নারী সংগ্রামী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী ছিলেন বিশিষ্ট ভারতীয় সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ এবং নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তিনি ব্রিটিশ ভারতের সময়কালে নারীশিক্ষা, নারীর সামাজিক upliftment ও ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী সিনেট সদস্য হিসেবে তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীদের সমস্যা তুলে ধরেন এবং সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবন নারী শক্তি ও সমাজসেবার এক অনন্য প্রতীক।
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
ঐতিহাসিক চরিত্র | জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী |
জন্ম | ২৫ জানুয়ারি ১৮৮৯ খ্রি |
জন্মস্থান | ব্রিটিশ ভারত (সম্ভবত বর্তমান বাংলাদেশ) |
পরিচিতি | সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ |
প্রধান অবদান | নারী শিক্ষা, নারী অধিকার, সমাজ সংস্কার |
সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা | অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স (AIWC) |
উল্লেখযোগ্য পদ | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী সিনেট সদস্য |
প্রভাব | ভারতীয় নারীবাদ ও সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা |
উত্তরাধিকার | নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট নাম |
মৃত্যু | ২২ নভেম্বর ১৯৪৫ খ্রি |
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
ভূমিকা :- জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী ছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক অগ্রগণ্য নারী সমাজসেবী, শিক্ষাবিদ এবং নারীবাদী চিন্তাধারার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি এমন এক সময়ে নারীদের পক্ষে কাজ শুরু করেছিলেন, যখন সমাজে নারীদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং অবহেলিত। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি নারীশিক্ষা, নারীর অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে সমাজে পরিবর্তনের বার্তা ছড়িয়ে দেন।
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর জন্ম
১৮৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সমাজকর্মী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর পিতামাতা
তার পিতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ছিলেন প্রসিদ্ধ সমাজসেবক, দেশকর্মী ও নারীকল্যাণব্রতী। মাতা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট (১৮৮৩)। তিনি শুধু ডাক্তারই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক কর্মী এবং সমাজ-সেবিকাও।
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর শিক্ষা ও প্রেরণা
পিতামাতার নিকট থেকেই জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী পেয়েছিলেন জীবনের সকল শিক্ষা ও প্রেরণা। তাঁদের মতোই সাহস ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কংগ্রেস কর্মী। যেমন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব তেমনি ছিল স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ।
অধ্যক্ষ জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
তিনি এম এ. পাস করার পর বেথুন স্কুল, কটক র্যাভেনশ গার্লস কলেজ, কলম্বো বুদ্ধিস্ট গার্লস কলেজ, জলন্ধর কন্যা মহাবিদ্যালয়, কলকাতা ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল প্রভৃতি নারী শিক্ষায়তনের অধ্যক্ষারূপে স্ত্রীশিক্ষা প্রচারে বিশেষ সহায়তা করেন। বিদ্যাসাগর বাণীভবন সংগঠনেও তাঁর দান অনেকখানি।
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী কর্তৃক নারী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠন
১৯২০ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী গঠন করলেন নারী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী। এদেশের নারী এই প্রথম প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলেন সংঘবদ্ধভাবে। জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর অধিনায়কত্বে মেয়েরা সাহসের সঙ্গে প্রকাশ্য অধিবেশনে কাজ করে সকলকে বিস্মিত করলেন।
প্রাইমারী এডুকেশন কমিটির সহায়ক সদস্যা জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
তখনকার দিনে মেয়েদের পক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দলবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে আসা এবং কংগ্রেসে যোগ দেওয়া কম দুঃসাহসের পরিচায়ক ছিল না। সেই সময় তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করাও কম দক্ষতার কথা নয়। দেশবন্ধু তাঁর পারদর্শিতা দেখে তাঁকে কর্পোরেশন প্রাইমারী এডুকেশন কমিটির সহায়ক সদস্যা রূপে গ্রহণ করেন।
সভানেত্রী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
এরপর জ্যোতির্ময়ী দেবী জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগাবার জন্য, কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করবার জন্য বহু সভা সমিতি, যুব সম্মেলন ও জেলা সম্মেলন প্রভৃতির সভানেত্রী রূপে দেশের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মুক্তি সংগ্রামে জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
১৯৩০ সালে তিনি চাকরীর মায়া ত্যাগ করে মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনেও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি যে শুধু নিজে যোগদান করেছিলেন তা নয়, শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে গিয়ে সভা সমিতিতে উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা দিয়ে সর্বসাধারণকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং প্রেরণা দিয়েছেন। ঐ দুইবাবের আন্দোলনেই তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
কলকাতা কাউন্সিলার জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
১৯৩৩ সালে কলকাতা কপোরেশনের প্রথম দুইজন মহিলা কাউন্সিলারের মধ্যে তিনি অন্যতম কাউন্সিলার রূপে নির্বাচিত হন।
কলকাতার ছাত্রদের শোভাযাত্রা
তিনি ছিলেন ছাত্রবন্ধু। তার হৃদয় ছিল দরদী। ১৯৪৫ সালের ২১শে নভেম্বর আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর মোকদ্দমার সময় কলকাতার ছাত্ররা দলবদ্ধ ভাবে ঐসব বন্দীদের মুক্তির জন্য শোভাযাত্রা করেছিলেন। তাঁরা প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিলেন ডালহৌসি স্কোয়ারে। তখন সেটা ছিল নিষিদ্ধ এলাকা। পুলিস আটকে রাখল তাঁদের ধর্মতলায়। ছাত্ররা এগিয়ে যেতে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। পুলিস গুলী ছুঁড়তে লাগল। ছাত্ররা পুলিসের গুলীর সামনে বুক পেতে দাঁড়ালেন। আহতের সংখ্য়া অনেক। নিয়ে গেছে তাঁদের হাসপাতালে। নিহত হয়েছেন কিশোর ছাত্র বামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ধর্মতলায় ছাত্রদের পাশে জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী
রাত প্রায় বারোটার সময় ঐ ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী সশস্ত্র পুলিসের ব্যূহ ভেদ করে ছাত্রদের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন ধর্মতলায়। তিনি কম্পিতকণ্ঠে ছাত্রদের সম্বোধন করে বললেন, “তোমাদের মৃত এবং আহত বন্ধুদের দেখে আমি হাসপাতাল থেকে আসছি। বাংলার ছাত্র, তোমরা অসীম বীরত্ব দেখিয়েছ, পুলিসের গুলী তোমাদের ভয় দেখাতে পারে নি, ছত্রভঙ্গ করতে পারে নি, তোমরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে অনমনীয় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছ, দিয়েছ ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের চ্যালেঞ্জের উত্তর। সমস্ত দেশের আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে তোমাদের মাথায়।” সারা রাত্রি রইলেন তিনি ছাত্রদের পাশে ধর্মতলার রাস্তায়।
জয়ী ছাত্রসমাজ
দ্বিতীয় দিনে দ্বিগুণ ছাত্র এসে যোগ দিলেন ধর্মতলার ছাত্রদের সঙ্গে। তাঁদের সংকল্প দেখে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট আরো শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। আরো গুলী বর্ষিত হল, আরো রক্ত ছাত্রদের বুক থেকে বয়ে গেল। অনেক রক্তের বিনিময়ে বিজয়ী বীর ছাত্ররা সেদিন ডালহৌসি স্কোয়ারে যাবার দাবী আদায় করেছিলেন। ছাত্রদের বিদ্রোহের কাছে ব্রিটিশ সিংহের মাথা নত করতে হয়েছিল।
সংগ্রামী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর মৃত্যু
ছাত্রদের ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেই ১৯৪৫ সালের ২২শে নভেম্বর জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী ছাত্রদের শোভাযাত্রার নেতৃত্ব করে চলেছিলেন শ্মশানে। শহীদ রামেশ্বরের শবদেহ বহন করে শোভাযাত্রা অগ্রসর হচ্ছিল। পথে মিলিটারী ট্রাক পশ্চাৎ থেকে এসে তাঁর মোটরে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর মৃত্যু হয়। এই দরদী মহীয়সী নারীর মৃত্যু ছাত্র আন্দোলনে তার ভূমিকার গৌরবময় পরিণতি।
উপসংহার :- জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী ছিলেন এক অসাধারণ মানবতাবাদী, যিনি নারীর অধিকার, শিক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি কেবল একজন সমাজকর্মী বা শিক্ষাবিদ ছিলেন না, বরং নারী মুক্তি আন্দোলনের এক দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর চিন্তা, কর্ম ও নেতৃত্ব আজও ভারতীয় সমাজে নারীবাদী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, প্রতিকূল সামাজিক অবস্থার মধ্যেও একজন নারী কীভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং সমাজে পরিবর্তনের স্রোত বইয়ে দিতে পারে। আজকের প্রজন্মের জন্য তাঁর জীবন এক অনুপ্রেরণা, যা নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন জাগায়। জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর জীবন ও আদর্শ ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(FAQ) জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ এবং নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তিনি নারীশিক্ষা, সামাজিক ন্যায় ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর জন্ম হয় ১৮৮৯ সালে, ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত এক শিক্ষিত পরিবারে।
নারীশিক্ষা বিস্তার, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমাজ সংস্কার এবং অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্সের মাধ্যমে নারীদের জাতীয় পর্যায়ে সংগঠিত করা।
অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স (AIWC)-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর মৃত্যু হয় ১৯৪৫ সালে।
তিনি নারীসমাজকে শিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তোলার জন্য যে সংগ্রাম করেছেন, তা আজও নারীবাদী আন্দোলনের এক শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়।