদশ শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে আরব সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিম এবং তুর্কো আফগান শাসকদ্বয় সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘোরী ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান চালিয়েছিলেন এবং সাফল্য অর্জন করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল ভারতীয়দের সামরিক শক্তির সংখ্যাগত আধিক্য ও ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বহিরাগত মুলসমানদের বিরুদ্ধে তারা কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি। ভারতের সামরিক শক্তির স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত রাজপুত জাতি একের পর এক রণক্ষেত্রে মুসলমানদের কাছে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

বিদেশী ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন, লেনপুল, ভিনসেন্ট স্মিথ প্রমুখ মনে করেন, শীতপ্রধান দেশ থেকে আগত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও মাংসাশী মুসলমানদের বাধা দেওয়া ভারতীয়দের পক্ষে সম্ভব হয় নি। কিন্তু ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তবের মতে, এই তত্ত্ব ঠিক নয়। কারণ – (১) তখন ভারতীয় সৈনিকরা সবাই নিরামিষাশী ছিল না, (২) বহু রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনী সাহসিকতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছিল। (৩) কেবল মধ্যযুগের ভারত নয় এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। তাই পশ্চিমী লেখকদের বক্তব্য থেকে নয়, ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থা বা অবক্ষয়ের মধ্যেই হিন্দুদের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

ড. যদুনাথ সরকার লিখেছেন, “A nation’s greatest enemy is within not without.” বস্তুত কোনো দেশের রাজনৈতিক অনৈক্য, সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা এবং সামরিক বিশৃঙ্খলা সেই দেশকে দুর্বল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এই ধরনের একটি দেশের পক্ষে অপেক্ষাকৃত গতিশীল কোনো জাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। ভারতবর্ষ তখন অজস্র ছোটো ছোটো রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ছিল প্রবল। তাই আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ তারা গড়ে তুলতে পারে নি।

অধ্যাপক যদুনাথ সরকার, কে. এ. নিজামী, কে. এস. লাল, আর. সি. মজুমদার প্ৰমুখ অধিকাংশ ইতিহাসবিদ তৎকালীন বৈষম্যপূর্ণ ভারতীয় সমাজবাস্থাকে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতীয় সমাজ ছিল বর্ণবৈষম্যে দীর্ণ। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের একক আধিপত্য, অর্থবান বৈশ্যদের এবং নিপীড়িত শূদ্রদের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, তাতে সুবিধা হয়েছিল আক্রমণকারীদের। তাই নিম্নশ্রেণির মানুষ এই আক্রমণের সময় প্রতিরোধের কাজে কেবল উদাসীন ছিল না, অনেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের সামাজিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় তুর্কীদের পক্ষে যোগদানও করেছিল। পক্ষান্তরে, ইসলামধর্মে জাতিভেদ ছিল না। তাই তারা লড়াই করেছিল হাতে হাত দিয়ে।

নবোত্থিত ইসলামের সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শবাদ আক্রমণকারীদের মধ্যে এক নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেছিল। অন্ধবিশ্বাসী ও ‘পৌত্তলিকদের ধ্বংসসাধনের মাধ্যমে ‘গাজী’ উপাধি লাভের ইচ্ছা এবং ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের মাধ্যমে বেহেস্তের পথ প্রশস্ত করার কামনায় মুসলমান সৈনিকরা জীবনপণ লড়াই করেছিল। এই ধর্মীয় প্রেরণাকে শক্তিশালী করেছিল আর্থিক প্রেরণা। হিন্দু-মন্দির ও জনপদ লুণ্ঠন করে লুণ্ঠিত অর্থের একাংশ ব্যক্তিগত পুরস্কার লাভের প্রতিশ্রুতি তাদের মনে উদ্দামের সঞ্চার করেছিল।

হিন্দুদের ব্যর্থতার আরেকটি বড় কারণ ছিল নৈতিক অবক্ষয়। কে. এম. পানিক্করের মতে, “Cultured degeneration was the foremost cause of the defeat of Rajputs, “তার মতে, তান্ত্রিক দর্শনের জনপ্রিয়তা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ধর্মীয় তত্ত্ব, নৈতিক অবক্ষয়ের সূচনা করেছিল।

ড. আর. সি. দত্তের মতে, ভারতে সামন্ত প্রথার অস্তিত্ব যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছিল তার সুযোগ নিয়েছিল আক্রমণকারীরা। বিভিন্ন সামন্ত প্রধানদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। সামন্ত-প্রভুরা যথাযথ পদ্ধতিতে সৈনিক সংগ্রহ বা শিক্ষা দিতেন না। ফলে সামন্তদের ওপর নির্ভরশীল বাহিনী প্রয়োজনের মুহূর্তে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি।

হিন্দুদের প্রাচীনপন্থী সামরিক সংগঠন তাদের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। ভারতীয়দের সামরিক সংগঠন সুসংগঠিত ছিল না। প্রাচীন যুদ্ধ-পদ্ধতি, হস্তী-বাহিনীর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা, অনুন্নত অস্ত্রশস্ত্র, সামরিক কাজে কূট-কৌশল প্রয়োগের ব্যর্থতা প্রভৃতি ভারতীয় বাহিনীর কার্যকারিতা নষ্ট করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে যোদ্ধা হিসেবে ভারতীয় সৈনিকেরা বিশেষত রাজপুতরা তুর্কীদের থেকে পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ভারতীয়দের মধ্যে সংগঠনী-প্রতিভার অভাব ছিল। তাই ঐতিহাসিক স্মিথ লিখেছেন, “Hindu kings though fully equal to their assailants in courage and contempt of death, where interior in the art of war and for that reason lost their independence.”

ভারতীয় সৈন্যরা যুদ্ধ করেছিল শুধুমাত্র তরবারি নিয়ে। কিন্তু তুর্কীরা ছিল ভালো তীরন্দাজ। যুদ্ধক্ষেত্রে তুর্কীদের দ্রুতগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনী ভারতীয়দের হস্তী বাহিনীর তুলনায় অধিক কার্যকরী ছিল। অশ্বারোহণের সুবিধার্থে তুর্কী-বাহিনী লৌহরেকাব ব্যবহার করত এবং নিরাপত্তার জন্য পরিধান করত ভারী বর্ম। ফলে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল।

ভারতীয়দের যুদ্ধ কৌশলগত ত্রুটিও তাদের ব্যর্থতাকে অবশ্যম্ভাবী করেছিল। অধ্যাপক হবিবুল্লা লিখেছেন যে, রাজপুতরা যদি রক্ষণাত্মক যুদ্ধ না-করে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করত, তাহলে যুদ্ধের ফলাফল উল্টো হতে পারত। রাজপুতরা তাদের সেনাবাহিনীকে চিরাচরিত তিনটি ভাগে (উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য) বিভক্ত রেখে লড়াই করেছিল। কিন্তু তুর্কীরা এর সাথে যুক্ত করেছিল আরো দুটি ভাগ – অগ্রবর্তী-বাহিনী ও সংরক্ষিত-বাহিনী। এই অগ্রবর্তী বাহিনীর দ্বারা তারা শত্রুর ক্ষমতা যাচাই করে দুর্বল অংশে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। একইভাবে রণক্লান্ত সৈনিকদের পাশে আকস্মিক সংরক্ষিত বাহিনীকে উপস্থিত করে তারা শত্রুপক্ষের ওপর তীব্র চাপসৃষ্টি করতে পেরেছিল।

যুদ্ধ-পদ্ধতি এবং নৈতিকতার সমন্বয় ভারতীয়দের প্রতিরোধকে অনেকটা দুর্বল করেছিল। রাজপুতরা নৈতিক মূল্যবোধের দ্বারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হতেন। তাই পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়া, বিশ্বাসঘাতকের সাহায্য নেওয়া, কিংবা শত্রুর খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার জন্য শস্যক্ষেত্র পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি নীতিবিরুদ্ধ কর্মসূচি পরিহার করেছিল। তাই শত্রুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে নি। ইউ. এন. ঘোষাল লিখেছেন, ‘They were inspired by a high sense of chivalry and military honor which made they until exam for practical success in warfare.”

সর্বোপরি ভারতীয়দের মধ্যে একক ও দক্ষ নেতৃত্বের একান্ত অভাব ছিল। মহম্মদ ঘোরী বা তাঁর পূর্বে আগত গজনীর মামুদ, আরবীয় সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিম প্রমুখের একক দক্ষতা ও নেতৃত্বদানের যে ক্ষমতা ছিল, তা এককভাবে কোনো ভারতীয় নেতার মধ্যে ছিল না।

ভারতীয়দের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ভবিষ্যৎ বিশ্বাস তাদের প্রতিরোধ-শক্তি ক্ষীণ করেছিল। মুসলমানরা যখন আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করত যে, বিধর্মীর বিরুদ্ধে তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তখন হিন্দুরা বিশ্বাস করত যে, কলিযুগে তাদের বিনাস ঘটবে। ফলে মুসলমানরা যখন লড়াই করার প্রেরণা পেয়েছিল তখন হিন্দুরা লড়াই করার মানসিকতা থেকে হতাশার জগতে প্রবেশ করেছিল। তাছাড়া বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের অহিংসার তত্ত্ব ভারতীয়দের যুদ্ধ ক্ষমতা হ্রাস করেছিল। এই সকল কারণের সমন্বয়ে তুর্কীরা বিজয়ী হয়েছিল।

তাই ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তবের ভাষায় বলা যায়, “The absence of political unity, social divisions, rise of brahmanism, moral degeneration and the superiority of the Turks in military skill organization were responsible for the success of the Turks.”

১১। ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের কাহিনী উল্লেখ কর। এটিকে ‘অলীক কল্পনা’ বলা যায় কী?

ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ছিলেন মহম্মদ ঘোরীর অন্যতম ক্রীতদাস। সুযোদ্ধা ও সংগঠক হিসেবে তিনি দক্ষতা দেখান। দিল্লী দখলের পর ঘোরী বারাণসির পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলের শাসনদায়িত্ব ইখতিয়ারকে দিয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চাকাঙ্খী ও ভাগ্যান্বেষী সৈনিক ইখতিয়ারউদ্দিন নিজ উদ্যোগে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নেন।

এই সময় বিহার ও বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় শাসন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইখতিয়ার প্রথমে বিহারের বিখ্যাত বৌদ্ধবিহার নালন্দা ও বিক্রমশীলা আক্রমণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। এখানে একটি দূর্গ নির্মাণ করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। অতঃপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে বঙ্গ দেশের দিকে। বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধ বহির্বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি অবহিত ছিলেন। বাংলার সেন বংশীয় রাজার দুর্বলতাও তাঁর অজানা ছিল না। তাই তিনি বঙ্গদেশ দখল করে নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করতে উদ্যোগী হন। আনুমানিক ১২০৩-৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সহ তিনি বঙ্গের রাজধানী নদীয়া নগরী আক্রমণ করেন। তুর্কীসেনারা সম্ভবতঃ অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে নদীয়া প্রাসাদে প্রবেশ করেছিল এবং মধ্যাহ্নভোজে রত রাজা লক্ষ্মণ সেনকে অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে স্বমূর্তি ধারণ করে এবং আক্রমণ চালায়। ইতিমধ্যে অবশিষ্ট তুর্কী বাহিনী নদীয়া শহরে আক্রমণ শুরু করলে রাজা লক্ষণ সেন অসহায় হয়ে পড়েন।

মিনহাজউদ্দিনের ‘তবাকত-ই-নাসিরী” এবং ইসামীর ‘ফুতুহ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থগুলি থেকে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন কর্তৃক বাংলা বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ অনুসারে ইখতিয়ারউদ্দিন ১৭ জন অশ্ববিক্রেতা হিসেবে ১২০৩-১২০৪ খ্রিস্টাব্দে নদিয়া আক্রমণ করেন এবং রাজা লক্ষ্মণ সেন কোনো বাধা না দিয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে যান এবং সোনার গাঁ-তে নতুন রাজ্য স্থাপন করেন। বিনাযুদ্ধে মাত্র ১৭ জন তুর্কি সেনার কাছে রাজা লক্ষ্মণ সেনের এই আত্মসমর্পণের ঘটনাকে অনেকেই কাপুরুষতার লক্ষণ বলেছেন। নবীনচন্দ্র সেন লিখেছেন, “সপ্তদশ অশ্বারোহী যবনের……….. সোনার বাংলা রাজ্য দিলা বিসর্জন।”

ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ এই বিবরণকে ‘অলীক কল্পনা’ বলে মনে করেন। তাদের মতে, মিনহাজউদ্দিন বা ইসামী কেউই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না এবং ঘটনার যথাক্রমে পঞ্চাশ ও একশো বছর পরে এই বিবরণ লিপিবন্ধ করেছিলেন। স্বভাবতই তাদের বক্তব্যে কল্পনার আতিশয্য ছিল। মিনহাজের বক্তব্যে স্ববিরোধিতা আছে। তিনি লক্ষ্মণ সেনকে “আর্যাবর্তের রাজাদের মধ্যে প্রধান” এবং “হিন্দুস্তানের রায়গণের মধ্যে খলিফাস্থানীয়” বলে প্রশংসা করেছেন। তাহলে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহীর ভয়ে তিনি রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেলেন কেন – এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

বলা যায় যে, ইক্তিয়ারউদ্দিন যখন নদিয়া প্রাসাদের সিংহদুয়ারে উপস্থিত হন তখন তার সাথে ১৬ বা ১৭ অশ্বারোহী হয়তো ছিল। পরন্তু তারা অশ্ব-বিক্রেতার ছদ্মবেশে থাকায় রক্ষীদের সন্দেহ হয় নি। কিন্তু তার মূলবাহিনী তখন নগরের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিল। প্রাসাদের অভ্যন্তরে ঢোকার পর যখন এই ১৭ জন অশ্বারোহী স্বরূপ প্রকাশ করে, একই সময়ে তার মূলবাহিনী নগরীতে ঢুকে জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করেছিল। জনগণের তীব্র কোলাহল শুনে লক্ষ্মণ সেন পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং রাজ্য ছেড়ে চলে যান।

১৭ অশ্বারোহীর কাহিনি কাল্পনিক হলেও লক্ষ্মণ সেনের এই আচরণ রাজাসুলভ ছিল না। তুর্কি আক্রমণের যুগে সীমান্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না-করে এবং আত্মরক্ষার জন্য নিজের রাজ্য ও জনগণকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যাওয়া অবশ্যই বীরত্বের বা মহত্ত্বের পরিচয় ছিল না।

Leave a Comment