পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি কৃষক কল্যাণ স্কিম কৃষক বন্ধু প্রকল্প, যেখানে চাষিরা বার্ষিক আর্থিক সহায়তা, মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ও চাষের সুরক্ষা পান।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্পে চাষিদের জন্য মরশুমি আর্থিক সহায়তা ও পরিবারকে জীবনবীমা সুরক্ষা প্রদান করা হয়, যা কৃষি পরিবারকে আর্থিক সুরক্ষা দেয়।
কৃষক বন্ধু প্রকল্প
| ঐতিহাসিক ঘটনা | কৃষক বন্ধু প্রকল্প |
| রাজ্য ও দেশ | পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
| সূচনা বর্ষ | ২০১৯ খ্রি |
| পরিচালনা দপ্তর | কৃষি দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার |
| লক্ষ্য | কৃষকদের আর্থিক সহায়তা ও সামগ্রিক কল্যাণ |
| প্রকল্পের উদ্দেশ্য | কৃষকদের চাষ খরচে সহায়তা, দুর্যোগে পাশে দাঁড়ানো, আত্মমর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি |
| প্রধান সুবিধা | চাষের জন্য বার্ষিক নগদ সহায়তা, মৃত্যুকালীন আর্থিক অনুদান |
| বার্ষিক সহায়তা | সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা (২ কিস্তিতে প্রদান) |
| মৃত্যুকালীন অনুদান | ২,০০,০০০ টাকা (১৮–৬০ বছর বয়সী কৃষকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে) |
| প্রয়োজনীয় যোগ্যতা | পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা, কৃষিকাজে যুক্ত ব্যক্তি, বয়স ১৮–৬০ বছরের মধ্যে |
| প্রদান পদ্ধতি | সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে (DBT) |
| আবেদনের মাধ্যম | ব্লক কৃষি অফিস/কৃষি সহায়ক/দুয়ারে সরকার ক্যাম্প |
ভূমিকা: কৃষি— বাংলার প্রাণ, আর কৃষক সেই প্রাণের ধারক। মাঠে ফসল ফলাতে যে মানুষটি ভোরের শিশির পায়ে মাড়িয়ে দিন কাটান, তাঁর জীবন ও সংগ্রামকে আগলে রাখতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করেছে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ— কৃষক বন্ধু প্রকল্প। এটি শুধুই আর্থিক সহায়তা নয়, বরং বাংলার কৃষক সমাজের সম্মান, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যতের প্রতি এক দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতীক। “কৃষকই দেশের মেরুদণ্ড” — এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প রাজ্যের কৃষি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
কৃষক বন্ধু কি ?
মাটির সাথে সম্পৃক্ত কৃষকের জীবন অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা থাকলেও, এই প্রকল্প তাঁর পরিবারকে দেয় নিরাপত্তার ছাতা, আশা দেয় দুঃসময়ে বাঁচার, আর আত্মবিশ্বাস জোগায় লড়াইয়ে জেতার। শস্যভরা মাঠ, হাসিমুখ কৃষক পরিবার— সেই স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই কৃষক বন্ধু। কারণ –
“যে কৃষক বাঁচে, সে ফসল বাঁচায়।
যে ফসল বাঁচে, সে বাংলা বাঁচায়।”
পশ্চিমবঙ্গের কৃষক বন্ধু প্রকল্পের লক্ষ্য
বাংলার কৃষকদের চাষের খরচ কমানো, আর্থিক দুর্দশা থেকে রক্ষা করা, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষক পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা প্রভৃতি।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের জন্য যোগ্যতা
এই প্রকল্পটির জন্য সকল রেজিস্টার্ড কৃষক ও ভাগচাষি (বর্গাদার) আবেদন করতে পারেন, আবেদনকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আধার ও জমির নথি থাকা বাধ্যতামূলক, ১৮–৬০ বছর বয়সীরা জীবন বীমার সুবিধা পান। আবেদনকারীকে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হতে হবে। আবেদনকারী অবশ্যই একজন কৃষক হবেন। নিজস্ব চাষযোগ্য জমির কৃষকেরা বা যাদের রেকর্ড অফ রাইট্স (RoR), পাট্টা বা ফরেস্ট পাট্টা রয়েছে এবং নথিভুক্ত ভাগচাষিরাও এই প্রকল্পের যোগ্য।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নথি
পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বন্ধু প্রকল্পে আবেদনের জন্য ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাসবুক (IFSC সহ), পাসপোর্ট সাইজ ছবি, আধার ও ব্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত মোবাইল নম্বর, জমির ROR / পাট্টা / খতিয়ান, কৃষক বন্ধু ফর্ম, ভাগচাষি হলে চুক্তি বা নথিভুক্তির প্রমাণ পত্র প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বন্ধু প্রকল্পে আবেদনের স্থান
Block অফিসে (কৃষি বা BDO অফিস), BLRO অফিসে, কৃষক বন্ধু পোর্টাল (অনলাইন আবেদন)-এ আবেদন করা যাবে।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পে আবেদন ফর্মে যা থাকে
এই প্রকল্পে আবেদন ফর্মে কৃষকের নাম, ঠিকানা, বয়স, ব্যাংক ডিটেইলস, জমি ও চাষ সংক্রান্ত তথ্য, নোমিনির নাম, স্ব-ঘোষণা/স্বাক্ষর করার কলাম থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষক বন্ধু প্রকল্পের মূল প্রাপ্তি
বার্ষিক আর্থিক সহায়তা (কৃষিকাজের জন্য) হিসেবে প্রত্যেক নথিভুক্ত কৃষক ১ একর বা তার বেশি চাষযোগ্য জমির ক্ষেত্রে বছরে 10,000 টাকা দুই কিস্তিতে (খারিফ ও রবি) পান। ১ একরের কম চাষযোগ্য জমির ক্ষেত্রে কৃষকরা বছর প্রতি ৪,০০০ টাকা আর্থিক সহায়তা পান। দুর্ঘটনাজনিত জীবন বীমা কভার হিসেবে কৃষিকাজের সময় মৃত্যু বা সম্পূর্ণ অক্ষমতার ক্ষেত্রে 2 লক্ষ পর্যন্ত সাহায্য। আংশিক অক্ষমতার ক্ষেত্রে 1 লক্ষ পর্যন্ত সহায়তা।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের প্রধান সুবিধা
(১) চাষের জন্য আর্থিক সহায়তা
প্রতি বছর ১০,০০০ টাকা (সাধারণত ২ কিস্তিতে) নথিভুক্ত কৃষকদের দেওয়া হয়। ক্ষুদ্র/প্রান্তিক কৃষকরা (১ একর পর্যন্ত) এবং অন্য কৃষকরাও সুবিধা পেয়ে থাকেন।
(২) মৃত্যু বা দুর্ঘটনা বিমা
কৃষকের মৃত্যু হলে (১৮–৬০ বছর) পরিবার ২,০০,০০০ টাকা সহায়তা পায়। আংশিক বা স্থায়ী অক্ষমতা হলেও ১,০০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত সুবিধা।
DBT মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংকে টাকা
সহায়তার টাকা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (Direct Benefit Transfer) ঢোকে। ফলে দালাল বা মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয় না।
প্রিমিয়াম সম্পূর্ণ সরকারি ভর্তুকি
এই প্রকল্পে কৃষকদের কোনো প্রিমিয়াম দিতে হয় না, পুরোটাই সরকার দেয়।
PM-Kisan ও কৃষক বন্ধু প্রকল্প
যারা PM-Kisan পান তারাও Krishak Bandhu পেতে পারেন, এটি আলাদা প্রকল্প। আবেদন করার পর সরকার নিজে যাচাই করে নাম অন্তর্ভুক্ত করে।
পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বন্ধু প্রকল্পে উপকৃত কৃষক
এই প্রকল্পের দ্বারা বর্তমানে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ৯০ লক্ষেরও বেশী কৃষক উপকৃত হয়েছেন।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পে ডেথ বেনিফিটের জন্য প্রয়োজনীয় নথি
মৃত কৃষকের পরিচয়ের ফটোকপি, মৃত কৃষকের মৃত্যু শংসাপত্রের ফটোকপি, BDO থেকে যোগ্য আবেদনকারীর শংসাপত্র, মৃত কৃষকের ROR, আবেদনকারীর নিজস্ব করা আবেদন ফর্ম।
পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বন্ধু প্রকল্পের আবেদন কিভাবে করবেন
দুয়ারে সরকার ক্যাম্প অথবা বি ডি ও অফিস থেকে কৃষক বন্ধু ফর্মটি সংগ্রহ করতে হবে। মূল আবেদনের ফর্মটির সাথে আরও দুটি জরুরী সংযোজিত ফর্ম পূরণ করতে হবে এবং উপরে উল্লিখিত নথিগুলির সাথে জমা করতে হবে।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুবিধা (Advantages)
(১) আর্থিক সহায়তা
কৃষকরা বছরে প্রায় ১০,০০০ টাকা সাহায্য পান, যা চাষের খরচ যেমন – বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদিতে ক্রয়ে কাজে লাগে।
(২) দুর্ঘটনা বিমা সুবিধা
কৃষকের (১৮–৬০ বছর) মৃত্যু হলে পরিবার ২ লক্ষ ক্ষতিপূরণ পায়। দুর্ঘটনায় স্থায়ী বা আংশিক অক্ষমতা হলেও ১–২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সহায়তা দেওয়া হয়।
(৩) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের অগ্রাধিকার
১ একর পর্যন্ত জমির মালিক কৃষকরাও সুবিধা পান, ফলে দরিদ্র কৃষকরা বেশি উপকৃত হন।
(৪) সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা (DBT)
মধ্যস্থতাকারীর ঝামেলা ছাড়াই অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা আসে, ফলে দুর্নীতির সম্ভাবনা কম।
(৫) দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে আবেদন সহজ
গ্রাম এলাকায় ক্যাম্পের মাধ্যমে আবেদন করা সহজ, ফলে কৃষকরা অফিসে না গিয়েও নথি জমা দিতে পারেন।
(৬) কৃষকের পরিবারকে সুরক্ষা
বিমা কভারেজ থাকার কারণে কৃষকের অনুপস্থিতিতে পরিবার আর্থিক সুরক্ষা পায়।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের অসুবিধা (Disadvantages)
(১) সহায়তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়
বড় জমি বা বেশি চাষ খরচের ক্ষেত্রে ১০,০০০ টাকা পর্যাপ্ত নয়, ফলে অনেক কৃষক পুরোপুরি উপকৃত হতে পারেন না।
(২) নথিভুক্তি ও যাচাইকরণে সময় লাগে
জমির পর্চা, কৃষক আইডি, তথ্য যাচাই ইত্যাদির কারণে টাকা পেতে দেরি হতে পারে।
(৩) সব কৃষক সচেতন নন
অনেক গ্রামীণ কৃষক প্রকল্প সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য জানেন না, ফলে আবেদন থেকে বঞ্চিত হন।
(৪) ডিজিটাল নির্ভরতা সমস্যা
অনলাইনে তথ্য আপডেট বা আবেদন করতে গিয়ে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য অনেকে অসুবিধায় পড়েন।
(৫) বিমা সুবিধা শুধু ৬০ বছর পর্যন্ত
৬০ বছরের বেশি কৃষকেরা বিমা (দুর্ঘটনা কভার) সুবিধা পান না, যা একটি সীমাবদ্ধতা।
(৬) জমির মালিকানা বাধ্যতামূলক
যেসব কৃষক ভাড়ায় বা বর্গায় চাষ করেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা জমির মালিকানা না থাকায় সুবিধা পেতে সমস্যা অনুভব করেন।
উপসংহার: কৃষক বন্ধু প্রকল্প বাংলার কৃষক সমাজের জীবনে এক সুদূরপ্রসারী ও মানবিক উদ্যোগ। এটি শুধু আর্থিক অনুদান নয়, বরং কৃষকের সংগ্রামমুখর জীবনকে নিরাপত্তা, সম্মান ও আত্মবিশ্বাসের দৃঢ় ভিত প্রদান করে। আজ যখন অনিশ্চয়তা কৃষকের নিত্য সঙ্গী, তখন কৃষক বন্ধু প্রকল্প হয়ে উঠেছে ভরসার হাত— যা দুঃসময়ে পরিবারকে রক্ষা করে, আর স্বপ্ন দেখায় নতুন সম্ভাবনার। কৃষকের কল্যাণ মানেই ফসলের বিকাশ, গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তি, আর সর্বোপরি বাংলার সমৃদ্ধি। কারণ –
“কৃষক হাসলে, মাঠ হাসে।
মাঠ হাসলে, বাংলা হাসে।”
তাই কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর নামই কৃষক বন্ধু, আর বাংলা এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সেই কৃষকরাই— যারা প্রতিদিন মাটির বুকে সোনার ফসল ফলান।
আরোও প্রকল্প
(FAQ) কৃষক বন্ধু প্রকল্প সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষক কল্যাণমূলক প্রকল্প, যার মাধ্যমে কৃষকদের চাষের জন্য বার্ষিক আর্থিক সহায়তা এবং কৃষকের অকালমৃত্যু হলে পরিবারকে এককালীন অনুদান দেওয়া হয়।
২০১৯ সালে প্রকল্পটি চালু করা হয়।
বছরে চাষের জন্য সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা নগদ সহায়তা (২ কিস্তিতে), ১৮–৬০ বছর বয়সী কৃষকের মৃত্যু হলে পরিবারকে ২,০০,০০০ টাকা আর্থিক সহায়তা, সুবিধা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে DBT পদ্ধতিতে পাঠানো হয়।
পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা, কৃষিকাজে যুক্ত ব্যক্তি, ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী কৃষক ছোট, প্রান্তিক, বর্গাদার, পাট্টাধারকসহ সব কৃষক আবেদন করতে পারেন।
না, কোনো ভেদ নেই। সব শ্রেণির কৃষক সুবিধা পেতে পারেন।
সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা দুই কিস্তিতে, সরাসরি কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে DBT (Direct Benefit Transfer) মাধ্যমে পাঠানো হয়।
মৃত কৃষকের বয়স ১৮–৬০ বছরের মধ্যে হতে হবে, তিনি কৃষক বন্ধু প্রকল্পের নথিভুক্ত সদস্য হওয়া আবশ্যক।
ব্লক কৃষি অফিসে (BAO), দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে, কৃষি সহায়ক / ব্লক স্তরের কৃষি আধিকারিকদের মাধ্যমেও আবেদন করা যায়।
আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক পাসবই (আকাউন্ট DBT সক্রিয় থাকতে হবে), কৃষিজমি সংক্রান্ত নথি (খতিয়ান/পাট্টা/বর্গা চুক্তি ইত্যাদি), বয়সের প্রমাণপত্র (যদি প্রযোজ্য হয়)।
হ্যাঁ, বর্গাদার, লিজ নেওয়া জমি, পাট্টা জমি বা শেয়ারক্রপার হিসেবে চাষ করলে-ও আবেদন করা যায়।
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে DBT ও NPCI ম্যাপিং সক্রিয় আছে কি না যাচাই করুন, ব্লক কৃষি অফিসে যোগাযোগ করুন, কৃষি সহায়কের সাহায্য নিন।
