2nd Semister: আদি মধ্যযুগের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (মান)

১। ‘অগ্রহার’ দান কী?

উত্তর:- খ্রিস্টীয় চতুর্থ-নবম শতকে ভারতে ধর্মস্থান, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং উচ্চ কর্মচারীদের কর-মুক্ত ভূমি দান করা হত। এই জমির উৎপাদন দান-গ্রহীতা ভোগ করতেন। এমন জমিকে ‘অগ্রহার’ বা নিষ্কর ভূমি দান বলা হত।

২। ভারতে ‘অগ্রহার’ দানের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

উত্তর:- নিষ্কর ভূমিদানের (অগ্রহার) ফলে ভারতে জমিতে ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ঘটে। আগে সব জমির মালিক ছিলেন রাজা। এখন ব্যক্তিগতভাবে দান প্রাপক জমিতে মালিকানা লাভ করেন। এর ফলে ভারতে নতুন শক্তি কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। একে ভারতে সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাবের উপাদান বলা হয়।

৩। ভারতের সামন্ততন্ত্র কী ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের অনুরূপ ছিল?

উত্তর:- ভারতে ও ইউরোপের সামন্ততন্ত্র অনুরূপ ছিল না। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভূমিদাস শ্রেণীর অস্তিত্ব, চুক্তি ব্যবস্থা, উৎপাদনের উপকরণের উপর সামন্ত প্রভুর কর্তৃত্ব ইত্যাদি। এগুলির অস্তিত্ব ভারতে ছিল না।

৪। ‘চর্যাপদ’ কে এবং কোথায় আবিষ্কার করেন?

উত্তর:- পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে প্রথম বৌদ্ধ চর্যাপদ আবিষ্কার করেন।

৫। চর্যাপদ কী?

উত্তর:- চর্যাপদগুলি হল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি উৎস। এর ভিত্তিতেই বাংলায় সহজিয়া গান, বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গানের সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য কর্ম হিসেবে এগুলি খুব উচ্চমানের নয়। জটিল দর্শন তত্ত্বের প্রভাবে এগুলিকে দুর্বোধ্য মনে হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতি প্রেম, আবেগ এগুলিতেও দেখা যায়।

৬। ‘গোপুরম’ কী?

উত্তর:- দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় শিল্প শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মন্দিরের চতুর্দিকে প্রাচীর বেষ্টন এবং সম্মুখ ভাগে বিশাল প্রবেশ পথে সুউচ্চ ও সুসজ্জিত তোরণ নির্মাণ। এই তোরণকে বলা হয় গোপুরম।

৭। আলবার কারা?

উত্তর:- দক্ষিণ ভারতে একদল ভক্তিবাদী সাধক সপ্তম ও নবম শতকের মধ্যবর্তীকালে প্রেম ও ঈশ্বরের আনুগত্য-ভিত্তিক বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। এঁদের বৈষ্ণব আলবার বলা হত। ঐতিহ্য অনুসারে বারোজন আলবার সাধক জন্মে ছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন সরযোগী, ভূতযোগী, মহদযোগী, ভক্তিমার প্রমুখ।

৮। ‘শৈব নায়নার’ কারা?

উত্তর:- দক্ষিণ ভারতে সপ্তম-নবম শতকে একদল ভক্তিবাদী সাধক আধ্যাত্মিকতা বিশিষ্ট শৈবধর্ম প্রচার করেছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন তিরুমূলের, অপ্পর, সুন্দরর প্রমুখ।

৯। দায়ভাগ কী?

উত্তর:- আদি-মধ্যযুগে সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত একটি বিধি ছিল ‘দায়ভাগ’। এটির প্রণেতা জীমূতবাহন। এই বিধি অনুযায়ী পরিবারের প্রধান ছিলেন সকল সম্পত্তির একক অধিকারী। তিনি ইচ্ছানুযায়ী সেই সম্পত্তি দান বা বিক্রয় করতে পারতেন। মূলত বাংলা দেশে এই বিধান চালু ছিল।

১০। ‘মিতাক্ষরা’ আইন কী?

উত্তর:- আদিমধ্যযুগে বিজ্ঞানেশ্বর সম্পত্তির অধিকার বিষয়ক যে আইনবিধি রচনা করেন তা ‘মিতাক্ষরা’ নামে খ্যাত। এই বিধি অনুযায়ী, পরিবারের প্রধান সকল সম্পত্তির মালিক ছিলেন। কিন্তু তিনি তা দান বা বিক্রি করার অধিকারী নন। তবে জীবদ্দশায় পুত্রদের সম্মতিক্রমে সম্মতি বণ্টন করে দিতে পারতেন। বাংলা ছাড়া দেশের অধিকাংশ অঞ্চল মিতাক্ষরা আইন অনুসারে সম্পত্তির মালিকানা স্থির হত।

১১। ‘পুনর্ভূ’ বলতে কী বোঝ?

উত্তর:- মেধাতিথির ভাষ্য অনুযায়ী স্বামী নিরুদ্দিষ্ট হলে বা দীর্ঘকাল প্রবাসী থাকলে এবং নির্দিষ্ট সময়ের পরেও প্রত্যাবর্তন না করলে তাঁর পত্নী অন্যের আশ্রয় প্রার্থী বা পানিপার্থী হতে পারতেন। এই পুনর্বিবাহিত রমনীকে ‘পুনর্ভূ’ বলা হত। পরবর্তীতে পূর্ব স্বামী ফিরে এলেও স্ত্রীর ওপর দাবী করতে পারতেন না।

১২। ‘সনকাদি সম্প্রদায়’ কে প্রতিষ্ঠা করেন? পম্প ও পোন্ন কোন ভাষার লেখক ছিলেন?

উত্তর:- ‘সনকাদি সম্প্রদায়’ প্রতিষ্ঠা করেন অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু ব্রাহ্মণ নিম্বার্ক। পম্প ও পোন্ন কানাড়া (কন্নড়) ভাষার লেখক ছিলেন ।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (মান – ২)

১। অগ্রহার ব্যবস্থা কীভাবে সামন্ততন্ত্রের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল?

উত্তর:- খ্রিস্টীয় ৩০০ শতকে উত্তর ভারতে নিষ্কর ভূমিদান প্রথার সূচনা ঘটেছিল। প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ধর্মস্থান অর্থাৎ মঠ, মন্দির বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত প্রমুখকে নিষ্কর ভূমিদান শুরু হয়। এই করমুক্ত গ্রাম বা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড দানের রীতি ‘অগ্রহার’ নামে খ্যাত। সাতবাহন প্রজাদের আমলে এমন ভূমিদানের ঘটনা প্রথম দেখা যায়। ৩০০ খ্রিস্টাব্দের পর অগ্রহার দানব্যবস্থা ব্যাপকতা পায়। প্রথমে শক, কুষাণ, সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধসংঘকে ভূমিদান করতেন। ক্রমে ধনী বণিক, কারিগর প্রভৃতি বৃত্তিজীবি ব্যক্তিবর্গও পূর্ণসঞ্চয়ের বাসনায় ধর্মপ্রতিষ্ঠানকে স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি দান করতে শুরু করেন।

চতুর্থ শতক থেকে অগ্রহার দান ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। এখন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদেরও ভূমিদান ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়। রাজা তাঁর উচ্চকর্মচারীদেরও নগদ বেতনের পরিবর্তে নিষ্কর ভূমিদান শুরু করেন। ফলে প্রশাসনিক ক্ষমতাবান গোষ্ঠীও ভূমির অধিকারী হতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি আসে দানকৃত ভূমির পরিচালন ব্যবস্থায়, যা ভারতে সামন্ততান্ত্রিকতার আবির্ভাবের সম্ভাবনা জোরালো করেছিল।

এতকাল দানগ্রহীতা দানকৃত জমির কর বা রাজস্ব ভোগের অধিকারী হতেন। কৃষককে জমি বন্দোবস্ত বা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল রাজকীয় প্রশাসনের হাতে। কিন্তু ভূমিদানের ব্যাপকতার কারণে রাজা দানকৃত জমির তত্ত্বাবধান ও কর আদায়ের দায়িত্বও জমি প্রাপকের হাতে ছেড়ে দেন। এই সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ধর্ম-নিরপেক্ষ জমি প্রাপকরা নিজস্ব আইনকানুন, লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। এঁরা জোর পূর্বক কৃষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে থাকেন। এইভাবে দেশের মধ্যে রাজকীয় শক্তির বাইরে ভূস্বামীদের শক্তিকেন্দ্র গড়ে ওঠে, যা রাজকীয় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়। এরপর ভূমি ব্যবস্থায় মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা ও শোষন শুরু হয়। এদুটিকেই সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাবের সূচক বলে ড. রামশরন শর্মা, ডি. এন. ঝা প্রমুখ অভিহিত করেছেন।

২। আদি মধ্যযুগে ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

উত্তর:- গুপ্তযুগে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে গভীর অনুশীলন শুরু হয়েছিল, আদি-মধ্যযুগে তা অব্যাহত ছিল। অষ্টম শতকের বিশিষ্ট গণিতকার ছিলেন শ্রীধর আচার্য। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম গণিতসার। এই গ্রন্থে তিনি শূন্যের বহুমাত্রিক ব্যবহার ও তার গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নাম অনুসন্ধানের কাজে গণিতের প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। নবম শতকে গণিতের ওপর ‘সারসংগ্রহ’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ লেখেন মহাবীর। এই গ্রন্থে তিনি দ্বিঘাত সমীকরণের ত্রিমুখী সমাধান, উপবৃত্ত, ভগ্নাংশ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

নবম শতকের আর-একজন বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ হলেন মুঞ্জাল। দ্বাদশ শতকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লঘুমানস’ প্রকাশিত হয়। আরব পর্যটক অলবেরুণী তাঁর গ্রন্থে পণ্ডিত মুঞ্জালের প্রশংসা করেছেন। আয়নবিদ্যা, আয়ন গতিবেগ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তীকালের লেখকদের গবেষণায় বিশেষ সাহায্য করে। দ্বাদশ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আচার্য ভাস্কর আয়ন গতি আলোচনার সময় মুঞ্জালের অবদান স্বীকার করেছেন।

দশম শতকে ভট্টোৎপল রচনা করেন ‘গণিতস্কন্ধ’ নামক গ্রন্থ। তাঁর সমসাময়িক গণিতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন বিজয় নন্দী, কল্যাণ বর্মন প্রমুখ। এঁরা যথাক্রমে ‘করণতিলক’ ও ‘সারাবলি’ নামক গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আদি মধ্যযুগে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার ওপর মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন আচার্য ভাস্কর। তাঁর গ্রন্থের নাম ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’। দু খণ্ডে রচিত এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি লীলাবতী ও বীজগণিত সম্পর্কে আলোচনা করেন। দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু হল জ্যোতির্বিদ্যা। এই গ্রন্থ দুটি গণিতশাস্ত্রের এক উল্লেখযোগ্য অবদান রূপে বিবেচিত হয়। ভাস্করাচার্যের আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘বারণকুতূহল’।

নবম শতকের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন কনৌজের বলভদ্র। জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর অবস্থান সম্পর্কে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। পতঞ্জলীর যোগসূত্রের ওপরেও তিনি টীকা লেখেন। সম্ভবত দশম শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী দ্বিতীয় আর্যভট্ট আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম ‘আর্যসিদ্ধান্ত। একাদশ শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ‘রাজমৃগাঙ্ক’ ও ‘ভাস্বতী’ নামক দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়। এদের রচয়িতা ছিলেন যথাক্রমে ভোজদেব ও শতানন্দ।

৩। আদি মধ্যযুগে ভারতে বিবাহ রীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

উত্তর:- ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশের ধারায় সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিবাহকে মানুষের পবিত্র ও প্রয়োজনীয় কর্তব্যরূপে বিবেচনা করা হত। সাধারণভাবে আট ধরনের বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। এগুলি হল ব্রাহ্মবিবাহ, দৈববিবাহ, প্রাজাপত্যবিবাহ, আর্য বিবাহ, গান্ধর্ব বিবাহ, আসুর বিবাহ, রাক্ষসবিবাহ এবং পিশাচ বিবাহ।

ব্রাহ্ম বিবাহ ব্যবস্থায় কন্যার পিতা মনোনীত সুপাত্রের হাতে সালঙ্করা কন্যাকে সম্প্রদান করে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতেন। দৈববিবাহে কন্যার পিতা তাঁর সন্তানকে সৎ পুরোহিতের হাতে সম্প্রদান করতেন। আর্যবিবাহে কন্যাপণ গ্রহণ করা হত। পাত্রপক্ষ কন্যার পিতাকে গো-দান করে তাঁর কন্যার পাণিগ্রহণের অধিকারী হতেন। প্রাজাপত্যবিবাহে কন্যার পিতা নিজ মনোনীত পাত্রের হাতে কন্যাকে সম্প্রদান করতেন। কন্যা তাঁর ধর্মীয় কর্তব্যপালনের এবং পাত্র ধর্মানুযায়ী পাত্রীর ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়বদ্ধতা ঘোষণা করতেন। গান্ধর্ব বিবাহে পাত্রপাত্রী নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী পরস্পরের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত। আসুর বিবাহ ব্যবস্থায় পাত্রপক্ষ নগদ অর্থের বিনিময়ে কন্যাকে গ্রহণ করত অর্থাৎ এই বিবাহে কন্যা ক্রয় করা হত।

রাক্ষসবিবাহে পাত্রীকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে বিবাহ করা হত। পিশাচ বিবাহে নিদ্রিত, অপ্রকৃতিস্থ বা মত্ত অসহায় কন্যাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মূলত সম্ভোগের উদ্দেশ্যে বিবাহ করা হত। এই ব্যবস্থা ছিল খুবই ব্যতিক্রমী ও নিন্দিত একটি প্রথা। ক্ষত্রিয় রাজবংশগুলিতে স্বয়ংবর সভা আহ্বান করে কন্যার বিবাহের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এক্ষেত্রে কন্যা তাঁর পছন্দের যে কোনো একজনকে স্বামীত্বে বরণ করে নিতেন। মহাভারতের অর্জুন-সুভদ্রার বিবাহ যেমন রাক্ষস বিবাহের দৃষ্টান্ত, তেমনি রামায়ণে রাম-সীতার বিবাহ স্বয়ংবর বিবাহের একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক ও সপ্তম শতকের অন্তর্বর্তীকালে প্রচলিত বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্মবিবাহ, দৈববিবাহ, প্রাজাপত্যবিবাহ এবং আর্যবিবাহ ছিল অন্যতম। তবে সেই সময় প্রেমজ বিবাহও প্রচলিত ছিল। আলোচ্যকালে দুষ্মন্ত শকুন্তলার বিবাহ প্রেমজ বিবাহের অন্যতম দৃষ্টান্ত। তবে সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে বিশেষত নবম শতকে রচিত মেধাতিথির সামাজিক আইনসমূহের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, স্থিরীকৃত বিবাহ সর্বজনস্বীকৃত ছিল। তবে প্রেমজ বিবাহ সম্পূর্ণ বর্জিত হয় নি। এমনকি অসবর্ণ বিবাহ স্বীকৃত ছিল। আদি মধ্যযুগের চূড়ান্ত পর্বে অর্থাৎ নবম থেকে দ্বাদশ শতকে নারীজাতির অবস্থার বিশেষ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। এই পর্বে বাল্যবিবাহ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

৪। আদি মধ্যযুগের ভারতে গিল্ডের গুরুত্ব নিরুপণ করো।

উত্তর:- খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পর থেকে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বণিকসংঘের বা শিল্পীসংঘের উদ্ভব। এই সময় থেকেই বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত কারিগরদের মধ্যে পেশাগত সম্পর্ক গড়ে ওঠার ফলে শিল্প ও বাণিজ্য একটি সংগঠিত রূপ পায়। একই পেশার বিভিন্ন মানুষের এই সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানকেই ‘সংঘ’ বা ‘শ্রেণি’ বা ‘গিল্ড’ বলা হয়ে থাকে। ধনীদের অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচাবার তাগিদেই প্রধানত কারিগর বা শ্রমিকশ্রেণি ‘গিল্ড’ গঠন করে। পরে গিল্ডের মাধ্যমে নানা সুযোগসুবিধা পাওয়ার ফলে এবং সামাজিক আত্মসম্মানবোধ ফিরে পাওয়ার ফলে গিল্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

প্রত্যেক সংঘের একজন প্রধান পরিচালক থাকতেন, যাকে ‘অধ্যক্ষ’ বা ‘মুখ্য’ বা ‘জেত্থক’ বলা হত। তাকে সাহায্য করার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট দুটি উপদেষ্টা সমিতি থাকত। গিল্ডের নিজস্ব রীতিনীতিগুলি আইনের স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তাদের নিজস্ব সামরিক শক্তিও ছিল। বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যের পথ সুগম করার পাশাপাশি গিল্ডগুলি তৎকালীন সমাজে আধুনিক ব্যাংকের ভূমিকা নিত। নগদ অর্থ বা স্থাবর সম্পত্তি চিরকালীন ভিত্তিতে আমানত হিসেবে রেখে তারা মানুষকে ঋণ দিত। গিল্ডের বিচারালয় সদস্যদের পারিবারিক কলহের মীমাংসা করত এবং সদস্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিত।

গুপ্তযুগে গিল্ডগুলি নগরের শাসনকার্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত। রাষ্ট্রের তরফ থেকে অবশ্য গিল্ডগুলির ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করার চেষ্টা করা হত। সংঘগুলিকে রাষ্ট্রের কাছে নাম নথিভুক্ত করতে হত। তবে গুপ্তযুগে গিল্ডগুলি এতটাই স্বাধীন হয়ে উঠেছিল যে, তারা কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করত। তাদের নিজস্ব প্রতীক ছিল। এইভাবে সে যুগে সংঘগুলি সমাজের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রগতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। গিল্ডগুলি ছিল যুগপৎ সমাজের শক্তি ও অলংকার।

দ্বাদশ শতক থেকে শ্রেণিসংগঠনগুলির চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছিল বলে সাম্প্রতিক কালে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন। সম্ভবত আদি মধ্যযুগে সংঘগুলির সদস্য সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পুরোনো সংঘগুলি ভেঙে যায় এবং ক্রমে জাতিভিত্তিক সংঘ গড়ে ওঠে। স্বভাবতই সংঘগুলি আগেকার সাংগঠনিক শক্তি ও সংহতি থেকে বিচ্যুত হয়। আদি মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময়ে শিল্প সংগঠনগুলির অবক্ষয় দেখা দেয়। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতে, আদি মধ্যযুগে গিল্ডগুলি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়লে, তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি আপনা থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এইভাবে রাজকীয় হস্তক্ষেপ, শ্রেণিগুলির সামাজিক চরিত্রের পরিবর্তন, শ্রেণিসংগঠনের খণ্ডিতকরণ, শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা ইত্যাদি একাধিক কারণে আদি মধ্যযুগে গিল্ড ব্যবস্থার অবক্ষয় হয়।

৫। আদি-মধ্যযুগের ভারতের কৃষিপ্রযুক্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো ।

উত্তর:- আদি-মধ্যযুগে ছোটো ছোটো রাজ্যগুলির বৃহৎ রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়ার চেতনা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্ত কৃষিভিত্তি। নিশ্চিত কৃষি-আয় থেকে রাষ্ট্র তার কর্মীগোষ্ঠীকে ও সেনাদের প্রতিপালন করতে পারবে – এই চেতনা কৃষি সম্প্রসারণের প্রেরণা দিয়েছিল। উন্নত কৃষি উৎপাদনের একটি আবশ্যিক শর্ত হল জলসেচের সুবন্দোবস্ত। বিশেষত অরণ্য অঞ্চলে বা উঁচু পতিত ভূমিতে চাষের ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা ছিল খুব আবশ্যিক। আদি মধ্যযুগের প্রথমার্ধে সেচব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল। রাজকীয় উদ্যোগ যেমন ছিল, তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগেরও অভাব ছিল না। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, রাজা রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি বিশাল দিঘি খনন করে জলসেচের বন্দোবস্ত করেছিলেন। জল উত্তোলনের জন্য সেকালে ‘অরঘট্ট’ নামক যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই যন্ত্রের দ্বারা একটি চক্রাকার কাঠামোর গায়ে অনেকগুলি ঘটিজাতীয় পাত্র লাগিয়ে নীচু থেকে জল উত্তোলন করা যেত।

সপ্তম শতক ও পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখ থেকে সেকালের উন্নত কৃষি উৎপাদনের কথা প্রমাণিত হয়। সমকালে রচিত কৃষিবিষয়ক গ্রন্থ ‘কৃষিপরাশর’, ‘শূন্যপুরাণ’, ‘মন্থকোষ’ ইত্যাদি গ্রন্থে তৎকালীন কৃষি-প্রণালী, উৎপাদিত পণ্যাদি, সেচব্যবস্থা ইত্যাদির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এই সকল গ্রন্থের প্রণয়ন-প্রবণতা কৃষিকার্যের প্রতি সমকালীন সমাজের অনুরাগের পরিচয় বহন করে। বিভিন্ন লেখমালাগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে কৃষিবিষয়ক তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করেছে। ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বিলহরি লেখ’তে শাক ও বেগুন চাষের উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারত, কোঙ্কন উপকূল, আসাম ও বাংলাদেশে নারকেল ও সুপারি উৎপাদন হত। দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক পানের চাষ হত।

আদি মধ্যযুগের বাংলার একটি লেখতে ‘বারজিক’ শব্দটির উল্লেখ আছে। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার ‘বারজিক’ শব্দটিকে পানচাষ ক্ষেত্র ‘বরজ’-এর সাথে অভিন্ন বলে মতপ্রকাশ করেছেন। সুস্বাদু মশলার উৎপাদক হিসেবে ভারতের নাম বিশ্ববিখ্যাত। আদি মধ্যযুগের সাহিত্য ও লেখমালা থেকে সেকালে মশলা চাষের বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকে উৎকীর্ণ গুজরাটের একটি লেখতে কর্পূর, হিং, জায়ফল, জয়িত্রি, খেজুর ইত্যাদি চাষের কথা উল্লেখ আছে। মরিচ উৎপাদনের কথা মালবার উপকূল অঞ্চলের একাধিপত্যের কথা স্থানীয় লেখমালা এবং চৈনিক ও আরবি পর্যটকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। রাজতরঙ্গিণীতে কাশ্মীরে জাফরান চাষের উল্লেখ পাওয়া যায়। জনৈক চিনা রাজকর্মচারী চৌ-জু-কুয়া তাঁর ‘চু-ফান-চি’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রচুর তুলো উৎপাদিত হত।

অধ্যাপক চক্রবর্তী লিখেছেন “আদি মধ্যযুগের ফসলের এই তালিকা থেকে কৃষি-উৎপাদনের দৃঢ় ভিত্তি, বহুল ফলন ও ফসলের বৈচিত্র্য অনুধাবন করতে কোনো দ্বিধা ও অসুবিধা হয় না।”

৬। টীকা লেখো: স্তূপ।

উত্তর:- বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থাপত্যকীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হল স্তূপ। বৌদ্ধরা প্রথমদিকে তাদের উপাসনাস্থলে স্তূপ নির্মাণ করত। ক্রমশ স্তূপ নির্মাণ পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হতে থাকে এবং বুদ্ধের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানগুলিতে ভক্তরা স্তূপ নির্মাণ করতে থাকেন। স্তূপের আকৃতি হল অর্ধগোলাকার। স্তূপের ওই গম্বুজের মতো অর্ধগোলাকার অংশটিকে বলা হত অণ্ড, যা একটি বেদির ওপর নির্মিত হত। অণ্ডের ওপর থাকত ছত্রদণ্ড। স্তূপকে বেষ্টন করে কাঠের বা পাথরের বেষ্টনী থাকত। চারপাশে থাকত চারটি তোরণদ্বার। পরবর্তীকালে স্তূপগুলি ক্রমশ‍ই অধিক উচ্চতাপ্রাপ্ত হতে থাকে। গম্বুজগুলি ক্রমশ শঙ্কু আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

কথিত আছে, মৌর্য সম্রাট অশোক বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৮৪,০০০ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। প্রাচীন স্তূপগুলির মধ্যে ভারহুত, বোধগয়া ও সাঁচি স্তূপের উল্লেখ করা যায়। সাঁচির প্রাচীনতম স্তূপটি সম্রাট অশোকের দ্বারা নির্মিত। সিংহলের রাজধানী অনুরাধাপুরেও একটি বড়ো স্তূপ পাওয়া গেছে। তবে ভারতীয় স্তূপগুলির মধ্যে বড়ো স্তূপটি আবিষ্কৃত হয়েছে পেশোয়ারে। এটি সম্রাট কনিষ্কের দ্বারা নির্মিত। দক্ষিণ ভারতীয় স্তূপগুলির মধ্যে অমরাবতী, নাগার্জুনকোণ্ডা, ঘন্টাসল, ভট্টিপ্রোলু প্রভৃতি স্থানে নির্মিত স্তূপগুলি উল্লেখের দাবি রাখে।

৭। আদি-মধ্যযুগে শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্রসাধনার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর:- আদি-মধ্যযুগে ভারতে ধর্মচিন্তার দুটি বিশিষ্ট দিক ছিল শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্রবাদের প্রসার। বস্তুত, সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতে এই দুটি ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। শাক্তধর্মের উৎস আদিম যুগে মাতৃকাদেবীর পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে পাওয়া যায়। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন যে, শাক্তধর্ম ও তন্ত্রকে অভিন্ন ভাবা সঠিক নয়। অবশ্য তন্ত্র অতি প্রাচীন হলেও অধিকাংশ তান্ত্রিক গ্রন্থ মধ্যযুগে রচিত হয়েছে। শাক্তধর্মে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী। তিনি নানা নামে ও নানা রূপে কল্পিত হন।

প্রাচীন যুগে কাত্যায়নী, কন্যাকুমারী শক্তির আধার রূপে বন্দিত হতেন। তেমনি গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর ভারতে দুর্গা, উমা, গৌরী, কালী শাক্ত দেবীরূপে প্রচার পেয়েছেন। উড়িষ্যার জগন্নাথ উপাসনায় সুভদ্রা, বৈদান্তিক বৈষ্ণবদের বিচারে বৈষ্ণবী বা লক্ষ্মী, শ্রীচেতন্য সম্প্রদায়ের কাছে রাধা এই শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিতা হন। ঈশ্বর ও শাক্তধর্মের মূলতত্ত্ব একই। প্রভেদ একটিই – শৈবধর্মে পুরুষের প্রাধান্য এবং শাক্তধর্মে প্রকৃতির প্রাধান্য। বীর শৈবধর্মে শক্তির প্রাধান্য এত বেশি যে, দার্শনিকরা এটিকে শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলে বর্ণনা করেন।

রোমিলা থাপারের মতে, তন্ত্রবাদের জন্ম ষষ্ঠ শতকে, তবে তান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয় অষ্টম শতকে। অনেকের মতে, তন্ত্রবাদ হল বৈদিক মতবাদের সরল সংস্করণ। উত্তর-পূর্ব ভারতে তন্ত্রবাদের প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। তীব্বতীয় পূজা-পদ্ধতি ভারতীয় তন্ত্রবাদকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। তান্ত্রিক পূজা-পদ্ধতির বিশেষ অঙ্গ হল উপাসনা, রহস্যময় মন্ত্র, যাদুকরী প্রতীক এবং কোনো বিশেষ দেবতার আরাধনা। সকল বর্ণের মানুষ এবং নারী তন্ত্রবাদের চর্চা করার অধিকারী। তান্ত্রিক সাধনার তিনটি ধারা হল – পশু, বীর ও দিব্য। পশু হল সেই সকল জীবাত্মা যারা ষড় রিপুর অধীন। নৈতিক প্রচেষ্টা দ্বারা পশুর ‘বীর’ ভাব অর্জিত হয়। আর দিব্যস্তরে জীব সকল কলুষতামুক্ত হয়।

পশুভাবের মানুষকে দিব্যভাবে উন্নীত করাই তন্ত্রের লক্ষ্য। এজন্য সাতটি আচার অনুশীলন করতে হয়। এগুলি হল বৈষ্ণব, শৈব, দক্ষিণ, বাম, সিদ্ধান্ত ও কৌল। এগুলি শুচিতা, ভক্তি, জ্ঞান, উপলব্ধি ও মোক্ষের পর্যায়ে উন্নীত হতে সাহায্য করে। তন্ত্রে গুরুর প্রয়োজন সর্বাধিক। গুরু শিষ্যকে তার ‘কুল’ অনুসারে সঠিক পথের নির্দেশ দেন। নারীও গুরু হতে পারেন। শিষ্যের যোগ্যতা ও মানসিকতা অনুসারে তার দীক্ষা হয়, যেমন – ক্রিয়াদীক্ষা, বোধদীক্ষা, তত্ত্বদীক্ষা, শক্তিদীক্ষা, নামদীক্ষা ইত্যাদি। তন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ‘মন্ত্র’। মন্ত্রশক্তি দু-প্রকার – ‘বাচক’ ও ‘বাচ্য’। বাচক আসলে বাচ্যের স্বরূপ প্রকাশ করে। অর্থাৎ প্রথমটি জানার পদ্ধতি এবং দ্বিতীয়টি জানার বিষয়।

তান্ত্রিক পূজা-পদ্ধতিতে দু-রকম রহস্যের অনুকরণ করা হয় – (১) পঞ্চ ‘ম’-কার সাধনা বা ‘পঞ্চতত্ত্ব’ এবং (২) ‘ষট্‌চক্রভেদ’। পঞ্চ ‘ম’-কার হল মুদ্রা, মৎস্য, মাংস, মদ্য ও মৈথুন। মুদ্রা ও মাংস যথাক্রমে শস্য ও প্রজননের প্রতীক। মাংস ও মদ্য সৃষ্টি উপাদান কারণের প্রতীক অর্থাৎ জীবনীশক্তি। ষট্ চক্রভেদ হল শক্তির নিজস্ব উৎসে প্রত্যাবর্তন। কায়-সাধনার দ্বারা কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে নিম্নতর চক্রগুলির মধ্য দিয়ে ‘সহস্রারে’ অর্থাৎ শক্তির উৎসে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়। কেবল বামাচারী, সিদ্ধান্তচারী ও কৌলাচারীরা পঞ্চ ‘ম’-কার সাধনার অধিকারী হন।

ড. রোমিলা থাপারের মতে, “তন্ত্রবাদের জন্ম হয়েছিল গোঁড়া হিন্দু পূজা-পদ্ধতি ও ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য।” তাছাড়া তন্ত্রবাদে যাদুবিদ্যার প্রতি আগ্রহ থেকে নানা ধাতু ও রাসায়নিক বস্তু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয় এবং তার ফলে কিছু কিছু আবিষ্কার সম্ভব হয়। তিনি মনে করেন যে, ত্রয়োদশ শতকে নিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় পরিণত করার যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিল, তন্ত্রবাদ তা নিয়েও চর্চা করে।

৮। বৈষ্ণব আলবার সম্প্রদায় সম্পর্কে টীকা লেখ।

উত্তর:- দক্ষিণ ভারতে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা করেন বৈষ্ণব আলবার (আড়বার) ও শৈব নায়নার সাধকরা। তাঁরা প্রচার করেন যে, ধর্ম নিছক আচারসর্বস্ব প্রাণহীন আনুষ্ঠানিক পূজার্চনা নয়। ধর্ম হল এক গভীর সুখানুভূতি, যে অনুভূতি ঈশ্বর ও ভক্তের মধ্যে প্রাণময় প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি করে। আলবার ও নায়নার সাধকরা সহজ, সরল কথ্যভাষায় তাদের মত প্রচার করেন। তেলেগু ও তামিল ভাষায় তারা ভক্তিগীতি রচনা করেন এবং নানা স্থান পরিভ্রমণ করে প্রেম ও ভক্তির বাণী প্রচার করেন। তাঁরা জাতিভেদ মানতেন না। তারা দৃঢ়তার সাথে প্রচার করেন যে, ঈশ্বর কোনো বিশেষ জাতি বা বর্ণের নয়, ঈশ্বর সকল মানুষের।

বৈষ্ণব আলবারদের উদ্যোগে দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ভক্তিবাদ সপ্তম থেকে নবম শতকের মধ্যে বহুল জনপ্রিয়তা পায়। ঐতিহ্য অনুসারে তামিল অঞ্চলে বারোজন আলবার সাধক জন্মেছিলেন। এঁরা হলেন পোইগই বা সরযোগী, ভৃতাত্তা বা ভূতযোগী, যোই বা মহযোগী, তিরুমঢ়িশাই বা ভক্তিসার, নম্মাঢ় বা শকটকোপ, কুলশেখর, মধুরকবি, পেরিয়াঢ়বার বা বিষ্ণুচিত্ত, আণ্ডাল বা গোদা। শেষোক্ত জন ছিলেন বিষ্ণুচিত্তের কন্যা। তিনি নিজেকে গোপীরূপে কল্পনা করে প্রেমিক হিসেবে বিষ্ণু রঙ্গনাথের ভজনা করতেন। অবশিষ্ট আলবার সাধকরা ছিলেন তোণ্ডরডিপ্পোরি, তিরুপ্পন বা যোগীবাহন। শেষ আলবার সাধকের নাম, তিরুমঙ্গই বা পরকাল। এঁদের মধ্যে প্রথম চারজন পল্লব রাজ্যে জন্মেছিলেন। শেষের তিনজন জন্মেছিলেন চোলরাজ্যে। বাকি সবাই ছিলেন পাণ্ড্যরাজের সন্তান। তবে আলবার সাধকদের প্রায় সবাই সমাজের নিম্নশ্রেণি থেকে উঠে এসেছিলেন।

আলবার সাধকরা গীত রচনা ও জনগণের মধ্যে তা প্রচার করে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করতেন। ‘প্রবন্ধম’ নামক প্রাচীন তামিল সাহিত্য সংকলন থেকে আলবার সাধকদের সংগীতচর্চার বিবরণ জানা যায়। এই সংকলনে আলবার সাধকদের রচিত ৪ হাজারেরও বেশি সংগীত স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ আলবার সাধক তিরুমঙ্গই একাই রচনা করেছিলেন ১৩৬১টি সংগীত। একাদশতম সাধক তিরুপ্পন লিখেছেন মাত্র ১০টি সংগীত। পঞ্চম আলবার নম্মাঢ় ১৩০০-র বেশি গীত রচনা করেছেন। এঁদের সংগীতে লীলাকীর্তন স্থান পেয়েছে।

৯। শৈব নায়নার কারা?

উত্তর:- বৈষ্ণব আলবারদের অনুরূপ দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদী শৈবধর্মের প্রচার করে শৈব নায়নার সাধকবৃন্দ। এঁরা তামিল ভাষায় ভক্তিগীতি রচনা করে শৈবধর্মকে আধ্যাত্মিকতাবিশিষ্ট ধর্মভাবনা হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। ঐতিহ্য অনুসারে নায়নার সাধকের সংখ্যা ৬৩ জন। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান ছিলেন সাধক তিরুমুলর। ষষ্ঠ শতকে আবির্ভূত এই নায়নার সাধক ৩ হাজারেরও বেশি শ্লোক রচনা করেছেন। তাঁর ‘তিরুমন্দিরম’ গ্রন্থে ‘পতি-পশুনাথ’ নামক শৈব-সিদ্ধান্ত মতবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাঁর মতে, শৈব গ্রন্থ ‘আগম-সিদ্ধান্ত’ বেদের মতোই ঈশ্বরের বাণী। অন্যান্য সাধকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন অপ্পর (৬০০-৮১ খ্রিঃ), সম্বন্দর ( ৬৪৪-৬০ খ্রিঃ), মাণিক্যবাচকর (৬৬০-৯২ খ্রিঃ), সুন্দরর (৭১০-৩৫ খ্রিঃ) প্রমুখ।

অপ্পর বিরচিত মোট ৩১৩টি পদের পরিচয় পাওয়া গেছে। সম্বন্দর বেঁচেছিলেন মাত্র ১৬ বছর। অথচ এই অল্প সময়ে তিনি ১০ হাজারের বেশি পদ রচনা করে আপন প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তবে এদের অধিকাংশই পাওয়া যায় নি। মাত্র ৩৮৫টি পদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মাণিক্যবাচকর জীবন শুরু করেছিলেন পাণ্ডারাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি ত্যাগ করে সাধকের জীবন বেছে নেন। তিন শৈব-সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে বহু পদ রচনা করেছেন। সুন্দরর রচিত ভক্তিগীতিগুলি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। মন্দিরের প্রার্থনা সংগীত হিসেবে তাঁর পদাবলি আজও গীত হয়।

তামিল শৈব সাহিত্য ‘পেরিয়াপুরম’ গ্ৰন্থে ৬৩ জন শৈবসাধকের জীবনী ও কীর্তি লিপিবদ্ধ করা আছে। এঁদের মধ্যে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ যেমন আছেন, তেমনি আছেন অস্পৃশ্য ব্যাধজাতির মানুষও। শৈব-নায়নার সাধক পদে তাঁতি, জেলে, ধোপা, তেলি ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষের অধিষ্ঠান ভারতের জাতিবর্ণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ভাঙনের নিদর্শন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

১০। আদি-মধ্যযুগে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও ‘স্ত্রী ধন’ সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর:- নারীর সামাজিক অধিকারের মতোই অর্থনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আদি-মধ্যযুগে নারী-পুরুষ বৈষম্য অব্যাহত ছিল। মনু ও যাজ্ঞবল্ক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নারীর বিশেষ অধিকার হিসেবে ‘স্ত্রীধন’ ভোগের বিধান উভয়ে স্বীকার করেছেন। সাধারণভাবে স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর সরাসরি কোনো অধিকার ছিল না। এমনকী স্বামীর মৃত্যুর পরেও বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির অংশিদারীত্ব পেতেন না। তবে জীবিত অবস্থায় সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা হলে পুত্র সন্তানদের অনুরূপ পত্নীও একটা অংশ পেতেন। অবশ্য স্বামী পরিত্যাক্তা নারী স্বামীর সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ পাওয়ার অধিকারী ছিলেন।

যাজ্ঞবল্ক বলেছেন যে অপুত্রক অবস্থায় স্বামী মারা গেলে তার সম্পত্তির উপর বিধবা পত্নীর বৈধ অধিকার থাকবে। মনু ও যাজ্ঞবল্ক ৬ প্রকার স্ত্রীধনের কথা স্বীকার করেছেন। যাজ্ঞবল্ক বর্ণিত অধ্যাগ্নি, অধ্যবাহনীক, পিতৃদত্ত, মাতৃদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত, প্রীতিদত্ত স্ত্রীধনের সাথে আরও তিনটি সম্পত্তিকে জীবনের অর্ন্তভুক্ত করেছেন। এগুলি হল শুল্ক, অন্বাধেয় এবং সৌদায়িক। আদি মধ্যযুগেও এই অধিকারগুলি স্বীকৃত ছিল। তবে এই পর্বে জীমূতবাহন ও বিজ্ঞানেশ্বরের রচনার প্রেক্ষিতে নারীর আর্থসামাজিক অধিকার কিছুটা জটীল হয়েছে। জীমূতবাহনের বিখ্যাত গ্রন্থ দায়ভাগ এবং বিজ্ঞানেশ্বরের রচনা মিতাক্ষরা।

আদি মধ্যযুগে সম্পত্তির অধিকার বা সম্পত্তির বিভাজন সম্পর্কে দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা গ্রন্থের নির্দেশ গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে মিতাক্ষরা আইন অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকার স্থির করা হত। বাংলাদেশে মূলত প্রচলিত ছিল জিমূতবাহনের দায়ভাগ গ্রন্থের বিধান। দায়ভাগ অনুযায়ী পরিবারের প্রধান ছিলেন সকল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারী। তিনি ইচ্ছানুযায়ী সেই সম্পত্তি দান বা বিক্রয় করতে পারতেন। এইভাবে উপস্বত্বভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি হয় এবং বৃহদাকার একক ভূসম্পত্তির পরিমাণ হ্রাস পায়। অন্যদিকে মিতাক্ষরা অনুযায়ী পরিবারের প্রধান জমি বিক্রি বা দান করতে পারতেন না। কেবল পুত্রদের ইচ্ছানুসারে জীবদ্দশায় সম্পত্তিভাগ করতে পারতেন। এই কারণে মিতাক্ষর অঞ্চলে সতীদাহ প্রথার ব্যাপকতা দেখা গিয়েছিল।

রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর (মান – ১০)

১। আদি মধ্যযুগে (৬৫০-১২০০) ভারতে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ কীভাবে ঘটেছিল?

উত্তর:- আদি মধ্যযুগে ‘অগ্রহার’ ছিল নিস্কর ভূমিদান ব্যবস্থা। খ্রিস্টীয় ৩০০ শতকে ও পরবর্তীকালে ভারতে এই ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। পরবর্তী গুপ্তযুগে এবং বাকাটক, সাতবাহন, পাল, সেন, প্রতিহার, রাষ্ট্রকুট প্রভৃতি বংশের আঞ্চলিক শাসকেরা তাম্রশাসন জারি করে অগ্রহার ভূমিদান বন্দোবস্ত অব্যাহত রাখে। ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভূমিদান ব্যবস্থা পরিণত রূপ পায়। এই সময় নিস্কর ভূমি বা গ্রামদানের ঘটনা প্রায় সর্বভারতীয় চরিত্র পেয়েছিল। ফলে অগ্রহার ব্যবস্থার বৈচিত্র্য ও জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং ভারতের আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়।

Dr. R. S. Sharma, B. N. S. Jadav, D. N Jha প্রমুখ মনে করেন যে, তাম্রশাসন জারি করে ‘অগ্রহার’ ভূমিদানের মাধ্যমে ভারতে সামন্ততান্ত্রিকতার বীজ বপন করা হয়। প্রাথমিকভাবে অগ্রহার দান ধর্মস্থান ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও তাম্রশাসন জারি করে রাজস্ব হস্তান্তরের ঘটনা বাড়তে থাকে। ড. শর্মার মতে, লৌকিক উদ্দেশ্যে রাজস্ব দানের রীতি চালু হলে ভারতে সামস্তপ্রথার ভিত্তি দৃঢ় হয়।

ড. শর্মা ভারতে সামত্তপ্রথার উদ্ভব ও বিকাশ কালকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ ছিল সূচনা কাল, ৬০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দে সামস্তপ্রথা ব্যাপকতা পায় এবং ৯০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে জমি বা গ্রামের ওপর দানগ্রহীতাদের আধিপত্য স্থাপিত হয় এবং তাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী ৩০০ বছরের অগ্রহার দানের রীতি অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমকালীন লেখগুলি থেকে বাংলার পাল বংশ, চন্দ্র বংশ, সেন বংশ, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ, উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রতিহার বংশ এবং সুদূর দক্ষিণে রাজবংশগুলি কর্তৃক ব্যাপকহারে ‘অগ্রহার’, ‘ব্রহ্মদেয়’ বা ‘দেবদান’ ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়।

ব্যক্তি হিসেবে কোনো ব্রাহ্মণ বা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘অগ্রহার’ ব্যবস্থার সুযোগসুবিধা ভোগ করার ফলে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দুটি অভিঘাত দেখা যায়। – ভূমিব্যবস্থার ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার ঘটে এবং স্বামী ও ভূম্যধিকারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে এই ব্যবস্থার ব্যাপকতা আর্থসামাজিক রূপান্তর নিয়ে আসে। ভূস্বামীদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং ভূমিব্যবস্থায় স্তরবিন্যাস যেমন – রাজা, ভূস্বামী, কৃষক, ভুজ মানব ইত্যাদি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্ভাবনা প্রকট করে। জমিতে ব্যক্তি মালিকানা সৃষ্টি সারা দেশে নতুন অর্থবান ভূস্বামী শ্রেণী তৈরী করে। এঁরা ছিলেন মধ্যসত্বভোগী। জমির মালিক ছিলেন স্বয়ং রাজা বা ‘মহিপতি’। জমির প্রাপক ছিলেন স্বামী বা ভূস্বামী। কিন্তু এঁরা নিজেরা চাষাবাদ করতেন না। চাষের কাজ করত কৃষক শ্রেণী বা কর্ষক। এইভাবে ভূমিদানের ফলে ‘ত্রিস্তর’ ভূমি-সমাজ তৈরী হয় এবং মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর শোষণ কায়েম হয়। এইভাবে সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ভারতের কৃষি-অর্থনীতিতে প্রবেশ করে।

অবশ্য দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবনস মুখিয়া প্রমুখ ড. শর্মার সাথে একমত হতে পারেন নি। তাদের মতে, ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ভারতীয় ভূমি ব্যবস্থায় ছিল না। সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যেমন – উৎপাদনের উপকরণের ওপর ভূস্বামীদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব, জমির সাথে কৃষকের বন্ধন এবং জমি বিক্রয়ের সাথে সাথে কৃষকের হস্তান্তর অর্থাৎ ভূমিদাস প্রথা ইত্যাদি ভারতবর্ষে ছিল না। তাই আদিমধ্যযুগের সূচনাকালে ভারতবর্ষে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল বলে তারা মনে করেন না।

আসলে মধ্যযুগের ইউরোপের সাথে ভারতের আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যের মিল খোঁজা সঠিক নয়। ইউরোপের পরিস্থিতি ভারতের থেকে ছিল স্বতন্ত্র। তাই ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের সাথে ভারতীয় সামন্ত ব্যবস্থার তুলনা করা সমীচীন নয়। বলা যায়, ভারতে ইউরোপের মত ‘প্রবল সামন্ততন্ত্র’ কখনোই ছিল না। তবে সপ্তম শতক ও দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতবর্ষে ভূমিদানের ব্যাপকতা এবং নতুন ভূস্বামী শ্রেণীর সৃষ্টির ফলে সামন্তব্যবস্থার প্রায় অনুরূপ ভূমি-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

২। ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে রামশরণ শর্মার বক্তব্য কী ছিল?

উত্তর:- Dr. R. S. Sharma মনে করেন যে, তাম্রশাসন জারি করে ‘অগ্রহার’ ভূমিদানের মাধ্যমে ভারতে সামন্ততান্ত্রিকতার বীজ বপন করা হয়। প্রাথমিকভাবে অগ্রহার দান ধর্মস্থান ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও তাম্রশাসন জারি করে রাজস্ব হস্তান্তরের ঘটনা বাড়তে থাকে। ড. শর্মার মতে, লৌকিক উদ্দেশ্যে রাজস্ব দানের রীতি চালু হলে ভারতে সামস্তপ্রথার ভিত্তি দৃঢ় হয়।

ড. শর্মা ভারতে সামত্তপ্রথার উদ্ভব ও বিকাশ কালকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ ছিল সূচনা কাল, ৬০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দে সামস্তপ্রথা ব্যাপকতা পায় এবং ৯০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে জমি বা গ্রামের ওপর দানগ্রহীতাদের আধিপত্য স্থাপিত হয় এবং তাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী ৩০০ বছরের অগ্রহার দানের রীতি অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমকালীন লেখগুলি থেকে বাংলার পাল বংশ, চন্দ্র বংশ, সেন বংশ, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ, উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রতিহার বংশ এবং সুদূর দক্ষিণে রাজবংশগুলি কর্তৃক ব্যাপকহারে ‘অগ্রহার’, ‘ব্রহ্মদেয়’ বা ‘দেবদান’ ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়।

ড. শর্মা আরও দেখিয়েছেন যে, পাল, প্রতিহারদের তাম্রশাসনগুলিতে দান করা গ্রামের সীমানা স্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট থাকত না। ফলে দানগ্রহীতা কৃষি এলাকার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আরও বেশি পরিমাণ রাজস্ব ভোগের সুযোগ পেতেন। এই অতিরিক্ত উৎপাদনে কোনো অংশ রাজকোশে জমা দিতে হত না। এইভাবে জমির ওপরে রাষ্ট্রীয় ও যৌথ অধিকারের ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে ভূস্বামীদের অধিকার বৃদ্ধি পেয়েছিল।

নোবুরু কারাসিমা তাঁর ‘Private land in the lower kaveri valley’ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে, সুদূর দক্ষিণে ব্যক্তিমালিকানার বিকাশ ঘটেছিল। তাঁর গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ ভারতে ব্যক্তিগত অধিকারের ধারণা বৃদ্ধি পাওয়ায় এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলের জমি ক্রয় করে স্থানীয় অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন। চোল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও এইভাবে ভূস্বামী হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর গবেষণায় জানা যায় যে, রাজরাজ বা রাজেন্দ্র চোলের আমলে বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী অর্থবান হয়েছিলেন। এই লুণ্ঠনের অর্থে জমি ক্রয় করে তাঁরা ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার ঘটান।

‘অগ্রহার’ দ্বারা উপকৃত ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি সাধারণভাবে ক্ষমতাবান ছিল। কিন্তু যখন কোনো রাজা স্থানীয় উচ্চপদস্থ কর্মচারীর হাতে বৃহৎ ভূখণ্ডের অধিকার ও প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করেন, তখন ভূস্বামীরা অনেক বেশি ক্ষমতাবান হন এবং সামন্ততান্ত্রিক অধিকার জোরালো হয়। ড. শর্মার মতে, সামন্তরা নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্য সংকুচিত হয় এবং মুদ্রার ব্যবহার হ্রাস পায়। ফলে নগদ অর্থে কর্মচারীদের বেতন হিসেবে নির্দিষ্ট এলাকায় রাজস্ব ভোগের অধিকার দেওয়া হয়। এইভাবে অভিজাত ভূস্বামীদের উদ্ভব ঘটে এবং রাজনৈতিক ও সামরিক অধিকারের ওপর তাদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। সামন্তদের জন্য এইভাবে নির্দিষ্ট এলাকার রাজস্ব বরাদ্দ করার মধ্যে মধ্যযুগীয় জায়গির ব্যবস্থার পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

প্রতিহাররাজ তৃতীয় বিগ্ৰহপালের আমলে সামন্তরা যে এক-একটি এলাকা বংশানুক্রমিক ভাবে ভোগ করতেন, তার নজির আছে। এর ফলে ভূমিব্যবস্থা ও আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে সামন্তদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধির সুযোগ এসেছিল। ড. শৰ্মা আদি মধ্যযুগে সামন্তদের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে কৃষক অসন্তোষ এবং সেই বিদ্রোহ দমনে সামন্তদের ওপর রাজার নির্ভরতার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এমন দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি পাল রাজা রামপালের আমলে কৈবর্ত বিদ্রোহকে চিহ্নিত করেছেন। এই চাষি কৈবর্তদের দমনের জন্য রামপাল কর্তৃক সামন্তদের সাহায্য গ্রহণের ঘটনাটিকে সামন্তদের প্রচন্ড দাপটের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ড. শৰ্মা ৩০০-১০০০ অব্দে ভারতের বাণিজ্যে অধোগতি এবং নগরের অবক্ষয়ের বিষয় উল্লেখ করেছেন। সামন্তব্যবস্থার ফলে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঘটলে বাণিজ্য শিথিল হয় এবং একই কারণে নগরের অবক্ষয় ঘটতে থাকে। এটিকেও তিনি আদি মধ্যযুগের জমির ওপর ব্যক্তিমালিকানার পরিণতি বলে মনে করেন।

৩। আদি মধ্যযুগের সমাজে জাতি ও বর্ণব্যবস্থার রূপান্তর বর্ণনা কর।

উত্তর:- ভারতীয় সমাজব্যবস্থার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বর্ণ ও জাতি সম্পর্কিত ধারণা এবং উভয়ের সম্পর্ক। বর্ণ ও জাতিব্যবস্থার আপাত মিল থাকলেও দুটি ধারণা সম্পূর্ণ অভিন্ন নয়। এদের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রভেদ বর্তমান। বর্ণ চারটি, কিন্তু জাতি অসংখ্য। হাজার হাজার জাতি কোনো-না-কোনো বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন ভারতে বর্ণব্যবস্থাকে বিশেষ ‘একক’ বলে মনে করা হত। এক বর্ণের মধ্যে অনেক জাতির অবস্থান ঘটত। বর্ণবিভক্ত ভারতীয় সমাজে বিদেশিদের আগমন ও বসবাস এবং বিভিন্ন উপজাতির সমাবেশের ফলে জাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধর্মশাস্ত্রে এই সকল জাতিকে বর্ণসংকর বা বর্ণসংকীর্ণ আখ্যা দিয়ে আদি বর্ণবিভক্ত সমাজে সাঙ্গীকরণের ব্যবস্থা করা হয়। সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে বর্ণ ও জাতির প্রভেদ ধীরে ধীরে কমে আসে।

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে তাম্রশাসন জারি করে ভূমিদানের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এইভাবে জমি ও ক্ষমতা বণ্টনের ফলে নতুন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণিব্যবস্থা গড়ে উঠে, যা প্রচলিত চতুর্বর্ণব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র। সপ্তম শতকের পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে চতুর্বর্ণের উপযোগী বাসস্থানের বর্ণনা স্থান পেত। পরবর্তীকালের কোনো কোনো গ্রন্থে এই চতুর্বর্ণব্যবস্থা লঙ্ঘিত হয়েছে। গণপতি শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘ময়মত’ পুঁথির অনুবাদে সম্রাট, দ্বিজ, নৃপতি, বৈশ্য, সেনাপ্রধান, শূদ্র, সামন্ত প্রমুখদের বাসগৃহের আকৃতি, যা সামাজিক মর্যাদার দ্যোতক, উল্লেখ করা হয়েছে।

বরাহমিহির তাঁর ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে জন্মভিত্তিক চতুর্বর্ণব্যবস্থাকে রক্ষা করার প্রয়াস করেছেন। কিন্তু প্রায় সমকালীন অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণপ্রথার কঠোরতাকে অগ্রাহ্য করে সামন্তপ্রভু ও উপসামন্তদের সামাজিক স্তর নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অধ্যাপক শর্মা আদি-মধ্যযুগের সমাজব্যবস্থার সাথে বৈদিক যুগের বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মধ্যস্বত্বভোগী ভূস্বামীদের বর্ণব্যবস্থা-বহির্ভূত সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার উল্লেখ করেছেন। ছত্রধারণ, অশ্বারোহণ, পালকিযাত্রা, তোরণ নির্মাণ ইত্যাদি সামাজিক মর্যাদার দ্যোতক উপাদানগুলি বিভিন্ন স্তরের ভূস্বামীরা নিজ অবস্থান অনুযায়ী ভোগ করতে পারতেন। এক্ষেত্রে প্রচলিত বর্ণ ব্যবস্থার কোনো গুরুত্ব ছিল না। প্রাপকের ভৌমিক অবস্থানই ছিল তার মর্যাদার মাপকাঠি।

আদি-মধ্যযুগের ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পেশা ও প্রশাসনিক ক্ষমতাভিত্তিক বহু উপাধির জন্ম হয়েছে, যাদের কোনো নির্দিষ্ট বর্ণ বা জাতি হিসেবে সংগঠিত করা যায় না। উত্তর ভারতের মহত্তর, পশ্চিম ভারতের পট্টকিল, দাক্ষিণাত্যে গাবুণ্ডা প্রভৃতি কোনো একক জাতি নয়। মধ্যযুগের গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতাধারী এই সকল গোষ্ঠী যথেষ্ট ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন। এদের উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমানের মেহতা, মাহাথা, মালহোত্র, মেহরোত্রা কিংবা পটেল, পাতিল অথবা কর্ণাটকের গৌড়া, দেবগৌড়া প্রমুখকে অভিন্ন জাতি-বর্ণের অন্তর্ভুক্ত শ্রেণি হিসেবে দেখা যায় না। অধ্যাপক শর্মার মতে, গ্রামীণ বন্দোবস্তে এই সম্পদশালী শ্রেণিকে গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে জাতিবর্ণনির্বিশেষে দেখা গেছে।

আদি-মধ্যযুগে ভূমিদান ব্যবস্থার ব্যাপকতার সূত্রে নতুন বৃত্তিজীবী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণ ও কর্মচারীদের ভূমিস্বত্বদানের সঙ্গে সঙ্গে জমির রাজস্ব নির্ধারণ, কৃষক নিয়োগ, ভূমিস্বত্বাধিকারীর নথি রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই কাজ সম্পাদনের জন্য করণিক এবং নথিরক্ষক নামক কর্মচারী নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়ে। এর থেকেই লিপিকর বা কায়স্থ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম শতকে জমির স্বত্ব এবং সীমানা-সংক্রান্ত বিতর্ক ক্রমে বৃদ্ধি পায়। এই বিতর্কের সমাধানের জন্য নথিপত্রের সাক্ষ্য খুব জরুরি অনুভূত হয়। ফলে সমাজে কায়স্থ বা লিপিকরদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ক্রমে কায়স্থরা ভারতের সমাজব্যবস্থা ও জাতিপ্রথার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

এই কায়স্থ শ্রেণিই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার করণ উপাধি ভোগ করেন। তারা সবাই কায়স্থ শ্রেণির অন্তর্ভুক। প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় তাদের স্থান নির্ণয় কিছুটা কঠিন। প্রথমদিকে শিক্ষিত ব্রাহ্মণরাই কায়স্থ বা লিপিকর হিসেবে নিযুক্ত হতেন। ক্রমে বিভিন্ন বর্ণ থেকে লিপিকররা নিযুক্ত হতে থাকেন। কায়স্থ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মানুষেরা সামাজিক ক্ষেত্রে ক্রমশ একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করেন এবং এই নতুন সম্প্রদায়ের মধ্যেই সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়। স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে কায়স্থদের উৎপত্তি বা প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় তাদের স্থান সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। সম্প্রতি উচ্চ বিচারালয় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও শূদ্র উভয় বর্ণের অস্তিত্ব আছে বলে রায় দিয়েছে।

আদি-মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বৈশ্যদের অবনমন এবং শূদ্রদের উত্থান। ফলে উভয় বর্ণ এক সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করতে শুরু করে। আরবীয় পণ্ডিত অলবেরুণীর মতে, সেকালে বৈশ্য ও শূদ্রদের মধ্যে বিশেষ তফাত ছিল না। তারা একই এলাকায় মিলেমিশে বসবাস করত। স্কন্দপুরাণ-এর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, কলিযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের পতন ঘটেছিল। ড. শর্মার মতে, একাদশ শতক থেকে বৈশ্যরা প্রথাগত ও আইনত দিক থেকে শূদ্র হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, বাংলায় সেনবংশের রাজত্বকালে ব্যবসাবাণিজ্যের পতনের ফলে বাণিজ্যজীবীদের অবস্থা সঙ্গিন হয়েছিল। পরিণামে সুবর্ণবণিক, তৈলকার, স্বর্ণকার, কর্মকার, কৈবর্ত, সূত্রধর প্রমুখ সৎ শূদ্র পদ থেকে অবনমিত হয়েছিলেন।

অন্যদিকে একই সময়ে (সপ্তম-একাদশ শতক) শূদ্রদের সামাজিক অবস্থান ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। এখন তারা কেবল কৃষিশ্রমিক বা দাসমাত্র ছিল না। শূদ্ররা এখন কৃষিজীবী শ্রেণি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ‘স্কন্দপুরাণ’ গ্রন্থে শূদ্রদের অন্নদানকারী (অন্নদ) ও গৃহপতি বলা হয়েছে। হিউয়েন সাঙও শূদ্রদের কৃষিজীবী বলে উল্লেখ করেছেন। এইভাবে আদি-মধ্যযুগে শূদ্র ও বৈশ্যদের মধ্যে তফাতটা প্রায় মুছে যায়। সমাজে সম্পদ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ী, কারিগর ও শ্রমজীবী মানুষ একই বর্ণভুক্ত হিসেবে পরিগণিত হয়।

৪। আদি-মধ্যযুগে শূদ্রদের সামাজিক অবস্থা নির্ণয় কর।

উত্তর:- শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। এহেন মেরুকরণ এবং মধ্যবর্তী গোষ্ঠীর অভাব এই সকল এলাকায় কৃষি সম্পর্কে জটিলতার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু অবশিষ্ট ভারতে রাজপুত জাতির উদ্ভব এবং ক্ষত্রিয় হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠা সামাজিক ক্ষেত্রে ভেদাভেদের সীমারেখা কিছুটা শিথিল করেছিল। তাই উত্তর ভারতে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের অধীনে অনেক জাতি সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে দুই মেরুতে অবস্থান করছিল ব্রাহ্মণ ও শূদ্ররা। এই অঞ্চলে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সুপ্রতিষ্ঠিত বর্ণসম্প্রদায় ছিল না। ব্রাহ্মণদের সংখ্যা শূদ্রদের তুলনায় ছিল কম। মূলত ভূমিকেন্দ্রিক একটি সম্প্রদায় হিসেবে ব্রাহ্মণরা বিবেচিত হত। কৃষক, কারিগর ও আদি উপজাতীয় মানুষেরা শূদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’ ও ‘বৃহৎধর্মপুরাণ’ সাহিত্যে সৎ-শূদ্র ও অসৎ-শূদ্র হিসেবে প্রায় পঞ্চাশটি জাতির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণসহ ছত্রিশটি প্রচলিত জাতির পাশাপাশি বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে সৎ ও অসৎ শূদ্র হিসেবে অসংখ্য জাতির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে’ উল্লিখিত সৎ শূদ্র জাতির অন্যতম ছিল গোয়ালা, নাপিত, মোদক, তাম্বুলি, মালাকার, কংসকার, কর্মকার, শঙ্খকার ইত্যাদি। ‘মিশ্র-শূদ্র’ জাতি হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায় স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, রাজমিস্ত্রি, চিত্রকরণ, সূত্রধর, তেলি, শিকারি, কুস্তিগির, সেট, চর্মকার, মাংসবিক্রেতা, কোল, চণ্ডাল, হাড়ি, ডোম, যুগি, কৈবর্ত, রজক, ধীবর, তস্কর ইত্যাদি। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ এদের ‘অসৎ-শূদ্র’ অভিধা দেওয়া হয় নি, তবে ‘পতিত’ বা ‘অধম’ বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে।

‘বৃহৎধর্মপুরাণে’ শূদ্রদের সৎ-শূদ্র ও মিশ্রজাতি – এই দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। মিশ্রজাতিভুক্তদের পতিত বা অসৎ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের আবার উত্তম, মধ্যম ও অন্ত্যজ – এই ত্রিস্তর বিভাজন করা হয়েছে। তিনটি স্তরে বিন্যস্ত মিশ্রজাতিভূক্তদের সংখ্যা চল্লিশ। এই সময় নীচু বা অস্পৃশ্য জাতির দ্রুত বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রামশরণ শর্মা বলেছেন যে, গুপ্ত-পরবর্তী যুগে বহু স্থানীয় উপজাতি ব্রাহ্মাণ্যকরণ ব্যবস্থার মধ্যে গৃহীত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে কোনো কোনো জাতি কৃষিকাজে যুক্ত ছিল, কিন্তু আধুনিক কৃষিকর্ম অনুসরণ করে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর বিষয়ে তাদের অনীহা ছিল। এই সকল জাতিকে ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থার বাইরে রাখার জন্য অস্পৃশ্য আখ্যা দেওয়া হত। দ্বিতীয়ত, কিছু উপজাতি ব্রাহ্মাণ্যকরণের পথে বাধার সৃষ্টি করত। এদেরও একইভাবে গ্রাম-সমাজের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পালরাজাদের বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিদ্রোহকে এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা যায়। অধ্যাপক শৰ্মা আদি-মধ্যযুগকে ‘জাতিবিস্তার’ ও ‘খণ্ডবিচ্ছিন্নতার যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

রাজপুত জাতির সৃষ্টি জাতিবিস্তারের কাজকে ত্বরান্বিত করেছিল। চালুক্য, চান্দেল্ল প্রমুখ সূর্য ও চন্দ্রবংশ সম্ভূত রাজপুত ক্ষত্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিদেশি জাতিগুলির ভারতে অনুপ্রবেশ ও এদেশীয় সমাজের অঙ্গীভূত হওয়ার সূত্রে রাজপুতদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। হুন, গুর্জর প্রভৃতি জাতির ভারতীয় বংশধররা রাজপুত নামাঙ্কিত হয়ে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার অঙ্গীভূত হলে জাতির সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। সোলাঙ্কি, চৌহান, তোমর, গাহড়বাল প্রমুখ রাজপুত জাতি ক্ষত্রিয় হিসেবেই ভারতীয় বর্ণব্যবস্থায় জাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে।

বর্ণভেদ ও জাতিভেদ ব্যবস্থা প্রাচীন যুগের ভারতীয় সমাজে শোষণ-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে সক্রিয় ছিল বলে বার বার আলোচিত হয়েছে। এই অসহনীয় সামাজিক ব্যবস্থার ফলে সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিল নিম্নশ্রেণির মানুষ। তাই বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্মমত প্রাচীনযুগে কিংবা ভক্তিবাদ মধ্যযুগে সমাজের এই বিশেষ অংশের সমর্থনে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অসংখ্য নতুন ধর্মসম্প্রদায় ভারতীয় সমাজে জাতিভেদ ব্যবস্থাকেই পুষ্ট করেছে। রামশরণ শর্মা লিখেছেন যে, “জন্মগত সুযোগ-সুবিধা এবং জাতিভেদ দূর করার জন্য যে ধর্মীয় সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছিল, তারাই আবার বর্ণব্যবস্থার শিকার হয়েছে।” একে তিনি ‘ইতিহাসের পরিহাস’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সপ্তম শতকের মধ্যেই বৌদ্ধরা আঠারোটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কর্ণাটকে আদি-মধ্যযুগে জৈনদের মধ্যে সাতটি পৃথক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামীদের মধ্যেও সম্প্রদায়গত জাতিভেদ দেখা যায়। গুরু-কেন্দ্রিক এক-একটি ধর্মসম্প্রদায় নিজেদের গুরুর পরিচয়কে ভিত্তি করে পৃথক পৃথক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়, যেমন – কর্ণাটকে লিঙ্গায়েত ও বীর শৈব কিংবা উত্তর ভারতে রাধাস্বামীন সম্প্রদায় স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

৫। আদি-মধ্যযুগের সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর:- ভারতীয় সমাজ মূলত পিতৃতান্ত্রিক। প্রাচীন স্মৃতিসাহিত্যে নারীজাতির প্রতি সামাজিক অবহেলা ও পারিবারিক অনুকম্পার বহু দৃষ্টান্ত আছে। ধর্মশাস্ত্রের বিধানে সম্পত্তির উপর পুরুষের অধিকারকে ‘কর্তৃত্ব ও গৌরবের প্রতীক’ বলা হয়েছে। তবে আদিম উপজাতীয় সমাজে জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে নারী ও পুরুষের সামাজিক ভেদাভেদ ততটা তীব্র ছিল না। ক্রমে কৃষিভিত্তিক স্থায়ী সমাজ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে নারীর উপর পুরুষ জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ঘটতে থাকে।

মৌর্যত্তরযুগে নারীর অবস্থা সম্পর্কে নানা তথ্য স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ, অর্থশাস্ত্র, গ্রিক রচনা ইত্যাদি থেকে পাওয়া যায়। মৌর্যযুগে নারীরক্ষিবাহীনির অস্তিত্ব ছিল। গুপ্তচর হিসেবেও নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অশোকের লেখ অনুসারে ধর্মকাজেও নারী অংশগ্রহণ করতেন। কালক্রমে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি অনুসরণ করে নারীর উপর বিধিনিষেধ চাপানো শুরু হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদি মধ্যযুগের গোড়ায় শিক্ষা সংস্কৃতিতে নারীর অংশগ্রহণের উল্লেখ থাকলেও সেগুলিকে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যায়। মুষ্টিমেয় বিত্তবান বা ক্ষমতাবান পরিবারের নারীর এই সুযোগ পেতেন। কিন্তু ভারতের সার্বিক চিত্র ছিল বিপরীত। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে নারী বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবেন। অগ্নিতে আহুতি প্রদান কিংবা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার থেকেও নারীদের বঞ্চিত করা হয়েছিল।

আদিমধ্যযুগে নারীজাতির অধিকার কিংবা নারী পুরুষের সামাজিক অবস্থানের কোনো গুরুতর পরিবর্তন ঘটেনি। এইসময় স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান প্রয়োগে কঠোরতা বাড়ানো হয়েছিল। কিশোরী কন্যাকে বিবাহ দান করা পিতামাতার প্রাথমিক কর্তব্য বলে বিবেচিত হত। এই সময় নারীর পত্নীত্বের অধিকার কিছুটা সুদৃঢ় করা হয়েছিল মাত্র। কয়েকটি বিশেষ কারণ ছাড়া পত্নীকে পরিত্যাগ করা যেত না, এমনকী ব্যাভিচারীনি পত্নীকেও শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান দ্বারা স্বমর্যাদায় পুনপ্রতিষ্ঠিত করা যেত।

স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থে বলা হয়েছে যে পত্নী স্থায়ীভাবে অসুস্থ হলে, সন্তানধারণে অক্ষম হলে কিংবা শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে-স্বামী দ্বিতীয়া পত্নী গ্রহণ করতে পারতেন। অবশ্য সেক্ষেত্রে প্রথমা পত্নীর ভরণপোষণ এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকতেন। কোনো স্বামী অকারণে তার পত্নীকে সামাজিক ও আর্থিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে রাজদরবারে স্বামীকে অভিযুক্ত করা যেত। এতদসত্ত্বেও বিজ্ঞানেশ্বর-এর রচনা থেকে জানা যায় যে আদি-মধ্যযুগে অনুলোম পর্যায় থেকে পুরুষের বহুবিবাহ ছিল সাধারণ ঘটনা।

আদি-মধ্যযুগে নারীর সামাজিক অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং শাসক হিসেবে দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনার দৃষ্টান্ত আদি মধ্যকালীন ভারতে নারীর অধিকারে নতুন বার্তা বহন করে আনে। ভেনিসীয় পর্যটক মার্কোপোলোর বিবরণ থেকে জানা যায় কাকতীয় রাজ্যের রানী রুদ্রামা দীর্ঘ ৪০ বছর দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। চালুক্যরাজ প্রথম সোমেশ্বরের মহিষী এবং ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের মহিষী দক্ষ প্রশাসিকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চালুক্যদের অধীন সামন্তরাজাদের কোনো কোনো পত্নী রাজনীতিতে অংশ নিয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ কানাড়া জেলায় রাণী বল্লমহাদেবী দীর্ঘ ১৪ বছর দক্ষতা ও সাহসের সাথে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন এবং ‘পরমাবলসাধক’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। কাশ্মীরের আঞ্চলিক শাসিকা হিসেবে রাণী দিদ্দা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

রাজনীতিতে অংশ নিলেও এগুলিকে আদি-মধ্যযুগে নারীর সার্বিক জীবনচিত্র বলা যায় না। রোমিলা থাপার মনে করেন আদি-মদ্যযুগে নারীর মর্যাদা কখনোই স্থিতিশীল বা একইরকম ছিল না। ‘Indian women’ প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন (১৯৭৫) যে, সেকালে নারী একদিকে যথেষ্ট কতৃত্ব ও স্বাধীনতার অধিকরিনী ছিলেন আবার কখনও সমানভাবে পরাধীন ছিলেন। নারীদের গৃহকোণে গৃহস্থালী কাজে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা আদি-মধ্য যুগেও পূর্বের মতোই বলবৎ ছিল।

আদি মধ্যযুগের চূড়ান্ত পর্বে (৯-১২ শতক) নারীজাতির অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটে নি। স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই সময় পত্নীকে পরিত্যাগের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ ছিল। এমনকী ব্যাভিচারীনি পত্নীকেও ত্যাগ করা যেত না। প্রায়শ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তাকে গ্রহণ করতে হত। কোনো পরিস্থিতিতেই পত্নীর উপর শারীরিক নির্যাতন করা যেত না।

৬। আদি-মধ্যযুগে নগরায়ণ কিভাবে ঘটেছিল? অথবা, ভারতে তৃতীয় নগরায়ণ সম্পর্কে লেখ।

উত্তর:- ভারতবর্ষে নগরের উদ্ভব হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫০ অব্দে। হরপ্পা-সংস্কৃতির মধ্যে এই প্রথম পর্বের নগরায়ণের প্রকাশ ঘটে। প্রথম পর্বের নগরায়ণের পতন ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দে। ভারতবর্ষে দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণের মূল কেন্দ্র ছিল মধ্যগাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল। ভারতে তৃতীয় পর্যায়ের নগরায়ণ ঘটে আদি-মধ্যযুগে। কিন্তু এই নগরায়ণের সঠিক সময়কাল সম্পর্কে অধ্যাপক শর্মার সাথে অধ্যাপক ব্ৰজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতভেদ দেখা যায়। শর্মার মতে, ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অধিকাংশ নগর বিলুপ্তির পথে এগোতে থাকে। সামান্য কিছু ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকে। তারপর সেগুলিও ধ্বংস হয়ে যায়। এমন নগর এদেশে খুব কমই আছে, যার অস্তিত্ব ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল বলে মনে করা যায়।

এই প্রসঙ্গে আদি-মধ্যযুগে বাণিজ্যের সংকোচনজনিত কারণে নগরায়ণ ব্যবস্থার অধোগতির বিষয়টি স্মরণীয়। নবম শতক থেকে আরবদের লেখার মধ্যে আরব ও ভারতীয় বণিকদের বাণিজ্যের কথা জানা যায়। সুলেমান, ইবন খুরদাবাদ, আল মাসুদ, আল ইদ্রিসি প্রমুখের লেখায় গুজরাট, কোঙ্কন ও মালাবার উপকূলের ভারতীয় বন্দর ও শহরের অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। চোল বন্দরে প্রায় দশ হাজার মুসলমান বাস করতেন বলে আল মাসুদি লক্ষ্য করেছেন। নবম শতকের রাষ্ট্রকূট লেখমালা তে এই বক্তব্যের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। ইহুদি বণিকদের গেনিজা পত্রমালার ভিত্তিতে এস. ডি. গয়েতিয়েন ভারত ও আলেকজান্দ্রিয়ার উজ্জ্বল বাণিজ্যের কথা বলেছেন। নবম শতকে আরব বণিকদের রচনা থেকে বাংলায় ‘সমন্দর’ নামক বন্দরের অস্তিত্ব জানা যায়। এই সকল বিবরণ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, আদি-মধ্যযুগে বাণিজ্যের গতি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায় নি এবং নগরায়ণের কাজ সীমিত আকারে হলেও অব্যাহত ছিল।

অন্যদিকে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় একথা বিশ্বাস করেন যে, চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সময়কালে উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি সমৃদ্ধ নগর অবক্ষয়ের কবলে পড়েছিল। কিন্তু এই অবক্ষয় সার্বিক ছিল বলে ড. চট্টোপাধ্যায় মনে করেন না। সমকালীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ও লেখর ভিত্তিতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, আদি-মধ্যযুগেও বেশ কিছু নগর নিজ নিজ চরিত্র বজায় রাখতে পেরেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, দ্বিতীয় পর্বের বিখ্যাত নগর অহিচ্ছত্র ষষ্ঠ শতকের পরেও শহুরে চরিত্র বজায় রেখেছিল। দিল্লির পুরোনো কিল্লা, উত্তরপ্রদেশের অত্রঞ্জিখেড়া প্রভৃতি স্থানে উৎখনন করে তুর্কি অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত নগরের অবক্ষয়ের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। একইভাবে ৩০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের অন্তর্বর্তীকালে বারাণসী নগরের অস্তিত্ব অব্যাহত ছিল। বারাণসীর সন্নিকটে রাজঘাটে চতুর্থ স্তর (৩০০-৭০০ খ্রিঃ) এবং পঞ্চম স্তরে (৭০০-১২০০ খ্রি:) খননকার্যের ফলে এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

৮৬৭-৯০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ দশটি লেখ থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় বুলন্দ শহরের সন্নিকটে তত্তানন্দপুর শহরের অস্তিত্ব জানা যায়। লেখমালাতে বিভিন্ন রাস্তার বর্ণনা (কুরথ্যা ও বৃহদ্রথ্যা), শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাজার (পূর্ব হট্ট), বাজারে যাওয়ার পথ (হট্টমার্গ) ইত্যাদি উন্নত নগরজীবনের সাক্ষ্য বহন করে। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন, “তত্ত্বানন্দপুর যে নগরসুলভ আকার চরিত্র ধারণ করেছিল, ‘আহাড়ের’ উৎখনন থেকেও তার সমর্থন মিলেছে।”

প্রতিহার সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সিয়াডোনিতে প্রাপ্ত লেখটি ৯০৭-৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে সেখানে নগরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এখানে ‘পত্তন’ (শহর), ‘হট্ট’ (বিপণনকেন্দ্র), ‘অপরসরক’ (বারান্দাযুক্ত বাড়ি) ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার নগর চরিত্রের আভাস দেয়। নগরজীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মণ্ডপিকারও অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করা হয়। বাণিজ্যিক কেন্দ্রের পাশাপাশি সম্ভবত সিয়াডোনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৮৭৫ ও ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের দুটি লেখ থেকে জানা যায় যে, গুর্জর-প্রতিহারদের আর একটি ব্যস্ত নগর ছিল গোপাদ্রি (বর্তমান গোয়ালিয়র)। নগরটি সম্ভবত প্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। সে কারণে নগরটিকে ‘কোট্ট’ বা ‘কেল্লা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিহার রাজাগণ নিযুক্ত ‘কোট্ট পাল’ এই দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। ‘বলাধিকৃত’ উপাধিধারী উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারী গোপাদ্রিতে অবস্থান করতেন। এর থেকে এই নগরীর প্রশাসনিক গুরুত্ব বোঝা যায়।

ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় গুর্জর ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘পৃথুদক’ (আধুনিক পেহোয়া) নামক আদি-মধ্যযুগের একটি নগরের উল্লেখ করেছেন। তবে পৃথুদকের তুলনায় সিয়াডোনি ও গোপাদ্রি অনেক বেশি সমৃদ্ধ, ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল বলে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় মনে করেন। সিয়াডোনি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল। অন্যদিকে গোপাদ্রি সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

দশম শতকে উৎকীর্ণ কলচুরি রাজ্যের শাসক দ্বিতীয় লক্ষ্মণরাজ-এর ‘করিতলাই লেখ’র ভিত্তিতে ড. চট্টোপাধ্যায় ওই অঞ্চলে (মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর) নগরায়ণের সাক্ষ্য উপস্থিত করেছেন। এই লেখতে ‘পুরপত্তন’ কথাটি উৎকীর্ণ আছে। এছাড়া ‘বিলহরি’ লেখতে এই অঞ্চলে বৃহদাকার পত্তন মণ্ডপিকার কথা উল্লেখ আছে। সম্ভবত বিলহরির সুবিস্তৃত উৎপাদনক্ষেত্র ওই অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজাত উদ্‌বৃত্ত জোগান দিত। এইভাবে বিলহরি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। একইভাবে রাজস্থানের নাডোল কৃষি-বাণিজ্যের আর একটি কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এখানে ‘মণ্ডপিকা’ গড়ে উঠলে নাডোল শহুরে চরিত্র লাভ করে। পরবর্তীকালে চহমান রাজাদের রাজধানী হিসেবে নাডোল প্রতিষ্ঠা পায়।

আর চম্পকলক্ষ্মী মালাবার উপকূল-সহ দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যের প্রসার সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তিনিও আদি-মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যকেন্দ্রিক নগরের উদ্ভবের কথা স্বীকার করেছেন। ‘গ্রোথ অব আর্বান সেন্টার্স ইন সাউথ ইন্ডিয়া..’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘কুড়ামুক্কু-পালাইয়ারাই’ নামক জোড়া শহরের উত্থান ও বিকাশের কথা উল্লেখ করেছেন। কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই যুগ্ম শহরের পটভূমিতে তিনি স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চাহিদা, সন্নিহিত পশ্চাৎভূমি থেকে উদ্‌বৃত্তের জোগান ইত্যাদি উপাদানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। বাণিজ্যের কারণে এখানে জনবসতি বৃদ্ধি পায়। শহরের উদ্ভবের প্রাথমিক পর্বে স্থানীয় মন্দির কর্তৃপক্ষ নানাভাবে বণিকদের সাহায্য করেন। এইভাবে কুড়ামুক্কু পালাইয়ারাই শহরের প্রতিষ্ঠা ঘটে।

৭। আদি-মধ্যযুগে ভারতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের অবস্থা উল্লেখ কর।

উত্তর:- আদি মধ্যযুগের অর্থনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে রামশরণ শর্মা, ডি. এন. ঝা প্রমুখের বিশ্লেষণের সাথে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখের বক্তব্যের মৌলিক পার্থক্য সমকালীন বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। শর্মা প্রমুখ মনে করেন যে, অগ্রহারব্যবস্থা ও ভূমিদাস কর্মসূচির বহুমাত্রিক প্রয়োগ ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি করে, যার পরিণতিতে একদল শক্তিশালী ভূম্যধিকারীর উদ্ভব ঘটে। ক্রমে উৎপাদন-ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের প্রাধান্য ঘটে এবং অনিবার্যভাবে বাণিজ্যের অবক্ষয় দ্রুততর হয়। একইভাবে সামন্তব্যবস্থার বিকাশ ভারত-রোম বাণিজ্যের ধারাকে শিথিল করলে বহির্বাণিজ্যেও মন্দা প্রকটতর হয়।

পক্ষান্তরে, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গবেষক মুদ্রা ও লেখমালার ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, ষষ্ঠ শতক ও একাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ ও গতি কিছুটা দুর্বল হলেও, তাকে এককথায় অবক্ষয়ী বা নগণ্য বলা যায় না। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় মধ্য ভারতের বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বণিকদের ব্যস্ততার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ভকত প্রসাদ মজুমদার দেখিয়েছেন যে, সপ্তম-ত্রয়োদশ শতকে উত্তর ভারতের শহর ও উপকূল ভাগে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রাণবন্ত চরিত্র অব্যাহত ছিল। তিনি মনে করেন, আদি-মধ্যযুগে বাণিজ্যের মৌলিক পরিবর্তন হয়তো ঘটে, কিংবা নতুন নতুন অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রসার লক্ষণীয়ভাবে ঘটেনি, তবে পূর্ব প্রচলিত বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি সমস্ত সময় জুড়েই অতীতের ধারা বহমান রেখেছিল। এ বিষয়ে রণবীর চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘মণ্ডপিকা : আদি-মধ্যযুগে উত্তর ভারতের স্থানীয় বাণিজ্যকেন্দ্র’ উল্লেখের দাবি রাখে।

সমকালীন লেখমালার সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, আদি-মধ্যযুগে উত্তর ভারতে বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল মণ্ডপিকাসমূহ। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, খ্রিস্টীয় ৬০০ অব্দের আগে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মগুপিকার বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই অনুমান করা যায় যে, স্তম্ভযুক্ত আচ্ছাদিত মণ্ডপ বা মণ্ডপিকা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে আদি-মধ্যযুগেই গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে কাংড়া, ভরতপুর, জব্বলপুর, রাজস্থান, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে বহু মণ্ডপিকা গড়ে ওঠে। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন যে, রাজস্থান ও গুজরাটে বহুসংখ্যক মণ্ডপ গড়ে উঠেছিল। ৬৪৪-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে উৎকীর্ণ চব্বিশটি লেখ বিশ্লেষণ করে বারোটি মণ্ডপিকা ও বারোটি হাটের (হট্ট) অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। রাজস্থানের মণ্ডপিকাগুলির অবস্থান গ্রাম ও শহর উভয় অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত, শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত বৃহদাকার মণ্ডপিকাগুলি মহামণ্ডপিকা নামে অভিহিত হত।

উত্তর ভারতের মণ্ডপিকার মতো দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ‘নগরম’ -এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনেথ হল চোল আমলের লেখমালা থেকে এরকম তেত্রিশটি বাণিজ্যকেন্দ্রের নাম উদ্ধার করেছেন। তাঁর মতে, একাধিক গ্রামের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রতিটি নাড়ুতে একটি করে নগরম থাকত। এই কেন্দ্র থেকে নাড়ুর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গ্রামের সাথে যেমন বাণিজ্যসম্পর্ক গড়ে তোলা হত, তেমনি অন্য নাড়ুর সাথেও বাণিজ্যসম্পর্ক গড়ে তোলা হত। কেনেথ হল দক্ষিণ ভারতে স্থলবাণিজ্যের বৃহত্তর কেন্দ্র হিসেবে ‘এরিবীর পট্টিনম’ নামক কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হল (Hall) নাড়ু পিছু একটি করে নগরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত প্রধানত স্থলপথে। সমকালীন লেখমালা থেকে স্থলপথগুলির বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তা থেকে অনুমান করা হয় যে, স্থলপথে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ‘দুধপানি লেখ’ থেকে জানা যায় যে, অষ্টম শতকে তিনভাই বাণিজ্যের কাজে অযোধ্যা থেকে স্থলপথে পশ্চিম বাংলার তাম্রলিপ্তে এসেছিল। কিয়াতানের চৈনিক বিবরণ (৭৮৫-৮০৫ খ্রিঃ) থেকে জানা যায় যে, কামরূপ থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে পূর্ব ভারতের মধ্যস্থল মগধে পৌঁছানো যেত।

আরবীয় লেখক অলবেরুণীর রচনা থেকে আদি-মধ্যযুগের শেষদিকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথের বিবরণ জানা যায়। কনৌজের সাথে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। একটি পথ কনৌজ থেকে বারাণসী, পাটনা ও মুঙ্গের হয়ে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। আর একটি পথ কনৌজ থেকে প্রয়াগ, উড়িষ্যা হয়ে সুদূর দক্ষিণ ভারতের কান্যকুব্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অলবেরুণীর বিবরণী অনুসারে কনৌজের সাথে সুদূর কামরূপ, কাশ্মীর, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলের স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। আর একটি পথ গুজরাটের সোমনাথ বন্দরের সাথে মথুরার যোগসাধন করেছিল। স্থলপথ ধরে বাণিজ্য করার জন্য সম্ভবত বণিকদের ‘মার্গনক’ নামক একটি কর দিতে হত।

বাণিজ্যে গতিশীলতার অন্যতম নিদর্শন হল বণিকদের সংঘবদ্ধতা ও সাংগঠনিক স্তরে বাণিজ্যের নিরাপত্তা বিধান। সেদিক থেকেও আদি-মধ্যযুগ পিছিয়ে ছিল না। মৌর্য ও গুপ্তযুগে ‘শ্রেষ্ঠী’, ‘স্বার্থবাহ’ নামাঙ্কিত বাণিজ্যজীবীদের অভিধাগুলির ব্যবহার আদি-মধ্যযুগেও দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতের কোহলাপুর (১১৩৬ খ্রিঃ), সিরাজ (১১৪৩ খ্রিঃ) ও বেলগাঁও (১২০৫ খ্রিঃ)-তে প্রাপ্ত তিনটি লেখতে বণিকদের সমাবেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে সমবেত বণিকদের নাম, পরিচয়, আবাসস্থল ইত্যাদির বিবরণ পাওয়া যায়।

উত্তর ভারতে বণিক সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকের একটি লেখ থেকে ‘মনিগ্রামম’ ও ‘নানাদেশি’ নামক বণিক সংগঠনের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এই সংগঠনের বণিকরা দূরবর্তী দেশ থেকে মূল্যবান পাথর, বিলাসদ্রব্য, সুগন্ধি, ধাতু ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। বণিক সংগঠনগুলি নিজস্ব সেনাবাহিনী পোষণ করত, যা তাদের সাংগঠনিক ও বৃত্তিগত শক্তির পরিচয় দেয়। সম্ভবত, স্থানীয় শাসকবৃন্দ আর্থিক কারণে বণিকদের সাথে সহযোগিতা করতেন।

৮। আদি-মধ্যযুগে ভারতে সমুদ্রবাণিজ্য সম্পর্কে কী জানো।

উত্তর:- অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখ অনেকেই সমকালীন লেখমালা, পর্যটকদের বিবরণী, মুদ্রা ইত্যাদির ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, সপ্তম শতকের পরবর্তীকালেও ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি অব্যাহত ছিল। রণবীর চক্রবর্তী আদি-মধ্যযুগে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিশেষভাবে কোঙ্কন উপকূলের বাণিজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরীর গবেষণার সাথে একমত হয়ে তিনি লিখেছেন যে, সপ্তম শতকে ইসলামের প্রসার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে গুরুতর পরিবর্তন নিয়ে আসে, ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়ে।

জর্জ হৌরানী ভারত সাগরে আরব বণিকদের কার্যকলাপের ওপর গবেষণা করে বলেছেন যে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে আরব বণিকরা দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নিয়ে চিন পর্যন্ত চলে যেতেন। চৈনিক বিবরণীতে ‘পো-সো’ এবং ‘তা-সি’ নামক জাহাজের উল্লেখ আছে। হৌরানীর মতে, যথাক্রমে পারসি ও আরব জাহাজ বোঝাতে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগরের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার সময় এই জাহাজগুলি বিশ্রামের জন্য অবশ্যই ভারতের উপকূল বন্দরগুলিতে নোঙ্গর ফেলত। তখন বাষ্পচালিত নৌ-যান আবিষ্কৃত হয় নি। ফলে নাবিকরা মৌসুমি বায়ুর ওপর ভর করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিত। স্বভাবতই ভারতের পশ্চিম-উপকূলে আরব জাহাজগুলিকে সাময়িক বিরতি ঘটাতে হত। সেখান থেকে আবার চিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করত।

কীর্তিনারায়ণ চৌধুরীর মতে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের আগে পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়া থেকে রওনা হয়ে বাণিজ্য জাহাজগুলি চিনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত চলাচল করত। কিন্তু এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা ছিল বেশ ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। তাই অষ্টম শতকের পরবর্তীকালে পশ্চিম এশিয়ার জাহাজগুলি ভারতের পশ্চিম উপকূলে কুইলন ও কালিকট বন্দরে নোঙ্গর করত। মৌসুমি বায়ুর সাহায্য নিয়ে এই যাত্রা ছিল সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ। অতঃপর চিনা জাহাজগুলি ওই পণ্য সংগ্রহ করে চিনে যেত। এর ফলে ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় বন্দরগুলি পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জাহাজের যোগসূত্রে পরিণত হয়। এইভাবে ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ পশ্চিম-উপকূলীয় বন্দরগুলি চিন বাণিজ্যের মধ্যবর্তীর ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়। এইভাবে ভারতীয় বাণিজ্যে নতুন প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে।

সমকালীন আরব লেখকদের বর্ণনা থেকেও আদি-মধ্যযুগে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবাণিজ্যে ভারতের এবং বিশেষভাবে পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলির অংশগ্রহণের তথ্য সমর্থিত হয়। আরব লেখকরা অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের অন্তর্বর্তীকালে ভারতের অনেকগুলি ব্যস্ত বাণিজ্যের উল্লেখ করেছেন। পারস্যের বসরা ও সিরাক থেকে আরব পণ্যবোঝাই জাহাজগুলি গুজরাটের কানবায়া (ক্যাম্বে), কোঙ্কনের সুবারা (সোপারা), সিন্দাবুর (গোয়া), সৈদুর (চৌল), মালাবারের কুলমমালি (কুইন) প্রভৃতি বন্দরে এসে ভিড়ত।

রাষ্ট্রকূট আমলের লেখমালা ও আরব বণিকদের রচনা থেকে সেকালে আরব-ভারত বাণিজ্য ও সুসম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। তৃতীয় ইন্দ্র ও তৃতীয় কৃষ্ণের আমলেও কোঙ্কন উপকূলে আরব বণিকদের বাণিজ্যিক ব্যস্ততা অব্যাহত ছিল। রাষ্ট্রকূটদের পরে কোঙ্কনে ‘শিলাহার’ বংশের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। শিলাহার রাজা ছিন্ডুরাজের তাম্রশাসন থেকে (১০৩৪ খ্রিঃ) বোঝা যায় যে, তাঁর আমলেও কোঙ্কন উপকূলে আরব বণিকদের বাণিজ্য গতিময় ছিল। তাঁর লেখতে আরব বণিকদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। আল মাসুদীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, দশম শতকে চৌল বন্দরে আরব বণিকদের স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। ওমান, বসরা, সিরাফ, বাগদাদ প্রভৃতি স্থানের বহু মুসলমান বণিক এখানে বাণিজ্যিক কাজে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

দশম শতকের মধ্যভাগে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের সমুদ্রবাণিজ্যে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। মিশরে ফতিমিদ সাম্রাজ্যের উত্থান (৯৬৯ খ্রিঃ) এবং সিরাফ অঞ্চলের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার পরিণামে বাণিজ্যকর্মে পারস্য উপসাগরের গুরুত্ব কমে যায়। এই সময় লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক ব্যস্ততা বৃদ্ধি পায়। লোহিত সাগরের দুই প্রান্তের দুটি বন্দর ‘এডেন’ ও ‘আলেকজান্দ্রিয়া’ এশীয় বাণিজ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। লোহিত সাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রবাণিজ্য ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের সাথে সহজে সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে। এই সময় কোঙ্কনের বন্দরগুলির পরিবর্তে মালাবার উপকূলের বন্দরগুলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ এডেন থেকে জাহাজগুলি খুব সহজে এবং কম সময়ে কুইলন, কালিকট, ম্যাঙ্গালোর, গোয়া ইত্যাদি বন্দরে উপস্থিত হতে পারে।

আদি-মধ্যযুগে পূর্ব ভারতে এবং নির্দিষ্টভাবে বঙ্গদেশের বাণিজ্যচিত্রে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ব্রহ্মদেশ, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, সিংহল প্রভৃতি দেশের সাথে পূর্ব ভারতের বাণিজ্য যোগাযোগের অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল তাম্রলিপ্ত বন্দর। কিন্তু অষ্টম শতকে এই বন্দরের গুরুত্ব ভীষণ হ্রাস পায়। তবে বহির্বাণিজ্যের ধারা বন্ধ হয়ে যায় নি। নবম-দশম শতকের আরব লেখকদের রচনায় ‘সমন্দর’ নামক ব্যস্ত বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত, এই বন্দরের অবস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত চট্টগ্রামের সন্নিকটে।

চোল রাজাদের আমলে দক্ষিণ ভারতের করমণ্ডল উপকূল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সাথে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ খ্যাতি পায়। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সমুদ্রবাণিজ্যে চোলরাজাদের অংশগ্রহণ নানা সূত্রে সমর্থিত হয়। চোলরাজা রাজরাজ, প্রথম রাজেন্দ্র এবং প্রথম কুলোতুঙ্গ প্রমুখের দীর্ঘ শাসনপর্বে চোলদের শক্তিশালী নৌবহরের উপস্থিতিও তাদের বাণিজ্যকর্মের আগ্রহকে সমর্থন করে। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন যে, চোল বণিকরা বহির্বাণিজ্যে বেশি উৎসাহী ছিলেন। পূর্ব উপকূলে মহাবলীপুরম (মামল্লপুর), কাবেরী পত্তনম, শালিয়ুর, কোরাকাই বন্দর এবং মালাবার উপকূলে কুইলন বহির্বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। পারস্য, আরবদেশ ও চিনের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত, চিনের মূল ভূখণ্ডে একটি ভারতীয় উপনিবেশ ছিল।

রাজেন্দ্র চোলের ‘পুট্টুর তাম্রলেখ’ (১০২০ খ্রিঃ) থেকে অনুমান করা হয় যে, মালয় উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলে কম্বোজ (কাম্বোডিয়া বা কাম্পুচিয়া)-এর সাথেও চোলদের নিয়মিত বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল। সম্ভবত, কম্বোজরাজ প্রথম সূর্যবর্মন রাজেন্দ্র চোলের উদ্দেশ্যে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। চোলরাজ প্রথম কুলোতুঙ্গ বাণিজ্য শুল্ক রহিত করে বৈদেশিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছিলেন। পাগানের (বর্তমান ব্রহ্মদেশ) রাজার সাথে কুলোতুঙ্গের কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চিনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে কুলোতুঙ্গ পাগানের শাসকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ১০৬৮ ও ১০৯০ খ্রিস্টাব্দের দুটি লেখ থেকে কুলোতুঙ্গের আমলের ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিশাখাপত্তনম ও কুলোতুঙ্গ চোলপত্তনম নামক বন্দরের নাম জানা যায়। সম্ভবত, বিশাখাপত্তনমের নাম পালটে রাজার নামানুসারে কুলোতুঙ্গ চোলপত্তনম করা হয়েছিল।

৯। আদি-মধ্যযুগে জল সেচ ও কৃষি-প্রযুক্তি সম্পর্কে উল্লেখ কর।

উত্তর:- ড. হরবনস মুখিয়া মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক উদ্যমের অভাব আদি-মধ্যযুগে কৃষি উৎপাদনের উপায়, পদ্ধতি ও সম্পর্কের পরিবর্তন রুদ্ধ করেছিল। কিন্তু অধ্যাপক শর্মার মতে, নানা কারণে এই যুগটি নিঃসন্দেহে ব্যাপক উৎপাদন ও কৃষি সম্প্রসারণের কাল ছিল। তাঁর মতে, এই সময় ছোটো ছোটো রাজ্যগুলির বৃহৎ রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়ার চেতনা সক্রিয় ছিল। এজন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্ত কৃষিভিত্তি। নিশ্চিত কৃষি-আয় থেকে রাষ্ট্র তার কর্মীগোষ্ঠীকে ও সেনাদের প্রতিপালন করতে পারবে – এই চেতনা কৃষি সম্প্রসারণের প্রেরণা দিয়েছিল। একই সময়ে ক্ষয়িষ্ণু শহরগুলি থেকে ব্রাহ্মণ-সহ প্রতিপত্তিশালী লোকেরা গ্রামাঞ্চলে পরিযান করত। তারা শাসকের কাছ থেকে জমি নিয়ে সেখানে উন্নততর প্রণালীতে কৃষি-উৎপাদনে মনোযোগী হলে স্বাভাবিক ভাবেই কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

সাতবাহন, গুপ্ত ও বাকাটকদের রাজ্যে পতিত জমি অগ্রহার বা নিষ্কর হিসেবে দান করার রেওয়াজ ছিল। পরবর্তী কালেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। অন্তত উত্তর ও পূর্ব ভারতে অনাবাদী জমিই অগ্রহার হিসেবে দান করা হত। সপ্তম শতকে প্রাচীন শ্রীহট্টের এক সামন্ত প্রায় দুইশত ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করেন। তাঁর ‘টিপেরা তাম্রশাসনে’ বার বার বলা হয়েছে যে, দান করা জমি হিংস্র পশুতে ভরা গভীর অরণ্যে অবস্থিত ছিল। সপ্তম শতকের মেদিনীপুর লেখ থেকে জানা যায় যে, দণ্ডভুক্তি অঞ্চলের বহু অনাবাদী জমিকে ‘ব্রাহ্মণ শাসন’ গ্রামে রূপান্তরিত করা হয়। এই সকল অনাবাদী জমিকে দানগ্রহীতারা আবাদী জমিতে রূপান্তরিত করেন। ফলে দেশের কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

তৎকালীন নিয়ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত বা ধর্মীয় ব্যক্তিরা দৈহিক শ্রম এবং বিশেষ করে হলকর্ষণ জাতীয় কর্মে লিপ্ত হতেন না। ফলে এই কৃষিকার্যে তাঁরা কৃষক নিয়োগ করতেন। ফলে কৃষি-উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার অভাব ঘটত না। উন্নত কৃষি-উৎপাদনের প্রমাণ হিসেবে সেকালে বড়ো লাঙল-এর ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। বিগ্রহরাজের হর্ষ লেখতে (৯৭৫ খ্রিঃ) ‘বৃহৎ হল’ বা বড়ো লাঙলের কথা বলা হয়েছে। সেকালে কাঠের তৈরি লাঙল ব্যবহার করা হত, যা গভীর গর্ত করতে সক্ষম।

উন্নত কৃষি-উৎপাদনের একটি আবশ্যিক শর্ত হল জলসেচের সুবন্দোবস্ত। বিশেষত অরণ্য অঞ্চলে বা উঁচু পতিত জমিতে চাষের ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা ছিল খুবই আবশ্যিক। আদি মধ্যযুগের প্রথমার্ধে সেচব্যবস্থার দিকেও যে নজর দেওয়া হয়েছিল, সমকালীন লেখতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীরের কৃষি-উৎপাদন বিতস্তা নদীর খামখেয়ালিপনার জন্য ব্যাহত হত। বিতস্তার জলস্ফীতি বহুবার কৃষিজমিকে প্লাবিত করে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরের রাজা অবন্তীবর্মনের উদ্যোগে সূর্য নামক জনৈক প্রযুক্তিবিদ বিতস্তা নদের গতিপথ পরিবর্তন করে কাশ্মীরের কৃষি-উৎপাদনে অনিশ্চয়তার অবসান ঘটান। একই সঙ্গে জলসেচের ব্যবস্থা করেও কৃষি-অর্থনীতিকে সবল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই কাজে রাজকীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ছিল, তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগেরও অভাব ছিল না।

সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, রাজা রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে এক বিশাল দিঘি খনন করে জলসেচের বন্দোবস্ত করেছিলেন। চোলদের লেখাতেও অনুরূপ জলাশয় নির্মাণে জনগণের উদ্যোগের কথা উল্লেখ আছে। চোল আমলের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার সাথে জলসেচ ব্যবস্থার পরিচালনাতেও মিল দেখা যায়। এখানে সেচব্যবস্থার পরিকল্পনা, রূপায়ণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নির্বাচিত প্রতিনিধি সভাগুলিই প্রধান ভূমিকা পালন করত। রামশরণ শর্মা গুজরাট ও রাজস্থান অঞ্চলে ‘বাপী’ নামক একধরনের গভীর কূপ খননের কথা বলেছেন। ভূপ্রকৃতিগত কারণে এই সকল অঞ্চলে সেচখাল খনন করা সহজসাধ্য ছিল না। পরিবর্তে ‘বাপী’ নামক গভীর কূপ জমিতে সেচের কাজে বেশি উপযোগী ছিল।

জল উত্তোলনের জন্য সেকালে ‘অরঘট্ট’ নামক যন্ত্রের উল্লেখ ড. শর্মা, রোমিলা থাপার, হেমচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখের গ্রন্থে পাওয়া যায়। হলায়ুধ-এর ‘অভিধানরত্নমালা’ গ্রন্থে অনুরূপ এক সেচযন্ত্রকেই ‘উদঘাটক’ বলা হয়েছে। একটি চক্রাকার কাঠামোর গায়ে অনেকগুলি ঘটিজাতীয় পাত্র লাগিয়ে নিচু থেকে জল উত্তোলন করা যেত। রাজস্থানের মান্দোরের দুটি ভাস্কর্যে এই জাতীয় যন্ত্রের প্রতিকৃতি দেখা যায়। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, অনেকে এই সেচ যন্ত্রটিকে ‘পার্সিয়ান হুইল’ বলে মনে করেন। কিন্তু ড. ইরফান হাবিবের গবেষণার ভিত্তিতে ড. চক্রবর্তী বলেছেন, ‘পার্সিয়ান হুইল’ যন্ত্রটি ভারতীয় অরঘট্টর তুলনায় অনেক উন্নত, জটিল ও বেশি কার্যকরী। চতুৰ্দশ শতকে ইবন বতুতা বাংলাদেশ পর্যটনকালে পূর্ববাংলা থেকে আসামের দিকে যাওয়ার সময় নদী থেকে জল তোলার জন্য একধরনের চক্রাকার যন্ত্র দেখেছিলেন। সম্ভবত এটি ‘অরঘট্ট’ জাতীয় কোনো যন্ত্র ছিল।

সপ্তম শতক ও পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখ থেকে সেকালের উন্নত কৃষি-উৎপাদনের কথা প্রমাণিত হয়। সমকালে রচিত কয়েকটি কৃষি-বিষয়ক গ্রন্থ হল ‘কৃষিপরাশর, ‘শূন্যপুরাণ,’ ‘মঙ্খকোষ’ ইত্যাদি। দক্ষিণ ভারত, কোঙ্কন উপকূল, আসাম ও বাংলাদেশে নারকেল ও সুপারি উৎপাদন হত। দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক পানের চাষ হত। আদি-মধ্যযুগের বাংলার একটি লেখতে ‘বারজিক’ শব্দটির উল্লেখ আছে। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার ‘বারজিক’ শব্দটিকে পানচাষের ক্ষেত্র ‘বরজ’-এর সাথে অভিন্ন বলে মতপ্রকাশ করেছেন।

সুস্বাদু মশলার উৎপাদক হিসেবে ভারতের নাম বিশ্বখ্যাত। আদি-মধ্যযুগের সাহিত্য ও লেখমালা থেকে সেকালে মশলা চাষের বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকে উৎকীর্ণ গুজরাটের একটি লেখতে কর্পূর, হিং, জায়ফল, জয়িত্রী, খেজুর ইত্যাদি চাষের কথা উল্লেখ আছে। সম্ভবত মরিচ গুজরাটে চাষ হত না। মরিচ উৎপাদনে মালাবার উপকূল অঞ্চলের একাধিপত্যর কথা স্থানীয় লেখমালা এবং চৈনিক ও আরবি পর্যটকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্ৰন্থে কাশ্মীরে জাফরান চাষের উল্লেখ পাওয়া যায়। কার্পাস ও তৈল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আদি-মধ্যযুগের দক্ষতা প্রমাণিত। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর মতে, গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে কার্পাস উৎপাদনের অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল।

১০। আদি-মধ্যযুগে ‘গিল্ড’ বা শ্ৰেণী জাতীয় সংগঠনের ইতিহাস লেখা।

উত্তর:- খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে ভারতে কারিগরি শিল্প ও অকৃষিবৃত্তি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কারিগরি শিল্প ও সেইসব শিল্পে নিযুক্ত কারিগরদের মধ্যে নতুন পেশাগত সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। এইভাবে একই পেশার বিভিন্ন মানুষ তাদের উৎপাদন ও তার বাজারিকরণ সুষ্ঠ ভাবে করার প্রয়োজনে যে সংগঠন গড়ে তোলেন তা আধুনিক কালের গিল্ড- এর পূর্বসুরী ছিল। প্রাচীন ও আদিমধ্যযুগে এই ধরনের কারিগরি সংগঠনগুলি ‘শ্রেণী’, ‘সংঘ’, ‘গণ’, ‘কুঞ্জ’ ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত ছিল। শ্ৰেণী জাতীয় সংগঠনের উদ্ভবের সম্ভবত মূল কারণ ছিল সমাজের ধনী ও প্রভাবশালী শ্রেণীর অত্যাচার থেকে কারিগর ও শ্রমিকদের রক্ষা করা।

D.D. Kosambi-এর মতে গুপ্তযুগে গিল্ড বা শ্রেণীর শক্তি কিছুটা শিথিল হয়েছিল। রোম সাম্রাজ্যের পতন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবের ফলে দূর বিস্তৃত বাণিজ্য দলের পরিবর্তে ছোট ছোট বাণিজ্যকারী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আগেকার শক্তিশালী গিল্ডগুলি ভেঙে গিয়েছিল। তবে স্কন্দগুপ্তের ইন্দোর লেখ এবং কুমার গুপ্তের মান্দারসোর লেখ-এর ভিত্তিতে Dr. R.C Majumdar বলেছেন, ‘আদি মধ্যযুগের সূচনাপর্বের গিল্ডগুলি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। কারণ শিল্প বাণিজ্যে শৈথিল্য এলেও গিল্ডগুলি সামাজিকভাবে আর্থিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতির আঁধার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভক্তপ্রসাদ মজুমদার ভারতের পূর্ব সীমায় কামরূপীর বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটেছিল বলে প্রমাণ করেছেন। আল মাসুদি, ইবন খোরদাদবা, চৌজুকুয়া এবং হুদুদ-অল-অলম গ্রন্থের বক্তব্য থেকে বস্ত্র শিল্পের বিকাশের কথা জানা যায়। তৈলবীজ উৎপাদন, ধাতুশিল্প বিশেষত লৌহ শিল্প আদি-মধ্যযুগে যথেষ্ট উন্নত ছিল। স্বভাবতই এই পর্বে শিল্প সংগঠন হিসাবে গিল্ড বা শ্রেণীর অস্তিত্ব-এর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

সমসাময়িক লেখমালায় ধর্মশাস্ত্রসহ বিভিন্ন সাহিত্যে শ্রেণী বা গিল্ড-এর কথা বলা হয়েছে। তবে প্রাক গুপ্ত সময়কালের মত গুরুত্ব বা প্রভাব সম্ভবত গিল্ডগুলির ছিল না। ‘মনুস্মৃতির’ ওপর মেধাতিথির ভাষ্য ব্যাখ্যা করে Lalan Ji Gopal, দেখিয়েছেন যে, আদি-মধ্যযুগে সদস্যদের ওপর শ্রেণীর প্রভাব আগের মতো জোরাল ছিল না। এই সময় শ্রেণীগুলি সামগ্রিক ব্যাপারকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং পাশাপাশি শ্রেণীর সদস্যদের ব্যক্তিগত স্বতন্ত্রবোধ অনেকটাই বেড়েছিল। ফলে সমবায়মূলক সংগঠন হিসাবে শ্রেণীর দুর্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইতিপূর্বে নারদ স্মৃতির ভিত্তিতে রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছেন যে, কর ফাঁকি, জুয়া খেলা, বারাঙ্গনা পোষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজা শ্রেণীর ক্রিয়াকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। অর্থাৎ শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ব্যবস্থার ওপর শাসকের ক্ষমতা বেড়েছিল এবং পরিণামে শ্রেণীর স্বাতন্ত্র বিঘ্নিত ও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে রচিত সাহিত্যে শ্রেণীকরণ শব্দের উল্লেখ আছে, এর অর্থ একটি বিশেষ প্রশাসনিক দপ্তর (করণ) শ্রেণীর ওপর পর্যবেক্ষণ চালাত। এই বিবরণ গিল্ড বা শ্রেণীর ক্রিয়াকলাপ-এর ওপর প্রশাসনিক নজরদারি ও হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। সমকালীন সাহিত্যে শ্রেণীগুলিকে বা গিল্ডগুলিকে ‘জাতি’ অভিধা দেওয়া হয়েছে, অর্থ্যাৎ জাতি ও গিল্ড প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ১৩-১৪ শতকে রচিত দুটি পুরাণে গিল্ড বা শ্রেণীকে ‘সংকর’ বা ‘মিশ্র’ জাতি বলা হয়েছে। সমাজের চোখে এদের স্থান ছিল নীচে। জম্মুদ্বীপ প্রগ্গ্যতি রচনায় কুম্ভকার, তাঁতি, সুবর্ণকার, প্রভৃতি মিশ্র জাতি ও শ্রেণীগুলির ছোঁয়া শুদ্ধ বলা হয়েছে। অন্যদিকে চর্মকার, তেলি, রম্বকার, কাঁসারি প্রভৃতি মিশ্র জাতির গিল্ডকে অশুদ্ধ মনে করা হত।

গোয়ালিয়র লেখতে তৈলিক মহত্তর, মালিকামেহোর, শিয়ালকূট নামক সংঘ যথাক্রমে তৈলিক মালাকার ও পাথরকাটা শিল্পে যুক্ত কিছু মানুষের সংগঠন ছিল। এক্ষেত্রে পরিষ্কার যে একই শিল্পে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে একই বৃত্তির মধ্যে একই অঞ্চলে একাধিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, আদি-মধ্যযুগে শ্রেণী (গিল্ড) কোনো একটি বৃত্তিতে নিযুক্ত সকল কারিগরের একটি মাত্র সংগঠন হিসাবে টিকে ছিল না। ক্রমশ এক একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে শ্রেণী সংগঠন গড়ে উঠেছিল।

ভক্তপ্রসাদ মজুমদার-এর মতে, আদি-মধ্যযুগে ভূমির ওপর ব্যক্তিগত অধিকার কায়েম হলে কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তাই কৃষির শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে শিল্প ও কারিগরির ক্ষেত্রে শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়। এইভাবে আদি-মধ্যযুগে রাজকীয় হস্তক্ষেপ, শ্রেণীগুলির জাতিতে রূপান্তর ঘটায়, তাদের সামাজিক অবসান ঘটায় এবং শ্রেণীতে অর্থলগ্নির হার শিথীল হয় এবং পরিণামে শ্রেণী সংগঠনগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

১১। আদি-মধ্যযুগের স্থাপত্য চর্চা সম্পর্কে লেখো ?

উত্তর:- আদি মধ্যযুগের ভারতে স্থাপত্য চর্চার প্রধান প্রধান ক্ষেত্রগুলি ছিল মন্দির, স্তূপ ও বিহার। ভারতের চিরাচরিত শিল্প ঐতিহ্য ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদি-মধ্যযুগে নতুন স্থাপত্য রীতির সূচনা করেছিল। আদি মধ্যযুগে মন্দির স্থাপত্যে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সাধারণভাবে মন্দির শিল্পের তিনিট ধারা ছিল – নাগর শৈলী, দ্রাবিড় শৈলী ও বেসরা শৈলী। নাগর শৈলী প্রচলিত ছিল হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বা ভূ-ভাগে। দ্রাবিড় শৈলীর প্রাধান্য দেখা যায় কৃষ্ণানদী ও কন্যাকুমারিকা অন্তরীপের মধ্যবর্তী এলাকায়। বিন্ধ্য পর্বত ও কৃষ্ণানদীর মধ্যবর্তী এলাকায় ছিল বেসরা শৈলীর প্রাধান্য। উল্লেখ্য যে বেসরা শৈলীর মধ্যে নাগর ও দ্রাবিড় শৈলীর মিশ্রণ ঘটেছিল। এই কারণে এটিকে স্বতন্ত্র শিল্প শৈলী না বলে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে চালুক্য শৈলী বলার পক্ষপাতি।

প্রাক আদি-মধ্যযুগে পল্লব স্থাপত্যের সূচনা হয় এবং অষ্টম নবম শতকে সেগুলি চূড়ান্ত রূপ পায়। রাজসিংহ শৈলীর অবদান হল বিভিন্ন অংশের সংযোজন ভিত্তিক মন্দির নির্মাণ। যেমন – কৈলাসনাথ মন্দির ও বৈকুণ্ঠপেরুমল মন্দির। অষ্টম শতকে নির্মিত মহাবলিপুরমের তীর মন্দির গুলিও স্বতন্ত্র মন্দির শৈলীর দৃষ্টান্ত। নবম শতকে অপরাজিত গোষ্ঠীর স্থাপত্যের উপর চোল স্থাপত্যের প্রভাব দেখা যায়।

চোলদের আমলে দ্রাবিড় শৈলী পরিণত রূপ পায়। চোলদের প্রথমপর্বের মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-বিজয়ালয় চোলেশ্বর মন্দির। এই মন্দিরের গর্ভগৃহ এবং তার চারদিকে বর্গাকৃতি প্রদক্ষিণ পথ আছে, সারি সারি স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপ, একাধিক স্থলবিশিষ্ট বিমান এবং বিমানের শীর্ষে স্তূপিকা চোল শিল্পের বৈশিষ্ট্য। চোল শিল্পের বিকাশ ঘটে প্রথম পরান্তকের আমলে। কোরোঙ্গনাথ মন্দির দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। প্রথম রাজরাজ ও রাজেন্দ্র চোলের আমলে দক্ষিণ ভারতে অনেকগুলি মন্দির গড়ে ওঠে। দ্রাবিড় শৈলীর দুটি বিশিষ্ট মন্দির ছিল রাজরাজের বৃহদীশ্বর মন্দির এবং রাজেন্দ্র চোলের গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরম মন্দির।

বৃহদীশ্বর মন্দিরের পূর্বদিকে গোপুরমসহ মন্দিরটির আয়তন ছিল দৈর্ঘ প্রস্থ ১৬৭ × ৮৪ মিটার। মন্দিরের বিমানটি সম্পর্কে Percy Brown বলেছেন, “The finest single creation of the Dravidian craftsman”। গঙ্গাইকোণ্ড মন্দিরটির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে প্রাচ্যের আবেগ প্রসূত দুরন্ত অনুভূমি। ১১৪ × ৩৪ মিটার আয়তন বিশিষ্ট এই মন্দিরের সুউচ্চ বিমানটি দর্শনীয়। N.K. Shastri মতে, “তাঞ্জোর ও চোলপুরমের মন্দিরদুটির মধ্যে যথাক্রমে প্রকাশ পেয়েছে শক্তিমত্তা ও সৌন্দর্যবোধ।” আদিমধ্যযুগের শেষ দিকে চোল শিল্পের উপর পাণ্ড্য শিল্পধারার প্রভাব দেখা যায়। রাষ্ট্রকূটদের আমলে শিল্পকলার বিশেষ অগ্রগতি দেখা যায় না। রাষ্ট্রকূট রাজ প্রথম কৃষ্ণের আমলে ইলোরায় বিখ্যাত কৈলাসনাথ মন্দির নির্মিত হয়।

আদি-মধ্যযুগে বাংলায় স্থাপত্য চর্চার অন্যতম নিদর্শন ছিল স্তূপ, বিহার ও মন্দির। তবে এগুলির অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে সেকালে বহু স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে লিখিত একটি বৌদ্ধ পুঁথিতে মৃগস্থাপন স্তূপের একটি চিত্র আছে। বৌদ্ধপুঁথি থেকে তুলাক্ষেত্র বর্ধমান স্তূপ নামক একধরনের স্তূপের কথা জানা যায়। যোগি গুল্ফা নামক স্থানে পাথরের একটি ছোটো স্তূপ পাওয়া গেছে। এই স্তূপের আকৃতি অনেকটা মন্দিরের মতো। ডঃ আর. সি. মজুমদারের মতে, এটিকে বাংলার স্তূপ শিল্পের শেষপর্বের নিদর্শন বলা যায়।

বিহার গুলি নির্মিত হয়েছিল মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের বসবাসের জন্য। পাহাড়পুরে একটি বিশাল বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। সম্ভবত অষ্টম শতকে পালবংশীয় ধর্মপাল এখানে শঙ্কুবিহার নির্মাণ করেছিলেন। বিশালাকার এই বিহারের অঙ্গন প্রতিদিকে প্রায় ৩০০ গজ দীর্ঘ ছিল। সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত এই অঙ্গণে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য প্রায় ১৮০ টি বাসকক্ষ নির্মিত হয়েছিল। বিস্তৃত অঙ্গনের ঠিক মাঝখানে ছিল প্রকাণ্ড এক মন্দির। সমকালীন একটি লেখতে এই মহাবিহারকে জগতে ‘নয়নের একমাত্র বিরামস্থল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। স্থাপত্যবিদ কাশিনাথ দিক্ষিতের মতে, পঞ্চম শতকে নির্মিত পাহাড়পুর চতুর্মুখ জৈন মন্দিরের অনুকরণে এই বৌদ্ধ বিহারটি নির্মিত হয়েছিল।

এগারো শতকে নির্মিত বাঁকুড়া জেলার সর্বেশ্বর মন্দির, বারো শতকে বর্ধমান জেলার গঙ্গারামপুরের মন্দির এবং পুরুলিয়ার বান্দাতে নির্মিত প্রস্তর মন্দিরগুলি নির্মাণে অভিনবত্ব নেই। ডঃ দেবলামিত্রের গবেষণা থেকে জানা যায় পুরুলিয়া জেলার তৈলকুপি অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ নগরী ছিল। সেখানে অন্তত ২৫-২৬ টি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। বেলে পাথরের এই শিব মন্দিরগুলি নবম-ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দিরগুলির সাথে ভুবনেশ্বর মন্দিরের মিল দেখা যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মন্দির আয়তনে ছোটো এবং এদের নির্মাণে কোনো অভিনবত্ব বা দুঃসাহসিক পরিকল্পনা দেখা যায় না।

গুপ্ত পরবর্তীকালে বাংলার ভাস্কর্য শিল্পে যে অবসাদ এসেছিল পালযুগ তা কাটিয়ে ওঠে। অষ্টম শতকে বাংলার ভাস্কর্য শৈলী সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়। গুপ্তযুগে ভাস্কর্য শিল্পে সারনাথের যে স্থান, পালযুগে পাহাড়পুর সেই স্থান দখল করে। পাল ভাস্কর্যে গুপ্ত ভাস্কর্যের অনুকরণের প্রয়াস দেখা যায়। তবে সীমিত সংখ্যায় হলেও বাংলায় স্বতন্ত্র বা মৌলিক ভাস্কর্য শৈলীর উপস্থিতি চোখে পড়ে। কোনো কোনো ভাস্কর্যে প্রচলিত শৈলীর সাথে মৌলিক চিন্তার সমন্বয় দেখা যায়। পাহাড়পুরের গুহায় অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের একটিমাত্র মূর্তি পাওয়া গেছে। বেশিরভাগই নানা ভঙ্গিমায় নারি মূর্তি। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে অবলম্বন করে কয়েকটি মূর্তি নির্মিত হয়েছে। এই মূর্তিগুলিতে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নায়কদের সাধারণ মানুষ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। সেনযুগের মূর্তিগুলির অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা দেখা যায়। তাই এগুলিতে আধ্যাত্মভাবের অভাব আছে। ধীমান ও বিতপাল এই যুগের দুই শ্রেষ্ঠ ভাস্কর।

অষ্টম শতকের আগে বাংলায় চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া যায় না। ‘অষ্টসহাশ্রিকা’ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’, ‘বধিচর্চাবতার’ প্রভৃতি পাণ্ডুলিপি থেকে এযুগের চিত্রচর্চার ধারণা পাওয়া যায়। চিত্রগুলি আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু ভাবাবেগ ও কল্পনায় সমৃদ্ধ। রঙের বিন্যাস এবং রেখা দীর্ঘ ও প্রসারিত।

১২। আদি-মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য সহ আঞ্চলিক সাহিত্যের বিকাশ আলোচনা কর।

উত্তর:- গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে কেন্দ্রকরণের অভাব ও অঞ্চলিক রাজনীতির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই রাজনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদের প্রভাব সাহিত্য ও সাংস্কৃতির উপরেও পড়ে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক রাজ্যগুলির ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মননশীলতার চর্চায় কার্পন্য করে নি। এই পর্বে বাংলাভাষা সহ সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কানাড়া ইত্যাদি ভাষা সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা দেখা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই সময় নতুন ধর্মমতের উদ্ভব ও বিকাশের ফলে ধর্মীয় সাহিত্য রচনার প্রবণতা ছিল। শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, তান্ত্রিক বৌদ্ধ ইত্যাদি নতুন নতুন ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিতে বহু পুঁথি ও শাস্ত্র রচিত হয়। তবে, ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের জগতও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল।

আদি-মধ্যযুগে বাংলা ভাষা সাহিত্যের নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রকাশ দেখা যায়। সংস্কৃত ভাষার জঠর থেকে অন্যান্য ভাষার মত বাংলা ভাষারও পরীক্ষামূলক বিকাশ এই ভাবে ঘটেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় চর্যাপদে। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে ‘চর্যাগীতির’ সংকলন আবিস্কার করে সেগুলিকে চর্যা চর্য বিনিশ্চয় নামে পুনঃ প্রকাশ করেন। এগুলিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন মনে করা হয়। ডঃ সহিদুল্লার মতে, চর্যাপদ সপ্তম শতকে রচিত হয়েছিল। তবে, ডঃ আর সি মজুমদার এই সময়কাল কিছুটা পিছিয়ে দশম শতকে বলে উল্লেখ করেছেন। এই পর্বে বাংলা ও বাংলার বাইরে সৌরশ্রেণী অপভ্রংশ ভাষার বহুল প্রচলন ছিল। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা অপভ্রংশ ভাষায় চর্যাপদ রচনা করে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের গুঢ় নীতিগুলি মানুষের কাছে প্রচার করেন। এর পাশাপাশি প্রাচীন বাংলা ভাষার ব্যবহারও ছিল। প্রাচীন বাংলায় লেখা প্রায় ৫০টি চর্যাপদের সন্ধান পাওয়া গেছে। চর্যাপদগুলি উচ্চ মানের সাহিত্য হয়তো ছিল না। তবে, এদের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে কবির প্রকৃতি, প্রেম, আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ দেখা গেছে।

ডঃ আর সি মজুমদারের মতে, “চর্যাপদগুলি বাংলা সাহিত্যের আদিম উৎস। এর প্রভাবেই পরবর্তীকালে বাংলা সহজিয়া গান, বৈষ্ণব পদাবলী ও বাউল গানের সৃষ্টি হয়েছে।” চর্যাপদ ছাড়াও বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থ হিসাবে ‘মানস উল্লাস’, ‘গীতগোবিন্দ’ প্রভৃতির নাম স্মরণীয়। কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দে মাগধী অপভ্রংশ ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে এই ভাষাকে পরিশিলীত করেই আধুনিক বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে।

আদি-মধ্যযুগের বাংলায় সংস্কৃত ভাষার সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অনুশীলনের উপর বাঙালীদের বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। নবম শতকে গৌড় অভিনন্দ নামক কবি কাদম্বরী কথাসার রচনা করেন, কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত ‘রাম চরিত’ চিরকালীন জনপ্রিয় কাব্য গ্রন্থ হিসাবে খ্যাত। দ্ব্যর্থ বোধক এই গ্রন্থে একদিকে রামায়ণের রামচন্দ্রের, অন্যদিকে পাল রাজা রামপালের গুণকীর্তন করা হয়েছে। আর এক বাঙালী শ্রীধর ভট্ট ন্যায়কন্দলী নামক টীকাভাষ্য রচনা করেন। সংস্কৃত ভাষায় ভেষজ সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে চক্ৰপানী দত্ত, নীশ্চলকর, শূরপাল প্রমুখ টিকাভাষ্য লেখেন। শুরপাল তার গ্রন্থে বিভিন্ন উদ্ভিদের ভেষজগুণ ব্যাখ্যা করেন।

পাল যুগের বিশিষ্ট বাঙালী সাহিত্যকার ছিলেন জীমূতবাহন। তার ‘দায়ভাগ’ গ্রন্থে ভূ-সম্পত্তির বণ্টন বিষয়ে নিয়ম বিধি সংকলিত করেন। বাংলা দেশে জীমূতবাহনের আইন নীতি প্রচলন ছিল। আদি-মধ্যযুগে বৌদ্ধ শাস্ত্রকার হিসাবে শীলভদ্র, শান্তিদেব, জ্ঞান মিশ্র প্রমুখের নাম স্মরণীয়। বিশিষ্ট পণ্ডিত দীপঙ্কর শ্রী জ্ঞান বৌদ্ধ দর্শনের উপর প্রায় ১৬৮টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।

সেন বংশের শাসনকালে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটে। সেন রাজা বল্লাল সেন প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র ভিত্তিক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। হিন্দু নিত্য কর্মভিত্তিক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। হিন্দু নিত্য কর্মের উল্লেখ করে অনিরুদ্ধ ভট্ট রচনা করেন দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ। সাহিত্যিক হলায়ুধ বৈদিক ধর্ম ও আচার ভিত্তিক ধর্মাচার বিষয়ক গ্রন্থ ব্রাহ্মণ সর্বস্ব রচনা করেন। সে কালের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন জয়দেব। তার অমর গ্রন্থ ‘গীতগোবিন্দ’ প্রসঙ্গে মজুমদার লিখেছেন, ‘কেবলমাত্র ভাব ও রসের বিচারে এই গ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট কাব্য হিসাবে মর্যাদা পাবে’।

দক্ষিণ ভারতে, তামিল, তেলেগু ও কন্নড় ভাষায় আঞ্চলিক সাহিত্য চর্চা চলেছে, মূলত ধর্ম ও আচারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ভাষা সাহিত্যগুলি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তামিল রচনাকার হিসাবে নম্বি-আন্ডার-নম্বি, তিরুমল, উমাপতি সেইকন্দর প্রমুখের নাম স্মরণীয়। ধর্ম নিরপেক্ষ তামিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল চোল রাজাদের প্রশস্তি গুলি। জৈন কবি দশম শতকের গোড়ায় জীবক চিন্তামণি নামে যে কাব্য রচনা করেন সেটিকে তামিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসাবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও কবি কম্বন রচিত রামায়ণ গ্রন্থটি তামিল ভাষায় জনপ্রিয় সাহিত্য হিসাবে বন্দিত। প্রথম কুলোতুঙ্গের আমলে কলিঙ্গ যুদ্ধকে ভিত্তি করে তার সভাকবি জয়নগোন্দর রচনা করেন কলিঙ্গাত্তু পরাণী। তামিল মহিলা কবি হিসাবে আভভাই বিশেষ খ্যাতি পান। সাধারণ মানুষের জীবন ভিত্তিক সাহিত্য রচনার জন্য তাকে ‘তামিল কাব্যের জননী’ বলা হয়।

কানাড়া ভাষা সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল জৈন, বীরশৈব ও বৈষ্ণব দর্শন তত্ত্ব। রাষ্ট্রকূট রাজ অমোঘ বর্ষ রচিত ‘কবিরাজমার্গ’ ছিল কানাড়ী ভাষার আদি অলংকার শাস্ত্র। তবে কানাড়া ভাষায় প্রথম সাহিত্যগুণসম্পন্ন রচনাটি হল ভদ্দারাধনা। লেখক শিবকোটি এতে জৈন সাধকদের জীবনী তুলে ধরেন। অপর কানাড়া কবি পম্প রচনা করেন আদি পুরান ও বিক্রমার্জুন বিজয় নামক ২টি কাব্য। তার শিষ্য পোন্ন সংস্কৃত ও কানাড়া উভয় ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এযুগের আর এক কানাড়া কবি ছিলেন রন্ন। এরা কানাড়া সাহিত্যের তিনরত্ন বলে সম্মানিত হতেন। এছাড়া দুর্গা সিংহ, শ্রীধরাচার্য, কীতিবর্মা প্রমুখ বিশিষ্ট কন্নড় সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাত ছিলেন।

দক্ষিণ ভারতের অন্ধ অঞ্চলের ভাষা তেলেগু। আদি তেলেগু ভাষার চর্চা শিলালিপিতে শুরু হয়েছিল। পাণ্ডুরঙ্গের দানপত্রে তা দেখা যায়। মার্গ ধারায় তেলেগু ভাষা চর্চার দৃষ্টান্ত একাদশ শতকের আগে পাওয়া যায় নি। এই ধরনের সাহিত্যের প্রথম উদাহরণ হল নান্যয়া কর্তৃক মহাভারতের অনুবাদ। তার প্রধান সহযোগী ছিলেন ভীমকবি। নান্যয়া রচিত তেলেগু ব্যাকরণ ‘অন্ধ্র-শব্দ-চিন্তামণি’ বিশেষ জনপ্রিয়। এছাড়া ‘ভীমেশ্বর পুরান’ ‘রাঘব-পাণ্ডবিয়া সেকালের জনপ্রিয় গ্রন্থ ছিল।

১৩। আদি-মধ্যযুগে ভারতে শৈব ধর্মের বিকল্প সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর:- প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকেই ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসে দেবতা রূপে পশুপতি বা শিবের কল্পনা দেখা যায়। বৈষ্ণবধর্মের মত শৈবধর্মও একশ্বরবাদী এবং প্রধানত ভক্তিবাদকে ভিত্তি করেই এই ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। ভারতের সমাজচেতনা ও রাষ্ট্রচেতনা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শৈবধর্মও জনপ্রিয়তা ও দৃড় ভিত্তিলাভ করেছে। বৌদ্ধ বা বৈষ্ণব ধর্মের মতই শৈবধর্মও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে দ্রুত প্রসার ও প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পেরেছে। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, “এই অনুমান অসঙ্গত নয় যে, শক্তিসাধনার মত শৈব সাধনারও সূত্রপাত প্রাক্-বৈদিক যুগে এবং বেদোত্তর ভারতের ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও শক্তি-সাধনার মত শৈব-সাধনাও অবিচ্ছিন্নভাবে টিকে আছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোতে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে এইরূপ অনুমান অসঙ্গত নয়।

মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত একটি সীলে তিন মুখ ও দুই শৃঙ্গবিশিষ্ট এবং যোগাসনে উপবিষ্ট একটি মূর্তি অঙ্কিত আছে। মূর্তিটির বক্ষদেশে কয়েকটি মালা আছে এবং উভয় পার্শ্বে হস্তী, ব্যাঘ্র, গণ্ডার ও মহিষ – এই চারটি প্রাণী অঙ্কিত আছে। এই মূর্তিটিকে ঐতিহাসিক স্যার জন মার্শাল পশুপতি শিবের আদি প্রতীক বলে উল্লেখ করেছেন। হরপ্পায় প্রাপ্ত আর একটি সীলে যোগাসনে উপবিষ্ট এবং নানা প্রাণী পরিবেষ্টিত একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। এই সীলটির উল্টোপিঠে বৃষমূর্তি ও ত্রিশূলধ্বজ অঙ্কিত আছে। দ্বিতীয় সীলটিকে প্রথম সীলটির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায়। মূর্তিটি উপবেশন ভঙ্গী, বৃষের অবস্থান এবং ত্রিশূলধ্বজ আধুনিক শিব-কল্পনার সাথে অনেকটাই সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে বহু ঐতিহাসিক জন মার্শালের বক্তব্যের সাথে একমত হয়ে হরপ্পা-সংস্কৃতিতে শিবের উপাসনার কথা সমর্থন করেছেন।

আদি-মধ্যযুগের বহু আঞ্চলিক ভারতীয় শাসক শৈবধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাংলার সেনবংশীয় লক্ষ্মণ সেন, গাহড়বাল রাজা গোবিন্দচন্দ্র, চালুক্যরাজ, মূলরাজ প্রমুখ শৈব ছিলেন। বৈষ্ণবধর্মের মতো শৈবধর্মও একেশ্বরবাদী। হরপ্পা-সংস্কৃতির আমল থেকেই বহু ও বিচিত্র ধারার সমন্বয়ে শৈবধর্ম আদি মধ্যযুগ ও মধ্যযুগে রূপ পরিগ্রহ করেছে। মহাভারতের ভাষ্য অনুযায়ী উমাপতি শিব শ্রীকণ্ঠ পাশুপত ধর্মের প্রবর্তক। ষষ্ঠ শতকের বহু রাজা ও রাজবংশ যেমন – যশোবর্মন, মিহিরকুল, বাকাটক বংশ, বলভীর মৈত্রক বংশ, গুপ্তরাজা দেবগুপ্ত, বিষ্ণুগুপ্ত প্রমুখ শৈবধর্মের উপাসক ছিলেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে উত্তর ভারত, পশ্চিম ভারত ও পূর্ব ভারতের উড়িষ্যায় পাশুপত ধর্মের যথেষ্ট জনপ্রিতা ছিল। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে।

সপ্তম শতকে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর একটি তাম্রশাসন থেকে নাসিক অঞ্চলে ‘কালামুখাদি’ সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। দশম-একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে এদের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। এরা ছিল শৈব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এরা যোগসাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। অরুনন্দী রচিত শিবজ্ঞান সিন্ধিয়ার এবং উমাপতির শিব প্রকাশম গ্রন্থে শৈবসিদ্ধান্ত নামে একটি নতুন মতবাদের বিবরণ পাওয়া যায়। এই নতুন মতবাদে বলা হয়েছে, ঈশ্বর স্বয়ং শিব, যিনি স্বেচ্ছায় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার করেন। তিনি সকল পরিণামের উৎস, কিন্তু নিজে পরিণামের অধীন নন। ধর্মাচারণের দিক থেকে শৈব-সিদ্ধান্তকারীরা ভক্তিবাদী। .

একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে দক্ষিণ ভারতে ‘আগমান্ত শৈবধর্ম’ নামে আর একটি মতবাদের উদ্ভব ঘটে। চোলরাজারা আগমান্ত শৈবদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই মতের সাধকরা তন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এঁরা জাতিপ্রথার বিরোধিতা করেন। এরা পতি, পশু ও পাশ – এই ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। নবম শতকে কাশ্মীরে শৈববাদের উদ্ভব হয়। চোলরাজারা আগমান্ত শৈবদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই মতের সাধকরা ‘তন্ত্র’ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ‘শিবসূত্র’ গ্রন্থের প্রণেতা বসুগুপ্ত কাশ্মীর শৈববাদের প্রবক্তা ছিলেন। ত্রিতত্ত্বের দিকে ঝোঁক আছে বলে এটি ত্রিক নামে অভিহিত হয়। কাশ্মীর শৈববাদে শিব হলেন বিশুদ্ধ চৈতন্য, চরম অভিজ্ঞতা ও পরমেশ্বর। তিনি সকল জীবনের আত্মাস্বরূপ, অপরিবর্তনীয় ও পূর্ণ। শিব তাঁর শক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বজগতের প্রকাশ ঘটান।

Leave a Comment