বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ -র পিতা, প্রকৃত নাম, উড়িষ্যা গমন, আলীবর্দী খাঁ উপাধি লাভ, বিহারের সহকারী শাসনকর্তা, সিংহাসন লাভের ষড়যন্ত্র, বাংলার মসনদ দখল, রাজত্বকাল, তার সমস্যা, মারাঠা আক্রমণ, মারাঠাদের সাথে সন্ধি, বাংলায় মারাঠা আক্রমণের প্রভাব, ইংরেজ বণিকদের সাথে বিরোধ, যোগ্য প্রশাসক, রাজস্ব আদায়ে উদারতা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
নবাব আলিবর্দি খাঁ প্রসঙ্গে আলিবর্দি খাঁর প্রকৃত নাম, আলিবর্দি খাঁর বাংলার মসনদ দখল, নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্বকাল, আলিবর্দি খাঁর সমস্যা, মারাঠাদের সাথে আলিবর্দি খাঁর সন্ধি, বাংলায় মারাঠা আক্রমণের প্রভাব, আলিবর্দি খাঁর পূর্বসূরি মুর্শিদ কুলি খাঁ, যোগ্য প্রশাসক আলিবর্দি খাঁ, আলিবর্দি খাঁর রাজস্ব আদায়ে উদারতা, আলিবর্দি খাঁর ধর্মীয় উদারতা, আলিবর্দি খাঁর মৃত্যু ও সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন লাভ।
নবাব আলিবর্দি খাঁ (১৭৪০-৫৬ খ্রিঃ)
ঐতিহাসিক চরিত্র | আলিবর্দি খাঁ |
জন্ম | ১০ মে, ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দ |
পরিচিতি | বাংলার নবাব |
রাজত্বকাল | ১৭৪০-১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ |
পূর্বসূরি | সরফরাজ খান |
উত্তরসূরি | সিরাজদ্দৌলা |
মৃত্যু | ৯ এপ্রিল, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকে যে সব বিদেশি ভাগ্যান্বেষী ভারত ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে আলিবর্দি খাঁ অন্যতম।
নবাব আলিবর্দি খাঁর পিতা
আলিবর্দি খাঁ-র পিতা আরব বংশীয় মির্জা মহম্মদ কিছুদিন ঔরঙ্গজেব -এর পুত্র আজম শাহের অধীনে সামান্য কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র হাজি আহম্মদ ও মির্জা মহম্মদ আলি-ও আজম শাহের অধীনে চাকুরি করতেন।
নবাব আলিবর্দি খাঁর প্রকৃত নাম
আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী
নবাব আলিবর্দি খাঁর উড়িষ্যা গমন
১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল রাজপরিবারে যে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে আজমের মৃত্যু ঘটে। এই সময় হাজি আহম্মদ ও তাঁর অনুজ মির্জা মহম্মদ আলি ভাগ্যান্বেষণে উড়িষ্যায় যান এবং সেখানে ‘নায়েব-নাজিম’ সুজাউদ্দিনের অধীনে চাকুরিতে নিযুক্ত হন।
আলিবর্দি খাঁ উপাধি লাভ
বাংলার মসনদ দখলের সময় এই দুই ভাই সুজাউদ্দিনকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। বাংলার সিংহাসনে বসে সুজাউদ্দিন কনিষ্ঠ ভ্রাতা মির্জা মহম্মদ আলিকে আকবরনগরের’ফৌজদার’ নিযুক্ত করেনতাঁকে ‘আলিবর্দি খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
বিহারের সহকারী শাসনকর্তা আলিবর্দি খাঁ
১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার বাংলার সঙ্গে যুক্ত হলে আলিবর্দি খাঁ বিহারের ‘নায়েব নাজিম’ বা সহকারী শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এই সময় বিহারের বিদ্রোহী জমিদারদের কঠোর হস্তে দমন করে তিনি বিহারে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন।
আলিবর্দি খাঁর সিংহাসন লাভের ষড়যন্ত্র
সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর (১৭৩৯ খ্রিঃ) সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে বসলে অচিরেই তাঁর অপদার্থতা জনসমক্ষে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলিবর্দি খাঁ ও হাজি আহম্মদনবাবকে উৎখাত করে সিংহাসন দখলের জন্য এক ষড়যন্ত্রে অবতীর্ণ হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আলমচাদ, জগৎ শেঠ প্রমুখ অভিজাতরা।
আলিবর্দি খাঁ কর্তৃক বাংলার মসনদ দখল
শেষ পর্যন্ত ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে নবাবকে পরাজিত করে আলিবর্দি খাঁ বাংলার মসনদ দখল করেন। ইতিপূর্বে অবশ্য দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে ‘সুবাদারি’ সনদ আনা হয়েছিল।
নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্বকাল
১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলার নবাব ছিলেন।
আলিবর্দি খাঁর সমস্যা
নবাব আলিবর্দি খাঁ-র শাসনকাল একেবারে শান্তিপূর্ণ ছিল না। তাঁকে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন –
(ক) রুস্তম জঙ্গের বিদ্রোহ
- (১) আলিবর্দির সিংহাসনারোহণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানান পূর্বতন নবাব সুজাউদ্দিনের জামাতা ও উড়িষ্যার সহকারী শাসনকর্তা রুস্তম জঙ্গ (দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি নামেও পরিচিত)।
- (২) বাংলার মসনদ দখলের জন্য তিনি মুর্শিদাবাদ -এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বালেশ্বরের সন্নিকটে আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
(খ) মারাঠা আক্রমণ
- (১) আলিবর্দির আমলের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল বাংলার ওপর মারাঠা আক্রমণ। ১৭৪২ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর মারাঠারা বাংলার ওপর আক্রমণ হেনে ব্যাপক লুন্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালাত।
- (২) মারাঠাদের আক্রমণে বাংলার সমাজ ও অর্থনীতি একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরের মারাঠা নায়ক রঘুজি ভোঁসলে-র সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত-এর নেতৃত্বে মারাঠারা উড়িষ্যার ভেতর দিয়ে এসে বর্ধমান -এর কাটোয়া হয়ে মুর্শিদাবাদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং মুর্শিদাবাদের ধনকুবের জগৎ শেঠের কোষাগার লুন্ঠন করে।
- (৩) কাটোয়া ছিল তাদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি এবং এখানে তারা একজন ফৌজদার নিয়োগ করে। তারা প্রতি বছর বাংলার ওপর আক্রমণ হানত এবং ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যা ও গৃহে অগ্নিসংযোগ করত। তাদের অত্যাচার সারা দেশে এক ত্রাসের সৃষ্টি করে।
- (৪) ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দি খাঁ মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতকে এক ভোজসভায় ডেকে এনে প্রতারণার মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করেন। এতেও কিন্তু মারাঠা আক্রমণ বন্ধ হয় নি।
মারাঠাদের সাথে আলিবর্দি খাঁর সন্ধি
শেষ পর্যন্ত আলিবর্দি খাঁ ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের সঙ্গে এক সন্ধি করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। সন্ধির শর্ত হিসেবে,
- (১) উড়িষ্যার ওপর রঘুজি ভোঁসলের প্রভুত্ব স্বীকৃত হয়।
- (২) আলিবর্দি খাঁ রঘুজিকে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা ‘চৌথ’ দিতে স্বীকৃত হন এবং
- (৩) রঘুজি ভবিষ্যতে বাংলার ওপর আক্রমণ হানবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
আলিবর্দি খাঁর আমলে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের প্রভাব
মারাঠা আক্রমণ বাংলার সমাজ ও অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যেমন –
- (১) উড়িষ্যা ও বাংলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষরা প্রাণের তাগিদে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করলে, এই সব অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে। কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়।
- (২)আক্রমণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ধনবানদের অনেকেই কলকাতায় ইংরেজদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।এর ফলে কলকাতা নগরীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
আলিবর্দি খাঁর আমলে মুর্শিদ খুলি খানের নীতি পুনরায় শুরু
মসনদ লাভ করে তিনি মুর্শিদ কুলি খান -এর নীতি পুনরায় শুরু করেন। তিনি পাটনা, দাক্কা এবং ওড়িশার মতো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফৌজদারদেরও বেছে নিয়েছিলেন।
ইংরেজ বণিকদের সাথে আলিবর্দি খাঁর বিরোধ
মুঘল সম্রাট কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করত। বিভিন্ন কারণে এই ইংরেজ বণিকদের সাথে নবাবের বিরোধ শুরু হয়।
যোগ্য প্রশাসক আলিবর্দি খাঁ
যোগ্য প্রশাসক ও প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে আলিবর্দি খাঁ স্মরণীয় হয়ে আছেন। সমকালীন ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মারাঠা আক্রমণ বিধ্বস্ত বাংলার পুনর্গঠনে তিনি বিশেষ যত্নবান হন।
রাজস্ব আদায়ে আলিবর্দি খাঁর উদারতা
কৃষকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থাকরেন। রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট উদারতা প্রদর্শন করেন।
আলিবর্দি খাঁর ধর্মীয় উদারতা
রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তিনি কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ করতেন না। জানকীরাম, দুর্লভরাম, রামনারায়ণ, উমিদ রায় প্রমুখ হিন্দু কর্মচারীরা তাঁর শাসনব্যবস্থায়উল্লেখযোগ্য ছিলেন।
নবাব আলিবর্দি খাঁর মৃত্যু
দীর্ঘদিন যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকার দরুন আলীবর্দীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তিনি মুর্শিদাবাদে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের খোশবাগে তার সমাধি অবস্থিত।
সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন লাভ
আলিবর্দি খাঁর মৃত্যুর পর তার মেয়ে আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজদ্দৌলা বাংলার মসনদে আরোহণ করেন।
উপসংহার :- একজন অসমসাহসী ও রণনিপুণ সেনাপতি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন এবং কর্মদক্ষ ও দূরদর্শী শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “আলিবর্দি খাঁ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই sikshalay.co.in ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মির্জা মুহম্মদ আলী।
৯ এপ্রিল, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
সিরাজদ্দৌলা।