হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

ঊনবিংশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি কবি, লেখক ও সমাজসেবক হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩)। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাথমিক যুগের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি সমাজ ও দেশের প্রতি গভীর প্রেম এবং আত্মত্যাগের আদর্শ প্রকাশ করে। “চৈতন্য চরিতামৃত” এবং “কবিতা কৌমুদী” তাঁর বিখ্যাত রচনা। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর সাহিত্যিক অবদান বাঙালি সমাজে দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

Table of Contents

কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

ঐতিহাসিক চরিত্রহেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম১৮৩৮ খ্রি
জন্মস্থানহাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ
পেশাকবি, লেখক, সমাজ সংস্কারক
সাহিত্যিক অবদানআধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রদূত
বিখ্যাত রচনা‘চৈতন্য চরিতামৃত’, ‘কবিতা কৌমুদী’
বিষয়ভিত্তিক রচনাদেশপ্রেম, সামাজিক বিচার, আত্মত্যাগ
ধর্মীয় প্রভাবচৈতন্য ভাবাদর্শ
মৃত্যু১৯০৩ খ্রি
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর পরাধীন ভারত-এ প্রথম যে জাতীয় কবি স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংহতির স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মধুসূদন দত্তর পর হেমচন্দ্রকেই বলা হয় বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় মহাকবি। মধুসূদনের অকাল মৃত্যুর পর বঙ্গদর্শন পত্রিকাবঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “মহাকবির সিংহাসন শূন্য হয় নাই। এ দুঃখ-সাগরে সেইটি বাঙ্গালীর সৌভাগ্য নক্ষত্র। মধুসূদনের ভেরী নীরব হইয়াছে, কিন্তু হেমচন্দ্রের বীণা অক্ষয় হউক। বঙ্গ কবির সিংহাসনে যিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি অনন্তধামে যাত্রা করিয়াছেন। কিন্তু হেমচন্দ্র থাকিতে বঙ্গমাতার ক্রোড় সুকবিশূন্য বলিয়া আমরা কখনও রোদন করিব না।” বস্তুত উনিশ শতকের বাংলার শীর্ষস্থানীয় কবিযুগলের নাম হল মধুসুদন ও হেমচন্দ্র। হেমচন্দ্রই তাঁর লেখার মাধ্যমে স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে ভারতবাসীকে অধীনতার পাশ ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল হুগলি জেলার গুলিটা গ্রামে মাতুলালয়ে হেমচন্দ্রের জন্ম। তাঁর পিতা কৈলাসচন্দ্রের আদি নিবাস ছিল উত্তরপাড়ায়। বিবাহের পর থেকে তিনি শ্বশুরালয়েই বাস করতেন।

শৈশবে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

কৈলাসচন্দ্র ও আনন্দময়ীর ছয় পুত্রকন্যার মধ্যে হেমচন্দ্রই ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। শৈশবে মামার বাড়ির গ্রামের পাঠশালাতেই শিক্ষারম্ভ হয় তাঁর। নয় বছর বয়সে তিনি দাদামশায়ের কাছে তাঁর খিদিরপুরের বাড়িতে চলে আসেন এবং এখানেই পড়াশুনা শুরু করেন। ছেলেবেলা থেকেই হেমচন্দ্র ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। তাঁর অন্তর ছিল অত্যন্ত কোমল। পরের দুঃখ দেখলে প্রাণ কেঁদে উঠত।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন

ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী। বিভিন্ন বিষয় জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। তাই জ্ঞান বুদ্ধিতে সহপাঠীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। পড়াশুনাতে বরাবরই তিনি বৃত্তি লাভ করেছেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে হেমচন্দ্র বি.এ. পাস করেন।

প্রধান শিক্ষক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

কিছুকাল তিনি মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে কেরানির কাজ করেন। পরে কলকাতা ট্রেনিং একাডেমির প্রধান শিক্ষকের পদে চাকরি গ্রহণ করেন।

আইন ব্যবসায় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে এল, এল, পাস করার পরে তিনি কলকাতা হাইকোর্ট-এ আইন ব্যবসায় শুরু করেন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মুন্সেফ পদ পেয়ে প্রথমে শ্রীরামপুরে ও পরে হাওড়ায় মুন্সেফের কাজ করেন। তারপর পুনরায় ওকালতির কাজে হাইকোর্টে ফিরে আসেন এবং ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে হেমচন্দ্র সরকারী উকিল নিযুক্ত হন। এই সময়ে আইন বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরাজি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে তিনি সরকারের কাছ থেকে দু’হাজার টাকা পুরস্কার পান। হাইকোর্টে আইন ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থাগম হত হেমচন্দ্রের। দেড়শো বছর আগে মাসিক তিন হাজার টাকা আয় থেকেই বোঝা যায় ওকালতিতে তিনি অসামান্য সাফল্য লাভ করেছিলেন।

বঙ্গ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ জাতীয় কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

হেমচন্দ্রের প্রকৃত পরিচয়, তিনি বঙ্গ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ জাতীয় কবি। ওকালতির সদাব্যস্ত জীবনে যেটুকু অবসর তিনি পেতেন সাহিত্য সাধনায় তা ব্যয় করতেন। কিন্তু পরে এমন একটা সময় উপস্থিত হল যখন আইনের কচকচি তাঁর কাছে নিতান্তই নীরস বলে বোধ হল। কাব্য সাধনাতেই তাঁর মন অধিকতর আকৃষ্ট হল।

সাহিত্যিক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগুচ্ছ

১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ছাব্বিশ বছর বয়সে হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্যগুচ্ছ চিন্তা তরঙ্গিনী প্রকাশিত হল। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কবিখ্যাতি লাভ করেন। দুই বন্ধুর পরপর অকাল মৃত্যুর ঘটনায় মর্মাহত কবি রচনা করেছিলেন চিন্তা তরঙ্গিনী গ্রন্থ। প্রকাশের অল্পকালের মধ্যেই গ্রন্থটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে এক অভূতপূর্ব নজির। হেমচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছিলেন একুশ বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। আর তেইশ বছর বয়সে তাঁরই লেখা কাব্যগ্রন্থ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকাভুক্ত হল। কবির পক্ষে এই অভূতপূর্ব ঘটনা যেমন আনন্দের গৌরবের তেমনি সৌভাগ্যের বিষয়। বস্তুতঃ ঘটনাটি ছিল হেমচন্দ্রের কবি-প্রতিভার স্বীকৃতি।

কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃত্রসংহার কাব্য

এর চাইতেও আরও বড় স্বীকৃতি অপেক্ষা করছিল হেমচন্দ্রের জন্য। চব্বিশ বছর বয়সে হেমচন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে তাঁর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ৩৮ বছর বয়স্ক মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্য আত্মপ্রকাশ করল। মেঘনাদ বধ কাব্যগ্রন্থের জন্য মধুসুদন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তেমনি হেমচন্দ্র চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর বৃত্রসংহার কাব্যের জন্য। এই গ্রন্থে তিনি পৌরাণিক কাহিনীকে অবলম্বন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সময়ের বিচারে দেখতে গেলে সাহিত্যক্ষেত্রে হেমচন্দ্র ছিলেন এক ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি একই সঙ্গে মধুসূদনের সমসাময়িক আবার বঙ্কিম, নবীনচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ-এরও ছিলেন সমকালীন।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাসিক আয় হ্রাস

রবীন্দ্রনাথ হেমচন্দ্রের কবিতা প্রথম পড়েছিলেন বিহারীলালের অবোধবন্ধু পত্রিকাতে। টানা তিন বছর ধরে এই পত্রিকায় হেমচন্দ্রের কবিতা ছাপা হয়েছিল। একদিকে ওকালতি জগতে লক্ষ্মীর ভজনা, আবার তার পাশাপাশি সরস্বতীর সাধনা-এই দুই সাধনা একই সময়ে বজায় রাখতে গিয়ে পেশার ক্ষেত্রে ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে লাগলেন হেমচন্দ্র। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মাসিক আয় কমে আসতে থাকে। এই সমস্যাটিকে অগ্রাহ্য করেই তিনি নিজেকে কাব্যসাধনায় নিমগ্ন রাখেন এবং কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

ইংরেজ সরকারের রোষদৃষ্টিতে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় হেমচন্দ্রের ভারত সঙ্গীত কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই কবিতায় তিনি স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে ভারতবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বদেশীয়দের মধ্যে স্বদেশপ্রেমী কবি হিসেবে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করলেও শাসক ইংরেজ সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়েন। স্বদেশ চেতনামূলক এই কবিতা প্রকাশ করার জন্য পত্রিকার সম্পাদক ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছিল।

কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবাদ

ভারত সঙ্গীত ছাড়াও বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে তিনি স্বদেশপ্রেম উদ্দীপক ভাব প্রকাশ করেছেন। ভারতবিলাপ, কালচক্র, বীরবাহু কাব্য, রিপন উৎসব, ভারতের নিদ্রাভঙ্গ, গঙ্গা ও জন্মভূমি প্রভৃতি রচনা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। হেমচন্দ্রের সব চেয়ে বিখ্যাত রচনা বৃত্রসংহার কাব্য। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে দুই খন্ডে এই রচনা প্রকাশিত হয়। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরন্তন প্রতিবাদ ঘোষণা করেছেন।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসায় বঙ্কিমচন্দ্র

বৃত্রসংহার কাব্য প্রকাশিত হবার পর স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র কাব্যটির সপ্রশংস সমালোচনা লিখে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কাব্য আলোচনার এক স্থানে তিনি জগৎবিখ্যাত কবি মিলটনের সঙ্গে হেমচন্দ্রের তুলনা করেছেন। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘তৃতীয় সর্গে, বৃত্রাসুর সভাতলে প্রবেশ করিলেন। :

‘নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস, পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ’

এখানে ‘পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ’ ইহা প্রথম শ্রেণীর কবির উক্তি – মিলটনের যোগ্য। বৃত্রসংহার কাব্য মধ্যে এরূপ উক্তি অনেক আছে।’ বলাবাহুল্য, সাহিত্য সম্রাটের এরূপ উক্তি, তৎকালীন সময়ের ঈর্ষাকাতর নবীন কবিদের অনেকেরই মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিল। বস্তুতঃ কাব্য ভারতীর একনিষ্ঠ সাধক হেমচন্দ্র তাঁর সমকালের মানুষের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও প্রীতি যেমন লাভ করেছেন তেমনি অনাদর, অবজ্ঞা ও ঈর্ষাও কিছু তাঁর ভাগ্যে কম জোটেনি।

স্বদেশ প্রেমিক ও সত্যের পুজারী হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

কবি হেমচন্দ্র ছিলেন স্বদেশ প্রেমিক এবং সত্যের পুজারী। নানা ভাবে তাঁর কাব্যে এই ভাব উৎকীর্ণ হয়েছে। এছাড়াও নারীমুক্তি, বিশেষ করে অসহায় বিধবা রমণীর ওপর হিন্দু সমাজের হৃদয়হীন আচরণের বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁর কুলিন মহিলা বিলাপ কবিতাটি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহুবিবাহ রোধ আন্দোলনের সহায়ক হয়েছিল।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যানুবাদ

মৌলিক কাব্য রচনা ছাড়াও শ্রেষ্ঠ ইংরাজ কবিদের কবিতারও তিনি সুললিত কাব্যানুবাদ করেছিলেন। টেনিসন, ড্রাইডেন, আলেকজান্ডার পোপ প্রমুখ কবির রচনার তিনি অনুবাদ করেন যা অনুবাদকর্ম হয়েও মৌলিক রচনার স্বাদ-গন্ধী।

উদার ও পরদুঃখকাতর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

এককালে আইন ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন হেমচন্দ্র। কিন্তু তাঁর মন ছিল উদার ও পরদুঃখকাতর। বৈষয়িক ব্যাপারেও ছিলেন অনভিজ্ঞ। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে অর্থ সঞ্চয়ের জন্য কখনওই সচেষ্ট হন নি। তাঁর অর্জিত অর্থের একটা বৃহৎ অংশ আত্মীয়-স্বজন ও আশ্রিতদের ভরণপোষণে ব্যয়িত হত।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারিবারিক বিপর্যয়

  • (১) একটা সময়ে পারিবারিক ক্ষেত্রে এমন বিপর্যয় দেখা দেয় যে হেমচন্দ্র দুঃখ শোক ও মানসিক আমাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। স্ত্রী কামিনী দেবী মধ্য বয়সে পাগল হয়ে যান। স্ত্রীকে সুস্থ করার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই হয় ব্যর্থ। এই সময়েই একের পর এক আত্মীয় বিয়োগ-ব্যথা তাঁকে সইতে হয়।
  • (২) ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর তৃতীয় ভ্রাতা যোগেন্দ্রচন্দ্র মারা যান। কিছুদিনের মধ্যেই হেমচন্দ্রের বৈবাহিক পাইকপাড়া নিবাসী গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মারা যান। এই শোকাবহ ঘটনাগুলোর পরেই কবির শ্রদ্ধেয় সুহৃদ বিদ্যাসাগর মহাশয় এবং অকৃত্রিম বন্ধু বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুতে তিনি গভীর মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন।
  • (৩) পারিবারিক ক্ষেত্রে পুত্রদের তরফ থেকেও সুখী ও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি হেমচন্দ্র। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র অল্প বয়সেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। অন্য সন্তানদের মধ্যেও বিশেষ উপার্জনশীল কেউ ছিলেন না। কবির আর্থিক অনটনের দিনে পুত্রদের কাছ থেকে কোন প্রকার সহযোগিতাই তিনি পান নি।

কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন-কাহিনী নিদারুণ এক দলিল

  • (১) দুই চোখে ছানি পড়ায় ক্রমশঃ দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল, তাই কবির শেষ জীবনের প্রতিটি দিন ছিল দুঃখ ক্লেশে জর্জরিত। তাঁর এই সময়ের জীবন-কাহিনী নিদারুণ এক দলিল হয়ে রয়েছে। সাহিত্যরথী বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ‘অন্ধকবির শেষ কয়দিন’ রচনায় লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত স্থির হল কবির চোখে অস্ত্রোপচার করতে হবে।
  • (২) সাহেব ডাক্তার সন্ডার্স এলেন, এলেন ডাক্তার কালীচরণ বাগচী। বললেন, চোখে ছানি পড়েছে। অপারেশন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। দুই চোখের দৃষ্টিই ক্ষীণ। ঠিক হল কবির বাম চোখেই অপারেশন করা হবে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ নভেম্বর ডাক্তার সন্ডার্স, ডাক্তার কালীচরণ বাগচীর সহায়তায় কবি হেমচন্দ্রের বাম চোখে অস্ত্রোপচার করলেন।
  • (৩) কোনো হাসপাতালে না গিয়ে খিদিরপুরে কবির দ্বিতীয় ভাতা পূর্ণচন্দ্রের নতুন বাড়িতেই হেমচন্দ্রের চোখে অপারেশন করা হয়। সাত আট দিনের মাথায় বোঝা গেল, অপারেশন ‘নট সাকসেসফুল,’ বাম চোখটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। ডান চোখেও দেখেন না। কবি অন্ধ হলেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতঙ্কে শিউরে উঠলেন কবি। একই সঙ্গে অসহায় বিষন্ন ও কাতর মর্মভেদী হাহাকার উঠল অন্তঃস্থল থেকে।

অন্ধ কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবেদন

নৈরাশ্যপীড়িত অন্ধ কবি ঈশ্বরকে নিবেদন করে বলেন –

বিভু কি দশা হবে আমার                                          

একটি কুঠারাঘাত

শিরে হানি অকস্মাৎ

ঘুচাইলে ভবের স্বপন।

কবি আশা চূর্ণ করে

রাখিলে অবনী পরে

চিরদিন করিতে ক্রন্দন।।

আমার সম্বল মাত্র

ছিল হস্ত পদ নেত্র।

অন্য ধন ছিল না এ ভবে।

সে নেত্র করে হরণ

হরিলে সর্বস্ব ধন,

ভাসাইয়া দিলে ভবার্ণবে।।

উকিলের কাজে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা

দৃষ্টি ক্ষমতা হারাবার পর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে সরকারী উকিলের কাজে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন হেমচন্দ্র। কবির সম্যক অবস্থা অবগত হয়ে বাংলার সারস্বত সমাজ অকৃপণভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ জীবন

এই মহান কবি জীবনের শেষ পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন এবং তাঁর শেষের দিনগুলো ছিল দুঃখ-কষ্ট-লাঞ্ছিত। নেই নেই করেও স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি যেটুকু ছিল তাতে হেমচন্দ্রের শেষ জীবন দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত হবার কথা নয়। কিন্তু সেই সঞ্চয় তিনি রেখে দিয়েছিলেন আশ্রিতদের ভরণপোষণের জন্য। ফলে গুণগ্রাহী হিতৈষীদের দানের ওপরেই তাঁকে বেঁচে থাকতে হয়েছিল। বলতে গেলে এই সময়ে ভিক্ষাই ছিল তাঁর শেষ সম্বল।

কবি হেমচন্দ্রের সহায়তা

বান্ধব পত্রিকার স্পাদক রায়বাহাদুর কালীপ্রসন্ন ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রায়বাহাদুর হারাণচন্দ্র রক্ষিত, হিতবাদী সম্পাদক কালী প্রসন্ন কাব্যবিশারদ, অনুসন্ধান সম্পাদক দুর্গাদাস লাহিড়ী প্রমুখ মনীষী দুঃস্থ কবির জন্য অর্থ সাহায্যের চেষ্টা করেন। জীবনের শেষ কটা দিন দেশের মানুষের অর্থ সাহায্য নির্ভর করেই বেঁচেছিলেন হেমচন্দ্র।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু

শোকতাপ ও দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে মে খিদিরপুরের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরাধীন ভারতের গণজাগরণের প্রথম কবি।

উপসংহার :- হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, যিনি আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর সাহিত্যকর্মে দেশপ্রেম, মানবিকতা এবং আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা মূর্ত হয়েছে। “চৈতন্য চরিতামৃত” ও “কবিতা কৌমুদী” সহ তাঁর রচনাগুলি শুধু সাহিত্যিক নয়, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করেছে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর অবদান বাঙালি সমাজে চিরস্মরণীয়। একাধারে কবি, লেখক এবং সমাজসংস্কারক হিসেবে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এক অমূল্য উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, যা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

(FAQ) হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কেন বিখ্যাত?

আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা পর্বের অন্যতম কবি হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর রচনায় দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

২. হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান সাহিত্যকর্ম কী?

হেমচন্দ্রের “চৈতন্য চরিতামৃত” এবং “কবিতা কৌমুদী” তাঁর বিখ্যাত রচনা।

৩. হেমচন্দ্রের সাহিত্যিক প্রভাব কীভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কাজে লেগেছিল?

তাঁর কবিতা ও লেখাগুলি দেশপ্রেম জাগানোর পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

৪. হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কোন সমাজ সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন?

হেমচন্দ্র সমাজের শোষিত ও অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সাহিত্যকর্ম ব্যবহার করেছিলেন এবং সমাজে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন।

৫. হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য কেমন ছিল?

তাঁর সাহিত্য গভীর আদর্শ, দেশপ্রেম ও চৈতন্য ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল, যা পাঠককে চিন্তাশীল ও অনুপ্রাণিত করত।

Leave a Comment