অনর দ্য বালজাক (Honore de Balzac) ছিলেন ১৯শ শতকের একজন প্রখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার। তিনি তার বিস্তৃত সাহিত্যকর্ম “লা কমেদি ইউমেন” (La Comedie Humaine) এর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, যা ফরাসি সমাজের বিভিন্ন স্তরের জীবনধারা চিত্রিত করে। বালজাকের লেখা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ এবং বাস্তবধর্মী চরিত্রায়ণের জন্য বিখ্যাত। তার সাহিত্যিক রচনাগুলো বাস্তববাদী ধারা গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
অনর দ্য বালজাক
ঐতিহাসিক চরিত্র | বালজাক |
সম্পূর্ণ নাম | অনর দ্য বালজাক |
জন্ম | ২০ মে, ১৭৯৯ খ্রি |
জন্মস্থান | ট্যুর, ফ্রান্স |
পেশা | ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক |
প্রখ্যাত কাজ | La Comedie Humaine |
সাহিত্যিক ধারা | বাস্তববাদ (Realism) |
প্রভাবিত সাহিত্যিক আন্দোলন | ফরাসি বাস্তববাদী সাহিত্য |
উল্লেখযোগ্য চরিত্র | ইউজেনি গ্র্যান্ডেট, পেরে গোরিও, রাস্টিগনাক |
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক প্রভাব | চার্লস ডিকেন্স, মার্সেল প্রুস্ত, ফিওদর দস্তয়েভস্কি |
বিবাহিত জীবন | ইভেলিনা হানস্কা (১৮৫০ সালে বিয়ে) |
উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু | সমাজের শ্রেণি, অর্থনৈতিক সংঘাত, মানবিক চেতনা |
ভূমিকা :- বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে বালজাক এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর সৃষ্টির অভিনবত্ব ও বিশালতা তাঁকে এক অনন্য স্রষ্টার গৌরব দান করেছে। গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্ত সমাজজীবনের সার্থক রূপকার রূপে বাস্তববাদী উপন্যাসের পথিকৃতের ভূমিকায় ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর লেখনী। দীর্ঘ কুড়ি বছরের পরিশ্রমে একটা গোটা দেশ ও তার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জীবন্তরূপে চিত্রিত করেছেন তিনি। যে অভিনব উপন্যাসমালা তিনি রচনা করেছেন, তাতে বিধৃত হয়েছে কয়েক হাজার চরিত্র, বর্ণনায় ও সৌন্দর্যে যা অতুলনীয়। উপন্যাসকার বালজাকের জীবন ছিল তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের মতোই বিস্ময়কর।
বালজাকের জন্ম
২০ মে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে বালজাক জন্মগ্রহণ করেন। এমনই দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি যে মায়ের স্নেহ থেকে ছিলেন চিরবঞ্চিত। বড় হয়েছিলেন তিনি ঠাকুরমা আর প্রৌঢ় বাবার স্নেহয়ত্বে। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল অনর বালজাক।
অনর বালজাকের স্কুলজীবন
আট বছর বয়সে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল বালজাককে। কিন্তু জন্ম-ভাবুক প্রকৃতির এই বালকের পড়াশোনায় কোনো আগ্রহ ছিল না। স্কুলের নিয়মবন্ধ জীবন তাঁর কাছে কোনোদিনই সুখকর ঠেকত না। তাই স্কুলের কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিভাবকদের স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এ ছেলের কোনোদিনই পড়াশুনা হবে না। চোদ্দ বছর বয়সেই স্কুলজীবনের ইতি পড়েছিল তাঁর। এরপর কিশোর বালজাককে যে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল সেখানে নিয়মের কড়াকড়ি ততটা ছিল না। তবুও পড়াশুনায় বিশেষ উন্নতি দেখাতে পারেন নি তিনি। তবে দেখা গেল স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভালভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর সাফল্য সকলেরই বিস্ময় উৎপাদন করেছিল।
আইনের ক্লাসে বালজাক
স্কুলের পাট চুকলে বালজাককে ভর্তি করে দেওয়া হল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ক্লাসে। তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল আইন পাশ করে বালজাক আইনজ্ঞ হবেন। তাই পড়াশুনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এক আইনজ্ঞের অফিসে তাঁর কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই একটা বিষয়ে অনুরাগী ছিলেন বালজাক। তা হল সাহিত্য। ফলে আইনের পড়াশুনায় স্বাভাবিকভাবেই কোনো আকর্ষণ বোধ করলেন না তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই আইন পড়া ও শিক্ষানবিসীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন সাহিত্য রচনাই হবে তাঁর জীবনের উপজীব্য।
বালজাককে পিতার পরামর্শ
ছেলের লেখক হবার সঙ্কল্প জানতে পেরে তাঁর বাবা-মা উভয়েই হতাশ হলেন। বালজাকের পিতা ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষিকাজ পরিত্যাগ করে সারাজীবন অর্থ বিত্তের সাধনায় লেগে থেকে জীবনে সফল হয়েছিলেন। তাই অর্থকেই মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করতেন। স্বভাবতঃই পুত্রের লেখক হবার সঙ্কল্পকে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। সাহিত্য রচনা করে যে জীবন চলে না, মনের মত রোজগার করা যায় না, একথা ছেলেকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বালজাক কিছুতেই তাঁর সঙ্কল্প ত্যাগ করলেন না।
পিতার শর্তে সম্মত বালজাক
বাবামায়ের অনুনয়-বিনয়, তিরস্কার-সবকিছুই ব্যর্থ হল। শেষ পর্যন্ত পিতা তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন তাঁর একমাত্র সন্তানকে, এক বছর সে নিয়মিত মাসোহারা পাবে আর এই এক বছরের মধ্যে তাকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু ব্যর্থ হলে আবার আইনের পাঠ নিতে হবে। বাবার শর্তে সম্মত হলেন বালজাক।
সাহিত্যচর্চায় বালজাকের মনোনিবেশ
পিতার দেওয়া সামান্য মাসোহারা সম্বল করে তিনি পাড়ি দিলেন প্যারিসে। ভাড়া নিলেন একটা ছোট্ট ঘর। এখানেই শুরু হল তাঁর সাহিত্য রচনার জীবন। প্রথমে শুরু করলেন কাব্য-নাটক লেখা। দিনরাত লেখার মধ্যে ডুবে থাকেন। এইভাবে কেটে গেল একটি বছর। বাবা চিঠি দিয়ে জানতে চাইলেন, ছেলের সাহিত্যচর্চা কতদূর এগুলো। কাব্য নাটকের একটি অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন বালজাক। তুলে দিলেন বাবার হাতে।
বালজাকের লেখা পাণ্ডুলিপি
গ্রামের এক প্রবীণ লোক একসময়ে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ছেলের পান্ডুলিপিটি তাঁকে দেখিয়ে মতামত জানতে চাইলেন বালজাকের বাবা। তিনি পান্ডুলিপিটি পড়ে মন্তব্য করলেন, লেখা তেমন উৎরায়নি বটে তবে চেষ্টা করলে যে বালজাক ভবিষ্যতে ভাল লিখতে পারবেন, সে প্রমাণ তার লেখায় রয়েছে। প্রাক্তন সম্পাদকের মতামত শুনে সম্ভবতঃ কিছুটা আশান্বিত হলেন বাবা। তিনি জানালেন, আরো তিনমাস মাসোহারা চালাবেন। কিন্তু এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারলে সাহিত্যের মুখ চেয়ে আর কানাকড়িও খরচ করতে তিনি রাজি নন।
উপন্যাস রচনায় বালজাকের মনোনিবেশ
আরও তিনমাস বাড়তি সময় পেয়ে আশাহত বালজাক কিছুটা ভরসা পেলেন। ভাবলেন এই সময়ের মধ্যে, নিশ্চয় ভাল কিছু তিনি লিখতে পারবেন। প্যারিসের সেই ছোট্ট ঘরে ফিরে এসে এবারে আর কাব্য-নাটক নয়, উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন বালজাক। আবার সেই অমানুষিক পরিশ্রম। দিন নেই রাত নেই। খাওয়া-দাওয়ার প্রতিও কোন লক্ষ্য নেই। এক আসনে বসে পাতার পর পাতা লিখে চলেন। লেখার পর নিজেই আবার পড়েন। কিন্তু হতাশ হন, যা লিখতে চাইছেন, তা লিখতে পারেন নি। সমস্ত লেখা বাতিল করে দিয়ে আবার নতুন করে লেখা শুরু করেন।
বালজাককে মাসোহারা বন্ধ
তিনমাস সময় যেন হাওয়ার বেগে উড়ে গেল। বাবা চিঠি দিয়ে জানালেন, মাসোহারার টাকা আর পাঠানো হবে না। সামান্য যে টাকা তিনি মাসে মাসে পেতেন, তাতে প্যারিসের মতো শহরে কায়ক্লেশে দিন কাটাতে হতো তাঁকে। সেই টাকাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখলেন বালজাক। নিজের খরচ চালাবার মতো কোনো সংস্থানই যে তাঁর নেই। কিন্তু ফিরে গিয়ে আইনের ক্লাশে ভর্তি হতেও চরম অনীহা। কী করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না বালজাক।
পুরনো বন্ধুর সাথে বালজাকের সাক্ষাৎ
এই সময়ে আকস্মিক ভাবেই এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার কাছেই বাঁচার পথের সন্ধান পেয়ে গেলেন তিনি। বন্ধুটির ছিল পুস্তক প্রকাশনার একটি ছোটখাট ব্যবসা। হাল্কা ধরনের রোমান্টিক উপন্যাস ছাপতেন তিনি। বালজাককে বুদ্ধি দিলেন, আমাকে উপন্যাস লিখে দাও, তোমার টাকার অভাব ঘুচবে। তবে যা লিখবে তাতে লেখক হিসেবে ছাপা হবে আমার নাম।
অনর বালজাকের প্রথম উপন্যাস রচনা
এরপর বালজাক যেন অকূলে কূল পেলেন। বন্ধুর এই উদ্ভট প্রস্তাবেই রাজি হয়ে গেলেন। এবারে বালজাক ফরমায়েসি চটকদার রোমান্টিক উপন্যাস লিখতে বসে গেলেন। পরিশ্রমে তাঁর ক্লান্তি নেই। টানা কলম চালিয়ে দেড় মাসে শেষ করলেন প্রথম উপন্যাস। যথাসময়ে কিছু টাকাও হাতে এসে গেল। নিশ্চিন্ত হলেন বালজাক। আইনের কচকচি থেকে অব্যাহতি পাওয়া গেল ভেবে খুশিও হলেন।
বালজাকের উপন্যাসে প্রকাশক বন্ধুর নাম
এইভাবে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে পরপর চব্বিশটি উপন্যাস লেখেন বালজাক। এর প্রায় সব কটিতেই লেখক হিসেবে নাম ছিল প্রকাশক বন্ধুর। কয়েকটিতে ছাপা হয়েছিল ছদ্মনাম। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের শিক্ষানবিসী জীবনের লেখা এই উপন্যাসগুলির একটিও পরবর্তীকালে পাওয়া যায় নি। বালজাক নিজেও জানতেন এগুলোর কোনো স্থায়ী মূল্য থাকবে না, তাই কোনো বইই সংরক্ষণের চেষ্টা করেন নি।
লেখক হিসেবে বালজাকের খাতির
যাই হোক, ততদিনে বইপুস্তকের জগতে লেখক হিসেবে বালজাকের কিছুটা খাতির বেড়েছিল। সেই সুবাদে সামান্য অর্থার্জনও হচ্ছিল। যদিও পরিশ্রমের তুলনায় তা ছিল নগণ্য। বালজাকের সমস্ত পরিশ্রমই এভাবে যখন অপচয় হয়ে চলেছে সেই সময়ে দৈবযোগাযোগের মতোই একটা সুযোগ এসে গেল। তাঁর এক বন্ধুর মা দয়াপরবশ হয়ে কিছু টাকা দিতে চাইলেন যাতে নিজের লেখা উপন্যাস তিনি নিজেই ছাপতে পারেন। বালজাক আশান্বিত হয়ে আরো কিছু ধারকর্জ জোগাড় করে শেষ পর্যন্ত একটা ছোট ছাপাখানা কিনে ফেললেন। লেখার সঙ্গে সঙ্গে ছাপা হয়ে চলল বই। শুরু হল প্রকাশন ব্যবসা।
বালজাকের ঋণের বোঝা
কিন্তু ব্যবসায় বৃদ্ধি না থাকলে ব্যবসা চলে কী করে? ফলে যা হবার তাই হল। কিছুদিনের মধ্যেই মোটা দেনার বোঝা কাঁধে চাপল তাঁর। ফলে শুরু হলো পাওনাদারদের তাগাদা। কিন্তু লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়েছেন বালজাক। একবার স্বীকৃতি পেয়ে গেলে আর অর্থের অভাব থাকবে না। তাই ঋণের বোঝাকে তিনি গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না। দূরত্ব আত্মবিশ্বাস নিয়ে ডুবে থাকলেন লেখার মধ্যে। প্রেস ও ব্যবসা দেখাশোনা করতে লাগল অন্য লোক।
অনর দ্য বালজাকের প্রণয়
মাদাম বার্নি নামে এক বিধবা ছিলেন বালজাকের প্রতিবেশী। নটি সন্তানের জননী তিনি। তাঁর বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতেন বালজাক। মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত তাঁর স্নেহবুভুক্ষু মন মাদাম বার্নির কাছ থেকেই প্রথম লাভ করেছিল ভালবাসার স্বাদ। উদ্বেল হয়ে উঠলেন বালজাক। প্রিয়তমা প্রেয়সীরূপে তিনি পেতে চাইলেন মাদাম বার্নিকে। এই অবৈধ ভালবাসা স্বীকার করতে পারলেন না মাদাম। তিনি তাঁকে অনেক বোঝালেন। নীতি ও সমাজের প্রশ্ন তুলে নিরস্ত করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বালজাকের ভালবাসা হয়ে উঠেছিল দুর্নিবার। তাঁর ব্যথাভরা তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে মাদামের ভালাবাসা ছিল এক খন্ড মরূদ্যানের মতো নির্ভরতার স্থল। তাই মাদামের সব প্রতিরোধই ভেসে গেল, বালজাকের ভালবাসার বন্ধনে তাঁকে শেষ পর্যন্ত ধরা দিতে হল। কথাশিল্পী বালজাকের জীবনে মাদাম বার্নির ভালবাসা হয়ে উঠেছিল মহৎ প্রেরণার উৎস। তিনি তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছেন প্রতিনিয়ত, অনুপ্রাণিত করেছেন। আগ্রহের সঙ্গে তাঁর পান্ডুলিপি পড়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর জীবনে মাদামের প্রভাব ও ঋণের কথা পরবর্তী জীবনে বালজাক কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন।
পাওনাদারের তাড়নায় বালজাক
একদিকে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা, অন্যদিকে ব্যবসায়ের ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপ ও পাওনাদারের তাগিদ এই পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন বালজাক। এমন অনেকদিন হয়েছে পাওনাদারের ভয়ে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ছাপাখানা বিক্রি করে দিয়ে কিছু ধার দেনা মেটাতে হল। ব্যবসা করে যে ভাগ্য ফেরানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না বহু অর্থ, সময় ও সম্মানের মূল্যে শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারলেন বালজাক। তাঁকে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সাহিত্য সাধনার পথেই তা পেতে হবে।
বালজাকের নামে আদালতে নালিশ
কিন্তু ব্যবসার বিড়ম্বনা তখনো অবশিষ্ট ছিল। পাওনাদারের উৎপাতে নিরুপদ্রবে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হল না বালজাকের। তাঁর নামে আদালতে নালিশ হল এবং যথারীতি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হল। বেশি দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই নিরুপায় বালজাককে শেষ পর্যন্ত শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ব্রিটানিতে পালিয়ে যেতে হল। তাঁর নামে তখন সাত-সাতটা পরোয়ানা। সেখানেও থাকতে হচ্ছিল আড়ালে আবডালে গা-ঢেকে, যাতে কেউ তাঁকে চিনতে না পারে।
সুহৃদ বন্ধুর আশ্রয়ে বালজাক
ভাগ্যক্রমে এই সময় দেখা হয়ে গেল এক বন্ধুর সঙ্গে। নিজের বিপদের সব কথা বন্ধুকে জানালেন তিনি। সদয় হলেন বন্ধুটি। তাঁর বাড়িতেই দোতলার একটি ঘরে আসায় পেলেন বালজাক। বন্ধু জানালেন, এখানে তোমার কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে নিজের সাধনায় ডুব দাও। সাহিত্যের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর। বালজাকের জীবনে এই বন্ধুর সাহায্য, পরামর্শ ও উৎসাহের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো এই ছত্রছায়া লাভ না করলে বালজাকের জীবনে বিপর্যয় ছিল অনিবার্য। বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে বিভ্রান্ত জীবনে সুস্থির হয়ে সাহিত্য রচনা তাঁর পক্ষে কোনোদিনই হয়তো সম্ভব হত না।
প্রতিষ্ঠালাভের উদ্দেশ্যে বালজাকের লেখা
প্রবল উৎসাহে এবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে লিখতে বসলেন বালজাক। সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁকে তাঁর আসনটি নির্দিষ্ট করে নিতেই হবে। কঠিন বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত বালজাক ততদিনে লাভ করেছেন জীবন সম্পর্কে পরিপূর্ণ দৃষ্টি। অভিজ্ঞতায় পুষ্ট, সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর চিন্তা-ভাবনা, জীবনবোধ। তাই এবারে প্রতিষ্ঠালাভের উদ্দেশ্যে যে লেখা তিনি লিখতে শুরু করলেন তা ছিল জীবন-রসে সম্পৃক্ত। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা, জীবন সম্পর্কে পরিণত বোধ আর অক্লান্ত অমানুষিক পরিশ্রম – এই ত্রিধারার সম্মিলিত পরিণতি ছিল বালজাকের এই পর্যয়ের সাহিত্যজীবন।
বালজাকের ক্লান্তিহীন পরিশ্রম
এখানে তিনি প্রতিদিন রাত আটটায় ঘুমোতে যেতেন। রাত বারোটায় তাঁকে জাগিয়ে দেওয়া হত। সেই সময় থেকে ভোর না হওয়া পর্যন্ত অবিশ্রান্ত লিখে যেতেন তিনি। সকালে কিছু সময় ঘুমিয়ে নিয়ে আবার বসে যেতেন লিখতে। সমস্ত দিনে আর লেখা ছেড়ে উঠতেন না।
অনর বালজাকের প্রথম উপন্যাস The lost of the Chouaris
এইভাবে ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের শেষে তিনি শেষ করলেন তাঁর হিউমেন কমেডি সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘The lost of the Chouaris’। ফরাসি বিপ্লব-এর সমসাময়িক ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত বালজাকের এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে। বস্তুতঃ স্যার ওয়াল্টার স্কটকে অনুসরণ করে লেখা হলেও এই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ছিল তার মৌলিকত্ব, বর্ণনা ও সৌন্দর্য। এই গ্রন্থেই বালজাক সর্বপ্রথম নিজের নাম অনর বালজাক ব্যবহার করলেন।
বালজাকের উল্লেখযোগ্য রচনা
ওই বছরে প্রকাশিত হল তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘The Physiology of marnage’। এই উপন্যাসে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন নারীপুরুষের বিবাহ ও তাদের সম্পর্কের বিষয়। এরপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর উপন্যাস ও বড় গল্প। ‘The wild ass’s skin’, ‘A passion in the desert’ প্রকাশিত হয় ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে। পরের বছরেই প্রকাশিত হয় ‘The unknown Masterpiece’। উল্লেখযোগ্য যে ‘A passion in the desert’ গল্পটি বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দশটি গল্পের মধ্যে অন্যতম বলে স্বীকৃত।
নিজের নামের আগে দ্য কথাটি ব্যবহার
ইতিমধ্যে বালজাক তাঁর নামের আগে দ্য কথাটি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। ফ্রান্সের অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের নামের আগে মর্যাদাসূচক দ্য কথাটি যুক্ত করতেন। বালজাকও তাই নিজের কৌলিন্য বোঝাবার জনা লিখতেন অনর দ্য বালজাক।
বালজাকের আভিজাত্য প্রকাশের মনোভাব
তাঁর প্রকাশিত গল্প-উপন্যাস ততদিনে তাঁকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। খ্যাতির সঙ্গে প্রত্যাশিত অর্থার্জনও হতে লাগল। কিন্তু সেই অর্থ রক্ষা করবার কোনো দায় বোধ করতেন না বালজাক। বিলাস-ব্যসনে উড়িয়ে দিতেন। এসবের পেছনে কাজ করত তাঁর আভিজাত্য প্রকাশের মনোভাব।
মানুষ হিসেবে বালজাক
নিজের লেখা নিয়ে যতক্ষণ মগ্ন থাকতেন তিনি, ততক্ষণ থাকতেন এক মানুষ। লেখা ছাড়া তখন অন্য কিছু তাঁর মাথায় থাকত না। কোনো লেখা মনোমতো না হওয়া পর্যন্ত তিনি তা মাজাঘষা করে যেতেন। এই নিয়ে এমনই ব্যস্ত থাকতেন যে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও খেয়াল থাকত না। লেখার ঘরে একজন বন্দীর মতো জীবনযাপন করতেন। কিন্তু লেখা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই তিনি হয়ে যেতেন অন্য মানুষ। বিলাস আর আমোদপ্রমোদে গা ভাসিয়ে দিতেন। বন্ধুবান্ধবদের ডেকে ভোজ খাওয়াতেন।
বালজাকের ধার-কর্জের জীবন
এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবন বজায় রাখতে গিয়ে লিখে তিনি যা রোজগার করতেন, তার চেয়ে অনেক বেশিই খরচ হয়ে যেত। ফলে বাধ্য হয়ে ধার করতে হত। আর ধার-কর্জের ব্যাপারেও বালজাক ছিলেন শাহেন শা। একজনের ধার শোধ করার জন্য অন্য একজনের কাছে ধার করতেন। ফলে পাওনাদারের ভয়ে সর্বক্ষণ তাঁকে থাকতে হত তটস্থ। অনেক সময় লুকিয়ে পর্যন্ত থাকতে হত। পাওনাদারের বিড়ম্বনা এড়াতে মিথ্যা ছলনার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করতেন না তিনি। একবার তো কিছুদিনের জন্য হাজত বাসও করতে হয়েছিল। অথচ তাঁর সমসাময়িক সমস্ত লেখকের মধ্যে তাঁর আয় ছিল সবচেয়ে বেশি।
অনর বালজাকের লেখার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি
যত দিন যাচ্ছিল, ততই বালজাকের লেখার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নিজের চিন্তাভাবনা ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আরও মুন্সীয়ানার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারছিলেন। চরিত্র চিত্রণে, বর্ণনায়, সজীবতায় ও সৌন্দর্যে প্রতিটি রচনাই হয়ে উঠছিল অনবদ্য। বালজাকের ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্নমুখী অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও বিশাল। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই বিচ্ছুরিত হত তাঁর রচনা।
বালজাকের অভিনব পরিকল্পনা
এই সময় এক অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। প্যারিসের সমস্ত শ্রেণীর মানুষের জীবন, তাদের বিভিন্নমুখী সমস্যা, অনুভব উপলব্ধি, যা তিনি নিজে প্রত্যক্ষা করেছেন, তাকে উপজীব্য করে ধারাবাহিক উপন্যাসমালা রচনার কাজে হাত দিলেন। ইতালির মহাকবি দান্তের ডিভাইন কমেডি নামের অনুকরণে তাঁর উপন্যাসের সিরিজের নামকরণও স্থির করলেন-হিউম্যান কমেডি। এই সিরিজে ১৩৮ খানি উপন্যাসের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ কুড়ি বছরের চেষ্টায় ১৩০টির মতো উপন্যাস সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। আর এই বিশাল সৃষ্টির অন্ততঃ অর্ধেক উপন্যাস উৎকর্ষতার বিচারে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পাবার যোগ্য।
অনর বালজাকের বিস্ময়কর প্রতিভা
বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন বালজাক। সাহিত্যের আসরে আমৃত্যু তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্বের আসন অপরিবর্তিত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্য প্রতিভার এই উত্তরণের পশ্চাৎপটে অবশ্যই ছিল কঠোর নিষ্ঠা, শ্রম ও সাধনা।
বালজাকের লেখায় বিভিন্ন চরিত্র
হিউম্যান কমেডি উপন্যাসমালার মধ্যে কয়েক হাজার চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। তাঁর যাদুকরী লেখনীর স্পর্শে প্রতিটি চরিত্রই হয়ে উঠেছে জীবন্ত। বালজাক নিজের জীবনে চলার পথে, বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব চরিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন তাদেরই প্রতিচ্ছায়া তিনি অঙ্কন করেছেন তাঁর সাহিত্যে। তবে সমাজের আলোকিত অংশের তুলনায় অন্ধকারের মানুষেরাই তাঁর সাহিতে। বেশি স্থান পেয়েছে। তাদের প্রতি তাঁর মমত্ব কোথাও প্রচ্ছন্ন থাকেনি। গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তব চিত্ররূপ উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে। কিন্তু বালজাকের লেখকসত্তা ছিল সত্য ও সুন্দরের পূজারী। তাই অন্যায়কে কোথাও সমর্থন করেননি। সত্য আর ন্যায়ের সৌন্দর্যে মন্ডিত হয়েছে তাঁর হিউম্যান কমেডি। বালজাক সম্পর্কে জার্মানির লেখক স্টিফেন দুইগ যথার্থই বলেছেন, মনুষ্য চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিধাতার পরেই যে নামটি করতে হয় তা হল, অনর দ্য বালজাক।
অনর বালজাকের সৃষ্টির বিশালত্ব
বস্তুতঃ বালজাকের সৃষ্টির বিশালত্বের এর চেয়ে বড় ও যথার্থ স্বীকৃতি আর কিছু হতে পারে না। হিউম্যান কমেডির জনপ্রিয়তা বালজাককে সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা এনে দিল। তিনি পেলেন যশ ও অর্থ। মাদাম বার্নির মৃত্যু বালজাককে উতলা করে তুলেছিল। তাঁর স্নেহ-বুভুক্ষু হৃদয়কে স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর শূন্যতা পূরণ করবার জন্য একজন সঙ্গিনীর প্রয়োজন বোধ করতে লাগলেন তিনি।
বালজাকের রচনার পাঠিকা
- (১) পাঠকদের কাছ থেকে প্রতিদিনই কিছু চিঠি পেতেন বালজাক। প্রধানতঃ মেয়েরাই বেশি চিঠি লিখত। একদিন একটি চিঠির ভাষার গভীরতা আকর্ষণ করল বালজাককে। গতানুগতিক স্তুতি বা প্রশংসার বাইরেও লেখিকার নিজস্ব কিছু বক্তব্য ছিল তাঁর সাহিত্যে সৃষ্ট নায়িকা চরিত্র সম্পর্কে। কিন্তু চিঠিতে কোনো নাম ঠিকানা ছিল না তাই তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন, অপরিচিত এই পাঠিকার কাছ থেকে আবার যদি কোনো চিঠি আসে। এলও একদিন।
- (২) পত্র লেখিকা বালজাকের সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করে নিজের পরিচয়ও জানালেন। তাঁর নাম ইভলিনা হানস্কা। পোল্যান্ড-এর এক কাউন্টের স্ত্রী। স্বামী অসুস্থ বলে নিঃসঙ্গ। তাই সঙ্গী করে নিয়েছেন দেশ-বিদেশের লেখকদের ভাল ভাল বই। সেই সূত্রেই বালজাককে তাঁর পত্র লেখা। টানা এক বছর চলল তাঁদের পত্র (বালজাকের প্রেমপত্র) বিনিময়। চিঠিতেই পরস্পরের প্রতি গড়ে উঠল প্রেম। তারপর একদিন দেখা হল দুজনে।
- (৩) কিন্তু স্বপ্নের লেখকের চেহারা দেখে হতাশ হলেন সুন্দরী হানস্কা। কিন্তু তাঁর আবেগ হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তাই বালজাককে ত্যাগ করতে পারলেন না। হানস্কার স্বামী রয়েছেন। তবুও বালজাক চাইলেন তাঁকে বিয়ে করতে। বুদ্ধিমতি হানস্কা সম্মত হতে পারলেন না। তাহলে স্বামীর বিত্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে হবে তাঁকে। বালজাক বুঝতে পারলেন তাঁকে অনেক অর্থ উপার্জন করতে হবে। হানস্কাকে পেতে হলে। লেখা থেকে আর্থিক চাহিদা মিটবার নয়।
- (৪) রাতারাতি অর্থবান হবার আশায় বালজাক সার্বিয়ার রুপোর খনিতে রুপো তোলার কাজ শুরু করলেন। কিন্তু তাতে পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া গেল না। অধিকন্তু কঠোর পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ল। তবুও তিনি হানস্কাকে পাবার আশা ত্যাগ করতে পারেন না। এভাবে কেটে গেল দশ বছর। একদিন শুনলেন হানস্কার স্বামী মারা গিয়েছেন শুনে আশান্বিত হয়ে উঠলেন বালজাক। ভাবলেন এবারে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হবে।
- (৫) কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে হানস্কা কোনো আগ্রহ দেখালেন না। কিন্তু স্ত্রীর মতোই বাস করতে লাগলেন বালজাকের সঙ্গে। দুজনে মিলে দেশভ্রমণেও যান। কিন্তু গভীর মনোবেদনায় জর্জরিত হন বালজাক। এত কিছুর পরেও হানস্কাকে স্ত্রী হিসেবে পেলেন না।
অসুস্থ বালজাক
শৃঙ্খলাহীন জীবনের অপচয় বালজাকের শরীর ও মনকে ক্রমশই পঙ্গু করে তুলতে লাগল। তিনি বুঝতে পারছিলেন জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে হানস্কার এক জন্মদিনে তার বাড়িতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন বালজাক। মাস কয়েক বিছানায় পড়ে থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু দেহের শক্তি ফিরে পেলেন না আগের মতো।
বালজাকের বিবাহ
দীর্ঘ ১৮ বছরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে হানস্কা বালজাকের বেদনা অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবনের মেয়াদ যে ফুরিয়ে এসেছে তাও জানতেন। কিন্তু স্বামীর বিশাল সম্পত্তির অধিকার ত্যাগ করতেও পারছিলেন না তিনি। তবুও শেষপর্যন্ত বালজাককে বিবাহ করতে রাজি হলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তও স্বার্থমুক্ত ছিল না। অবশিষ্ট জীবন ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের স্ত্রী হিসাবে মর্যাদা লাভ করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ১৪ মার্চ বালজাককে বিয়ে করলেন হানস্কা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে উৎফুল্ল উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন বালজাক। হনিমুন সেরে এসে সস্ত্রীক বাস করবেন বলে স্ত্রীর জন্য প্রাসাদের মতো বাড়ি মির্মাণ করলেন তিনি।
অনর বালজাকের মৃত্যু
কিন্তু গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হনিমুন অসমাপ্ত রেখেই নতুন বাড়িতে ফিরে আসতে হল বালজাককে। শয্যা নিলেন। সেই ছিল তাঁর শেষ শয্যা। অনেক আশাই অপূর্ণ থেকে গেল তাঁর। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই আগস্ট জীবনের অন্তিম মুহূর্তে স্নেহময়ী জননীর কথা চিন্তা করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বালজাক।
উপসংহার :- অনর দ্য বালজাক ছিলেন ১৯শ শতকের ফরাসি সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি বাস্তববাদী ধারার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার বিশাল রচনা সংকলন “লা কমেদি ইউমেন” ফরাসি সমাজের জীবনযাত্রার জটিলতা এবং মানব প্রকৃতির গভীর অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরেছে। তিনি তার লেখায় সামাজিক শ্রেণী, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সংঘাতের যে চিত্রায়ণ করেছেন, তা আজও পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বালজাকের সাহিত্যকর্ম সময়ের সীমা ছাড়িয়ে মানুষের অভিজ্ঞতার সার্বজনীনতা তুলে ধরে, যা তাকে আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
(FAQ) অনর দ্য বালজাক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
অনর দ্য বালজাক (Honore de Balzac) ছিলেন ১৯শ শতকের একজন প্রখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার।
বালজাকের প্রধান সাহিত্যকর্ম হলো “লা কমেদি ইউমেন” (La Comedie Humaine), যা ফরাসি সমাজের বিভিন্ন স্তরের জীবন এবং সম্পর্ককে চিত্রিত করে একটি বিশাল উপন্যাসিক সিরিজ।
বালজাক বাস্তববাদী সাহিত্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার লেখা বাস্তব জীবনের সমস্যা, সম্পর্ক এবং সমাজের নানা দিককে গভীরভাবে উপস্থাপন করেছে।
তার অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস হলো “পেরে গোরিও” (Pere Goriot), যা ফরাসি সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
বালজাকের লেখা ফরাসি সমাজের শ্রেণীভেদ, অর্থনৈতিক সংঘাত এবং সামাজিক অগ্রগতি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছে, যা সমাজকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করতে সাহায্য করেছে।
বালজাকের সাহিত্যিক কাজ চার্লস ডিকেন্স, মার্সেল প্রুস্ত, ফিওদর দস্তয়েভস্কির মতো বিখ্যাত লেখকদের প্রভাবিত করেছে।