মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে নগর বিপ্লব ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শহর বা নগর, নগর গুলির বৈশিষ্ট্য হিসেবে গঠন প্রণালী, পরিকল্পনার অভাব, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গিল্ড বা সংঘ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান, শিক্ষা ও বিনোদন সম্পর্কে জানবো।
ইউরোপের নগরগুলির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে মধ্যযুগের নাগরগুলির উৎপত্তির সর্বজনগ্রাহ্য একটি বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা সম্ভব নয়, মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলির গঠন প্রণালী, মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলির পরিকল্পনার অভাব, মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলির শিক্ষা ও বিনোদন এবং মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলিতে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান সম্পর্কে জানব।
মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলির বৈশিষ্ট্য
ঐতিহাসিক ঘটনা | ইউরোপের নগরগুলির বৈশিষ্ট্য |
নজরদারি | উঁচু টাওয়ার |
ফটক | প্রধান প্রবেশপথ |
জনবসতি | অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ |
রাস্তা | সরু ও আঁকাবাঁকা |
সুন্দর অট্টালিকা | রোমান গির্জা ও টাউনহল |
উৎসব-এর অঙ্গ | মেলা |
ভূমিকা :-মধ্যযুগের প্রথমার্ধে বিভিন্ন বর্বর জাতির আক্রমণে ইউরোপ-এ যে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয় তার ফলে সেখানকার অর্থনীতি ও প্রাচীন নগরগুলি ভেঙে পড়েছিল। ইউরোপে সামন্তপ্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে নগরের বিকাশের পরিবর্তে গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির ভিত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে অশান্তি ও অস্থিরতা দূর হলে খ্রিস্টীয় নবম শতকে ইউরোপে আবার আর্থসামাজিক অগ্রগতি শুরু হয়।
নগর বিপ্লব
খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ইউরোপে একদিকে প্রাচীন ও ক্ষয়িষ্ণু নগরগুলি নতুন করে জেগে ওঠে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন নতুন নতুন শহরের উত্থান ঘটে। এই ঘটনা ইউরোপের ‘নগর- বিপ্লব নামে পরিচিত।
ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ নগর সমূহ
মধ্যযুগে, বিশেষ করে ১০০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পুরাতন ও নতুন বেশ কিছু নগরের অস্তিত্ব ছিল। এর মধ্যে প্রধান শহর বা নগরগুলি ছিল –
(১) ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ড-এর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি ছিল লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, ব্রিস্টল প্রভৃতি।
(২) ফ্রান্স
ফ্রান্স-এর প্রধান শহরগুলি ছিল প্যারিস, মার্সেই, অর্লিয়েন্স, নারবোনে, মন্টপেলিয়ার প্রভৃতি।
(৩) জার্মানি
জার্মানির প্রধান শহরগুলি ছিল হামবুর্গ, নুরেনবার্গ, মিউনিক, ব্রেমেন প্রভৃতি।
(৪) ইতালি
ইতালির প্রধান শহরগুলি ছিল ফ্লোরেন্স, ফ্লানডার্স, মিলান, ভেনিস, জেনোয়া, পিসা প্রভৃতি।
(৫) অন্যান্য দেশ
এছাড়াও অন্যান্য দেশে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য নগরগুলি ছিল মস্কো, কিয়েভ, কনস্ট্যান্টিনোপল, বার্সেলোনা, অ্যান্টোয়ার্প প্রভৃতি।
ইউরোপের নগর গুলির বৈশিষ্ট্য
মধ্যযুগে, বিশেষত খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে ইউরোপে নগরের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। নগরগুলিতে প্রচুর মানুষের বসবাস শুরু হয়। মধ্যযুগীয় এই সব নগরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(ক) গঠন প্রণালী
চোর, ডাকাত, সামন্তপ্রভুর আক্রমণ, বহিরাগত আক্রমণ প্রভৃতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে মধ্যযুগের ইউরোপের শহরগুলি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত। প্রাচীরের দেওয়ালের ভেতরের দিকে থাকত একাধিক তলবিশিষ্ট ঘর ও দুর্গ। এই দুর্গগুলি থেকে বহিরাক্রমণ প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া হত। একটি উঁচু টাওয়ার থেকে শহরের ওপর নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা থাকত। নগরে প্রবেশের জন্য কয়েকটি মাত্র পথ থাকত। প্রধান প্রবেশপথে একটি ফটক তৈরি করা হত।
(খ) পরিকল্পনার অভাব
- (১) মধ্যযুগের ইউরোপের নগরগুলি কোনো সুপরিকল্পিত চিন্তাভাবনা করে নির্মিত হয় নি। নগরগুলি ছিল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়িগুলি অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হত বলে শহরের জীবনযাত্রার মান বিশেষ ভালো ছিল না। শহরে পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে মানুষকে সর্বদা এক ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করতে হত।
- (২) প্রাচীরবেষ্টিত ছোট্ট অঞ্চলে একত্রে প্রচুর মানুষের বসবাসের ফলে মানুষের নাগরিক জীবনের মান ছিল খুবই নিম্ন। অপরিষ্কার পুকুর ও জলাশয় থেকে জল সরবরাহের ফলে শহরগুলিতে সর্বদা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করত। শহরের আবর্জনা পুকুর ও জলাশয়ের পানীয় জল দূষিত করত। এই জলই শহরে সরবরাহ করা হত। দূষিত জল পান করার ফলে শহরে কলেরার মতো মহামারি ছড়িয়ে পড়ত।
(গ) রাস্তাঘাট
- (১) শহরের অভ্যন্তরে রাস্তাঘাটগুলি ছিল সরু ও আঁকাবাঁকা। অধিকাংশ রাস্তাই ছিল কাঁচা। রাস্তাগুলির দুপাশে উঁচু উঁচু বাড়ি থাকায় দিনের বেলায়ও রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারত না। রাস্তার পাশে নিকাশি ব্যবস্থাও ছিল অপর্যাপ্ত।
- (২) এর ফলে শহরের সর্বত্র প্রচুর নোংরা আবর্জনা এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত। রাত্রে শহরে আলোর কোনো ব্যবস্থা থাকত না। ফলে পথিক ও আগন্তুকদের প্রায়ই বিপদের সম্মুখীন হতে হত। শহরের অন্ধকার রাস্তায় নিরাপত্তার একমাত্র ভরসা ছিল লণ্ঠন ও বল্লমধারী চৌকিদার।
(ঘ) ঘরবাড়ি
- (১) মধ্যযুগের শহরগুলির বেশিরভাগ ঘরবাড়ি রাস্তার দু-পাশ ঘেঁষে তৈরি হত। উঁচু বাড়িগুলির ওপরতলার বর্ধিত অংশ প্রায়ই রাস্তার কিছুটা ভেতর পর্যন্ত অংশ দখল করে নিত। ধনীরা গৃহনির্মাণে প্রায়ই পৌর আইন লঙ্ঘন করত। ধনীদের বাড়িগুলি হত পাকা।
- (২) দরিদ্রদের বাড়িগুলি কাঠ, খড় প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হত। বেশিরভাগ একতলা বাড়িতে টালির ছাউনি থাকত। শহরের প্রধান সুন্দর অট্টালিকাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রোমান গির্জা ও টাউনহল।
(ঙ) গিল্ড বা সংঘ
- (১) এই যুগের শহরগুলির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গিল্ড বা সংঘের অস্তিত্ব। নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বণিক ও কারিগররা শহরগুলিতে নিজ নিজ গিল্ড গঠন করত। গিল্ডগুলি শহরের বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনা করত। তারা বণিক ও কারিগর উভয় পক্ষেরই যথাযথ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করত।
- (২) এ ছাড়াও গিল্ডগুলি শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করত। গিল্ডগুলি শহরে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করত, দুঃস্থ কারিগর ও তার পরিবারকে সহায়তা করত এবং শহরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করত।
(চ) ব্যাবসাবাণিজ্য
মধ্যযুগের শহরগুলি ইউরোপের ব্যাবসাবাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অসংখ্য বণিক, শিল্পী, কারিগর ও শ্রমিক এই শহরগুলিতে বসবাস করত। কারখানায় বা বাণিজ্যে কারিগর বা শ্রমিক হিসেবে কাজের আশায় গ্রামগুলি থেকে বহু কৃষক ও ভূমিদাস এই সব শহরে চলে আসত। শহর থেকে বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পসামগ্রী দেশ-বিদেশের দূরদূরান্তের বাজারগুলিতে চলে যেত।
(ছ) ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান
- (১) শহরগুলিতে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ছিল তীব্র। প্রশাসন ও বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বহু উচ্চশ্রেণির লোকজন ও ধনী বণিক শহরে বসবাস করত। নাগরিক জীবনের সুখসুবিধা লাভের আশায় সামন্তপ্রভুরাও পরবর্তীকালে শহরে বসবাস করতে শুরু করে।
- (২) শহরে বসবাসকারী এই সব ধনী ও উচ্চবিত্তরা খুব দামি পোশাক পরত এবং অত্যন্ত বিলাসিতায় দিন কাটাত। শৌখিনতা ও আড়ম্বর ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
- (৩) পাশাপাশি শহরে প্রচুর দরিদ্র কারিগর ও শ্রমিক বসবাস করত। তারা অত্যন্ত সাধারণ পোশাক পরত এবং অনাড়ম্বরভাবে দিন কাটাত। দিবারাত্র কাজে নিযুক্ত থেকে তারা অবসর কাটানোর বিশেষ সময় পেত না।
(জ) শিক্ষা
শহরগুলিতে শিল্প-বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার ঘটলেও লেখাপড়ার প্রচলন খুব একটা ছিল না। শহরের দরিদ্র শ্রেণির কাছে শিক্ষা-সংস্কৃতি ছিল এক বিলাসিতার শামিল। দরিদ্র শ্রেণির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। মূলত ধনী বণিক পরিবারের সদস্যরাই শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকত। তারা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করত এবং মঠের সাধুসন্তদের শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে এনে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করত।
(ঝ) বিনোদন
- (১) শহরের মানুষ বছরের বিভিন্ন সময়ে আনন্দ উৎসবে যোগ দিত। আনন্দ-উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল মেলা। দেশ-বিদেশের বহু বণিক বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী এই সব মেলায় বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসত। মেলা উপলক্ষ্যে বসত নানা ভেলকিবাজির আসর।
- (২) জুয়াখেলা, মদ্যপান, কুকুরের লড়াই, মুরগির লড়াই প্রভৃতি ছিল মানুষের আনন্দ-বিনোদনের প্রধান উপাদান। তা ছাড়া বহু শহরে সাপ্তাহিক বাজার বসত। সাপ্তাহিক বাজারে কেনাকাটা শহুরে মানুষের বিনোদনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
উপসংহার :- মধ্যযুগের ইউরোপে নগরগুলির প্রাচীরের সম্ভ্রম জাগানো গঠন, কঠিন মসৃণ পাথরের সৌন্দর্য্য, ধনীদের বিলাস-বৈভব প্রভৃতি দূর থেকে দেখলে নগরগুলিকে ‘সৃষ্টির সংক্ষিপ্তসার’ বলে মনে হত। কিন্তু শহরে বসবাসকারী দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে নগরজীবন ছিল আতঙ্কের শামিল।
(FAQ) মধ্যযুগে ইউরোপের নগরগুলির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
প্রধান প্রবেশপথে।
অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ।
সরু, আঁকাবাঁকা ও অধিকাংশই কাঁচা।
রোমান গির্জা ও টাউন হল।
মেলা।