মহান বিপ্লবী জ্যোতিকণা দত্ত প্রমাণ করেছেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর অবদান ছিল নিঃস্বার্থ, সাহসী, অনেক সময় বাহিরের দৃশ্য থেকে অদৃশ্য। ইতিহাসে তার নাম ঝলমল করছেন না, কিন্তু তার সেরার উপস্থিতি—পিস্তল-বন্দুক হাতে স্বাধীনতার পানে এগিয়ে যাওয়া—বলছে তিনি ছিলেন এক সুদৃঢ় ও নির্ভীক বিপ্লবী।
বিপ্লবী জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা)
ঐতিহাসিক চরিত্র | জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা) |
জন্ম | ১৯১৩ সালের জানুয়ারি |
পরিচিতি | নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী |
কার্যকাল | ১৯৩০-এর দশক |
জড়িত আন্দোলন | ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী কার্যক্রম, ছাত্র আন্দোলন, সশস্ত্র সংগ্রাম |
সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক | মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত |
গ্রেপ্তার ও সাজা | পিস্তল রাখার অপরাধে গ্রেপ্তার; চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড |
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য | সাহস, গোপন কার্যকলাপ, সশস্ত্র সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব | নারী বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম; উপেক্ষিত ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় |
স্মৃতিচিহ্ন/উল্লেখ | “স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী” প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে |
জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা)
ভূমিকা :- ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নারী বিপ্লবীদের অবদান আজও যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় নি। বিপ্লবী জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা) সেইসব নির্ভীক নারীদের একজন, যাঁরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা)-র জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বাধীনতার ইতিহাস কেবল পুরুষদের নয়, সেই ইতিহাসে বহু নারীর ত্যাগ ও সংগ্রামও সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং গর্বের।
জ্যোতিকণা দত্তর জন্ম
মহান বিপ্লবী জ্যোতিকণা দত্ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে কুমিল্লার মামাবাড়ীতে। তাঁদের দেশ কুমিল্লা জেলার কালিকচ্ছে।
বিপ্লবী জ্যোতিকণা দত্তর পিতামাতা
তাঁর পিতা মোহিনীমোহন দত্ত ও মাতা চাকনলিনী দত্ত।
জ্যোতিকণা দত্তর পিতামহ
স্বাধীনচেতা নির্ভীক পণ্ডিত দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন জ্যোতিকণার পিতামহ। তিনি হিন্দু মুসলমান ক্রিশ্চান ধর্মের সমন্বয় করবার জন্য আরবী, ফার্সী, প্রাকৃত, পালি প্রভৃতি ভাষা শিখে গীতা, কোরান, বাইবেল অনুবাদ করে জ্যোতিকণা প্রমুখ নাতনী ও নাতিদের শোনাতেন। জ্যোতিকণার কাকা হচ্ছেন স্বনামধন্য বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত।
বিপ্লবী জ্যোতিকণা দত্তর শিক্ষা
ছোটবেলা থেকেই জ্যোতিকণা লেখাপড়ায় ভালো ছাত্রী ছিলেন। ছাত্রীজীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। কিন্তু তখনকার দিনের বিক্ষুব্ধ হাওয়া অনেক ভালো ছাত্রীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে আকর্ষণ করে নিত। বিপ্লবের আহ্বান নিয়ে বন্ধু বনলতা দাশগুপ্ত যখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন তখন তিনি তাঁকে ফিরিয়ে দেন নি।
পিস্তল গোপনের কাজে জ্যোতিকণা দত্ত
জ্যোতিকণা দত্ত বিপ্লবীদলের সভ্য ছিলেন না, কিন্তু বৈপ্লবিক কাজের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন তাঁর মনে ছাপ ফেলেছে, এমন সময় একদিন বনলতা দাশগুপ্ত কয়েকটি পিস্তল এনে তাঁকে দিলেন লুকিয়ে রাখতে। দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করলেন। ডায়োসেসান কলেজের বোর্ডিং-এ তিনি থাকতেন। ঐ কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন তিনি ও বনলতা ১৯৩৩ সালে।
জ্যোতিকণা দত্তর কারাদণ্ড
হঠাৎ একদিন বোর্ডিং-এর কোনো ছাত্রীর টাকা চুরির জন্য তল্লাসী হয় বোর্ডিং-এর সমস্ত মেয়েদের বাক্স এবং বিছানা। টাকার জন্য তল্লাসী করতে গিয়ে জ্যোতিকণার জিনিসপত্রের মধ্যে লুক্কায়িত পিস্তলগুলি ধরা পড়ে যায়। কলেজের কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ পুলিসে খবর দেন এবং জ্যোতিকণা গ্রেপ্তার হয়ে যান। অস্ত্র-আইনে তাঁর চার বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
সরল, মধুর স্বভাবের জ্যোতিকণা দত্ত
জেলের মধ্যে যে সব বন্দিনী আপন স্বভাব মাধুর্যে সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন, জ্যোতিকণা তাঁদের অন্যতম। এমন স্নিগ্ধ মধুর স্বভাব, এমন শিশুর মতো সরলতা, এমন আত্মবিশ্লেষণ করে করে নিজেকে বিচার করা এ যেন জ্যোতিকণার মতো মেয়েদের পক্ষেই সম্ভব।
ডাক্তার জ্যোতিকণা দত্ত
কারাগারে বন্দী জীবন থেকে মুক্তির পর তিনি ডাক্তারী পাস করেন।
জ্যোতিকণা দত্তর বিবাহ
১৯৪৭ সালের মে মাসে মতিরাম বেরা নামে একজন পাঞ্জাবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। শেষ বয়সে তিনি লণ্ডনে থেকেছেন। সেখানেই তাঁর স্বামী স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন।
উপসংহার :- আজকের সমাজে জ্যোতিকণার মতো সংগ্রামী নারীদের ইতিহাস জানার এবং তাঁদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাঁর নাম হয়তো পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা নেই, কিন্তু ইতিহাসের গহীনে তিনি চিরভাসমান এক দীপ্তিমান নাম হয়ে থাকবেন। তাঁর জীবন কাহিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেম, সাহস ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে যাবে।
(FAQ) জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
জ্যোতিকণা দত্ত (বেরা) ছিলেন একজন বাঙালি নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন।
জ্যোতিকণা দত্ত গোপনে একটি পিস্তল রাখার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হন এবং চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
জ্যোতিকণা দত্তর কর্মকাণ্ডে ছিল সাহস, আত্মনিবেদন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি অটল বিশ্বাস। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে নারীরাও অস্ত্র তুলে নিতে পারে দেশের স্বাধীনতার জন্য।
জ্যোতিকণা দত্ত মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিল।
হ্যাঁ, জ্যোতিকণা দত্তকে নিয়ে আলোচনা পাওয়া যায় “স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী” প্রভৃতি গ্রন্থে, যেখানে বাংলার নারী বিপ্লবীদের জীবনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু নারী বিপ্লবী উপেক্ষিত থেকেছেন। জ্যোতিকণা দত্তও তাঁদেরই একজন, যাঁর অবদান প্রচলিত ইতিহাসে খুব বেশি আলোচিত হয় নি।