প্রাচীন ভারতের একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক জীবক মূলত আয়ুর্বেদ চিকিৎসার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি রাজা বিম্বিসারের দরবারে প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসকও ছিলেন বলে কথিত আছে। জীবক তাঁর শল্যচিকিৎসা এবং ওষধি ব্যবহারের দক্ষতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন, বিশেষ করে তিনি ব্রেইন সার্জারির মতো জটিল চিকিৎসা পদ্ধতিতেও পারদর্শী ছিলেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী জীবক
ঐতিহাসিক চরিত্র | জীবক |
পুরো নাম | জীবক কুমারভচ্ছ |
পরিচিতি | প্রাচীন ভারত-এর বিখ্যাত চিকিৎসক, গৌতম বুদ্ধ-এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক |
পেশা | চিকিৎসক (আয়ুর্বেদ ও শল্যচিকিৎসক) |
কর্মস্থল | রাজা বিম্বিসার-এর রাজসভা |
শল্যচিকিৎসা | মাথার অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন শল্যচিকিৎসায় পারদর্শী |
শিক্ষালাভ | তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় |
ঔষধি গবেষণা | বহু প্রাকৃতিক ওষধির কার্যকারিতা আবিষ্কার |
সময়কাল | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী |
ভূমিকা :- মানুষের নীতিবোধ, মানবিকতা ও দক্ষতার উৎকর্ষ সাধনের যদি কোন সার্থক মাধ্যম থেকে থাকে তবে তা হল চিকিৎসাবিদ্যা। মানবসেবার এমন সহজ ও সম্ভাব্য পথ দ্বিতীয় নেই। প্রাচীন ভারতে যে কজন প্রতিভাধর চিকিৎসা বিজ্ঞানী নিজেদের কর্মকৃতিত্বের বলে দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে চিরকালের শ্রদ্ধা লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে জীবক বিশিষ্টতম। তিনি ছিলেন মহান মানবত্রাতা বুদ্ধের সমসাময়িক। জীবক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব নিজ শিষ্যদের বলতেন, ‘জীবককে তোমরা সামান্য ভেব না। তিনি এক ছদ্মবেশী মহাত্মা। এই জীবনেই পান করেছেন অমরত্বের অমৃত।’
চিকিৎসক জীবকের জন্ম
বুদ্ধের মহাজীবনের আলোয় আলোকিত ছিল জীবকের জীবন ও কর্ম। তাই বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা তাঁর জীবনের অনেক চমকপ্রদ তথ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বস্তুতঃ প্রাচীন ভারতের অপর কোনো বিজ্ঞানীর জীবন সম্পর্কেই এমন স্পষ্ট তথ্যাদি জানা যায় না। তবে তাঁর জন্ম সালটি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে রয়েছে মতভেদ। অনুমান করা হয় খ্রিস্টের জন্মের ৫৭০ বছর পূর্বে জীবকের জন্ম হয়েছিল।
জঙ্গলে পরিত্যক্ত জীবক
বর্তমানে উত্তর ভারতের যে শহরটির নাম রাজগীর, প্রাচীনকালে তার পরিচিতি ছিল রাজগৃহ নামে। এই রাজগৃহ ছিল মগধ সাম্রাজ্য-এর রাজধানী। সম্রাট বিম্বিসারের রাজত্বকালে এখানেই সলাবতী নামের এক নর্তকীর গর্ভে জন্ম হয়েছিল জীবকের। বিলাসিনী মা সদ্যজাত শিশুপুত্রকে এক জঙ্গলে ফেলে এসেছিলেন। কিন্তু মাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হলেও কয়েকজন পথিকের অনুগ্রহে পরিচয়হীন শিশুটির প্রাণরক্ষা হয়েছিল। জঙ্গল থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে তারা নিয়ে যায় এক চিকিৎসকের কাছে। তাঁর দয়া ও যত্নে শিশুটির জীবন রক্ষা পায়।
রাজসভায় জীবকের অবস্থান
কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটির সংবাদ পেয়ে যুবরাজ অভয় কৌতূহল বশে এসেছিলেন দেখতে। ফিরে যান তাকে পরম স্নেহে বুকে তুলে নিয়ে। যুবরাজ অভয়ের কাছেই প্রতিপালিত হতে থাকে সেই শিশু। তার নামকরণ তিনি করেন জীবক কুমার ভক্তবচ্ছ। এই নামের তাৎপর্য হল, মৃত্যুর মুখ থেকে জীবন ফিরে পেয়েছে বলে জীবক। আর রাজকুমার কর্তৃক প্রতিপালিত বলে কুমার ভক্ত।
কৈশোরেই জীবকের সঙ্কল্প
রাজ পরিবারেই বড় হয়ে ওঠেন জীবক। একসময় নিজের জন্ম ইতিহাসও তাঁর অজ্ঞাত থাকে না। এক চিকিৎসকের চিকিৎসা গুণে তাঁর জীবন রক্ষা পেয়েছিল। তাই তিনি কৈশোরেই সঙ্কল্প নেন, জন্ম নয়, কর্মই হবে তাঁর পরিচয়। চিকিৎসাবিদ্যাই হবে তাঁর জীবনের পথ। মানুষের সেবাতেই নিয়োজিত করবেন জীবন।
তক্ষশীলায় জীবকের শিক্ষা
সেই কালে তক্ষশীলা ছিল জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান। সেখানে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করবার সঙ্কল্প নিয়ে জীবক একদিন তক্ষশীলায় রওনা হলেন। কাউকে কিছু না জানিয়ে বহু মাসের পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে তক্ষশীলায় এসে তিনি এক চিকিৎসা বিজ্ঞানীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
জীবকের গুরু
বৌদ্ধ গ্রন্থকাররা জানিয়েছেন, জীবকের গুরু ছিলেন তৎকালের জগদ্বিখ্যাত চিকিৎসক। দেশ-বিদেশের শত শত ছাত্র তাঁর কাছে শিক্ষা লাভ করত। সাত বৎসর চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করে গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে রাজগৃহের পথে যাত্রা করেন জীবক।
প্রথম চিকিৎসায় সফল জীবক
- (১) বর্তমান উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলায় একটি অঞ্চলের নাম ছিল সাকেত। বাড়ি ফেরার পথে সেই সাকেতে পৌঁছলে, এমন একটি ঘটনা ঘটে যার ফলে চিকিৎসক হিসেবে জীবকের নাম রাতারাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাকেত শহরের এক ধনী সওদাগরের স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে কঠিন রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। দেশ বিদেশের বহু বৈদ্য তাঁর চিকিৎসা করেছেন কিন্তু রুগীর মাথার অসুখ কেউ ভাল করতে পারেন নি। অসুস্থ স্ত্রীর জন্য চরম অশান্তির মধ্যে দিন কাটছিল সেই সওদাগরের।
- (২) পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পথের পাশে এক গাছতলায় বসে বিশ্রাম করছিলেন জীবক। ঘটনাচক্রে সেই পথেই যাচ্ছিলেন সেই সওদাগর। দিব্যকান্তি যুবক জীবককে দেখে কৌতূহলী হয়ে তিনি তাঁর পরিচয় জানতে চান। সদ্য চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা সমাপ্ত করে বাড়ি ফিরে চলেছেন জানতে পেরে, তিনি জীবকে তাঁর দুঃখের কথা জানিয়ে অনুরোধ করেন স্ত্রীর চিকিৎসা করার জন্য।
- (৩) তখনো পর্যন্ত স্বাধীনভাবে কোনও রুগীর চিকিৎসা করেন নি জীবক। তাই বড় বড় চিকিৎসকরা যে রোগ ভাল করতে ব্যথ হয়েছেন সে ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাবার সাহস পেলেন না তিনি। সবিনয়ে নিজের অক্ষমতার কথা জানালেন সওদাগরকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সওদাগরের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সওদাগরের রোগ-পীড়িত স্ত্রীকে দেখতে যেতে হল।
- (৪) রুগীকে যথাযথ পরীক্ষা করার পর জীবক বিশেষ কিছু ভেষজ গুঁড়ো করে তার সঙ্গে ঘি মিশিয়ে খলনুড়িতে মেড়ে একটি পাত্রে জ্বাল দিলেন। তারপর তরল পদার্থটিকে অন্য এক পাত্রে নিয়ে সওদাগর-পত্নীকে দিলেন। বললেন চিৎ হয়ে শুয়ে একটু একটু করে তরলটি নাক দিয়ে টেনে নিতে।
- (৫) সওদাগর পত্নী অতি কষ্টে অনেক সময় ধরে কাজটি করলেন। তরলটি মুখে চলে এলো। বিস্বাদ ওষুধ। তবু ওই ভাবেই প্রক্রিয়াটি রুগীকে দিয়ে হাতে ধরে করালেন জীবক। ঘন্টা দুই পরেই মন্ত্রের মতো কাজ পাওয়া গেল। অসহ্য মাথার যন্ত্রণায় সাত বছর ধরে শয্যাশায়ী যে রুগী তিনি প্রশান্ত হাসি মুখে নিয়ে ধীরে ধীরে শয্যায় উঠে বসলেন। সমস্ত যন্ত্রণা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
- (৬) তরুণ চিকিৎসক জীবক এইভাবে তাঁর প্রথম চিকিৎসাতেই অসাধারণ সাফল্য পেলেন। লোকের মুখে মুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। কৃতজ্ঞ সওদাগর উপযুক্ত মর্যাদায় জীবকের হাতে তুলে দিলেন তখনকার মুদ্রায় ১৬০০ কার্যাপণ। সেই সঙ্গে উপহার দিলেন এক ক্রীতদাস, এক ক্রীতদাসী ও একটি রথ।
রাজগৃহে জীবকের প্রত্যাবর্তন
সমস্ত উপহার নিয়ে জীবক ফিরে এলেন রাজগৃহে। তাঁর পালক পিতা যুবরাজ অভয় এতদিন পরে জীবককে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলেন। তারপর তাঁর কৃতিত্বের সংবাদ পেয়ে মুগ্ধ হন। জীবক সওদাগরের দেওয়া যাবতীয় উপহাব পিতৃপ্রণামী হিসেবে তুলে দেন অভয়ের হাতে। জীবকের ব্যবহারে অভিভূত হন যুবরাজ।
জীবকের চিকিৎসা গবেষণা
এর পরেই জীবকের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। অভয় জীবকের চিকিৎসা গবেষণার জন্য রাজপ্রাসাদের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে দেন। সেখানেই নগরীর রুগীদের চিকিৎসা আরম্ভ করলেন জীবক। চিকিৎসার পাশাপাশি চলতে থাকে গবেষণার কাজও।
প্রধান রাজচিকিৎসক জীবক
খ্রিঃ পূঃ ৫৪৯ অব্দ। এই সময়ে মহারাজ বিম্বিসার হঠাৎ মলদ্বারের কঠিন রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। অসহ্য যন্ত্রণা তার সঙ্গে রক্তক্ষরণ। দিন দিনই তাঁর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। খবর পেয়ে ছুটে যান জীবক। রাজার অনুরোধে গ্রহণ করেন তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব। প্রথমে তিনি রুগীকে ভালভাবে পরীক্ষা করলেন। তারপর তাঁর পরীক্ষাগারে গিয়ে নানা ভেষজ মিশিয়ে তৈরি করলেন এক আশ্চর্য মলম। এই মলম দিনে দুবার করে এক সপ্তাহ ব্যবহার করেই রাজা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। আনন্দিত বিম্বিসার দুহাত ভরে নবীন চিকিৎসককে উপহার দিলেন। কেবল তাই নয়, অবিলম্বে জীবককে নিযুক্ত করলেন প্রধান রাজচিকিৎসকের পদে।
বুদ্ধের শরণে জীবক
এরপরেই ঘটে ভারত ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা। মগধ সাম্রাজ্যের মহাপরাক্রান্ত সম্রাট ভগবান বুদ্ধের কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। বৌদ্ধ ধর্ম হল রাজধর্ম। এই ঘটনায় বৌদ্ধধর্ম প্রসারের পথ আরও সুগম হল। সমগ্র ভারত ক্রমেই উত্তাল হয়ে ওঠে বুদ্ধদেবের প্রচারিত মহামন্ত্রে। অনুপ্রাণিত জীবক শরণ নিলেন বুদ্ধের। মহারাজ বিম্বিসার বুদ্ধদেব ও তাঁর সঙ্ঘের সন্ন্যাসীদের চিকিৎসার ভার অর্পণ করলেন জীবকের হাতে। তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের ব্যস্ততা আরও বাড়ল।
অবন্তী নগরে জীবক
- (১) সেই সময়ে অবন্তী রাজ্যে রাজত্ব করতেন রাজা কন্দপ্পজোত। হঠাৎ তিনি আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য কমলা রোগে। রাজার সমস্ত শরীরের রং হয়েছে হলুদবর্ণ। সেই সঙ্গে দুর্বলতা। কন্দপ্পজোত দিন দিনই অশক্ত হয়ে পড়তে লাগলেন। রাজবৈদ্যদের চিকিৎসাতেও কোনো ফল দর্শাল না। দূর-দূরান্ত থেকে নামী চিকিৎসকদের আনা হল। কিন্তু রোগ নিরাময়ের কোনো লক্ষণই দেখা গেল না।
- (২) শেষ পর্যন্ত অবন্তীরাজ চিঠি পাঠালেন বিম্বিসারের কাছে। রাজচিকিৎসক জীবককে পাঠিয়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করার জন্য অনুরোধ জানালেন। সেই করুণ চিঠি পেয়ে বিম্বিসার জীবককে পাঠিয়ে দিলেন অবন্তী নগরে। নবীন চিকিৎসক যথারীতি রুগীকে দেখলেন। কিন্তু চিকিৎসার জন্য যে ওষুধের কথা তিনি বিবেচনা করলেন, তা প্রয়োগে আকস্মিক বাধার সম্মুখীন হলেন তিনি।
- (৩) কথাপ্রসঙ্গে জীবক শুনলেন, রাজা কখনো ঘি খান না, এমন কি ঘি নাম পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না। অথচ জীবকের ওষুধ হবে ঘৃতপক্ক। কিন্তু রুগীর চিকিৎসা তো তাঁকে করতে হবে। ভেবেচিন্তে এক কৌশল অবলম্বন করলেন জীবক। যথাবিধি ওষুধ প্রস্তুত করে রাজার সেবকের হাতে দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ পরেই যেন সেটি রাজাকে খাইয়ে দেওয়া হয়।
- (৪) ওষুধ হস্তান্তর করে তিনি আর সেখানে অপেক্ষা করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে হাতীতে চড়ে রওনা হলেন রাজগৃহের পথে। এদিকে অবন্তীরাজ ওষুধ গলায় ঢালার পরেই বুঝতে পারলেন সেটি ঘৃতপক্ক। সব জেনেশুনে জীবক তাঁকে ঘৃতমিশ্রিত ওষুধই খাইয়েছে। ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারালেন তিনি। তখনই এক বলশালী ক্রীতদাসকে পাঠালেন জীবককে ধরে আনার জন্য।
- (৫) এদিকে চলতে চলতে পার্শ্ববর্তী কোশাম্বী নগরে পৌঁছেছেন জীবক। সকালবেলা এক পিপুল গাছের নিচে বসেছেন প্রাতঃরাশ নিয়ে। এমন সময় রাজাদেশ নিয়ে উপস্থিত হল অবন্তীরাজের সেই ক্রীতদাস। তখনই তাঁকে ফিরে যেতে হবে রাজার কাছে। ক্রীতদাস জানালেন, প্রয়োজন হলে জীবককে বেঁধে নিয়ে যেতেও সে পিছপা হবে না।
- (৬) ধীরভাবে সবকথা শুনলেন জীবক। তিনি হেসে বললেন, প্রাতরাশ শেষ করেই তিনি যাবেন তার সঙ্গে। এই বলে সাদরে সামান্য আমলকী ফল ক্রীতদাসটিকে দিলেন খাবার জন্য। আহ্লাদিত হয়ে লোকটি ফল মুখে দেয়। তারপরেই ছুটল পেট। তরল পায়খানা করে করে নেতিয়ে পড়ল তার শরীর। বেচারা তখন জীবককে কাকুতি মিনতি করে তার প্রাণ বাঁচাবার অনুরোধ জানাতে লাগল।
- (৭) জীবক তখন লোকটিকে তার পালিয়ে আসার কারণ খুলে জানিয়ে বলেন, তাঁকে মগধ-এ চলে যাবার সুযোগ করে দিলে তিনি তাকে সুস্থ হওয়ার ওষুধ দেবেন। প্রাণের দায়ে দাসটি জীবকের প্রস্তাবে সম্মত হয়। জীবক তখন তাকে আর এক ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর জীবক মগধের দিকে রওনা হন। আর দাসটি ফিরে গিয়ে অবন্তীরাজকে জানায় জীবকের সন্ধান পাওয়া গেল না।
- (৮) জীবক যে অষুধ রেখে গিয়েছিলেন তা খেয়ে অবন্তীরাজ কন্দপ্পজোত অল্পদিনেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। জীবকের প্রতি অন্যায় আচরণের জন্য খুবই অনুতপ্ত হলেন তিনি। জীবককে অবন্তীতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র পাঠালেন। মহারাজ বিম্বিসারই দূতকে বলে পাঠালেন, জীবকের আর অবন্তীতে যাওয়া সম্ভব নয়। অনুতপ্ত লাঞ্ছিত অবস্তীরাজ শেষ পর্যন্ত দূতের হাত দিয়েই উৎকৃষ্ট রেশম বস্ত্র জীবকের জন্য উপহার পাঠিয়ে দিলেন। সেই রাজকীয় উপহার বুদ্ধের চরণে উৎসর্গ করে ধন্য হলেন জীবক।
অস্ত্র-চিকিৎসক জীবক
চিকিৎসক জীবকের রোগ চিকিৎসার মধ্যে অস্ত্র-চিকিৎসাও অর্ন্তভুক্ত। প্রয়োজনে তিনি নিজেই রুগীর দেহে অস্ত্রোপচার করতেন। বৌদ্ধগ্রন্থগুলোতে তাঁর অস্ত্র-চিকিৎসার অনেক চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। শারীরবিদ্যা সর্ম্পকে গভীর জ্ঞান না থাকলে দক্ষ শল্য চিকিৎসক হওয়া যায় না। জীবক সেই বিদ্যাও অধিগত করেছিলেন।
জীবক কর্তৃক মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার
- (১) একবার রাজগৃহের এক বণিকের চিকিৎসা করেছিলেন জীবক। দেশ বিদেশে ঘুরে বহুকাল বাণিজ্য করেছেন সেই বণিক। কিন্তু শেষ বয়সে মস্তিষ্কের দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। অর্থের অভাব নেই। তাই দেশ বিদেশের নামকরা বৈদ্যরা এসে একে একে জড়ো হল বণিকভবনে। কিন্তু তাদের সকলেরই এক অভিমত, বণিকের রোগ দুরারোগ্য। তাকে সুস্থ করে তোলার কোনো ওষুধ তাদের জানা নেই।
- (২) মৃত্যুর মুখে এসে পৌঁছান বণিক। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজা বিম্বিসারের শরণ নিলেন। অনুরোধ জানালেন রাজবৈদ্য জীবক যেন তাঁর চিকিৎসা করেন। মরতে হলে তাঁর হাতেই তিনি মরতে চান। বণিকের কাতর অনুরোধে জীবককে বণিকের চিকিৎসার জন্য পাঠালেন বিম্বিসার। জীবক যথারীতি রুগীর পরীক্ষা করে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। রুগীও সম্মতি জানালেন।
- (৩) জীবক তাঁকে পুনরায় জানালেন, অস্ত্রোপচারের পর সাত মাস করে তাঁকে ডান বাম ও চিৎ হয়ে মোট একুশ মাস শুয়ে থাকতে হবে। তাহলেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। বণিক হাসিমুখে সম্মতি জানিয়ে জীবককে অবিলম্বে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। সম্ভবতঃ সেই যুগে জীবকই প্রথম মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করেছিলেন। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরূপ ঘটনার কোনো নজির পাওয়া যায় না।
- (৪) বণিকের সম্মতি পাবার পর তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে জীবক ভেতর থেকে বার করে আনলেন দুটো অতি ক্ষুদ্র কীট। তিনি জানালেন এই কীটের দংশনেই বণিকের পীড়ার উৎপত্তি। কয়েকদিনের মধ্যেই এই কীট মস্তিষ্কের আরও গভীরে ঢুকে বণিকের মৃত্যু ঘটাত। নিজের হাতেই কাটা ছেঁড়া চামড়া সেলাই করে তাতে নানা ধরনের ভেষজ প্রলেপ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।
- (৫) এবারে বিশ্রামের পর্ব। সাত দিন করে ডান, বাম ও পাশে কাত হয়ে ও চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হবে মোট একুশ মাস। কিন্তু এই নিয়মে একুশ দিন চলার পরেই অস্থির হয়ে উঠলেন বণিক। তিনি জীবককে জানালেন, তাঁর পক্ষে এই নিয়ম পালন করা সম্ভব হবে না।
- (৬) জীবক তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, তার আর দরকার হবে না, তিনি ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে গেছেন। নিয়ম মতো একুশদিনই বিশ্রাম করার কথা। তা তিনি করেছেন। বণিকের ধৈর্য পরীক্ষার জন্যই তিনি একুশ মাস বিশ্রামের কথা বলেছিলেন। জীবকের সুচিকিৎসায় বণিক জীবন ফিরে পেলেন। কৃতজ্ঞতারবশে তিনি তাঁর জীবন রক্ষাকারীকে সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দান করতে চাইলেন।
- (৭) অর্থ বিষয় আশয়ের প্রতি জীবক ছিলেন নির্লোভ। বুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মানুষের সেবা। তাঁর উপার্জনের সমস্ত অংশই তিনি ব্যয় করতেন আর্ত মানুষের কল্যাণের কাজে। তাই তিনি বণিকের কাছ থেকে মাত্র এক লক্ষ কার্যাপণ নিয়েছিলেন। আর তাঁর নির্দেশে বণিক রাজাকেও এক লক্ষ কার্যাপণ প্রণামী দিয়েছিলেন।
বুদ্ধদেবের প্রশংসা লাভে সক্ষম জীবক
জীবকের এই কীর্তির কথা জেতবনে অবস্থানকারী বুদ্ধের কাছেও পৌঁছায়। তাঁর প্রশংসা করে বুদ্ধ শিষ্যদের ডেকে বললেন, ‘নির্লোভ জীবকের বিস্ময়কর চিকিৎসা দেখো। তাঁর লোভশূন্য জীবনকে তোমরা শ্রদ্ধা করতে শেখো।’
পেটে অস্ত্রপ্রচারের কাজে জীবক
- (১) জীবকের অত্যাশ্চার্য অস্ত্র-চিকিৎসার আর একটি ঘটনা ঘটে কিছুদিনের মধ্যেই। নগরের এক ব্যায়ামবিদ নানা কসরৎ দেখিয়ে তার জীবিকা অর্জন করেন। একবার রাজগৃহে ব্যায়ামের কসরৎ দেখানোর সময় হঠাৎ তলপেটে আঘাত পেয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু তলপেটের অসহ্য ব্যথায় তিনি ছটফট করতে থাকেন। খাবাব খেতে পারেন না, দিন দিন শরীর শীর্ণ হয়ে পড়ছে।
- (২) বৃদ্ধ বৈদ্যরা ব্যায়ামবিদকে পরীক্ষা করে বলেন, কোনও ওষুধে কাজ হবে না। অস্ত্রের নাড়িভুঁড়ি জটপাকিয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। খবর পেয়ে রাজা পাঠিয়ে দিলেন জীবককে। তিনি এসে ব্যবস্থা করেন অস্ত্রোপচারের। নির্জন ঘরে সহকারীদের নিয়ে জীবক ব্যায়ামবিদের পেট কেটে বাইরে নিয়ে আসেন অন্ত্রটিকে। তারপর সন্তর্পণে নাড়িভুঁড়ির জট ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে পুনরায় যথাস্থানে বসিয়ে দেন।
- (৩) পেট সেলাই করে কাটা স্থানে ভেষজ ওষুধ লাগিয়ে জীবক চলে আসেন তাঁর বাড়িতে। কিছুদিন পরেই জীবক শুনতে পেলেন সেই তরুণ ব্যায়ামবীর আগের চেয়েও দ্বিগুণ তেজে তাঁর ব্যায়ামের কসরৎ দেখাতে শুরু করেছেন। তারপর একদিন কৃতজ্ঞ ব্যায়ামবিদ জীবকের কাছে এসে তাঁর হাতে তুলে দিলেন ১৬০০০০ কার্যাপণের তোড়া।
ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অধিকারী জীবক
অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে খ্রিস্টপূর্ব ৬ শতকের জীবক ছিলেন ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অধিকারী। মানবদেহের ভেতরকার অস্থিসন্ধি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ও রোগের অভ্রান্ত নিদান ব্যবস্থায় সেযুগে তাঁর তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। অথচ তিনি নির্লোভ জীবনে অতি সাধারণ ভাবেই দিনাতিপাত করতেন। অর্থ তাঁর কাছে এসেছে স্রোতের মতো। আবার সেই অর্থ তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন দীন-দুঃখীর সেবায়।
গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসক জীবক
- (১) বুদ্ধ ছিলেন তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা। যখনই কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, বুদ্ধের কাছে ছুটে এসে তার সমাধান জেনে আশ্বস্ত হয়েছেন। একবার স্বয়ং বুদ্ধ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পিত্তরসের গোলযোগ তাঁকে খুবই কষ্ট দিতে লাগল। খবর গেল জীবকের কাছে। ছুটে এসে তিনি নিজের হাতে তুলে নিলেন মানবত্রাতার চিকিৎসার ভার।
- (২) বুদ্ধের শরীরে কয়েকদিন বিশেষ ধরনের চর্বি নিজের হাতে মালিশ করলেন জীবক। এরপর কিছু পদ্মের পাপড়িতে ছড়িয়ে দেন এক ভেষজের গুঁড়ো। বুদ্ধকে টানা কয়েকদিন তা নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। সব ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরে চললেন জীবক।
- (৩) পথে হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, বুদ্ধকে যে বিরোচক ওষুধ দিয়েছেন, তার ফল তো পাওয়া যাবে না গরম জলে স্নান না করলে। অথচ তাড়াহুড়োয় এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই তাঁকে বলে আসা হয়নি। দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে পড়েন জীবক। এদিকে বুদ্ধের নির্মল হৃদয়ে জীবকের মনোবেদনার প্রতিফলন পড়ে। তখন তিনি নিজেই উষ্ণজলে স্নানের ব্যবস্থা করেন।
- (৪) বৌদ্ধ শাস্ত্রকারদের লেখা থেকে জানা যায়, জীবকের চিকিৎসকজীবনে একাধিকবার সুযোগ এসেছে বুদ্ধের মহাজীবনের চিকিৎসা করার। আবার সেই চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে বুদ্ধের জীবনের অলৌকিকতার প্রকাশ।
বুদ্ধদেবকে হত্যার চেষ্টা
- (১) বুদ্ধের এক স্বার্থপর জ্ঞাতিভাই দেবদত্ত। ঈর্ষান্বিত হয়ে তিনি নিজেও এক ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর অন্তঃসারশূন্য কথার চমক লোকের মন জয় করতে পারে না। দু-একজন যারা তাকে অনুসরণ করেছিল, তারাও কদিন পরে ভুল বুঝতে পেরে বুদ্ধের কাছে ছুটে চলে যান। নিরুপায় হয়ে ক্রোধান্বিত দেবদত্ত বুদ্ধকে হত্যা করার সঙ্কল্প করেন।
- (২) সুযোগ আসতেও বিলম্ব হয় না। একদিন রাজগৃহ নগরী থেকে দূরে এক পাহাড়ের পাদদেশে মধুকুচি নামক স্থানে একাকী পায়চারি করছেন বুদ্ধ। সবে সকাল হয়েছে। এমন সময় প্রতিহিংসাপরায়ণ দেবদত্ত পাহাড়ের ওপর থেকে বুদ্ধকে লক্ষ্য করে মস্ত এক পাথর গড়িয়ে দেন।
- (৩) সৌভাগ্যক্রমে গড়িয়ে পড়া পাথরখণ্ডটি বুদ্ধের ক্ষতি করতে পারে না। তাঁর পা ছুঁয়ে নিচে গড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই সামান্য আঘাতেহ বুদ্ধের পা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। আহত বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরা বয়ে নিয়ে আসেন আম্রবনে। জীবক তখন সেখানেই অবস্থান করছিলেন। তিনি বুদ্ধের পায়ের ক্ষত ধুয়ে ভেষজের প্রলেপ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন।
- (৪) সেই সময়েই জরুরী ডাক পেয়ে জীবককে মহানগরী রাজগৃহের বাইরে চলে যেতে হয়। যাবার আগে তিনি বুদ্ধের সেবকদের বলে যান, ফিরে এসেই ব্যান্ডেজ খুলবেন। দুর্ভাগ্যক্রমে রুগী দেখে তাঁর ফিরতে দেরি হয়ে যায়। তিনি যখন নগরপ্রাকারের দ্বারে পৌঁছান তখন রক্ষীরা সকলে চলে গেছে। অস্থির হয়ে পড়েন জীবক।
- (৫) বুদ্ধের পায়ের ব্যান্ডেজ যে খুলে দিতে হবে। না হলে তিনি তো প্রচন্ড ব্যথায় কষ্ট পাবেন, রাত্রে ঘুমোতে পারবেন না। ক্ষতিকারক কোনো প্রতিক্রিয়া হওয়াও অসম্ভব নয়। এসব ভেবে দিশাহারা জীবক কেবলই ছটফট করতে থাকেন। ওদিকে অমিতাভ বুদ্ধের চিন্তায় জীবকের কাতরতার প্রতিফলন পড়ে। সে রাতে তিনি পায়ের ব্যান্ডেজ খুলেই ঘুমোতে যান।
জীবক কর্তৃক নির্বিচারে মানুষের সেবা
চিকিৎসক জীবক নির্বিচারে সব শ্রেণীর মানুষেরই চিকিৎসা করেছেন। ধনী-দরিদ্র, রাজা-রাজড়া, পর্ণকুটিরবাসী সবার জন্যই জীবকের গৃহ ছিল অবারিত দ্বার। অসংখ্য দীনদুঃখীকে বিনা পারিশ্রমিকেই তিনি রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দান করেছেন।
ধৈর্যশীল জীবক
তাঁর কর্মব্যস্ততার বিরাম ছিল না। কাজের চাপে তবুও কখনও ধৈর্যচ্যুত হতে দেখা যায় নি তাঁকে। সঙ্ঘের সন্ন্যাসীদেরও নিয়মিত চিকিৎসা করেছেন তিনি। জীবকের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন বুদ্ধ নিজেও। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি প্রায়ই শিষ্যদের বলতেন, “জীবককে সামান্য ভেবো না। তিনি এক ছদ্মবেশী মহাত্মা। এই জীবনেই পান করছেন অমরত্বের অমৃত।”
জীবকের নিবাস
বুদ্ধ আর জীবক-দুজনের জীবন ছিল ওতপ্রোত। প্রতিদিন নিদ্রাভঙ্গের পর বুদ্ধের চরণ বন্দনা সেরে জীবক বসতেন লোক-চিকিৎসায়। আবার দিনের শেষে, সূর্য অস্তমিত হলে জীবক জেতবনে আসতেন বুদ্ধদর্শনে। রাজগৃহের আম্রবন, যা জেতবন নামে পরিচিত হয়েছিল, সেখানেই ছিল জীবকের নিবাস।
চিকিৎসক জীবকের অনুরোধে বুদ্ধসঙ্ঘে শরীরচর্চা
বুদ্ধসঙ্ঘের সন্ন্যাসীদের আত্মা আলোকিত ছিল বুদ্ধের জ্ঞানালোকে। বহিরঙ্গ জীবনে তাঁদের স্বাস্থ্য অটুট রাখতো জীবকের স্বাস্থ্যরক্ষার অনুশাসন। তাঁর অনুরোধেই বুদ্ধ তাঁর সঙ্ঘের সন্ন্যাসীদের প্রতিদিন হালকা শরীরচর্চার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁদের বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল মুক্ত স্থানে।
মানবতার অমৃতধারায় অভিসিঞ্চিত জীবকের জীবন
চিকিৎসক জীবকের মহাজীবনের মর্মলোকটি ছিল মানবতার অমৃতধারায় অভিসিঞ্চিত। একাধারে তিনি ছিলেন একজন সফল নির্লোভ আর্তের কাণ্ডারী মহাচিকিৎসক ও একজন সৎ, উদার, বুদ্ধগতপ্রাণ মহান মানুষ। তাই কি রাজদ্বারে কি দরিদ্রের পর্ণকুটিরে, সর্বত্রই ছিল তাঁর সমান সমাদর। তাঁর মহাজীবনের সংস্পর্শে নিষ্ঠুর নির্দয় বুদ্ধবিদ্বেষী রাজগৃহের রাজপুত্র অজাতশত্রুর হৃদয়েরও পরিবর্তন ঘটেছিল। অনুতাপের অশ্রুবিসর্জন করে তিনি শরণ নিয়েছিলেন তথাগত বুদ্ধের। বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের শরণ-ধ্বনি অবিরাম উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর মুখে।
উপসংহার :- জীবকের নির্লোভ জীবন ও তাঁর কর্মদক্ষতাকে শ্রদ্ধা জানাবার কথা বুদ্ধদেব বারবার বলতেন তাঁর শিষ্যদের। সমকালীন ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে রাজরাজড়া পর্যন্ত সকলেই পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছেন, মর্যাদা জানিয়েছেন জীবকের অলোকসামান্য চিকিৎসা প্রতিভাকে। ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে জীবক তাঁর জীবন ও কর্মের আলোকে আলোকিত এক আলোকস্তম্ভ স্বরূপ বিরাজমান।
(FAQ) চিকিৎসক জীবক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জীবক ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক, যিনি আয়ুর্বেদ এবং শল্যচিকিৎসায় অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবেও পরিচিত।
জীবক তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন, যেখানে তিনি বিশিষ্ট শিক্ষক আত্রেয়ীর কাছ থেকে শল্যচিকিৎসার জ্ঞান অর্জন করেন।
জীবক মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন শল্যচিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এছাড়া তিনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় উদ্ভিদের ব্যবহারেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
জীবক তার চিকিৎসা দক্ষতা, উদ্ভাবনী শল্যচিকিৎসা এবং গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জীবক রাজা বিম্বিসারের রাজসভায় প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছিলেন।