২০২৫ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ সিলেবাসের সাজেশন্ ভিত্তিক পিডিএফ নোটস্ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করুণ (দাম প্রতি ক্লাস ৯৯ টাকা)।

👉Chat on WhatsApp

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

একজন বিশিষ্ট বাঙালি প্রকৌশলী ও শিল্পপতি ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৫৪–১৯৩৬)। তিনি ভারতের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারদের অন্যতম এবং বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে আইআইইএসটি শিবপুর) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজেন্দ্রনাথ টাটা স্টিল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে তিনি কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট এবং ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তাঁর নেতৃত্বে নানা প্রকৌশল প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়।

Table of Contents

প্রকৌশলী রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

ঐতিহাসিক চরিত্ররাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
জন্ম২৩ জুন ১৮৫৪ খ্রি
জন্মস্থানকলকাতা, ব্রিটিশ ভারত
পেশাপ্রকৌশলী, শিল্পপতি
উল্লেখযোগ্য ভূমিকাটাটা স্টিল প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে সহযোগিতা
গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে, কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট
অবদানভারতীয় প্রকৌশল ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক
সম্মাননাব্রিটিশ সরকার থেকে রায়বাহাদুর উপাধি
মৃত্যু১৫ মে ১৯৩৬ খ্রি

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

ভূমিকা :- যে সকল বাঙালী মনীষীর কঠোর জীবনসাধনা ও গৌরবময় কর্মকৃতিত্বে বাঙালী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কর্মবীর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। স্বজাতির কীর্তিমান পুরুষদের জীবন-সাধনা কর্মকৃতিত্ব হল পরশমণির মতো। উত্তরপুরুষের স্থবির চেতনার তা নবজন্ম দান করে-সজীব সক্রিয় করে তোলে ধমনী। তাই একদিন যেই বাঙালী সন্তান অতি সাধারণ স্তর থেকে নিজেকে অতি অসাধারণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে স্বজাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন, তেমন একজনের কঠোর জীবনসংগ্রামের কথা তোমাদের শোনাব। অসাধারণ সেই বাঙালী সন্তানের নাম রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

বাঙালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস

  • (১) শিক্ষায় সংস্কৃতিতে, শিল্প বিজ্ঞান, রাজনীতি, ব্যবসা, ক্রীড়া ও শরীর চর্চায় ভারতের প্রাগ্রসর জাতি হিসেবে এককালে বাঙালীর খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। প্রধানত বাঙালী মনীষার অবিস্মরণীয় প্রজ্ঞার আলোকে রূপলাভ করেছে আধুনিক ভারতবর্ষ। বাঙালীজাতির গৌরবময় সে কীর্তিকাহিনী ভারত ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
  • (২) কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে জাতীয় জীবনের অতীত গরিমার সমস্ত উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয়ে আজকের বাঙালী এক নগণ্য মুষিকে পরিণত। উত্তরাধিকারের আস্ফালন করার যোগ্যতাটুকুও তার অবশিষ্ট নেই। আত্মবিস্মৃতি আর পূর্বসূরীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা একটা গোটা জাতির জীবনে কী করুণ পরিণতি ঘটাতে পারে বর্তমান বাঙালী সত্তা তার প্রকৃষ্ট নজির।
  • (৩) অবক্ষয়ের ধারামুখে রুখে দাঁড়াতে না পারলে এই জাতির পুনরভ্যুদয়ের আশা দুরাশা মাত্র। আর এই দুরূহ কাজ সম্ভব করে তুলবার জন্য একান্ত প্রয়োজন আত্মচেতনার জাগরণ ঘটানো, পূর্বসূরীদের গরিমা-গৌরবের স্মরণের মধ্যেই নিহীত আছে সেই সঞ্জীবনী শক্তি। স্মরণে মননে সংকল্পে তাকেই করতে হবে ধ্রুবতারা।
  • (৪) মুখে যাঁরা ভাষা ফুটিয়েছেন, বুকে দিয়েছেন বল, মনেতে তেজ আর বাহুতে শক্তি, সেই মহান পূর্বসূরীদের যোগ্য উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে তবে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভভ হবে। বাঙালী আবার টেনে ধরার শক্তি পাবে ইতিহাসের ঝুঁটি। জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের পুনরধিকার পারবে প্রতিষ্ঠা করতে।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন তারিখে চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার ভাবলা গ্রামে এক সাধারণ গৃহস্থের ঘরে রাজেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বারাসাতে মোক্তারী করতেন।

প্রকৌশলী রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের শৈশব

গাঁয়ের পাঠশালায় ভর্তি হবার বয়সেই, যখন মাত্র বছর ছয়েক তাঁর বয়স, সেই সময় ভগবানচন্দ্র পরলোক গমন করেন। অতি সামান্য রোজগার থেকে কোন সঞ্চয়ই রেখে যেতে পারেন নি তিনি। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে সংসারে নেমে এল অন্ধকার। নিঃসম্বল বিধবা শিশুপুত্রের হাত ধরে কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হলেন। কায়ক্লেশে তিনি দুটি প্রাণীর অন্ন সংস্থানের জন্য প্রাণপাত করতে লাগলেন।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষা

  • (১) গ্রামের পাঠশালায় সামান্য বাংলা লেখাপড়া শিখেছিলেন রাজেন্দ্রনাথ। বিধবা মায়ের সাধ ছেলেকে ইংরাজি স্কুলে লেখাপড়া শেখাবেন। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের কোনো সাহায্য পেলেন না। শেষে নিরুপায় হয়ে তিনি স্বামীর কর্মক্ষেত্র বারাসাতে পরিচিত এক ভদ্রলোকের দ্বারস্থ হলেন। তাঁর আশ্রয়ে রেখে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার আবেদন জানালেন।
  • (২) এক সময়ে এই সদাশয় ভদ্রলোক ভগবানচন্দ্রের কাছ থেকে নানাভাবে উপকার পেয়েছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতা বশে তিনি রাজেন্দ্রনাথের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে সম্মত হলেন। তাঁর বাড়িতেই আশ্রয় পেল পিতৃহীন বালক। তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল বারাসাতের স্কুলে।
  • (৩) লেখাপড়ায় বরাবরই মনোযোগী ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ। তাই পরীক্ষার ফলও সন্তোষজনক হতে লাগল। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই কঠিন বসন্ত রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।

তীব্র রোগে আক্রান্ত রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

রোগের তীব্র আক্রমণে জীবনসংশয় দেখা দেয় তাঁর। ভাগ্যক্রমে সে-যাত্রায় যমের মুখ থেকে ফিরে এলেন। কিন্তু শরীর এমন ভেঙ্গে পড়ল যে পড়াশুনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। অসহায় বিধবা মা ছেলের স্বাস্থ্য উদ্ধারের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।

আগ্রায় রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

  • (১) এই সময়ে সৌভাগ্যক্রমে আগ্রায় বসবাসকারী তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হল। ছেলেকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে আবেদন জানালেন সেই ভাইয়ের কাছে। তিনি সম্মত হলেন। দুর্বল রুগ্ন শরীর রাজেন্দ্রনাথের। সবে চোদ্দতে পা দিয়েছেন।
  • (২) সেই অবস্থায় গ্রামের পরিচিত একজনের সঙ্গে চৌত্রিশ মাইল পায়ে হেঁটে তিনি উপস্থিত হলেন নবাবগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়ি। তাঁর কাছ থেকেই পেলেন সামান্য পথখরচ আর কিছু শীতবস্ত্র। সেই নিয়েই বালক রাজেন্দ্রনাথ বহুকষ্টে আগ্রায় পৌঁছলেন।
  • (৩) আগ্রায় বছর তিনেক ছিলেন তিনি। সেখানে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু আকস্মিক ভাবে বাড়ি থেকে দুঃসংবাদ নিয়ে চিঠি এল। মা মৃত্যুশয্যায়, পত্রপাঠ তিনি যেন চলে আসেন।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ

  • (১) সেইকালে অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়া রীতি ছিল। গ্রামের বাড়িতে মা-ও যে তাকে সংসারী করাবার জন্য উৎসুক হয়েছেন, তা ভাবতে পারেন নি কিশোর রাজেন্দ্রনাথ। তাই চিঠি পাওয়া মাত্রই পড়াশুনা ফেলে রেখে ফিরে এলেন।
  • (২) এসে দেখেন মা সম্পূর্ণ সুস্থ। তিনি আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় তাঁর বিয়ের বন্দোবস্ত করেছেন। সেই উদ্দেশ্যেই মার অসুখের মিথ্যা সংবাদ দিয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে। রাজেন্দ্রনাথ কিন্তু বেঁকে বসলেন। তিনি কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হলেন না।
  • (৩) কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে বিয়ে করতে হল। এই বাল্য বিবাহের ক্ষোভ তিনি সারাজীবনে ভুলতে পারেন নি। পরবর্তীকালে যখনই সুযোগ পেতেন বাল্যবিবাহের পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য তরুণদের উপদেশ দিতেন।

কলকাতায় রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

আর আগ্রায় ফেরা হল না। বিয়ের পর কলকাতায় এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে থেকে লন্ডন মিশনারী সোসাইটি স্কুলে পড়াশুনা করতে লাগলেন। আগ্রায় খ্রিস্টান মিশনারীদের স্কুলে পড়াশুনা করতেন তিনি। অবৈতনিক ছাত্র হিসেবেই সুযোগ পেয়েছিলেন। কলকাতার স্কুলেও মিশনারীদের দয়াতেই তাঁর পড়াশুনা সম্ভব হয় এবং এই স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে খ্রিস্টান মিশনারীদের অবদান

খ্রিস্টান মিশনারীদের দয়ার কথা সারা জীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন রাজেন্দ্রনাথ। যখন প্রভূত অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন, সুযোগ পেলেই খ্রিস্টান মিশনের সেবাকর্মে অকাতরে অর্থ দান করেছেন। দুঃখের দিনের কথাগুলো কখনও ভোলেন নি তিনি যাঁদের কাছ থেকেই সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন, কৃতজ্ঞ অন্তরে তাঁদের স্মরণ করে গেছেন।

প্রকৌশলী রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্বাধীন জীবিকা অর্জনের সংকল্প

বাল্য শৈশব কৈশোর কঠোর দাবিদ্র্যের মধ্যে কেটেছে তাঁর। তাই দারিদ্র্যকে জয় করার দীক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন জীবনের নিদারুণ বাস্তবতা থেকে। ছেলেবেলাতেই সংকল্প করেছিলেন, অর্থের অভাব ঘোচাতে হবে। দশজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। যেমন করেই হোক স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করবেন।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা

কেরানীগিরির পরাধীন চাকরিকে রাজেন্দ্রনাথ জীবনের অপচয় বলেই মনে করতেন। তাই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর কোন রকমে একটা চাকরি লাভের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত না করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ ভর্তি হলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা বলতে তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে শেখানো হতো ওভারসিয়ারির কাজ। তিন বছর পড়ার পর পরীক্ষা দিয়ে পাস করলে একটা সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। আত্মীয়ের বাসায় থেকে রাজেন্দ্রনাথ পড়াশুনা চালাতে লাগলেন।

অর্থ উপার্জনের সন্ধানে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

তখন তো কেবল মাত্র পড়াশুনার চিন্তাই নয়। বাড়িতে রয়েছেন মা ও সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী। পুরো সংসারের ভার তাঁর কাঁধে। নিত্য অভাব অনটনের চাপ। তাই অবসর সময়ে ছাত্র পড়িয়ে সংসারে ঠেকা দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সংসারের চাপ ক্রমান্বয়ে এমনই বেড়ে উঠল যে সে চাপ সামলে তিন বছর পড়াশুনা চালানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। তাঁর আর ওভারসিয়ারির সার্টিফিকেট নেওয়া হল না। কলেজ ছেড়ে অর্থ উপার্জনের উপায় অনুসন্ধানে নামতে হল।

নিরাশ্রয় রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

  • (১) যে আত্মীয়ের আশ্রয়ে ছিলেন, রাজেন্দ্রনাথের নাজেহাল অবস্থা দেখে দয়াপরবশ চেষ্টাচরিত্র করে তিনি একটা চাকরির সন্ধান আনলেন। কিন্তু কেরানীর চাকরির জন্য আবেদন করতে রাজি হলেন না রাজেন্দ্রনাথ। এদিকে বাড়িতে মা বউ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, নিজেরও অন্নসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই।
  • (২) এই অবস্থায় একটা নিশ্চিত চাকরির সুযোগ অবহেলা করছেন রাজেন্দ্রনাথ, তাঁর আত্মীয় এই ধৃষ্টতা সহ্য করতে পারলেন না। বিশেষতঃ তাঁরই আশ্রয়ে যখন রয়েছেন রাজেন্দ্রনাথ।
  • (৩) অনেক বুঝিয়ে, ভর্ৎসনাতেও যখন রাজি করানো সম্ভব হল না, বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোক তাঁকে তাঁর বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন। বাধ্য হয়ে পথে নেমে এলেন রাজেন্দ্রনাথ। সহায় সম্বলহীন, বন্ধুহীন অবস্থায় কলকাতার পথকেই এবারে অবলম্বন করলেন।

কলকাতার পথে উদ্দেশ্যহীন রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

দরিদ্র বাঙালীর ছেলে হয়ে কেরানীগিরি করবেন না, স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করবার কথা ভাববেন-সেকালের সমাজে এই ভাবনা ছিল নিছকই হাস্যকর এক পাগলামী। সেই পাগলামীর বশেই শেষ পর্যন্ত শেষ আশ্রয়টুকু থেকে বিতাড়িত হলেও ভেঙ্গে পড়লেন না রাজেন্দ্রনাথ। কলকাতার পথে পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে লাগলেন।

স্কুল শিক্ষক রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

পথে দেখা হল এক বন্ধুর সঙ্গে। নিজের দূরবস্থার কথা তাঁকে খুলে বললেন। সহানুভূতিশীল বন্ধুটি তাঁকে নিজের মেসে নিয়ে গেল। সেখানে থেকেই অনেক ঘোরাঘুরির পর একটা স্কুল মাস্টারির কাজ জুটল। মাসিক বেতন পনেরো টাকা। স্কুল শিক্ষকের কাজ নিলেও নিজের আবাল্য পোষিত সংকল্পের কথা ভুললেন না রাজেন্দ্রনাথ। স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জনের কি উপায় করা যায়, কোথায় কিভাবে সুযোগ পাওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনিয়মিত আহার

চাকরি পাবার পর থেকেই মাসে দশটাকা করে নিয়মিত বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। পাঁচ টাকা দিয়ে কলকাতায় নিজের থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে হত। ফলে এই সময় অধিকাংশ দিনই তাঁকে একবেলা না খেয়ে থাকতে হত। দুবেলা টিফিনের কথা তো ছিল স্বপ্ন।

আলিপুর চিড়িয়াখানায় রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

  • (১) এক ছুটির দিনে রাজেন্দ্রনাথ কি মনে করে ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন আলিপুরে চিড়িয়াখানায়। মনে ভাবনাচিন্তার অন্ত নেই। ক্লান্ত হয়ে সেখানে পুকুরের ধারে এসে বসলেন। কাছেই সেই পুকুরের ওপরে একটা সাঁকো তৈরি হচ্ছিল। দেশীয় মজুরদের নিয়ে কাজ করছিলেন একজন সাহেব ইঞ্জিনিয়ার।
  • (২) সাহেবের সব কথা মজুররা বুঝতে পারছিল না। ফলে সাহেবকে কাজ বোঝাবার জন্য একই কথা বার বার বলতে হচ্ছিল। তাতে মাঝে মাঝে রেগেও উঠছিলেন তিনি। এই নিয়ে বেশ চেঁচামেচি হচ্ছিল কাজের জায়গায়।
  • (৩) রাজেন্দ্রনাথের সামনেই এই ঘটনা ঘটছিল। তিনি সাহেবের মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলেন। এক সময় উঠে এগিয়ে গিয়ে সাহেবের বক্তব্য বিষয়টা তিনি বুঝলেন। তারপর সাহেবকে বিনীত ভাবে বললেন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি বিষয়টা ওদের বুঝিয়ে দিতে পারি। সাহেব সম্মত হলেন। তখন রাজেন্দ্রনাথ নিজে মজুরদের সঙ্গে কাজে হাত লাগালেন।
  • (৪) তরুণ যুবকের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে সাহেব খুশি হলেন। তিনি তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। রাজেন্দ্রনাথ নিজের মনোবেদনা ও হতাশার কথা প্রকাশ করার একটা মনোমত সুযোগ এতদিনে পেলেন। আশান্বিত হয়ে অকপটে দুরবস্থার কথা জানিয়ে বললেন, আমি স্বাধীন ভাবে কাজ করতে চাই। কিন্তু কোনো সুযোগ পাচ্ছি না। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে একটা সুযোগ করে দিলে বাধিত হই।

কর্পোরেশনের কাজে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

সাহেব তাঁকে পরদিন তাঁর অফিসে দেখা করতে বললেন। এই উদার স্বভাব সাহেবের নাম ব্রাডফোর্ড লেসলী। তিনি ছিলেন সেই সময়কার কলকাতা করপোরেশনের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার। পরে নাইট হুড পেয়ে স্যার ব্রাডফোর্ড লেসলী হন। রাজেন্দ্রনাথ পরদিনই সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হলেন সাহেব এবং সেই দিনই তাঁকে করপোরেশনের একটা কাজের দায়িত্ব দিলেন। ভারতের অন্যতম যশস্বী শিল্পপতি ও ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথের সুবিশাল কর্মজীবনের সেটিই ছিল প্রথম কাজ। যথা সময়েই কাজটি সুসম্পন্ন করলেন তিনি। সাহেব খুশি হয়ে নতুন কাজের বরাত দিলেন তাঁকে।

মার্টিন কোম্পানির মালিক রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

এই ভাবে ধাপের পর ধাপ পার হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই রাজেন্দ্রনাথ একজন সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদার হয়ে উঠলেন। এতদিনের জীবনের ধারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল রাজেন্দ্রনাথের। গোড়ায় যে বিলাতি ঠিকাদার কোম্পানির ওভারসিয়ার রূপে কাজে নেমেছিলেন তিনি, পরে সেই মার্টিন কোম্পানিরই অংশীদার ও সর্বময় মালিক হন।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাতা রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

আজকের আধুনিক কলকাতা মহানগরীর অন্যতম গর্ব যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সৌধ ও পলতা ওয়াটার ওয়ার্কস আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে, এগুলো নির্মিত হয়েছিল সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথেরই তত্ত্বাবধানে। মার্টিন কোম্পানির রেলপথ স্থাপনের কৃতিত্বও তাঁরই।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কর্মকুশলতায় অলংকৃত কলকাতা

একদিন যে কলকাতা শহরে তিনি উপবাসী অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেই কলকাতা শহর সময়ান্তরে অলঙ্কৃত হয়ে উঠল তাঁরই কর্মকুশলতায়। অবিচল সংকল্প ও কঠোর পরিশ্রম মানুষকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকে। রাজেন্দ্রনাথ নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় এভাবে তাঁর জাতির জন্য এক নতুন পথ উন্মোচিত করে গেলেন।

ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অকাতরে অর্থ দান

প্রভূত অর্থ বিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েও নিজের অশ্রুসজল বাল্য কৈশোরের কথা তিনি কখনো ভোলেন নি। জনহিতকর কাজে অকাতরে তিনি অর্থব্যয় করতেন। নিজের জন্মভূমি বসিরহাটের উন্নতিকল্পে তিনি বহু অর্থ দান করেছেন।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি সম্মাননা

প্রকৌশলী রাজেন্দ্রনাথ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার এবং ব্যবসায়ের প্রয়োজনে পরে কয়েকবার বিলাত যান। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার শেরিফ হন। সম্মান মর্যাদায় সমাজের সর্বোচ্চ আসনে তাঁর স্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি-এস-সি (ইঞ্জিনিয়ারিং) উপাধিতে ভূষিত করে।

আদর্শ দৃষ্টান্ত রাজেন্দ্রনাথের জীবন

জীবনে আঘাত আছে, দুঃখ, পরাজয় সবই আছে। কিন্তু কোনও কিছুতেই যারা সঙ্কল্পচ্যুত না হয়ে, আপন লক্ষ্যে এগিয়ে চলতে পারে নিষ্ঠাভরে তাদের জয় যে অনিবার্য তারই এক আদর্শ দৃষ্টান্ত রাজেন্দ্রনাথের জীবন। এমন জীবনকে আদর্শরূপে গ্রহণ করতে পারলে সমগ্র জাতির চরিত্রে আবার বেগ সঞ্চারিত হবে, সোজা হয়ে উঠবে নুয়ে-পড়া মেরুদণ্ড।

রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু

স্বজাতির সম্মুখে স্বাবলম্বী জীবনের অতুল কর্ম কৃতিত্বের দৃষ্টান্ত রেখে কর্মবীর রাজেন্দ্রনাথ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ মে ইহলোক ত্যাগ করেন।

উপসংহার :- যে যুগের বাঙালী যুবক জীবনে একটা মাসমাইনের চাকরিকেই জীবনের সার্থকতা গণ্য করত, পরাধীন মসীজীবীর স্বপ্নে বিভোর থাকত, সেই যুগে চলমান স্রোতের মূর্তিমান প্রতিবাদ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। একজন স্বাধীন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ব্যবসাক্ষেত্রে বেনিয়া ইংরাজের সমকক্ষ প্রতিভা যে বাঙালীরও রয়েছে তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন। অবশ্য তার জন্য দরকার হয়েছে কঠোর পরিশ্রম আর সুদৃঢ় সঙ্কল্প। একজন সহায়সম্বলহীন মানুষ যে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় নিজেকে উন্নত করতে পারে, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবন আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

(FAQ) রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কে ছিলেন?

তিনি একজন বিশিষ্ট বাঙালি প্রকৌশলী এবং শিল্পপতি ছিলেন, যিনি ভারতের প্রকৌশল খাতের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

২। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন?

তিনি বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে আইআইইএসটি শিবপুর) থেকে প্রকৌশল বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।

৩। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য অবদান কী?

তিনি টাটা স্টিল প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে ও কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের প্রকল্পগুলিতে নেতৃত্ব দেন।

৪। ব্রিটিশ সরকার তাকে কোন সম্মান প্রদান করে?

ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করেছিল।

৫। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সফল প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম কোনটি?

ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে এবং কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো তাঁর নেতৃত্বে সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

Leave a Comment