একজন জার্মান সুরকার এবং বারোক যুগের অন্যতম প্রভাবশালী সংগীতজ্ঞ ছিলেন জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫-১৭৫০)। তার রচনা, যেমন “ব্র্যান্ডেনবার্গ কনসার্টো”, “গোল্ডবার্গ ভ্যারিয়েশনস”, এবং “দ্য ওয়েল-টেম্পার্ড ক্লাভিয়ার”, সংগীত ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। বাখ তার জটিল সুর, নিখুঁত কণ্ঠসঙ্গীত, এবং সুরসৃষ্টি কৌশলের জন্য বিখ্যাত, যা আধুনিক সংগীতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি মূলত চার্চ সঙ্গীত ও অর্গান বাদনের জন্য পরিচিত ছিলেন।
সুরকার জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ
ঐতিহাসিক চরিত্র | জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ |
জন্ম | ৩১ মার্চ, ১৬৮৫ খ্রি |
জন্মস্থান | আইজেনাখ, স্যাক্সনি-আইজেনাখ, জার্মানি |
পেশা | সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, অর্গানবাদক |
সঙ্গীত ধারা | বারোক সঙ্গীত |
প্রধান যন্ত্র | অর্গান, ক্লাভিচর্ড, হার্পসিকর্ড |
বিখ্যাত রচনা | ব্র্যান্ডেনবার্গ কনসার্টো, দ্য ওয়েল-টেম্পার্ড ক্লাভিয়ার, গোল্ডবার্গ ভ্যারিয়েশনস |
মৃত্যু | ২৮ জুলাই ১৭৫০ খ্রি |
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ
ভূমিকা :- সঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। এই অমর শিল্পীর বেদনাদীর্ণ জীবনকাহিনী উপন্যাসের কল্পিত গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ।
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের জন্ম
জার্মানির স্যাক্সনি অঞ্চলের আইসবাখ-এ ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের জন্ম। সেবাস্তিয়ানের বাবা যোহান অ্যারোনিয়াস ছিলেন আইসবাখ-এর টাউন কনসার্ট-এর যন্ত্রবাদক। তাঁর মায়ের নাম এলিজাবেথ লামারহাট। সেবাস্তিয়ান ছিলেন তাঁর পিতামাতার কনিষ্ঠ সন্তান।
সেবাস্তিয়ান বাখের বাল্যকাল
সঙ্গীতের পরিবেশেই জন্মেছিলেন সেবাস্তিয়ান। কিন্তু বাল্য বয়সেই তাঁর জীবন-বীণায় বেজে উঠেছিল বেসুরো তান। মাত্র দশ বছর বয়সেই অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে বাবা মা দুজনকেই হারান তিনি। তাঁর ভরণপোষণ ও লালন পালনের দায়িত্ব পড়ে বড় ভাই ক্রিস্টোফারের ওপরে। উত্তরাধিকার সূত্রেই পিতার সঙ্গীত প্রতিভা লাভ করেছিলেন সেবাস্তিয়ান। সেই সঙ্গে পেয়েছিলেন চমৎকার কন্ঠস্বর। তাই দাদা তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার দিকে অমনোযোগী হতে পারেন নি।
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের সঙ্গীতে তালিম
প্রথম জীবনে সঙ্গীতে তালিম পেয়েছিলেন যোহান পাসলবোন নামে একজন সঙ্গীত শিল্পীর কাছে। কিন্তু অধিক দূর অগ্রসর হবার আগেই মাত্র পনেরো বছর বয়সেই সংসারের প্রয়োজনে তাঁকে চাকরি নিতে হয়। চাকরিটাও পেয়েছিলেন কন্ঠস্বরের খাতিরে।
সেবাস্তিয়ান বাখের বিবাহ
১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে বাইশ বছর বয়সে সেবাস্তিয়ান বিয়ে করেন এক আত্মীয়-কন্যা মেরিয়া বারবারাকে। মাত্র তেরো বছর স্থায়ী হয়েছিল তাঁদের বিবাহিত জীবন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই বারবারা অকালে মারা যান। নবীন সঙ্গীতশিল্পীর তখন বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ। স্ত্রী বিয়োগের পর মানসিক ভাবে খুবই একা হয়ে পড়েন তিনি। এই একাকীত্ব তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টির কাজে অন্তরায় হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে পরের বছরেই ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন। স্ত্রীর নাম হল ম্যাগডালেনা।
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের চাকরী
পনেরো বছর বয়সেই চাকরি নিতে হয়েছিল সেবাস্তিয়ানকে। কিন্তু ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে একাধিকবার তাঁকে চাকরি বদল করতে হয়েছিল। ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে লিপজিগে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সেবাস্তিয়ান বাখ
সঙ্গীতের সাধক হলেও সেবাস্তিয়ানের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সংযম ও নিষ্ঠায় পরিপুষ্ট। ধীরস্থির মানুষটির উচ্ছ্বাস ছিল কম। সুন্দর কথা বলতে পারতেন, চলাফেরার ভঙ্গিটিও ছিল মনোমুগ্ধকর।
সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল সেবাস্তিয়ান বাখ
সর্বোপরি সংসারের প্রতি ছিলেন দায়িত্বশীল। একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা হিসেবে কর্তবা সম্পর্কে ছিলেন সদাসচেতন। বস্তুতঃ যেমন সুরের ছন্দে সদা নিমগ্ন ছিল তাঁর হৃদয়মন তেমনি ছন্দোময় ছিল তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজ। সংসার আর সঙ্গীত সাধনার মধ্যেই নিজেকে নিমগ্ন রাখতেন। সংসারের অর্থের চাহিদা মেটাবার জন্যই বারবার চাকরি বদল করতে হয়েছিল তাঁকে। অবস্থা মোটেই সচ্ছল ছিল না। আর্থিক অনটনের পীড়ায় ভুগেছেন বারবার। তাই সঙ্গী হয়েছিল পাওনাদারদের অপমান।
বিনয়ী ও অমায়িক সেবাস্তিয়ান বাখ
সারাজীবন ধরেই রোজগার করেছেন, কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ কোনও দিনই হাতে পান নি সেবাস্তিয়ান। সেকারণে প্রতিপদে চলতে হত হিসাব করে। এজন্য অনেক সময়েই তাঁকে কৃপণ বলে মনে হয়েছে। আসলে মানুষটি ছিলেন দিলখোলা। স্বভাবে ব্যবহারে ছিলেন বিনয়ী ও অমায়িক। মানুষের সঙ্গ পছন্দ করতেন বলে প্রিয় মানুষকে প্রায়ই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। এজন্য পরে অসুবিধাও ভোগ করতে হত খুব।
পরিশ্রমী সেবাস্তিয়ান বাখ
সঙ্গীতের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বিষয়ে ছিলেন খুবই সজাগ। সেই যুগে সঙ্গীত ও সঙ্গীত শিল্পীদের এতটা মর্যাদার চোখে দেখা হত না। সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে খুব কম লোকই গ্রহণ করত। এই পরিবেশে অর্থোপার্জন ও সঙ্গীতের সম্মানরক্ষার জন্য তাঁকে অপরিসীম পরিশ্রম করতে হত। ক্ষেত্র বিশেষে রুখে দাঁড়াবার প্রয়োজন হত। নিজের কর্তব্যনিষ্ঠার বলে সমসাময়িক কালের সকল বাধাই সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন তিনি। প্রত্যেকটি চাকুরিস্থলেই তিনি সুনামের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন।
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের সঙ্গীত রচনা
লিপজিগে দীর্ঘ সাতাশ বছর বসবাস করেছেন সেবাস্তিয়ান। এই সময়ে কঠোর সাধনা ও সৃষ্টিশীল রচনার মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিজেকে খ্যাতির চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। জীবনকালের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর অক্লান্তভাবে সঙ্গীত রচনার মধ্যে ব্যয় করেছেন সেবাস্তিয়ান। কিন্তু কখনো আত্মপ্রচারের দুর্বলতায় আক্রান্ত হন নি। ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাস ও ভক্তি তাঁর অন্তরে শক্তি জোগাত। কঠোর বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতে বিধ্বস্ত হয়েও কখনো বিচলিত হন নি। দুঃখ যন্ত্রণা তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে কখনো ম্লান করতে পারে নি।
আশানুরূপ অর্থলাভে অক্ষম সেবাস্তিয়ান বাখ
সমকালের আত্মসর্বস্ব অক্ষম ক্ষমতালোভীদের ঈর্ষা স্বার্থের আঘাতে বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন সেবাস্তিয়ান। অবহেলা অপমান তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে অবদমিত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এটা সত্য যে সত্যকার সঙ্গীত প্রতিভার অধিকারী হয়েও তদনুরূপ অর্থ বা ক্ষমতা লাভ করতে পারেন নি তিনি। কিন্তু অন্তঃসারশূন্য সমসাময়িক সমাজ তাঁর প্রতিভাকে কখনো অস্বীকার করতে পারে নি।
মৃত্যুর পরে সেবাস্তিয়ান বাখের সম্মান অর্জন
অখ্যাত, অবজ্ঞাত দরিদ্র অবস্থার মধ্যেই একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল সেবাস্তিয়ানকে। কিন্তু মহাকাল তাঁর কীর্তিকে বিস্মৃত হতে পারে নি। যে সমাদর সম্মান শ্রদ্ধা জীবিত অবস্থায় লাভ করেন নি তিনি, তাঁর মৃত্যুর তিনশ বছর পরে জগৎবাসীর কাছ থেকে তা লাভ করেছেন অনায়াসে।
স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারী সেবাস্তিয়ান বাখ
মহাকালের এক বিচিত্র রসিকতা জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর জীবন। ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে সেবাস্তিয়ান তাঁর পরিবারের ইতিহাস সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন অরিজিন অব দ্য মিউজিক্যাল ফ্যামিলি। সেই খসড়া রচনা থেকে জানা যায় এক সঙ্গীত-সাধক পরিবারেই জন্মেছিলেন তিনি। সঙ্গীতের জগতে তাঁর পূর্বপুরুষরাও খ্যাতকীর্তি ছিলেন। তবে একদিকে তাঁদের সকলের থেকে সেবাস্তিয়ান ছিলেন স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারী। তাঁর বংশে একমাত্র তিনিই সঙ্গীত রচনা করেন সর্বপ্রথম।
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের পূর্বসূরী
সেবাস্তিয়ানের পূর্বসূরীদের মধ্যে যোহান ক্রিস্টোফার, যোহান মাইকেল আর যোহান লাউইস খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যেও উইলহেলম ক্রেডিম্যান, কার্ট ফিলিপ ইম্যানুয়াল ও যোহান ক্রিস্টিয়ানও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। যোহান ক্রিস্টিয়ান তো আখ্যাত হয়েছিলেন ইংল্যান্ড-এর বাখ অভিধায়।
সেবাস্তিয়ান বাখের কয়ার মাস্টারের চাকরী
অখ্যাত দরিদ্র বাখ এক সময় কয়ার মাস্টারের চাকরি পেয়েছিলেন লিপজিগের সেন্ট টমাস চার্চ সংলগ্ন স্কুলে। এখানে চাকরি করাকালীন দীর্ঘদিন তিনি বাতি জ্বালিয়ে গভীর রাত্রি পর্যন্ত গান আর স্বরলিপি রচনা করেছেন। ফলে একটা সময়ে চোখের অসুখে আক্রান্ত হলেন তিনি। ডাক্তারেরা তাঁর চোখে অস্ত্রোপচারের নির্দেশ দিলেন।
চার্চের দেওয়া আশ্রয়ে সেবাস্তিয়ান বাখ
সময়টা ছিল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ। বাখ-এর বয়স হয়েছে পঁয়ষট্টি। প্রথমা স্ত্রী গত হয়েছেন। দ্বিতীয়া স্ত্রী অ্যানাই তখন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী। স্কুলের কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাঁকে ইতিমধ্যে। চার্চ অনুগ্রহ করে তাঁদের থাকার জন্য যে আশ্রয়টুকু দিয়েছিল তাঁদের তা ছেড়ে অন্যত্র যাবার সঙ্গতি নেই। তাই চার্চের দেওয়া জায়গাটুকুতেই সকলের মন জুগিয়ে থাকতে হচ্ছিল তাঁদের।
অর্গান বাজাতে সেবাস্তিয়ান বাখের অনুরোধ
- (১) দিনের বেলায় চার্চের অর্গান বাজানো চলে না। কর্তৃপক্ষের নিষেধ। রাতের বেলা যে অর্গানে বসবেন তারও উপায় নেই। অন্যদের ঘুমের অসুবিধা হবে। কিন্তু সুরই যে বাখ-এর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। সুর ছাড়া তিনি বাঁচেন কী করে? এই পরিস্থিতিতে তীব্র মানসিক কষ্টে দিন কাটছিল তাঁর।
- (২) ইতিমধ্যে ডাক্তার তাঁর চোখে অস্ত্রোপচারের দিন নির্দিষ্ট করলেন। আগের দিন বাখ খুবই অস্থির হয়ে পড়লেন। বার বার মিনতি জানাতে লাগলেন, তাঁকে একটু অর্গান বাজাতে সুযোগ দেবার জন্য। চার্চ কর্তৃপক্ষকে বলবার উপায় নেই।
- (৩) একেই তো তাঁরা দয়া করে বাসস্থানটুকু দিয়েছেন। তার ওপর অর্গান বাজিয়ে অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে দূরবস্থার অবধি থাকবে না। শেষ পর্যন্ত শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও হয়তো হারাতে হবে। অথচ বাখ এমন করুণভাবে বারবার কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন যে অ্যানা দিশাহারা হয়ে পড়লেন।
- (৪) পরদিনই অপারেশন। অপারেশনের পরে অবস্থা কেমন দাঁড়াবে কে জানে? হয়তো কোনও দিনই আর চোখে দেখতে পাবেন না বাখ। বসতে পারবেন না অর্গানের সামনে। অ্যানা ভাবতে থাকেন নানা কথা। একবার একটু অর্গান বাজাতে চেয়েছেন কেবল।
- (৫) স্বামীর এই সামান্য চাওয়াটুকু তাঁর জীবনের এমন সঙ্কটকালে পূরণ হবে না? অনেক ভাবনা চিন্তার পর অ্যানা মনস্থির করে ফেললেন। রাত গভীর হলে তিনি হাত ধরে বাখকে নিয়ে এলেন চার্চের হলঘরে। বসিয়ে দিলেন অর্গানের সামনে।
- (৬) সুরের প্রিয় যন্ত্রটিকে জড়িয়ে ধরে আবেগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন শিল্পী। চোখের কোল গড়িয়ে জল নেমে এল। এরপর সুর তুললেন অর্গানে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করলেন বাজানো। অ্যানাকে ডেকে বললেন, এবারে চলো আমি প্রস্তুত।
চূড়ান্ত অপমানিত সেবাস্তিয়ান বাখ
অর্গানের শব্দে চার্চের লোকজনের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাঁরা ছুটে এসে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন। একজন কয়ার মাস্টারের অর্গান বাজানোর অধিকার নেই। সেই নিয়ম ভঙ্গ করে এর আগেও অনেকবার অপমানিত হয়েছেন বাখ। কিন্তু আজকের অপরাধ গুরুতর। অ্যানা রাতের অন্ধকারে বাখকে লুকিয়ে গির্জায় নিয়ে এসেছেন। সে রাতে চূড়ান্ত অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে হল উভয়কে। স্বামীর শেষ ইচ্ছা একটু ক্ষণের জন্য হলেও পুরণ করতে পেরেছেন, এই পরিতৃপ্তিতে ভরেছিল অ্যানার মন। তাই বারবার চার্চের কিউরেটর উইনলিকের তাড়িয়ে দেবার হুমকি শুনেও মুখ বুজে থাকতে পেরেছেন।
সেবাস্তিয়ান বাখের মৃত্যু
পরদিন বাখ-এর চোখের অপারেশন হল। কিন্তু ফল হল বেদনাদায়ক। অপারেশনের পর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল পক্ষাঘাত। সেই অবস্থাতেই দু’বছর শয্যাশায়ী থাকলেন বাখ। তারপর ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
জোহান সেবাস্তিয়ান বাখের দুর্ভাগিনী স্ত্রী
অ্যানা একা হয়ে গেলেন। চার্চের ঘর ছেড়ে দিতে হল তাঁকে। সামান্য যা জিনিসপত্র ছিল বিক্রি করে দিলেন। কেবল রেখে দিলেন বাখ-এর গান আর স্বরলিপির পাণ্ডুলিপিগুলো। প্রাণে ধরে সেগুলো নষ্ট করতে পারলেন না। বাখ-এর দশজন ছেলেমেয়ে তখনো বেঁচেছিলেন। তাঁদের অনেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কারো কাছেই স্থান হল না অ্যানার। জঞ্জাল ভেবে পাণ্ডুলিপিগুলোও কেউ রাখতে রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত ফুটপাতেই আশ্রয় নিলেন দুর্ভাগিনী অ্যানা। বাখ-এর পরিচিত এক মাংসের দোকানের সামনে ঠাঁই হয়েছিল তাঁর। মাংসের দোকানী কোয়েলারের দয়াতেই কোনও রকমে ভিক্ষেসিক্ষে করে আরও দশ বছর বেঁচেছিলেন অ্যানা।
যবনিকার আড়ালে সেবাস্তিয়ান বাখের সঙ্গীত সাধনা
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারী শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার আগে তিনি বাখ-এর পাণ্ডুলিপির গোছা মাংসের দোকানীর হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো কোয়েলার রেখে দিয়েছিল তার সেলারে। বাখ-এর দুঃখময় জীবনের সঙ্গীত সাধনার ইতিহাস এরপর একশো বছর চাপা পড়েছিল সময়ের যবনিকার আড়ালে। সেই যবনিকা উন্মোচিত হয়েছিল লিপজিগের জিওয়ানড্ হাউস অর্কেস্ট্রার কনডাকটর ফেলিক্স মেনডেলেসনের হাতে।
সেবাস্তিয়ান বাখের পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার
- (১) লিপজিগ অর্কেস্ট্রার বোর্ড অব ট্রাস্টির আহ্বানে নিয়োগপত্র নিয়ে লিপজিগ শহরে এসেছিলেন ফেলিক্স। একদিন তিনি কোয়েলারের মাংসের দোকানে গিয়েছেন মাংস কিনতে। ততদিনে কোয়েলার গত হয়েছে। দোকান চালায় তারই এক বংশধর মার্টিন কোয়েলার।
- (২) নামী দোকান। তাই ভিড়ও খুব। মাংস মোড়ানোর কাগজ ফুরিয়ে গিয়েছিল। কোয়েলারের বউ ছুটে গিয়ে বাড়ির ভেতরে কাগজের স্তূপ থেকে কিছু কাগজ তুলে আনল। সেই কাগজে জড়িয়েই খদ্দেরদের মাংস দেওয়া হতে লাগল।
- (৩) ফেলিক্স পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সমস্ত কিছু। হঠাৎ হলদে হয়ে যাওয়া এক টুকরো কাগজের ওপরে চোখ পড়তেই ভীষণ ভাবে চমকে উঠলেন তিনি। দেখলেন তাতে লেখা রয়েছে এই কয়টি কথা – “দি প্যাশন অব আওয়ার লর্ড, অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু-বাই যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ।
- (৪) সময়টা ছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ। এমনি আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়েই বাখ রচিত সঙ্গীতের শেষ খণ্ডটি কালের যবনিকা ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
ইতিহাসে স্মরণীয় সেবাস্তিয়ান বাখের নাম
বাখ-এর সঙ্গীত নিয়ে এর পরের ইতিহাস ফেলিক্স-এর জীবনকে কেন্দ্র করে। বাখ-এর প্যাশন সঙ্গীতকে রূপান্তরিত করতে তাঁকে যে সংগ্রাম ও সাধনা করতে হয়েছিল, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।
সেবাস্তিয়ান বাখের রচিত গানের প্রথম অনুষ্ঠান
ফেলিক্স ছিলেন ইহুদী। তাই খ্রিস্টানদের গান গাইবার বিরুদ্ধে তাঁকে সমাজের কম বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি। বাখ-এর প্যাসন রূপায়িত করতে কোনও সঙ্গীতশিল্পীর সহযোগিতা পান নি তিনি। সেই গানের প্রথম অনুষ্ঠান তিনি করেছিলেন চারশো জন অখ্যাত চাষী অনুচরদের নিয়ে।
উপসংহার :- তারপর থেকে বাখ জয় করে নিয়েছিলেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। মুগ্ধ বিস্ময়ে মানুষ শুনেছে সেই ধ্রুপদী সঙ্গীতের মূর্ছনা। সমকালের মানুষের অবহেলা অবজ্ঞা পেলেও পরবর্তীকালের মানুষ বাখকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে ভোলে নি। তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে।
(FAQ) জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বাখ তার অসাধারণ সংগীত রচনা, বিশেষ করে বারোক ধাঁচের সুর, যেমন ব্র্যান্ডেনবার্গ কনসার্টো এবং দ্য ওয়েল-টেম্পার্ড ক্লাভিয়ার-এর জন্য বিখ্যাত।
বাখ তার জীবদ্দশায় মূলত একজন অর্গানবাদক এবং শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার রচনা মৃত্যুর পর আরো বিখ্যাত হয়।
বাখ প্রায় ১,১০০ এর বেশি সংগীত রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে ক্যান্টাটা, ফুগ, এবং ইনস্ট্রুমেন্টাল সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত।
বাখের জটিল সুরসংযোগ ও গাণিতিক ছন্দ আধুনিক সংগীত এবং জ্যাজ সুরের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বাখ অর্গান, ক্লাভিচর্ড, হার্পসিকর্ড এবং ভায়োলিনে দক্ষ ছিলেন।
ব্র্যান্ডেনবার্গ কনসার্টো এবং গোল্ডবার্গ ভ্যারিয়েশনস বাখের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাখের পরিবারে প্রায় ৫০ জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তার ছেলেরা, যেমন কার্ল ফিলিপ ইমানুয়েল বাখ এবং জোহান ক্রিস্টিয়ান বাখ, বিখ্যাত সুরকার হয়েছিলেন।