অথর্ববেদ

আজ আমরা অথর্ববেদ -এর ভাষা, রচনাকাল, নামকরণ, গঠন, ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত মন্ত্র, শাখা, বিন্যাস, বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানবো।

বেদের অন্যতম অংশ অথর্ববেদ প্রসঙ্গে অথর্ববেদের ভাষা, অথর্ববেদের রচনাকাল, অথর্ববেদের নামকরণ, অথর্ববেদের গঠন, ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত অথর্ববেদের মন্ত্র, অথর্ববেদের শাখা, লোক চিকিৎসার আদি উৎস অথর্ববেদ, অথর্ববেদের উপনিষদ, অথর্ববেদে বাস্তব বিষয়ের উপস্থাপন, অথর্ববেদের নয়টি শাখা, অথর্ববেদের বর্তমান অস্তিত্ব, অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখা, মূল অথর্ববেদ গ্ৰন্থ, অথর্ববেদের বিণ্যাস, অথর্ববেদের খণ্ডের নাম, অথর্ববেদের গ্ৰন্থন, অথর্ববেদের বিষয়বস্তু, শল্য চিকিৎসা ও ঔষধ সংক্রান্ত অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ, জ্বর, পাণ্ডুরোগ ও অন্যান্য রোগের জন্য অথর্ববেদের মন্ত্র।

Table of Contents

চতুর্থ বেদ অথর্ববেদ

ঐতিহাসিক গ্রন্থঅথর্ববেদ
পরিচিতি চতুর্থ বেদের শেষ বেদ
রচনাকালআনুমানিক ১২০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্ব
বিষয়জাদুমন্ত্রের সংকলন
অথর্ববেদ

ভূমিকা :- ভারত -এ হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ বেদের চতুর্থ ভাগ হল অথর্ববেদ। ‘অথর্ববেদ’ শব্দটি সংস্কৃত অথর্বণ ও বেদ শব্দ দু-টির সমষ্টি। অথর্ববেদ বৈদিক সাহিত্য -এর পরবর্তীকালীন সংযোজন।

অথর্ববেদের ভাষা

বেদের শেষ ভাগ অথর্ববেদ বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত।

ধর্মগ্রন্থ অথর্ববেদের রচনাকাল

সম্ভবত সামবেদযজুর্বেদ -এর সমসাময়িক কালে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ – ১০০০ অব্দ নাগাদ অথর্ববেদ রচিত হয়েছিল।

অথর্ববেদের নামকরণ

  • (১) মনিয়ার উইলিয়ামসের মতে অথর্ববেদের নামকরণ করা হয়েছে পৌরাণিক পুরোহিত অথর্বণের নাম অনুসারে। তিনিই প্রথম যাগযজ্ঞ ও সোমরস উৎসর্গ করার প্রথা উদ্ভব করেন এবং রোগ ও বিপর্যয়ের প্রতিকূল পদ্ধতি ও মন্ত্রগুলি রচনা করেন।
  • (২) মনিয়ার উইলিয়ামস উল্লেখ করেছেন যে, অগ্নির একটি অধুনা-অবলুপ্ত নাম ছিল ‘অথর’।
  • (৩) লরি প্যাটনের মতে ‘অথর্ববেদ’ নামটির অর্থ ‘অথর্বণগণের বেদ’।
  • (৪) অথর্ববেদের প্রাচীনতম অথর্বাঙ্গিরস নামটি এই বেদেই উল্লেখ করা হয়েছে। দুই জন বৈদিক ঋষি অথর্বণ ও আঙ্গিরসের নামানুসারে এই নামটি এসেছে।
  • (৫) মরিস ব্লুমফিল্ড বলেছেন যে, অথর্বণ ও আঙ্গিরস নাম দুটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থের দ্যোতক। প্রথম নামটি মাঙ্গলিক আর দ্বিতীয় নামটি প্রতিকূল জাদুবিদ্যার অর্থবাচক। কালক্রমে ইতিবাচক মাঙ্গলিক দিকটি অধিকতর সমাদর লাভ করে এবং ‘অথর্ববেদ’ নামটিই প্রচলিত হয়।
  • (৬)জর্জ ব্রাউনের মতে পরবর্তী নাম আঙ্গিরস অগ্নি ও বৈদিক পুরোহিতদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সম্ভবত এটির সঙ্গে নিপ্পুরের একটি আরামিক গ্রন্থে প্রাপ্ত প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয় আঙ্গিরোস -এর কোনো সম্পর্ক আছে।
  • (৭) অথর্ববেদ ভার্গবাঙ্গিরস ও ব্রহ্মাবেদ নামেও পরিচিত। ঋষি ভৃগু ও ব্রহ্মার নামে এই দুটি নাম এসেছে।

অথর্ববেদের গঠন

২০টি খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থে ৭৩০টি স্তোত্র ও প্রায় ৬০০০ মন্ত্র আছে।

ঋগ্বেদ থেকে অথর্ববেদে গৃহীত মন্ত্র

অথর্ববেদের এক-ষষ্ঠাংশ স্তোত্র ঋগ্বেদ থেকে সংকলিত। পঞ্চদশ ও ষোড়শ খণ্ড ব্যতীত এই গ্রন্থের স্তোত্রগুলি নানাপ্রকার বৈদিক ছন্দে রচিত।

অথর্ববেদের শাখা

এই গ্রন্থের দুটি পৃথক শাখা আছে – পৈপ্পলাদ ও শৌনকীয়। এই শাখাদুটি আজও বর্তমান। মনে করা হয় যে, পৈপ্পলাদ শাখার নির্ভরযোগ্য পাণ্ডুলিপিগুলি হারিয়ে গিয়েছে।

অথর্ববেদে লোকচিকিৎসার আদি রূপ প্রকাশিত

কেনেথ জিস্কের মতে অথর্ববেদ ‘প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় সমাজের লোকচিকিৎসার আদি রূপটি’ প্রকাশ করেছে।

ঐতিহাসিক গ্রন্থ অথর্ববেদের উপনিষদ

অথর্ববেদের শেষ অংশ (বেদান্ত) তিনটি প্রধান উপনিষদ‌ নিয়ে গঠিত। এগুলি হল মুণ্ডক উপনিষদ, মাণ্ডুক্য উপনিষদ‌ ও প্রশ্ন উপনিষদ‌। এগুলি হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন শাখাকে প্রভাবিত করেছে।

বাস্তব বিষয়ের সংকলন অথর্ববেদ

গবেষকদের মতে এই গ্রন্থ বৈদিক সমাজের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিত মতবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক সংকলন। এটি যজুর্বেদের মতো শুধু মাত্র যজ্ঞানুষ্ঠানের বিষয় নয়।

অথর্ববেদের নয়টি শাখা

চরণব্যূহ নামে পরবর্তীকালের একটি সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে অথর্ববেদের ৯ টি শাখার নাম জানা যায়। এগুলি হল পৈপ্পলাদ, স্তৌদ, মৌদ, শৌনকীয়, জাযল, অলদ, ব্রহ্মবাদ, দেবদুর্শ ও চারণবৈদ্য।

বর্তমানে অথর্ববেদের অস্তিত্ব

৯ টি শাখার মধ্যে শৌনকীয় শাখা এবং অধুনা-আবিষ্কৃত পৈপ্পলাদ শাখার একটি পাণ্ডুলিপিই এখন বর্তমান। পৈপ্পলাদ সংস্করণটি প্রাচীনতর।

অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখা

অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখার দশম খণ্ডে অদ্বৈতবাদ, ব্রহ্মের একত্ব, সমগ্র জীবজগৎ ও বিশ্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

মূল অথর্ববেদ গ্ৰন্থ

মূল অথর্ববেদ সংহিতা ১৮ টি কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত ছিল। শেষ কাণ্ড দুটি পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে।

অথর্ববেদের বিন্যাস

বেদের অপর ভাগগুলি বিষয় বা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির নামানুসারে বিন্যস্ত হলেও অথর্ববেদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এই বেদে বিষয়গুলি স্তোত্রের দৈর্ঘ্য অনুসারে বিন্যস্ত। প্রত্যেকটি কাণ্ডে প্রায় সমসংখ্যক শ্লোকের স্তোত্র সংকলিত হয়েছে।

অথর্ববেদের খন্ডের নাম

প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলিতে ক্ষুদ্রতম স্তোত্রের সংকলনটিকে প্রথম কাণ্ড বলা হয়েছে। এরপর বৃহদায়তন স্তোত্রের সংকলনগুলি দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি ক্রমে বিন্যস্ত।

ধর্মগ্রন্থ অথর্ববেদের গ্ৰথন

এই গ্ৰন্থের বেশিরভাগ স্তোত্রই কাব্যিক এবং বিভিন্ন ছন্দে নিবদ্ধ। তবে গ্রন্থের এক-ষষ্ঠাংশ গদ্যে রচিত।

অথর্ববেদের আলোচ্য বিষয়

প্রাচীন অথর্ববেদের প্রথম ৭ টি কাণ্ডে মোটামুটি সব ধরনের চিকিৎসার জন্য জাদুমন্ত্র ও জাদুর কথা, অষ্টম থেকে দ্বাদশ খণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়তত্ত্ব, ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ কাণ্ড পর্যন্ত জীবনের সংস্কারমূলক অনুষ্ঠানগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

অথর্ববেদের বিষয়বস্তু

  • (১) অথর্ববেদ সংহিতায় যে স্তোত্রগুলি আছে তার অনেকগুলিই জাদুমন্ত্র। বিশেষ কোনো কামনা সিদ্ধির জন্য কোনো ব্যক্তির দ্বারা বা তার হয়ে কোনো জাদুকরের দ্বারা এগুলির উচ্চারণের বিধান দেওয়া হয়েছে।
  • (২) এই স্তোত্রগুলির অধিকাংশই প্রিয়জনের দীর্ঘায়ু কামনা বা কোনো রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত মন্ত্র। এই সব ক্ষেত্রে রোগীকে গাছগাছড়া প্রভৃতি বস্তু ও একটি কবচ দেওয়ার বিধান রয়েছে।
  • (৩) কয়েকটি জাদুমন্ত্র সৈনিকদের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির উদ্দেশ্য যুদ্ধে শত্রুদের পরাজিত করা।
  • (৪) কয়েকটি আবার উৎকণ্ঠিত প্রেমিকের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির উদ্দেশ্য প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্ব্বীকে পরাহত করে অনিচ্ছুক প্রণয়ীকে বশীকরণ করা।
  • (৫) কয়েকটি ক্রীড়া বা বাণিজ্যে সাফল্য অধিক গবাদিপশু ও শস্যলাভ এবং ঘরের ছোটোখাটো বিপদ আপদ থেকে মুক্তিলাভের জন্য।
  • (৬) কয়েকটি স্তোত্র জাদুমন্ত্র-সম্পর্কিত নয়। এগুলি প্রার্থনা ও দার্শনিক চিন্তামূলক।

পৌরণিক অথর্ববেদ সংহিতা

অথর্ববেদ সংহিতা হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ বেদের চতুর্থ ভাগ, যা বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং ২০টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে ৭৩০টি স্তোত্র ও প্রায় ৬,০০০ মন্ত্র আছে। 

অথর্ববেদ মন্ত্র

এই অথর্ববেদে ৭৩০ টি সূক্ত এবং ৫,৯৭৭ টি মন্ত্র আছে, যা বেদের চতুর্থ ভাগ এবং হিন্দুধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ

শল্যচিকিৎসা ও ঔষধ সংক্রান্ত অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ

অথর্ববেদে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মন্ত্র ও শ্লোক আছে। যেমন, সদ্য-আবিষ্কৃত পৈপ্পলাদ সংস্করণে অস্থিভঙ্গ ও ক্ষতে রোহিণী লতা কিভাবে বাঁধতে হয় তার উল্লেখ আছে।

জ্বর, পাণ্ডুরোগ ও অন্যান্য রোগের জন্য অথর্ববেদের মন্ত্র

অথর্ববেদের অনেকগুলি স্তোত্র হল কোনো শিশু বা প্রণয়ীর আরোগ্য কামনা ও স্বাস্থ্যোদ্ধার এবং পরিবারের সদস্যদের নিশ্চিন্ত করার জন্য প্রার্থনা ও মন্ত্রের সংকলন।

উপসংহার :- বেদের চতুর্থ অংশ অথর্ববেদের বাংলা অনুবাদ করেন শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “অথর্ববেদ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে  তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) অথর্ববেদ হতে জিজ্ঞাস্য?

১. অশুভ শক্তি ও রোগ দূর করার জন্য জাদুবিদ্যার বেদ কোনটি?

অথর্ববেদ।

২. কোন বেদ ত্রয়ীর অংশ নয়?

অথর্ববেদ।

৩. অথর্ববেদের প্রকৃত নাম কি?

আঙ্গিরস।

৪. অথর্ববেদের অপর নাম কি?

অথর্বাঙ্গিরস।

৫. ব্রহ্মবেদ কাকে বলা হয়?

অথর্ববেদ।

৬. অথর্ববেদ কী?

অথর্ববেদ হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ বেদের চতুর্থ ভাগ।

৭. অথর্ববেদের বিষয়বস্তু কি?

হিন্দুধর্মের বেদের চতুর্থ ভাগ অথর্ববেদ মূলত মন্ত্র, প্রার্থনা, মন্ত্র এবং স্তোত্রের একটি বৈদিক যুগের সংগ্রহ, যেখানে রোগ, বিপদ ও কষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্ত্র ও পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এতে দার্শনিক চিন্তাভাবনাও রয়েছে। 

Leave a Comment