সঙ্কটের কল্পনাতে

সঙ্কটের কল্পনাতে

সন্তানের জীবনে সমস্যা আসার আগেই সব ঠিক করে দেন অনেক মা-বাবা। এই স্নোপ্লো পেরেন্টিং-এ সন্তানের ভবিষ্যৎই প্রশ্নের মুখে পড়ছে না তো? বাচ্চার ব্যাগ বইছেন, জিনিসপত্র হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছেন, চারবেলা নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন… ঘরে-বাইরে এ হেন অভিভাবকের সংখ্যা কম নয়। আসলে সন্তান বড় আদরের ধন। সমস্যা বা কষ্ট তাদের জীবনে আসুক, তা কোনও মা-বাবাই চান না। সন্তানের প্রতি সেই অতিরিক্ত চিন্তা থেকেই জন্ম হয় স্নোপ্লো পেরেন্টিংয়ের। বাচ্চার চলার পথ মসৃণ করতে তখন জীবনের খুঁটিনাটি সব কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অভিভাবকরা। সন্তানকে কষ্ট করতে হতে পারে, সেই আশঙ্কায় প্রতি মুহূর্তে তাকে আগলে রাখেন।

শুরুর কথা

এর শুরুটা কিন্তু একদম ছোট বয়সেই হয়। স্কুল বা খেলার মাঠে বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুবান্ধবের ঝগড়া মেটাতে এগিয়ে যান অনেক মা-বাবা। বাচ্চা যাতে বকুনি না খায়, তাই হোম ওয়ার্ক করে দেন নিজেরাই। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, “ক্রমশ সব সমস্যায় মা-বাবা ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলে, এক সময়ে সন্তান তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। ফলে প্রাপ্তবয়সে কর্মক্ষেত্রে হোক বা ব্যক্তিগত জীবনে, পদে পদে তাকে হোঁচট খেতে হয়।”

ফলস্বরূপ

আত্মবিশ্বাসের অভাব

জীবনে চলার পথে চড়াই-উৎরাই পেরোতেই হয়। কিন্তু এ ধরনের অভিভাবকত্বে বাচ্চার মধ্যে সে সবের মুখোমুখি হওয়ার আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না।

আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব

কোনও রকম মানিয়ে নেওয়া বা মেনে নেওয়া, পরিশ্রম ছাড়াই সব পেয়ে যাওয়ায় বাচ্চা ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। শত প্রয়োজন, সমস্যায় মা-বাবাও কিন্তু তখন সন্তানের সাহায্য পান না। পায়েল বলছেন, “এতে ভবিষ্যতে বিবাহিত জীবনেও সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক সময়েই জীবনসঙ্গীর প্রতি তাদের অত্যধিক আত্মকেন্দ্রিক আচরণ অশান্তি বয়ে আনে।”

স্বাবলম্বী না হওয়া

অনেক ছেলেমেয়েই বাড়িতে এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খায় না, সংসারের দায়িত্ব নেওয়া তো দূরস্থান। এদের যখন নিজের সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়, তখন তারা আর তা সামলাতে পারে না। পায়েল বলছেন, “এ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা প্রায়শই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে অনেকেই হয়তো নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। আবার অনেককেই সারা জীবন এর ফল ভুগতে হয়। কিন্তু বাবা-মায়ের প্রতি অভিযোগ থেকেই যায়।”

একা ও একাকিত্ব

সবেতেই মা-বাবার প্রশ্রয় পাওয়ায় বাচ্চা এক সময়ে অতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বাইরের দুনিয়া থেকে সেই প্রশ্রয় না পেলে বাচ্চা তখন গুটিয়ে আসে। এর ফলে এক সময়ে সে একা হয়ে যায়। একাকিত্ব মেটাতে তখন অনলাইন গেমস, ভার্চুয়াল দুনিয়ার মিথ্যা প্রশংসার জালে জড়িয়ে পড়তে থাকে।

সমস্যা হয় বাবা-মায়েদেরও

প্রতিটি সন্তানকে জড়িয়ে বাঁচতে চান সব মা-বাবাই। কিন্তু এ ধরনের পেরেন্টিংয়ে অভিভাবকেরা বুঝে উঠতে পারেন না সন্তানকে ঠিক কখন ছাড়তে হবে। ফলে এক সময়ে ছেলেমেয়ের জীবনসঙ্গী নির্বাচন, তার সংসার, সন্তান পালন প্রতিটি ব্যক্তিগত বিষয়ে তাঁরা নাক গলাতে থাকেন। এমনকি স্বাবলম্বী সন্তানের আর্থিক বিষয়েও হস্তক্ষেপ করে থাকেন। ফলে অনেক সময়েই সন্তানকে সাংসারিক অশান্তির সম্মুখীন হতে হয়। কখনও আবার সন্তানের জীবনে গুরুত্ব হারাচ্ছেন (বিশেষত সন্তানের বিয়ের পরে) ভেবে মানসিক সমস্যায় ভোগেন মা-বাবারা।

সমাধানের পথ

সন্তানকে আদরযত্নে রাখাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তাকে জীবনে চলার পথের উপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্বও বাবা-মায়ের। তার জন্য খানিকটা কঠোর হতেই হবে। পায়েল ঘোষ বলছেন, “শিশু সমস্যায় পড়লে বাবা-মা তাকে দিশা দেখাবেন বা আগাম বিপদ সম্পর্কে যেমন সচেতন করবেন, তেমনই প্রতি পদে তার উপরে অতিরিক্ত নজরদারি করাও ঠিক নয়।”

  • (১) সন্তানের বয়স তিন পেরোলেই সাংসারিক কাজে সন্তানকে জুড়ে নিন। ছোটখাটো কাজের দায়িত্ব দিন। এতে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে।
  • (২) একই সঙ্গে তাকে নিজের কাজ নিজে করতে শেখান। বাচ্চা স্কুলের রুটিন অনুযায়ী বইখাতা গোছাতে শিখুক, নিজের পড়া নিজেই করুক। পড়ায় কিছু বুঝতে না পারলে বা আটকালে মা-বাবা সাহায্য করতে পারেন।
  • (৩) বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া মেটানোর মতো ছোটখাটো সমস্যা তাকে নিজেকেই সামলাতে দিন।
  • (৪) সন্তানকে ভালবাসুন, কিন্তু তার অন্যায় আবদার, আচরণকে প্রশ্রয় দেবেন না। নিজের কাজ ঠিক মতো না করলে বা ভুল করলে যে শাস্তি পেতে হবে, তা বুঝিয়ে দিন।

পিতামাতার দায়িত্ব

শুধু বাচ্চাকে শেখালেই হবে না, বাড়িতেও বাবা-মা হিসেবে ওর রোল মডেল হয়ে উঠুন। মানবিকতা, সহানুভূতি এ সব শব্দের সঙ্গে বাচ্চাকে পরিচিত করে তুলতে হবে। সাবেক কালের সেই যে পরিচিত কথ্য ‘হাতের তেলোয়’ করে সন্তান মানুষ করা, স্নোপ্লো পেরেন্টিং কিন্তু সে রকমই। মনোবিদরা বলছেন, দু’-তিন বছর বয়স থেকেই কিন্তু খুদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হয়ে যায়। ভাল লাগা, খারাপ লাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছে তারা প্রকাশ করতে পারে। আপনার সন্তানও একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। তাই তাকে স্পেস দিতে হবে।

মনে রাখবেন

বাচ্চা অনেক সময়েই দাদু-ঠাকুমা বা দাদু-দিদার কাছে বড় হয়, যেখানে তাকে অতিরিক্ত আহ্লাদ দেওয়া হয়। দাদু-ঠাকুমার সামনে সন্তানকে শাসন করলেই তাঁরা দৌড়ে এসে আগলে নেন। পায়েল বলছেন, “আত্মীয়স্বজন কিংবা দাদু-ঠাকুমাকে বোঝাতে হবে, তাঁরাও যেন বাচ্চার অন্যায় আবদার মেনে না নেন কিংবা তাতে প্রশ্রয় না দেন।”

Leave a Comment