একজন বিখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ পিয়ের-সিমন লাপলাস (Pierre-Simon Laplace) ১৮-শতকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি মহাবিশ্বের গঠন এবং সৃষ্টির পেছনে পদার্থবিজ্ঞানী সূত্রাবলী প্রয়োগ করার জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে লাপলাসের কাজগুলির মধ্যে গ্রাভিটেশন তত্ত্বের বিকাশ, গাণিতিক সম্ভাবনার ভিত্তি স্থাপন এবং “লাপলাস ট্রান্সফর্ম” আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য। তাঁর বই “মেকানিক্যাল সিস্টেম অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের অগ্রগতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
মার্কুইস পিয়ের সাইমন দ্য লাপলাস
ঐতিহাসিক চরিত্র | পিয়ের লাপলাস |
পুরো নাম | মার্কুইস পিয়ের সাইমন দ্য লাপলাস |
জন্ম | ২৩ মার্চ ১৭৪৯ খ্রি, বোমন্ত-এন-অগ, ফ্রান্স |
পেশা | গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী |
প্রধান কাজ | মহাকর্ষ, সম্ভাব্যতা তত্ত্ব, স্থিতিস্থাপকতা |
লাপলাসের সমীকরণ | ভৌত বিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত আংশিক পার্থক্য সমীকরণ |
লাপলাস ট্রান্সফর্ম | ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সফর্ম |
উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা | ‘Traite de Mecanique Celeste’ (মহাকাশযান্ত্রিক তত্ত্ব), ‘Theorie analytique des probabilites’ |
উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব | লাপলাসের ডেমন (Laplace’s Demon) – ডিটারমিনিস্টিক মহাবিশ্ব ধারণা |
সম্মাননা | ফরাসি একাডেমির সদস্য, লিজিয়ন অফ অনার |
মৃত্যু | ৫ মার্চ ১৮২৭, প্যারিস, ফ্রান্স |
ভূমিকা :- বিশ্ব-গণিত ইতিহাসে এক দ্যুতিময় প্রতিভার নাম পিয়ের লাপলাস। সম্পূর্ণভাবে লিখতে গেলে তাঁর নাম দাঁড়ায় এরকম, মার্কুইস পিয়ের সাইমন দ্য লাপলাস। পিয়ের-সিমন লাপলাস (Pierre-Simon Laplace) ছিলেন ১৮শ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ফরাসি গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ। তাঁর কাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান, সম্ভাবনা তত্ত্ব, এবং পদার্থবিজ্ঞানে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তিনি নিউটন-এর গতি ও মহাকর্ষ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গ্রহগুলির গতি এবং সৌরজগতের স্থিতিশীলতা সম্পর্কে মূল্যবান বিশ্লেষণ প্রদান করেন। লাপলাসের উন্নত গণিত, বিশেষত লাপলাস ট্রান্সফর্ম, প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাঁর দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য দিকনির্দেশক হয়ে ওঠে।
পিয়ের লাপলাসের জন্ম
১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে মার্চ নর্মান্ডির বিমঁত নামের ছোট্ট শহরে অতি সাধারণ এক পরিবারে অঙ্কবিজ্ঞানী লাপলাসের জন্ম।
বিজ্ঞানী পিয়ের লাপলাসের পরিবার
সামান্য কিছু জমির আয়েই প্রতিপালিত হত তাঁদের পরিবারটি। ফলে নিত্য অভাব ছিল বাঁধা নিয়মের মধ্যে। তাই ছেলেবেলায় লাপলাসের লেখাপড়া বাধার মধ্য দিয়েই এগিয়েছিল।
পিয়ের লাপলাসের শিক্ষা
অসাধারণ মেধা এবং অঙ্কের প্রতি আকর্ষণ ছিল তাঁর সহজাত। গরীব ছেলেটির পড়াশুনা যাতে বন্ধ হয়ে না যায় তার জন্য সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন সহৃদয় আত্মীয়স্বজনেরা। তাঁরাই ভার নেন লাপলাসের লেখাপড়ার। মাত্র ১৮ বছর বয়সে কায়েন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাপলাস স্নাতক হন।
শিক্ষকতার কাজে পিয়ের লাপলাস
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিমঁতের সামরিক স্কুলে শিক্ষকতার কাজও পেয়ে যান। স্কুলে লাপলাস ছাত্রদের পড়াতেন অঙ্ক ও বিজ্ঞান। ছেলেদের পড়ানোর পাশাপাশি গবেষণার কাজও শুরু করেন। স্বপ্ন দেখেন বড় বিজ্ঞানী হওয়ার। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সুযোগ্য শিক্ষক হিসেবে বিমঁত শহরে লাপলাসের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা মুগ্ধ হয় তাঁর অতি কঠিন বিষয়ও অতি সরল সহজবোধ্য ভাবে বোঝাবার কায়দায়।
প্যারিসে পিয়ের লাপলাস
সামরিক বিদ্যালয়ে বেশি দিন কাজ করতে পারেন নি লাপলাস। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে এক সময় নিয়ে এল প্যারিসে। সেইকালে প্যারিস ছিল ইউরোপের জ্ঞান- বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পাদপীঠ। গণিতের সুখ্যাত পন্ডিত দ্য আলেমবাৎ বাস করতেন সেখানে। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে লাপলাস গণিতের উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে প্যারিসে এলেন আলেমবাতের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। এখানে বলবিদ্যার কিছু গাণিতিক সূত্রের মধ্যস্থতায় অতি নাটকীয়ভাবে আলেমবাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল উত্তরকালের বিশ্বগণিতের অন্যতম মনীষীর। লাপলাস পেলেন গভীরতর গবেষণার সুযোগ। প্রথম সাফল্যই লাপলাসকে বিজ্ঞানীমহলে পরিচিত করে তুলল। তাঁর এই কাজটি ছিল সৌরবলবিদ্যার গাণিতিক প্রয়োগ।
নক্ষত্রদের চ্যুতির কারণ সম্পর্কে পিয়ের লাপলাসের গবেষণা
সেই সময়ে নিউটন সহ অন্যান্য পদার্থ বিজ্ঞানীরা কক্ষ থেকে নক্ষত্রদের চ্যুতির কারণ অনুসন্ধানের কাজে হিমসিম খাচ্ছিলেন। অঙ্ক নির্দেশিত সৌরপথ থেকে বৃহস্পতি বা শনি এই দুই গ্রহ কখনো খানিকটা এগিয়ে আবার কখনো বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকে। পদার্থ বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় বিষয়টির কোনো ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না। সৌরজগতের এমনি নানা রহস্যেরই কূলকিনারা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যাকে সমাধান করার জন্য লাপলাস দাঁড় করালেন এক তত্ত্ব। বলাবাহুল্য, গাণিতিক পথেই তিনি তা করলেন। তিনি দেখালেন, সৌরপথে নক্ষত্রদের এই চ্যুতি বা অপসরণ কোন নতুন ঘটনা নয়। যুগ যুগ ধরে একই অবস্থা চলছে। নক্ষত্ররা ঘুরে ফিরে নিজেরাই নিজেদের ভারসাম্য ঠিক রেখে চলেছে। এই বিচ্যুতি কখনোই মহাশূন্যে কোন বিপর্যয়ের কারণ ঘটাবে না। লাপলাসের এই তত্ত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন দ্বার উন্মুক্ত করল।
আবর্তনশীল তরলের ভরের সাম্য সম্পর্কে পিয়ের লাপলাসের তত্ত্ব
এরপরে তিনি নতুন গবেষণা আরম্ভ করলেন মহাবিশ্ব ও মহাপ্রকৃতির মৌলশক্তিগুলির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে। এই সময়েই বিভিন্ন সৌর ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিরে একের পর এক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন লাপলাস। তাঁর আলোচিত বিষয়গুলো ছিল-নদীর জলের জোয়ার ভাঁটা, মহাকর্ষ বল, প্রক্ষিপ্ত বস্তুর গতি, শনিমন্ডলের গঠন ও আবর্তন প্রভৃতি। এই সময়েই তিনি আবর্তনশীল তরলের ভরের সাম্য অবস্থার ওপরে এক নতুন তত্ত্ব দাঁড় করালেন।
বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ারের সাথে পিয়ের লাপলাসের গবেষণা
লাগলাসের নিবিড় গবেষণার কাজ চলছিল প্যারিসের বিজ্ঞান আকাদেমিতে। এখানে তিনি রসায়ন বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ারের সঙ্গেও কাজ করেছেন। তাঁদের দুজনের মিলিত গবেষণার দ্বারা বিভিন্ন বস্তুর আপেক্ষিক তাপ ও দহনের ওপরে নানা বৈজ্ঞানিক তথ্য আহৃত হয়।
তাপীয় গতিবিদ্যা সম্পর্কে পিয়ের লাপলাসের গবেষণা
আধুনিক থার্মোডাইনামিক্স বা তাপীয় গতিবিদ্যা বিষয়ের লাপলাসই প্রথম সূত্রপাত করেছিলেন। আইসক্যালোমিটার নামে একটি নতুন যন্ত্র তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন। বরফের তাপ পরিমাপক এই যন্ত্রের সাহায্যে কোন বস্তুর আপেক্ষিক তাপ নিরূপণ করা সম্ভব হয়।
পিয়ের লাপলাসের সমীকরণ
এই সময়ে নানা বিষয়ের ওপরে পর পর গবেষণা করতে থাকেন লাপলাস। অবিচ্ছিন্ন গতিযুক্ত কোনও ভৌত পদার্থের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বিভবকে গণনা করার জন্য তিনি যে সমীকরণ তৈরি করেন, তাঁর নামেই সেই সমীকরণের নামকরণ করা হয়। কেবল অভিকর্ষ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁর উদ্ভাবিত সমীকরণটি বর্তমানে তড়িৎবিজ্ঞান, উদগতিবিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞানের নানা শাখাতেও ব্যবহার করা হয়।
বিজ্ঞানী কান্টের মতকে পিয়ের লাপলাসের সমর্থন
কান্ট নামে এক বিজ্ঞানী নির্ণয় করেছিলেন, মহাকাশের নীহারীকাপুঞ্জ অথবা সদাআবর্তনশীল গ্যাসের মধ্য থেকেই এই মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়েছে। তাঁর মতে প্রথম অবস্থায় এই গ্যাস ছিল প্রচন্ড উত্তপ্ত। সময়ের গতির সঙ্গে গ্যাস উত্তাপ হারিয়ে যখন শীতলতা প্রাপ্ত হতে থাকে তখনই তার কেন্দ্রের পাথর ও নানান গলিত ধাতব গ্যাসীয় মন্ডল থেকে বাইরে ছিটকে পড়ে। কোটি কোটি বছর ধরে ঠান্ডা হয়ে জমাট বাঁধে। এইভাবেই সৃষ্টি হয়েছে সৌর জগতের গ্রহ নক্ষত্রদের। লাপলাস কান্টের এই মতকে সমর্থন করেন এবং নিজ গবেষণা দ্বারা পুষ্ট করে তোলেন। মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদের চূড়ান্ত মীমাংসা আজও পর্যন্ত হয় নি। বিশ্বের নানা প্রান্তেই বিষয়টি নিয়ে চলেছে গভীর গবেষণা। এই গবেষণার একমাত্র প্রমাণসূত্র হিসেবে কান্ট ও লাপলাসের ব্যাখ্যাকেই স্বীকার করা হয়ে থাকে।
পিয়ের লাপলাসের গ্রন্থ
১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে লাপলাসের জ্যোর্তিবিজ্ঞানের নানা গবেষণা ফ্রান্সের বিজ্ঞান আকাদেমির নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই লেখাগুলোই একত্রিত করে পরে তিনি পাঁচটি সুবৃহৎ খন্ডে প্রকাশ করেন। গ্রন্থের নামকরণ করেন Mecanique Celestic বা জ্যোতির্বলবিদ্যা। গ্রন্থের বিভিন্ন খন্ডে লাপলাস বিধৃত করেছেন জ্যোতির্বলবিদ্যার ধারাবাহিক ইতিহাস সহ বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সৌরবিজ্ঞান ও বলবিদ্যার নানা সমস্যার সমাধান। পদার্থবিজ্ঞানকে সর্বসাধারণের বোধগম্য করার উদ্দেশ্যে লাপলাস তাঁর বইতে ব্যবহার করেছেন সহজ সরল ভাষা। ফলে তাঁর গ্রন্থ লাভ করেছিল অসাধারণ জনপ্রিয়তা। উৎসাহিত হয়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের ব্যাখ্যা করে দ্বিতীয় একটি বই প্রকাশ করেন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় লাপলাসের তৃতীয় গ্রন্থ থিওরি অ্যানালিটিক দেস প্রবাবিলিটিস। এই গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সূত্রের সম্ভাবনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পিয়ের লাপলাস বিজ্ঞানী হিসাবে
বিজ্ঞানী হিসাবে বহু মহৎ আবিষ্কারেরই জনক ছিলেন লাপলাস। তাঁর নানা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তরুণ বিজ্ঞানীদের সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন প্রচুর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, এইসব বিজ্ঞানীদের কারো প্রতিই সামান্যতম কৃতজ্ঞতাও তিনি তাঁর গ্রন্থে কোথাও করেন নি। সার্থক গবেষণাগুলির সূত্র বা উৎস সম্পর্কেও তিনি কোনো আভাস রাখেন নি।
মার্কুইস পিয়ের লাপলাস ব্যক্তিজীবনে
ব্যক্তি হিসেবে বিচার করলে এই মনীষী সম্পর্কে একটি অপ্রিয় মন্তব্য করতে হয়, লাপলাস ছিলেন চূড়ান্ত সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর মানুষ। নিজের কাজের সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য তিনি সমকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক তন্ত্রের সমর্থন করে গেছেন বরাবর।
রাজনীতি বিষয়ে পিয়ের লাপলাস
- (১) ফরাসী বিপ্লবের কালে দেশে ঘন ঘন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। যখন যে নায়ক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন লাপলাস নির্বিচারে তারই সমর্থন করে গেছেন। এ ব্যাপারে কোনরকম রাখঢাক ছিল না তাঁর। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব কালে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন সম্রাট ষোড়শ লুই ও রানী আঁতোয়ানেৎ। রাজতন্ত্রের বদলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হল বিপ্লবী সরকার। আর এই সরকারেরই অধীন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন লাপলাস। এই সময়ে বিপ্লবীদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা ও পদোন্নতি আদায় করেছিলেন তিনি।
- (২) এর পরেই নেপোলিয়ন-এর যখন উত্থান ঘটল, সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার পূজারী লাপলাস রাতারাতি হয়ে গেলেন রাজতন্ত্রের একান্ত অনুগত। তাঁর চাটুকারিতা কতদূর পৌঁছেছিল বোঝা যায়, যখন দেখি তিনি তাঁর একটি গবেষণা গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন নেপোলিয়নের নামে।
- (৩) নেপোলিয়নের পতন-এর পর ফ্রান্সের রাজাসনের দখল নেয় বুর্বো বংশের রাজারা। লাপলাসের নেপোলিয়ন ভক্তিও সঙ্গে সঙ্গে উবে গেল। তিনি শুরু করলেন নেপোলিয়নের সমালোচনা এবং তোষামোদ শুরু করলেন বুর্বো বংশের রাজাদের। এই অন্ধ রাজভক্তিরই পরিণাম তাঁর মার্কুইস উপাধি লাভ।
- (৪) এই ভাবেই নিজের ব্যক্তিত্বকে বারবার খর্ব করেছেন লাপলাস। নিজের সুযোগ সুবিধা লাভই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। বস্তুতঃ তিনি ছিলেন এক আদর্শহীন বিজ্ঞানী। অপরদিকে নিজের মনীষাকে তিনি নিয়োগ করেছিলেন বিজ্ঞানের সেবায় যা মানববিজ্ঞানের ইতিহাসকে করেছে উজ্জীবিত। একই সত্তার এই দ্বৈতরূপ আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে।
বিজ্ঞানী পিয়ের লাপলাসের অক্লান্ত নিষ্ঠা
অক্লান্ত নিষ্ঠায় নিজেকে বিজ্ঞানসাধনায় নিয়োজিত রেখেছিলেন লাপলাস। শেষ জীবনে তিনি বসবাস করেছেন আতুল শহরে। দেশবিদেশের বিজ্ঞানীরা এখানেই আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তরুণ বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজে সাহায্য সহযোগিতা করতে তিনি কখনো কার্পণ্য করেন নি। এতেই বোঝা যায় বিজ্ঞান সাধনার প্রতি তাঁর আন্তরিক আকর্ষণ ছিল কত গভীর।
পিয়ের লাপলাসের মৃত্যু
দীর্ঘ জীবনকাল পেয়েছিলেন লাপলাস। আটাত্তর বছর বয়সে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে আর্কুল শহরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার :- পিয়ের-সিমন লাপলাস ছিলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর গ্রাভিটেশন তত্ত্ব, লাপলাস ট্রান্সফর্ম এবং সম্ভাবনা তত্ত্ব বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। লাপলাসের কাজগুলি শুধু তত্ত্বগত বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়; তাঁর গবেষণা বাস্তব জীবন এবং প্রকৌশলে বিপুল প্রভাব ফেলেছে। তাঁর চিন্তাধারা এবং বৈজ্ঞানিক অবদান আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লাপলাসকে প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের অগ্রগতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি নিউটনের কাজকে আরও প্রসারিত করেছেন এবং মহাবিশ্বের গতিবিধির ওপর আমাদের বোধগম্যতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন।
(FAQ) মার্কুইস পিয়ের সাইমন দ্য লাপলাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
পিয়ের লাপলাসের প্রধান অবদানগুলির মধ্যে অন্যতম হলো “লাপলাস ট্রান্সফর্ম”, গ্রাভিটেশন তত্ত্বের বিকাশ, এবং সম্ভাবনা তত্ত্বে গাণিতিক ভিত্তি স্থাপন।
লাপলাস ট্রান্সফর্ম একটি গাণিতিক পদ্ধতি যা সময় ডোমেইন থেকে ফ্রিকোয়েন্সি ডোমেইনে ফাংশনকে রূপান্তরিত করে, যা প্রকৌশল এবং পদার্থবিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
পিয়ের লাপলাস মহাবিশ্বের গঠন এবং সৃষ্টির ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য পদার্থবিজ্ঞানী সূত্রাবলী প্রয়োগ করেছেন। তিনি গ্রহগুলোর গতিবিধি এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্রাভিটেশন তত্ত্বে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনেছেন।
Mecanique Celeste বইটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে লেখা, যেখানে মহাবিশ্বের গাণিতিক ব্যাখ্যা এবং গ্রহগুলোর গতিবিধি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
লাপলাসের দানাবাদ তত্ত্ব হল মহাবিশ্বের গঠন এবং গ্রহগুলোর গতিবিধির ব্যাখ্যা, যেখানে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে মহাবিশ্বের সবকিছু বৈজ্ঞানিক সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।