লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন, পৃথক রাষ্ট্রের দাবি, প্রস্তাব সমর্থন ও পাশ, হিন্দু রাজ, পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি, মুসলিম লীগের জাতি চেতনা, পাকিস্তান প্রস্তাব, নামকরণের ইতিহাস, লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য, লাহোর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, নিন্দা প্রকাশ, গান্ধীর প্রতিক্রিয়া, ভারত বিভাগ, কংগ্রেসের চিরাচরিত নীতি, লীগের দিল্লী অধিবেশন পাকিস্তান দাবির নিন্দা সম্পর্কে জানবো।
মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০খ্রিস্টাব্দ)
ঐতিহাসিক ঘটনা | লাহোর প্রস্তাব |
লাহোর অধিবেশন | ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ |
সভাপতি | মহম্মদ আলি জিন্নাহ |
প্রস্তাব উত্থাপন | ফজলুল হক |
প্রস্তাব সমর্থন | চৌধুরী রহমৎ আলি |
প্রস্তাব পাশ | ২৪ মার্চ, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর কালে ভারতীয় রাজনীতি যখন জটিল রূপ ধারণ করেছে, সেই অবস্থার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জিন্না ও মুসলিম লীগ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-এ একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান।
লাহোর প্রস্তাব
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ -এর অধিবেশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক বিখ্যাত ‘লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
পৃথক রাষ্ট্রের দাবি
ফজলুলহক বলেন যে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম দু’টি জাতি আছে—দু’টি সম্প্রদায় নয়। জাতি হিসেবে তিনি মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি করেন।
লাহোর প্রস্তাব সমর্থন ও পাশ
উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জমান এই প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। ২৪শে মার্চ প্রস্তাবটি পাশ হয়।
হিন্দুরাজ
সভাপতির ভাষণে জিন্না হিন্দু-প্রধান সরকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে “হিন্দু রাজ’ (Hindu Raj) বলে অভিহিত করেন এবং ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলগুলির জন্য স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান।
পৃথক জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি
জিন্না বলেন যে, “ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি ও সুখ আনয়ন করতে হলে আমাদের সকলের কাছে যে পথ খোলা আছে তা হল ভারতকে বিভক্ত করে প্রধান জাতিগুলির জন্য স্বাধীন, জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি করা।”
রহমৎ আলির প্রস্তাব ও লাহোর প্রস্তাব
লাহোর প্রস্তাব বহুলাংশে রহমৎ আলির প্রস্তাবেরই সংশোধিত রূপ। ‘রহমৎ আলির প্রস্তাবে’ কেবলমাত্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের মুসলিম- প্রধান অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। অপরপক্ষে, ‘লাহোর প্রস্তাবে উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলিকেও পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়।
মুসলিম লীগের জাতি চেতনা
এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, ভূখণ্ড, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক পরম্পরা নিয়ে গঠিত জাতি চেতনা এবং মুসলিম লীগের জাতি-চেতনা এক নয়। ভাষা-সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতি-চেতনার বিকাশ স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক, কিন্তু ধর্মভিত্তিক ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বের’ দাবি অস্বাভাবিক ও বিভেদমূলক।
পাকিস্তান প্রস্তাব
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর অধিবেশনে উত্থাপিত পৃথক রাষ্ট্রের এই প্রস্তাবটি ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামেই পরিচিত এবং এই অধিবেশনের কার্যবিবরণীতেও তা ‘লাহোর প্রস্তাব’ হিসেবেই উল্লিখিত আছে। এই প্রস্তাবের কোথাও ‘পাকিস্তান‘ শব্দের উল্লেখ নেই—যদিও পরবর্তীকালে এই প্রস্তাবটি ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামেই পরিচিত হয়।
পাকিস্তান প্রস্তাব নামকরণের ইতিহাস
এই পাকিস্তান নামকরণের একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। তা হল –
- (১) ডঃ অমলেন্দু দে বলেন যে, এই প্রস্তাবটি গৃহীত হবার পর বিভিন্ন হিন্দু ও জাতীয়তাবাদী পত্রিকায় এই প্রস্তাবটিকে বারংবার ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করায় কালক্রমে তা ‘পাকিস্তান প্রস্তাবে’ রূপান্তরিত হয়।
- (২) জিন্না একে ‘লাহোর প্রস্তাব’-ই বলতেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর তিনি সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ কথাটি ব্যবহার করেন এবং তারপর থেকে এটি ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত হতে থাকে।
- (৩) জিন্না বলেন যে, “পাকিস্তান শব্দ আমরা চালু করি নি। হিন্দুরাই এই শব্দটি আমাদের উপহার দিয়েছে।”ডঃ সুমিত সরকার বলেন যে, হিন্দু নেতা ও সংবাদপত্রগুলি পাকিস্তান, পাকিস্তান বলে সমালোচনার চিৎকার তুলে প্রস্তাবটিকে পাকিস্তান প্রস্তাবে পরিণত করেছে।
- (৪) ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটি নেই, দেশভাগের কথাও নেই এবং প্রস্তাবটি অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী। বস্তুত এই প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দ বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের নাম বা সীমানা কিছুরই উল্লেখ ছিল না।
- (৫) এই সবই করা হয় উত্তরপ্রদেশের মুসলিমদের ধোঁকা দেবার জন্য। পরিকল্পিত ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরপ্রদেশের নাম ছিল না, কিন্তু উত্তরপ্রদেশ ছিল জিন্না ও লীগের প্রধান ঘাঁটি।
- (৬) ডঃ আয়েষা জালাল বলেন যে, লাহোর প্রস্তাবের অস্পষ্টতা আসলে ছিল দর-কষাকষির হাতিয়ার।
লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য
ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করার জন্য অন্তত ছ’টি পরিকল্পনা লীগ- নেতৃত্বের কাছে উপস্থাপিত হয়। নানা দিক থেকে লাহোর পরিকল্পনা ছিল তাৎপর্য মণ্ডিত। যেমন–
(১) পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি
এতদিন পর্যন্ত মুসলিম লীগ পৃথক নির্বাচন, মুসলিমদের জন্য অধিকতর আসন সংরক্ষণ এবং সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের জন্য অধিকতর সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছিল। লাহোর প্রস্তাবেই সর্ব প্রথম এই সব কিছু দাবি বাদ দিয়ে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি করা হয়।
(২) সাম্প্রদায়িক ইন্ধন
মুসলিম লীগের পৃথক রাষ্ট্রের দাবি সাম্প্রদায়িকতা ও ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবে ইন্ধন জোগায়। মুসলিম সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে হিন্দু-বিদ্বেষ তীব্রতর হয়ে ওঠে। এরপর থেকে জিন্না প্রায়ই বলতে থাকেন যে, ভারতীয় সমস্যার একমাত্র সমাধান হল ভারত বিভাগ।
লাহোর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া
মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন –
(১) নিন্দা প্রকাশ
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, গান্ধীজি, হিন্দু সংবাদপত্র ও জনসাধারণ তীব্র ভাষায় এই প্রস্তাবের নিন্দা করতে থাকেন, কিন্তু এ সম্পর্কে তাঁদের কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব বা পারস্পরিক বোঝাপড়ার কোনো উদ্যোগ ছিল না।
(২) মহাত্মা গান্ধির প্রতিক্রিয়া
গান্ধীজি এই প্রস্তাবকে ‘ভারতের অঙ্গচ্ছেদের জন্য তৎপরতা’ বলে অভিহিত করে ভারতীয় মুসলিম সমাজকে ‘কল্যাণবোধ ও স্বার্থের’ খাতিরে ‘প্রত্যক্ষগোচর আত্মহত্যার’ প্রয়াস থেকে নিবৃত্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
(৩) ভারত বিভাগ ও বিরামহীন গৃহযুদ্ধ
২৬ শে মার্চ ‘স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকা লেখে যে, “আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ভারত বিভাগ এখন সজীব ‘ইস্যু’ হতে চলেছে।” ভারত সচিব বড়লাটকে লিখছেন যে, “পাকিস্তানের অর্থ হল ভারতে বিরামহীন গৃহযুদ্ধ।”
(৪) কংগ্রেসের চিরাচরিত নীতি
মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কংগ্রেস তার চিরাচরিত নীতি অনুসারে কয়েকজন মুসলিমকে তুলে ধরতে থাকে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
(৫) লীগের দিল্লী অধিবেশন
মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনের এক মাস পরে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘সর্বভারতীয় স্বাধীন মুসলিম অধিবেশন’-এ সিন্ধুপ্রদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আলাবক্স সভাপতিত্ব করেন।
(৬) দাবির নিন্দা
এই অধিবেশনে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র স্থাপনের দাবির নিন্দা করা হয় এবং বলা হয় যে, মুসলিম লীগ কখনই ভারতীয় মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি নয়।
উপসংহার:- মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনের পাশে দিল্লীর এই অধিবেশন ছিল নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। এ ছাড়া, মুসলিম লীগ ব্যতীত আরও যে দু-একটি মুসলিম সংগঠন ছিল, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় জীবনে তাদের কোনো গুরুত্ব ছিল না।
(FAQ) লাহোর প্রস্তাব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে।
মহম্মদ আলি জিন্নাহ।
ফজলুল হক।
চৌধুরী রহমত আলি।
২৪ মার্চ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে।
পাকিস্তান প্রস্তাব।