ভারতের হেমপ্রভা মজুমদার একজন অক্লান্ত নারী সংগ্রামী যিনি স্বদেশ-স্বাধীনতা ও নারী অধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, জেলে যান এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও শ্রমিক আন্দোলনে সহযোদ্ধা ছিলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমপ্রভা মজুমদার
ঐতিহাসিক চরিত্র | হেমপ্রভা মজুমদার |
জন্ম | ১৮৮৮ খ্রি |
পিতার নাম | গগনচন্দ্র চৌধুরী |
মাতার নাম | দিগম্বরী দেবী |
স্বামীর নাম | বসন্তকুমার মজুমদার |
মূল নিবাস | নোয়াখালী, বর্তমান বাংলাদেশ |
রাজনৈতিক সংযোগ | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক |
প্রথম রাজনৈতিক ভূমিকা | ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ |
আন্দোলন ও সংগ্রাম | অসহযোগ আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন |
কারাবরণ | চাঁদপুর ধর্মঘট ও ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে |
নির্বাচনী সাফল্য | ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন |
মূল অবদান | নারী অধিকার, শ্রমিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম |
মৃত্যু | ৩১ জানুয়ারি ১৯৬২ খ্রি |
হেমপ্রভা মজুমদার
ভূমিকা :- হেমপ্রভা মজুমদার ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ ও সাহসী নারী নেত্রী, যিনি জাতীয়তাবাদ, সমাজসেবা এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৮ সালে নোয়াখালীর এক শিক্ষিত পরিবারে। শৈশব থেকেই সমাজ ও মানুষের প্রতি তাঁর এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল। বিবাহের পর স্বামী বসন্তকুমার মজুমদারের অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।
হেমপ্রভা মজুমদারের জন্ম
১৮৮৮ সালে নোয়াখালিতে জন্মগ্রহণ করেন হেমপ্রভা মজুমদার। পিতা গগনচন্দ্র চৌধুরী, মাতা দিগম্বরী দেবী।
নারী সংগ্রামী হেমপ্রভা মজুমদারের বিবাহ
ত্রিপুরা জেলার কাশীনগর গ্রামের বসন্তকুমার মজুমদারের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বসন্তবাবু ১৮৯৩ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কংগ্রেস সেবক। স্বামীর নিকট থেকেই হেমপ্রভা মজুমদার দেশসেবার প্রেরণা পান।
রাজনীতিতে হেমপ্রভা মজুমদারের অংশগ্রহণ
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন। এর মাধ্যমেই তিনি জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন।
চিররঞ্জনের মৃত্যুর গুজব
১৯২১ সালের ৬ই ডিসেম্বর দেশবন্ধুর পুত্র চিররঞ্জনকে পুলিস গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে তাঁকে এমন প্রহার করে যে, গুজব রটে যায় চিররঞ্জন প্রহারের ফলে মারা গেছেন।
তেজস্বিনী নারী হেমপ্রভা মজুমদার
হেমপ্রভা দেবী সেই রাত্রেই চলে গেলেন আলিপুর জেল গেটে। কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রাহ্য়ই করল না। হেমপ্রভা মজুমদার গর্জন করে উঠে বলতে লাগলেন, চিররঞ্জনের খবর জানবার জন্য জনতা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। যদি তিনি কোনো খবর না নিয়ে ফিরে যান তবে তারা মনে করবে যে চিররঞ্জনের মৃত্যুর খবরই সত্য। তখন তারা দেশে যে আগুন জ্বালাবে তাকে নিভিয়ে দেবার শক্তি জেল কর্তৃপক্ষের নেই। এই হুঙ্কারে জেল কর্তৃপক্ষ নরম হয়ে গেল এবং দেশবন্ধুর ছেলের সঙ্গে তাঁকে দেখা করতে দিল। পুলিসের সঙ্গে, জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা লড়বার মতোই তেজস্বিনী নারী হেমপ্রভা মজুমদার।
অসুস্থ ঊর্মিলা দেবী
১৯২১ সালে উর্মিলা দেবী ‘নারী কর্মমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ সময়কার আন্দোলনে নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে যাবার পর বে-আইনী সভা-সমিতি ও আন্দোলন পরিচালনা করবার ভার এসে পড়ল ‘নারী কর্মমন্দির’ ও তার নেত্রী উর্মিলা দেবীর উপর। কিছুদিন কঠিন পরিশ্রম করার পর ঊর্মিলা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্বে হেমপ্রভা মজুমদার
এরপর পুলিসের অত্যাচার অগ্রাহ্য করে সভা-সমিতি ও আন্দোলন পরিচালনার ভার এসে পড়ে হেমপ্রভা দেবীর উপর। সেই সময় কলেজ স্কোয়ারে একটি বে-আইনী সভা অনুষ্ঠিত করবার সময় পুলিস একটি ছেলেকে বেটন দিয়ে প্রহার করছে দেখে যখন তিনি তাকে রক্ষা করতে যান তখন সার্জেন্টের বেটনের প্রহারে তিনি আহত হন ও তার একটি আঙুল ভেঙে যায়।
ধর্মঘটে সফল হেমপ্রভা মজুমদার
১৯২১ সালে চাঁদপুরে ও গোয়ালন্দে স্টীমার-ধর্মঘট হয়। এই ধর্মঘটের কালে হেমপ্রভা দেবী তাঁর স্বামী বসন্ত মজুমদারের সঙ্গে ধর্মঘটকারীদের এবং আসাম-প্রত্যাগত চা বাগানের কুলীদের অকৃত্রিম সেবা করেন। এই সেবাকাজের জন্যই ছয়মাস পর্যন্ত তিনি গোয়ালন্দে এসে অবস্থান করেন। সেই সময়ে তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবিকা দল গঠন করেন। ধর্মঘট সফল হয়। সেখান থেকে তিনি নারায়ণগঞ্জ গিয়েও স্টীমার-ধর্মঘট করান এবং মেয়েদের সংগঠন করেন।
হেমপ্রভা মজুমদার কর্তৃক মহিলা কর্মী সংসদ প্রতিষ্ঠা
‘নারী কর্মমন্দির’ উঠে যাবার পর ১৯২২ সালে হেমপ্রভা দেবী কলকাতায় ‘মহিলা কর্মী সংসদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে হেমপ্রভা মজুমদার
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি একবছরের জন্য কারারুদ্ধ হন; সঙ্গে তাঁর দুটি মেয়ে শান্তিপ্রভা ধর এবং অরুণা কর-ও কারাবরণ করেন।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধানসভার সদস্য হেমপ্রভা মজুমদার
১৯৩৫ সালে ভারত-শাসন-আইনে নারী ভোটাধিকার পায়। মহিলাদের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত মহিলাগণ ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য হবার অধিকার পেলেন। এই আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালে হেমপ্রভা মজুমদার বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধানসভাতে সদস্য নির্বাচিত হন।
সুভাসচন্দ্রের কংগ্রেসে হেমপ্রভা মজুমদার
বাংলাদেশে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সুভাষচন্দ্র বসু মূল কংগ্রেস থেকে আলাদাভাবে যে কংগ্রেস পরিচালিত করেন, হেমপ্রভা দেবী তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ফরওয়ার্ড-ব্লক দলে হেমপ্রভা মজুমদার
১৯৩৯ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন। তখন হেমপ্রভা দেবী তাতে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে নেতাজীর অন্তর্ধানের পর হেমপ্রভা দেবীর উপর ফরওয়ার্ড-ব্লকের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার ন্যস্ত হয়।
কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান হেমপ্রভা মজুমদার
১৯৪৪ সালে হেমপ্রভা মজুমদার কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান নিযুক্ত হন। শেষ জীবনে তিনি পাকিস্তান-এ অবস্থান করছেন।
হেমপ্রভা মজুমদারের মৃত্যু
তিনি ৩১ জানুয়ারি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার :- হেমপ্রভা মজুমদার ছিলেন এক সাহসিনী, যিনি জাতীয়তাবাদ, সমাজসেবা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল নিষ্ঠা, ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক কর্মীই নন, বরং নারীদের জন্য ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস, যিনি তাঁদের মধ্যে নেতৃত্বের দীপ্তি সঞ্চার করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে আইন অমান্য আন্দোলন, শ্রমিক অধিকার রক্ষা কিংবা নারী জাগরণ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য ও অমলিন। হেমপ্রভার কর্মময় জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় যে সামাজিক পরিবর্তন ও স্বাধীনতা অর্জনের পথ কখনো সহজ নয়, তবে দৃঢ় সংকল্প ও সাহসিকতা থাকলে সেই পথ অবশ্যই সম্ভব। তাঁর স্মৃতি ভারতীয় ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(FAQ) হেমপ্রভা মজুমদার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
হেমপ্রভা মজুমদার ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবী ও রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নারী অধিকার ও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
তিনি ১৮৮৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩১ জানুয়ারি ১৯৬২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
শুরুতে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এ যোগ দেন।
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং সশরীরে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে আইন অমান্য আন্দোলন, বস্ত্র বর্জন ও শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
হ্যাঁ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে তিনি একাধিকবার গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।
হ্যাঁ, ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধানসভায় নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি “অগ্নিকন্যা” নামে পরিচিত ছিলেন, যা তার সাহসী ও দৃঢ়চেতা ভূমিকার ইঙ্গিত বহন করে।
তিনি একজন প্রেরণাদায়ী নারী নেতা হিসেবে স্মরণীয়, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নারীমুক্তি ও সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।