বনলতা সেন (চক্রবর্তী)

স্বাধীনতা সংগ্রামী বনলতা সেন (চক্রবর্তী) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজকর্মী ও নারী শিক্ষার পথিকৃৎ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নারীর সামাজিক অবস্থান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও সমাজসেবার জন্য বনলতা সেন (চক্রবর্তী) বাংলার ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

বনলতা সেন (চক্রবর্তী)

ঐতিহাসিক চরিত্রবনলতা সেন (চক্রবর্তী)
জন্মডিসেম্বর ১৯১৫ খ্রি
পরিচিতিভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও নারী সমাজের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব
পেশাস্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজকর্মী, শিক্ষানুরাগী
আদর্শ ও প্রেরণামহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু ও বেগম রোকেয়ার মত সমাজসংস্কারকদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত
সম্পর্কিত আন্দোলনঅসহযোগ আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, নারী সংগঠন কার্যক্রম
উত্তরাধিকারনারী স্বাধীনতা ও শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি
অবদানব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, নারী শিক্ষার প্রচার, সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা

বনলতা সেন (চক্রবর্তী)

ভূমিকা :- স্বাধীনতা সংগ্রামী বনলতা সেন (চক্রবর্তী) ছিলেন এক সাহসী ও দেশপ্রেমিক বাঙালি নারী, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজসেবামূলক কাজ ও নারীশিক্ষার প্রসারে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর জীবন ছিল ত্যাগ, সাহস এবং দেশপ্রেমের প্রতীক। বাংলার নারী সমাজ যখন সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল, তখন বনলতা দেবী তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও জাগরণের বার্তা ছড়িয়ে দেন। তাঁর কর্মজীবন প্রমাণ করে, দেশের স্বাধীনতা ও সমাজের কল্যাণে একজন নারীর ভূমিকা কতটা গভীর ও অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে।

বনলতা সেনের জন্ম

১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বনলতা দেবী জন্মগ্রহণ করেন ফরিদপুর জেলার কার্তিকপুর গ্রামে। পিতৃভূমিও ঐস্থানেই।

সংগ্রামী বনলতা সেনের পিতামাতা

তাঁর পিতার নাম কালীপ্রসন্ন সেন ও মাতার নাম সরোজিনী দেবী।

বনলতা সেনের বাড়ীতে স্বদেশী পরিবেশ

ছোটবেলা থেকেই তাঁদের পরিবারে একটা স্বদেশী পরিবেশ তিনি দেখে আসছিলেন। মায়ের কাছ থেকে স্বদেশী যুগের বিপ্লবীদের কাহিনী এবং ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের কাহিনী তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। বাডীর অনেকেই ১৯২১ সালে স্কুল-কলেজ ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

দেশের কাজে বনলতা সেনের প্রেরণা

১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর এবং ১৯২৯ সালে যতীন দাসের মৃত্যুর পর দেশব্যাপী যে শোক ও আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে তিনি দেশের কাজ করবার জন্য প্রেরণা লাভ করেন।

অনুশীলন সমিতিতে বনলতা সেনের যোগদান

১৯৩০ সালে সমগ্র দেশ জুড়ে চলেছিল গান্ধীজীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলন। বিপ্লবী আন্দোলনের গতিও সেই সময় প্রবল। চারিদিকের এই আবহাওয়া তাঁকে রাজনীতিক্ষেত্রের দিকে আকর্ষণ করে। তিনি বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন।

মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠায় বনলতা সেন

কার্তিকপুর গ্রামে একটি ক্লাব ও লাইব্রেরি স্থাপনে তাঁর একটা প্রধান অংশ ছিল। একটি মহিলা সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেন।

ষড়যন্ত্রে জড়িত বনলতা দেবী

তিনি টিটাগড় ষড়যন্ত্র, আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র প্রভৃতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘মহিলা কর্মীসংঘ’, ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ প্রভৃতিতে যোগদান করে মহিলাদের মধ্যে তিনি কাজ করেন।

ছাত্র ফেডারেশন আন্দোলনে বনলতা সেন

১৯৩৭ সাল থেকে তিনি ‘বন্দীমুক্তি আন্দোলন’, ‘ছাত্র ফেডারেশন’ প্রভৃতি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ‘অল বেঙ্গল গার্লস্ স্টুডেন্টস্ কমিটি’-র তিনি সম্পাদিকা ছিলেন। ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু যখন পৃথক কংগ্রেস পরিচালিত করেন বনলতা দেবী তাতে যোগ দেন।

গ্রেপ্তার বনলতা সেন

১৯৪২ সালের আন্দোলনে একটি বে-আইনী শোভাযাত্রার পুরোভাগে থেকে তিনি শোভাযাত্রাসহ অগ্রসর হন। পুলিস লাঠি চার্জ করতে থাকে। পুলিসের লাঠির আঘাতে তিনি লাঞ্ছিত হন এবং গ্রেপ্তার বরণ করেন।

কারামুক্ত বনলতা সেন

প্রায় তিনবৎসর নিরাপত্তা বন্দীরূপে প্রেসিডেন্সি জেলে তিনি আটক থাকেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। কারাবাসকালেই পরীক্ষা দিয়ে তিনি এম.এ. পাস করেন।

বনলতা সেনের বিবাহ

মুক্তির পর অনুশীলন দলের বিপ্লবী সরোজকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।

রিলিফের কাজে বনলতা সেন

১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গার সময় তিনি দাঙ্গাবিধ্বস্তদের মধ্যে রিলিফের কাজ করেন। নানা স্থানের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

বনলতা সেনের বন্দী জীবনের এক ছবি

  • (১) তাঁর বন্দী-জীবনের একটি ছবি দেওয়া এখানে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। জেলখানা হচ্ছে গতিহীন স্থির জলের ডোবা। এখানে অনেকদিন থাকতে থাকতে সবকিছুই যেন একঘেয়ে হয়ে পচে উঠতে চায়। রাজবন্দীরা ঐ বদ্ধজলকে প্রাণস্পর্শে সঞ্জীবিত করবার প্রয়াসে যতগুলি পন্থা অবলম্বন করতেন, তার মধ্যে পড়াশুনা ও আলোচনা একটা প্রধান স্থান অধিকার করত।
  • (২) কার্ল মার্কস্, এঙ্গেলস প্রমুখের কঠিন কঠিন নানা বই পড়বার একটা আড্ডা ছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ফিমেল ইয়ার্ডে। আড্ডার পাঠকবৃন্দ ঐ কঠিন পুস্তকগুলিকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করতেন। তর্ক এবং যুক্তি তখন জাল বিস্তার করে সব কয়টি পাঠককে জড়িয়ে ফেলত।
  • (৩) জাল না ছেঁড়া পর্যন্ত কারো যুক্তি ছিল না। ঐ তর্কজাল তাঁদের দিনের চিন্তা, রাতের ঘুম সবই বেড়ে ধরত। ‘অ্যান্টি ডুহরিং’ প্রভৃতি পুস্তকের প্রতিটি পঙক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ এবং তার যুক্তি ও তর্ক বনলতা সেন মাঝে মাঝে এমনভাবে মেলে ধরতেন যে, অন্যরা সেই জালে অজানিতে জড়িয়ে যেতেন।
  • (৪) জাল ছিড়ে সাময়িক মুক্তি অবস্থা একসময় আসত মূল সন্ধানের একটা প্রবল চেষ্টার পর। তবু অনন্ত রহস্য় অনন্তই রযে যেতো। বনলতার যুক্তিবাদী মন তাঁর কারাজীবনের সতীর্থদের এমনি করে আনন্দ পরিবেশন করত।

উপসংহার :- বনলতা সেন (চক্রবর্তী) ছিলেন সেই সব সাহসী নারীদের অন্যতম, যাঁরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সমাজে নারীশিক্ষা, সচেতনতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর কর্মধারা শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। বনলতা দেবীর জীবন ও আদর্শ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, কীভাবে দেশপ্রেম ও সমাজসেবার মাধ্যমে একটি সার্থক ও অর্থবহ জীবন গড়ে তোলা যায়।

(FAQ) বনলতা সেন (চক্রবর্তী) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. বনলতা সেন (চক্রবর্তী) কে ছিলেন?

বনলতা দেবী ছিলেন একজন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজকর্মী ও নারী শিক্ষার পথিকৃৎ, যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

২. বনলতা সেন (চক্রবর্তী) কোন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

তিনি অসহযোগ আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলনসহ বিভিন্ন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

৩. বনলতা সেন (চক্রবর্তী)-এর প্রধান অবদান কী ছিল?

তাঁর প্রধান অবদান ছিল নারীশিক্ষার প্রসার, সমাজসংস্কারে নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন।

৪. বনলতা সেন (চক্রবর্তী) কাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন?

তিনি মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু এবং বেগম রোকেয়ার মত বিশিষ্ট সমাজসংস্কারক ও নেতাদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন।

৫. বনলতা সেন (চক্রবর্তী)-এর জীবন থেকে কী শেখা যায়?

তাঁর জীবন থেকে শেখা যায় দেশপ্রেম, সাহস, ত্যাগ ও সমাজকল্যাণের প্রকৃত অর্থ—যেখানে ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশের ও সমাজের কল্যাণ সর্বাগ্রে স্থান পায়।

৬. বনলতা সেন (চক্রবর্তী)-এর উত্তরাধিকার কী?

তাঁর সংগ্রামী জীবন ও আদর্শ নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয় চেতনার জাগরণে আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

Leave a Comment