মহিয়ষী চারুপ্রভা সেনগুপ্ত (২৯ মার্চ ১৮৯৭ – ২০ এপ্রিল ১৯৭৫) উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবনী, গ্রাম্য সমাজ এবং জাতীয় আন্দোলনের এক সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে আজও আলোচিত।
বিপ্লবী চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
ঐতিহাসিক চরিত্র | চারুপ্রভা সেনগুপ্ত |
জন্ম | ২৯ মার্চ ১৮৯৭ খ্রি |
জন্মস্থান | কাঁঠালিয়া গ্রাম, ময়মনসিংহ (বর্তমান বাংলাদেশ) |
পিতামাতা | মহেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, কুসুমকুমারী দেবী |
রাজনৈতিক ভূমিকা | লবণ আইন ভঙ্গ, ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন‘-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ |
সামাজিক কাজ | নারীশিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা, ‘প্রিয়পুজা’ পত্রিকা সম্পাদনা |
দাঙ্গা প্রশমন | ১৯৪৬ সালে ফরিদপুরে শান্তি কমিটি গঠন |
প্রকাশনা ও সাহিত্য | তাঁর জীবনীভিত্তিক বই: আগুনপাখি চারুপ্রভা (লেখিকা: মৌলি রায়) |
প্রধান অবদান | স্বাধীনতা সংগ্রাম, নারীশিক্ষা প্রচার, দাঙ্গা প্রতিরোধ |
মৃত্যু | ২০ এপ্রিল ১৯৭৫ |
চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
ভূমিকা :- চারুপ্রভা সেনগুপ্ত ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসিনী ও অগ্রণী নারীযোদ্ধা, যিনি “অগ্নিকন্যা” নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কেবল স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নিজেকে নিবেদন করেন নি, বরং নারীদের শিক্ষাদান, আত্মসম্মান ও অধিকারবোধ জাগ্রত করতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
চারুপ্রভা সেনগুপ্তর জন্ম
১৮৯৭ সালের ১৯শে মার্চ ময়মনসিংহের কাঠালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন চারুপ্রভা সেনগুপ্ত। পিত্রালয় বংশী গ্রামে।
বিপ্লবী চারুপ্রভা সেনগুপ্তর পরিবার
তাঁর পিতা মহেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও মাতা কুসুমকুমারী দেবী। আইনজীবী ও সাহিত্যিক ডঃ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। গান্ধীভক্ত ও খাদি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা খ্যাতনামা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত তার ভগ্নীপতি। তার ভগ্নী হেমপ্রভা দাশগুপ্ত অসহযোগ আন্দোলন-এ বিশিষ্ট অংশ গ্রহণ করেন এবং গান্ধীজীর অনুগামী হয়ে দেশসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
চারুপ্রভা সেনগুপ্তর বিবাহ
নারী বিপ্লবী চারুপ্রভা সেনগুপ্তর বিবাহ হয়েছিল ফরিদপুর জেলার লক্ষ্মণদিয়া গ্রামের ভারতবন্ধু সেনগুপ্তের সঙ্গে। তখন চারুপ্রভা নবম শ্রেণীর ছাত্রী।
বিপ্লবী চারুপ্রভা সেনগুপ্তর শ্বশুরবাড়ী
তাঁর শ্বশুরবাড়ী ছিল একটি শিক্ষিত পরিবার। তাঁরা স্ত্রীশিক্ষা প্রচারের জন্য ‘অন্তঃপুর শিক্ষা সমিতি’ গঠন করেছিলেন। এই শিক্ষার আবহাওয়াতে বড় হয়েছিলেন বলে চারুপ্রভা সেনগুপ্ত নিজেকে সাহিত্যের দিক থেকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন।
পত্রিকা সম্পাদক চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
তিনি ‘প্রিয়পূজা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। নানা পত্রিকায় লিখে তিনি সুনাম অর্জন করেন।
চারুপ্রভা সেনগুপ্তর সামনে অনুকূল পরিবেশ
তাঁর পিত্রালয়ের শিক্ষা ছিল স্বদেশীভাবাপন্ন, শ্বশুরালয়ও তাই। সহজেই তাঁর হৃদয়ের গতি এদিকে গড়ে উঠবার সুযোগ পেয়েছিল।
খদ্দর বিক্রির কাজে চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
১৯২৫ সালে তিনি সূতা কাটতে এবং খদ্দর পরতে শুরু করেন। রাত্রে বাড়ী বাড়ী গিয়ে তিনি খদ্দর বিক্রি করতেন। স্বামী ছিলেন ফরিদপুরের রাজবাড়ীর উকিল। সেখানেই ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র।
রাজনীতি ক্ষেত্রে চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর স্বামীর মৃত্যু তাঁর জীবনে বিপুল পরিবর্তন এনে দেয়। ১৯৩০ সালে তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষা ও গান্ধীজীর ডান্ডী অভিযান একই সময় যোগাযোগ হয়। গান্ধীজীর আহ্বান তাকে এতখানি বিচলিত করে যে, কলেজে না গিয়ে তিনি পুরোপুরি ভাবে রাজনীতি ক্ষেত্রে নেমে পড়েন।
ঘরের গণ্ডী ভাঙলেন চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
রাজবাড়ী শহরে সেই সময়ে মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে এসে আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা পেতেন। সেখানকার প্রথম লবণ সত্যাগ্রহী দলকে আশীর্বাদ করবার ভার পড়ে তাঁর উপর। আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের স্থলে তাঁর সঙ্গে যাবার জন্য তিনি একটি মেয়েকেও সংগ্রহ করতে পারেন নি। অবশেষে একাই তিনি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে এলেন। এইভাবে তাঁর ঘরের গণ্ডী ভাঙল।
গ্রেপ্তার চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
পিকেটিং, বে আইনী সভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান প্রভৃতি কাজ তিনি করে যেতে থাকেন। রাজবাড়ীর অনেক মেয়ে এবং বৌ ঘরের বাধা ভেঙে তখন সাহস করে বেরিয়ে এলেন। ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে তাকে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার ও জরিমানা করা হয়।
পুনরায় গ্রেপ্তার চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
১৯৩২ সালের আন্দোলনে আইন অমান্য করার অভিযোগে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ১৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
চারুপ্রভা সেনগুপ্তর বাড়ী তল্লাসী
১৯৩৩ সালে বেরিয়ে এসে তিনি হরিজন বিদ্যালয়ের কাজে ও চরকা খদ্দর ইত্যাদি গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৫ সালে তার ছেলেদের টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে গ্রেপ্তার করে এবং ঘন ঘন তাঁর বাড়ী তল্লাসী করে। অথচ তাঁদের বাড়ীর সঙ্গে বিপ্লবীদের কার্যকলাপের কোনো সম্বন্ধই ছিল না।
নিরাপত্তা বন্দী চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
এরপর তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তিনি কলকাতা চলে আসেন ১৯৩৬ সালে। ১৯৪২ সালের আন্দোলনে যোগদান করাতে তিনি এবং তাঁর প্রায় সব ছেলেমেয়েরাই গ্রেপ্তার হন। তিনি নিরাপত্তা বন্দীরূপে প্রায় ১০ মাস প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন।
শিশুসদন খোলেন চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
১৯৪৩ সালে মুক্তি পাবার পর তিনি ফরিদপুর জেলায় দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্যের জন্য কাজ করতে থাকেন। রাজবাড়ীতে দুঃস্থ শিশুদের জন্য এ আই ডব্লু সি-র সাহায্যে তিনি একটি শিশুসদন খোলেন। পরে এই শিশুসদন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে পরিণত হয় – নাম তার ‘কস্তুরবা বিদ্যামন্দির’।
চারুপ্রভা সেনগুপ্তর প্রতি গান্ধীজীর আহ্বান
১৯৭৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গার পর গান্ধীজী নোয়াখালি যাবার পথে তাঁকে সেখানে যেতে আহ্বান করা সত্ত্বেও তিনি নোয়াখালি যান নি। রাজবাড়ীতে তখন দাঙ্গার পূর্বাবস্থা। তাই তিনি সেখানে থেকেই শান্তি কমিটি গঠন করে দাঙ্গার সম্ভাবনাকে বোধ করতে সমর্থ হন।
বঙ্গ বিভাগের পর চারুপ্রভা সেনগুপ্ত
বঙ্গ বিভাগ হয়ে যাবার পরও তাঁর রাজবাড়ীতে যাতায়াত ছিল। কিন্তু পাসপোর্ট প্রথা চালু হবার পর মনে কেমন একটা ধাক্কা খেয়ে তাঁর সারা জীবনের কর্মক্ষেত্রে তিনি আর যেতে পারেন নি।
চারুপ্রভা সেনগুপ্তর মৃত্যু
তিনি ২০ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার :- চারুপ্রভা সেনগুপ্ত ছিলেন এক সাহসিনী, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং একই সঙ্গে সমাজে নারীর মর্যাদা ও শিক্ষার প্রসারের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামে নয়, সামাজিক কাজেও ছিলেন অগ্রণী। নারীশিক্ষা, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমাজ সংস্কারে তাঁর অবদান আজও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল।
(FAQ) বিপ্লবী চারুপ্রভা সেনগুপ্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
চারুপ্রভা সেনগুপ্ত ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সাহসী নারীযোদ্ধা ও সমাজকর্মী, যিনি “অগ্নিকন্যা” নামে পরিচিত ছিলেন।
তিনি ২৯ মার্চ ১৮৯৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কাঁঠালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, লবণ আইন ভঙ্গ করেন, কারাবরণ করেন, নারীশিক্ষা ও সমাজসেবায় অবদান রাখেন এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন।
তাঁর সাহস, প্রতিবাদী মনোভাব এবং নির্ভীক নেতৃত্বের কারণে তাঁকে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তিনি অন্তত দুইবার কারাবরণ করেন—১৯৩২ সালে (১৬ মাস) ও ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় (প্রায় ১০ মাস)।
তাঁর স্বামীর নাম ছিল ভারতবন্ধু সেনগুপ্ত।
হ্যাঁ, মৌলি রায় রচিত “আগুনপাখি চারুপ্রভা” নামক বইটি তাঁর জীবনকথা ও সংগ্রামের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।
তিনি ২০ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।