এবার নতুন বছরে নিজের পরিবর্তন হবে যেভাবে
আরও একটি বছর চলে গেল জীবন থেকে। পরিবর্তনের জন্য যে কোনো সময়ে কাজ শুরু করা যায়। কিন্তু নতুন বছরে নতুন কিছু শুরু করার ব্যাপারটাই আলাদা। আর তা যদি হয় আত্মোন্নয়নের জন্য অনুশীলন, তাহলে তো কথাই নেই। নিজের পরিবর্তনের জন্য বছরের প্রথম থেকেই চর্চা করা উচিত এমন কিছু অনুশীলন নিয়েই আজকের এই প্রবন্ধ।
অবস্থার পরিবর্তন আমরা সবাই চাই
নিজের অবস্থার পরিবর্তন (ইতিবাচক অর্থে) আমরা সবাই চাই। কিন্তু প্রথম দিনেই একসঙ্গে অনেক কাজ শুরু করি বলে শেষ পর্যন্ত আমরা ধরে রাখতে পারি না। পরিবর্তনের জন্য চাই তাই সঠিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনাতে ভুল থাকে বলেই আমরা শেষ পর্যন্ত রুটিনে স্থির থাকতে পারি না। সাধারণত, প্রথম যে ভুলটি আমরা করি তা হলো, একসঙ্গে অনেক কাজের পরিকল্পনা করি। দ্বিতীয় ভুল হলো, এক মুহূর্তেই আমরা সবকিছু পরিবর্তন করতে চাই। ফল পেতে চাইলে এই দুই ভুল করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একসঙ্গে অনেক কাজ করতে চাইলেই কি আমরা তা করতে পারি? পারি না। কারণ আমাদের শরীর অভ্যস্ত নয়। আমাদের শরীরে এই কাজগুলো করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি পাই না। ফলে কয়েকদিন চেষ্টা করালেও শরীর হাল ছেড়ে দেয়। পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দ্বিতীয় ভুল থেকে বাঁচতে চাইলে করণীয় কাজগুলোর ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য, পরে এক মাসের জন্য, এরপর তিন মাসের জন্য, এভাবে ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে।
সুস্থ দেহ সুস্থ মন
কর্ম ছাড়া সফলতা অর্জন করা যায় না। যে যত পরিশ্রম করতে পারে, সে তত সফল। কিন্তু পরিশ্রমের জন্য চাই শক্তি। সে শক্তি শারীরিক শক্তি, সে শক্তি মানসিক শক্তি। শারীরিক পরিশ্রমের সময় যেমন মানসিক একাগ্রতা প্রয়োজন হয়, তেমন মানসিক পরিশ্রমের সময়ও শারীরিক সুস্থতার প্রয়োজন হয়। তাই নিজের পরিবর্তনের জন্য প্রথমেই নিজের শারীরিক ও মানসিক শক্তির স্তরের উত্তরণ ঘটাতে হবে। প্রথম তিন মাস কয়েকটি ছোট অনুশীলন করলেই তা সম্ভব।
নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও জেগে ওঠা
শরীর একটি জৈবিক ঘড়ি অনুযায়ী নিজেকে অভ্যস্ত করে। কিন্ত ঘুমের সময়ের সময় নির্দিষ্ট না থাকলে শরীর কোনো একটি নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত হতে পারে না। ফলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম হয় না। সারাদিন দেহ ক্লান্ত থাকে। কাজে মন বসে না। এই সমস্যা সমাধানে ঘড়ি ধরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে। এর ফলে নির্দিষ্ট সময় এলেই শরীর দ্রুত বিশ্রামের প্রক্রিয়া শুরু করবে নিজে নিজেই। ফলে ঘুমের কারণে যে বিশ্রাম ও ক্ষয়পূরণ হয় তা সম্ভব হবে পরিপূর্ণভাবে।
জল পান
পানি বা জল রক্তে মিশে আমাদের দেহে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে এবং দেহের দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। জল পানের পরিমাণ কমে গেলে দেহ ক্লান্ত হয়। প্রথম তিন মাস প্রতিদিন দুপুর ২টার আগেই দুই লিটার জল পান করার অভ্যাস করুন।
শরীরচর্চা
সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা জল পান করে শরীর চর্চা করলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। শরীরের অলসতা কাটে। এই তিন মাসে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ মিনিট শরীরচর্চা করার অভ্যাস করুন। কোনোদিন যদি কোনো একটি বা তিনটিই যদি না করতে পারেন তবে কুণ্ঠিত হওয়ার দরকার নেই, পরদিন থেকে আবার শুরু করুন।
সক্রিয় কর্মঘণ্টা
নিরবচ্ছিন্ন কাজ করতে থাকলে দেহ তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যায়। ফলাফল আশানুরূপ হয় না। বলা হয় বিশ্রাম ও কাজ একসঙ্গে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা। বিশ্রামকে আমরা কাজ থেকে আলাদা করে দেখি। সেজন্য কর্মঘণ্টায় বিশ্রাম অন্তর্ভুক্ত থাকে না। সেজন্য এই কর্মঘণ্টা সাধারণ কর্মঘণ্টা। কিন্তু সক্রিয় কর্মঘণ্টায় বিশ্রাম অন্তর্ভুক্ত থাকে। ৪৫ মিনিট কাজ আর ১৫ মিনিট বিশ্রাম মিলে তৈরি হয় একটি সক্রিয় কর্মঘণ্টা। নিজের রুটিনে দিনে কমপক্ষে এমন পাঁচটি সক্রিয় কর্মঘণ্টা রাখুন। গভীর চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি বা দুটি কর্মঘণ্টা ব্যয় করুন, বাকিগুলো কাজ সম্পাদনার জন্য রাখুন। এভাবে কাজ করলে শরীর সহসা ক্লান্ত হবে না। কাজে মনোযোগও বাড়বে।
অভ্যাসের বদল
দীর্ঘ সময় ডিভাইসের আসক্তির কারণে আমাদের কী ক্ষতি হচ্ছে তা জানা সত্ত্বেও অনেকেই আমরা এই বদঅভ্যাসগুলো ছাড়তে পারি না। তাই এ অভ্যাসগুলো যদি ভালো অভ্যাসের দিয়ে বদলে ফেলি তাহলে খুব সহজেই এগুলো থেকে মুক্তি পাব আবার ভালো অভ্যাসটি আয়ত্তে চলে আসবে। যেমন, স্মার্টফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং করার অভ্যাসকে আমরা সহজেই বইপড়া দিয়ে বদলে ফেলতে পারি। প্রতি রাতে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করাকে খুব সহজেই বদলে ফেলতে পারি বইয়ের পডকাস্ট শোনা দিয়ে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে
অধিকাংশ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আগাপাশতলা ভাবি না। এই চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেই মূল কাজ থেকে সরে গিয়ে অন্য কাজে মনোযোগী হয়ে পড়ি। কিন্তু দেখা যায়, তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব আমাদের জীবনে পড়ে না। শুধু সময় নষ্ট হয়। এ ধরনের কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে প্রতিটি কাজের আগে ১০-১০-১০ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এক, কাজটি করলে ১০ মিনিটে আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? দুই, কাজটি করলে ১০ দিনে আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? তিন, কাজটি করলে ১০ মাসে আমার জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? প্রশ্নের উত্তর অনুযায়ী ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন কাজটি এখনই করা দরকার কি না বা কাজটি আদৌ করা দরকার কি না।
লক্ষ্যকে ছোট ভাগে ভাগ করুন
পরবর্তী ৯০ দিনে অর্জন করতে চান এমন একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। ১০ দিনের এই সময় তিনটি ভাগে ভাগ করুন এবং লক্ষ্যও তিনটি ভাগে ভাগ করুন। ৩০ দিন পরে যাচাই করুন কতটুকু লক্ষ্য অর্জিত হলো। যদি নির্ধারিত লক্ষ্যের থেকে কম হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে তা অর্জনে চেষ্টা করুন। এই লক্ষ্য হতে পারে, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, মনোযোগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি, যোগাযোগ বৃদ্ধি প্রভৃতি। লক্ষ্যকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নির্দিষ্ট সময় পর পর পর্যালোচনা করলে তা চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়।
পর্যালোচনা
প্রতি মাস শেষে কমপক্ষে ৩০ মিনিট একটি পর্যালোচনার সময় রাখতে হবে। নিজেকে এই সময়ে প্রশ্ন করতে হবে, এই মাসে এমন কী শিখলাম? এই মাসে সবচেয়ে বেশি উন্নতি কোথায় হয়েছে? কোন কাজটি ভিন্নভাবে করতে পারতাম? কোন বিষয়কে পরবর্তী মাসে আমি বেশি গুরুত্ব দেব? এই পর্যালোচনা পরবর্তী মাসে লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।