দৌলতুন্নেছা খাতুন

মহিয়ষী দৌলতুন্নেছা খাতুন ছিলেন একজন বিশিষ্ট নারী যিনি বাংলার সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নারীশিক্ষা, সামাজিক সংস্কার ও মানবিক মূল্যবোধ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর কর্মজীবন ও চিন্তাধারা নারী জাগরণে নতুন দিশা দেয় এবং তিনি ছিলেন নারীর আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথপ্রদর্শক। দৌলতুন্নেছা খাতুনের জীবন ও অবদান আজও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে স্মরণীয়।

Table of Contents

শিক্ষিকা দৌলতুন্নেছা খাতুন

ঐতিহাসিক চরিত্রদৌলতুন্নেছা খাতুন
পরিচিতিশিক্ষিকা, সমাজসংস্কারক ও নারী জাগরণের অগ্রদূত
জন্ম১৯১৮ সালের জুন মাসে
কর্মক্ষেত্রনারীশিক্ষা, সমাজসংস্কার, মানবকল্যাণমূলক কাজ
মূল অবদাননারী শিক্ষার প্রসার, সমাজে নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
ঐতিহাসিক গুরুত্ববাঙালি নারী জাগরণের ধারায় অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয়
উত্তরাধিকার ও স্মৃতিনারী শিক্ষা ও সমাজসেবায় তার অবদান আজও প্রেরণার উৎস
মৃত্যু১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ

দৌলতুন্নেছা খাতুন

ভূমিকা :- দৌলতুন্নেছা খাতুন ছিলেন বাংলার এক বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ও সমাজসংস্কারক, যিনি নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজে নারী জাগরণে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি এমন এক সময়ে কাজ করেছিলেন যখন নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি নারীদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে নিরলস পরিশ্রম করেন। তাঁর উদ্যোগে অনেক কন্যাশিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নারী সমাজে আত্মমর্যাদা ও সচেতনতার নতুন ধারা সূচিত হয়। দৌলতুন্নেছা খাতুন কেবল একজন শিক্ষিকা নন, বরং তিনি ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের এক অনুপ্রেরণাদায়ী শক্তি, যার চিন্তাধারা ও কর্ম আজও বাঙালি সমাজে প্রাসঙ্গিক ও শ্রদ্ধার পাত্র।

দৌলতুন্নেছা খাতুনের জন্ম

১৯১৮ সালের জুন মাসে বগুড়া জেলার সোনাতলা নামক গ্রামে দৌলতুন্নেছা খাতুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

সমাজসংস্কারক দৌলতুন্নেছা খাতুনের পিতামাতা

তাঁর পৈতৃক বাড়ী যশোহর জেলার মাগুরা মহকুমাতে। তাঁর পিতার নাম মহম্মদ ইয়াসীন ও মাতার নাম নুরুন্নেসা খাতুন।

দৌলতুন্নেছা খাতুনের বিবাহ

নিম্ন প্রাইমারী পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই দৌলতুন্নেছার মাত্র আটবছর বয়সে বগুড়ার ডাঃ হাফিজুর রহমানের সঙ্গে বিবাহ হয়।

লেখাপড়ায় অত্যন্ত আগ্রহী দৌলতুন্নেছা খাতুন

তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকেরা সেই সময়ে স্ত্রীশিক্ষার খুব বিরোধী ছিলেন। তবুও দৌলতুন্নেছার পিতামাতা তাঁর লেখাপড়া শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি ঢাকা ইডেন হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন ১২ বৎসর বয়স পর্যন্ত। তারপর তাঁকে শ্বশুরবাড়ী যেতে হয়। তাঁর স্বামী গাইবান্ধার ডাক্তার ছিলেন। লেখাপড়ায় অত্যন্ত আগ্রহ থাকাতে তিনি সেখানেই বাড়ীতে বসে লেখাপড়া করতে থাকেন।

গাইবান্ধা মহিলা সমিতির সম্পাদিকা দৌলতুন্নেছা খাতুন

১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য় আন্দোলনের সভা ও শোভাযাত্রায় দৌলতুন্নেছা যোগদান করেন। ১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় দৌলতুন্নেছা দেবী ও অন্য়ান্য কয়েকজন মিলে গাইবান্ধা মহিলা সমিতি গঠন করেন। যদিও বয়স তখন তার মাত্র ১৪ বৎসর, দায়িত্বজ্ঞানে ও কর্মভার গ্রহণে তিনি পরিণত বয়সের পরিচয় দিতেন। সমিতির সম্পাদিকা ছিলেন তিনি নিজে, সভানেত্রী ছিলেন মহামায়া ভট্টাচার্য এবং সহ-সভানেত্রী দক্ষবালা দাস।

দৌলতুন্নেছা খাতুনের বক্তৃতায় আকৃষ্ট সাধারণ মানুষ

এই সমিতি সভা, শোভাযাত্রা, পিকেটিং, ১৪৪ ধারা অমান্য় ও প্রচারকার্য ইত্যাদি পূর্ণোদ্দমে করতে থাকে। আশেপাশের ৭৮টি গ্রামের মহিলাগণও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বামুনডাঙা, সুরতগালি, নলডাঙা, বিজয়ভাঙা, ফুলছড়ি, কূপতলা, তুলসীঘাট প্রভৃতি গ্রামে তিনি যখন বক্তৃতা দিতেন তখন গ্রামের বহু হিন্দু-মুসলমান দলে দলে দৌলতুন্নেছার বক্তৃতা শুনতে আসতেন। ঘোর পর্দানসীন মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়ে, তাতে আবার অত ছোট, তাই সভা লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো। দৌলতুন্নেছা দেবী প্রাণের আবেগে বক্তৃতা দিয়ে সকলকে আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান করতেন।

গৃহহারা দৌলতুন্নেছা খাতুন

কিছুদিন পরে তাঁর স্বামীকে গাইবান্ধার বাইরে বহিষ্কৃত করা হয়। তাঁদের গাইবান্ধার বাড়ীও বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতিতে যেদিন পুলিস এসে তাদের বাড়ী বাজেয়াপ্ত করে সেদিন দেবরকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে শহরের রাজপথে এসে দাঁড়াতে হয়। একজন ভদ্রলোক সযত্নে তাঁকে তার পরিবারে নিয়ে গিয়ে আশ্রণ দেন।

গ্রেপ্তার দৌলতুন্নেছা খাতুন

সমস্ত বাধাবিঘ্ন ও নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে দৌলতুন্নেছা আন্দোলন পরিচালনা করে যান। অবশেষে পুলিস ফুলছড়ি গ্রাম থেকে তাকে, মহামায়া ভট্টাচার্যকে এবং প্রতিভা সবকারকে গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। দৌলতুন্নেছা খাতুন রাজসাহী, প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর জেলে বন্দী ছিলেন। এই সময় দৌলতুন্নেছার আত্মীয়া সমবয়সী জিখাউননাহাব রবিনা খাতুন এবং রোকেয়া খাতুন এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁদের গেপ্তার করা হয় নি।

বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দৌলতুন্নেছা খাতুন

মুক্তির পর দৌলতুন্নেছা দেবী দেখলেন আন্দোলন মন্দীভূত। তিনি পড়াশুনায় মন দিলেন। ঘরে বসে পড়াশুনা করে তিনি বি.এ. পর্যন্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নানা প্রবন্ধ ও গল্প লিখে তিনি তাঁর সাহিত্য রুচির পরিচয় দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমিতির কাজও করতেন।

সমাজসেবামূলক কাজে প্রবৃত্ত দৌলতুন্নেছা খাতুন

১৯৭৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অনাথ শিশু ও বালক-বালিকাদেব জন্য় একটি অনাথ আশ্রম স্থাপন করেন এবং সমাজসেবামূলক কাজে প্রবৃত্ত হন।

পূর্ব-পাকিস্তানে দৌলতুন্নেছা খাতুন

এরপর তিনি স্বামী-পুত্রের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে আসেন এবং নানারূপ গঠনমূলক কাজের মধ্য দিয়ে দেশসেবায় নিযুক্ত থাকেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ব্যবস্থা-পরিষদের সদ্য নির্বাচিত হন। সুলেখিকা, সুবক্তা এবং সমাজসেবিকারূপে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে পরিচিত মুখ।

দৌলতুন্নেছা খাতুনের চীন পরিভ্রমণ

১৯৫৬ সালে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে চীনে প্রেরিত ডেলিগেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তিনি চীন পরিভ্রমণ করে এসেছেন।

মহিয়ষী দৌলতুন্নেছা খাতুনের মৃত্যু

১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষিকা, সমাজসংস্কারক ও নারী জাগরণের অগ্রদূত দৌলতুন্নেছা দেবী পরলোক গমন করেন।

উপসংহার :- দৌলতুন্নেছা দেবী ছিলেন এমন এক প্রগতিশীল নারী যিনি সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নারীর অবস্থান উন্নত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তাঁর কর্ম ও চিন্তাধারা শুধু নারীর মুক্তিই নয়, গোটা সমাজের মানসিক বিকাশে অবদান রেখেছে। তিনি দেখিয়েছেন যে শিক্ষা ও সচেতনতা সমাজ পরিবর্তনের প্রধান অস্ত্র। দৌলতুন্নেছা খাতুনের জীবন ও কর্ম আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সাহস, মানবতা ও দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে সামাজিক রূপান্তর সম্ভব। তাঁর স্মৃতি বাংলা নারী সমাজের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিরকাল অম্লান থাকবে।

(FAQ) দৌলতুন্নেছা খাতুন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. দৌলতুন্নেছা খাতুন কে ছিলেন?

দৌলতুন্নেছা খাতুন ছিলেন বাংলার একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা, সমাজসংস্কারক ও নারী জাগরণের অগ্রদূত, যিনি নারীশিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

২. দৌলতুন্নেছা খাতুনের প্রধান অবদান কী ছিল?

তাঁর প্রধান অবদান ছিল নারীশিক্ষার প্রসার, সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার মাধ্যমে নারীর আত্মনির্ভরতা গড়ে তোলা।

৩. তিনি কোন সময়কালে সক্রিয় ছিলেন?

দৌলতুন্নেছা খাতুন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সক্রিয়ভাবে সমাজসেবায় যুক্ত ছিলেন।

৪. দৌলতুন্নেছা খাতুনের কাজের মূল লক্ষ্য কী ছিল?

তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তার, কুসংস্কার দূরীকরণ এবং নারী সমাজকে আত্মসম্মান ও সচেতনতার পথে এগিয়ে নেওয়া।

৫. সমাজে তাঁর প্রভাব কীভাবে অনুভূত হয়েছিল?

তাঁর উদ্যোগ ও কাজের ফলে নারীশিক্ষার প্রতি সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং বহু নারী শিক্ষা ও সমাজসেবায় এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত হয়।

৬. আজকের দিনে দৌলতুন্নেছা খাতুনের প্রাসঙ্গিকতা কী?

আজও তাঁর চিন্তা ও কাজ নারীশিক্ষা, সমতা ও মানবিক সমাজ গঠনের অনুপ্রেরণা জোগায়।

Leave a Comment