বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রচারক, শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দার্শনিক গুরু এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন রামানুজ স্বামী (১০১৭–১১৩৭)। ভক্তি আন্দোলন, জাতিভেদ বিরোধিতা ও শ্রীবৈষ্ণব মতবাদের বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অমর। তিনি ছিলেন ভক্তির মাধ্যমে মোক্ষলাভের ব্যাখ্যাদাতা এবং জাতিভেদহীন সমাজের প্রবল সমর্থক। তাঁর প্রচারিত বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শন আজও শ্রীবৈষ্ণব মতবাদের মূল ভিত্তি।
দার্শনিক রামানুজ স্বামী
| ঐতিহাসিক চরিত্র | রামানুজ স্বামী |
| পূর্ণ নাম | শ্রী রামানুজাচার্য |
| জন্ম | ১০১৭ খ্রিস্টাব্দ, শ্রীপেরুমবুদুর, তামিলনাড়ু |
| দর্শন | বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত |
| সম্প্রদায় | শ্রীবৈষ্ণব |
| গুরু | যাদবপ্রকাশ (শিক্ষাগুরু), পরবর্তীতে আলবান্দার/যামুনাচার্য দ্বারা প্রভাবিত |
| প্রধান গ্রন্থ | শ্রী ভাষ্য, বেদার্থ সংগ্রহ, গীতা ভাষ্য, নত্নমণি (টীকা ও ব্যাখ্যা) ইত্যাদি |
| উপাস্য দেবতা | ভগবান বিষ্ণু/নারায়ণ |
| প্রধান ক্ষেত্র | দর্শন প্রচার, ভক্তি আন্দোলন, মন্দির সংস্কার, সমাজ সংস্কার |
| অবদান | ভক্তি মাধ্যমে মোক্ষ তত্ত্ব ব্যাখ্যা, জাতিভেদ বিরোধিতা, শ্রীবৈষ্ণব মতবাদের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার |
| বিখ্যাত শিষ্য | কূরেশ (কূরত্তাল্বার), দাশরথি, এম্বার, অনন্তাল্বার প্রমুখ |
| গুরুত্বপূর্ণ মন্দির সংযোগ | শ্রীরঙ্গনাথ স্বামী মন্দির, শ্রীরঙ্গম |
| মূল শিক্ষা | ভক্তি, শরণাগতি, ঈশ্বর–জীব–জগতের অভিন্ন কিন্তু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পর্ক |
| প্রভাব | দক্ষিণ ভারত-এর ভক্তি আন্দোলন-এর প্রধান স্তম্ভ; ভারতীয় বৈষ্ণব দর্শনে গভীর ও স্থায়ী প্রভাব |
| মৃত্যু | ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দ, শ্রীরঙ্গম |
রামানুজ স্বামী
ভূমিকা :- শ্রী রামানুজ স্বামী, যিনি শ্রী রামানুজাচার্য নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন একাদশ–দ্বাদশ শতাব্দীর ভারতীয় হিন্দু দর্শনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্য, বৈষ্ণব ধর্মগুরু ও সমাজ সংস্কারক। শ্রী রামানুজ স্বামী ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ; তাঁর জীবন ও দর্শন দক্ষিণ ভারত থেকে সমগ্র ভারতবর্ষে বৈষ্ণব ভাবধারার বিস্তার ঘটায় এবং মানবিকতা, ভক্তি ও সমতার চেতনাকে চিরন্তন রূপ প্রদান করে।
রামানুজ স্বামীর জন্ম
শ্রী রামানুজ স্বামী ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের শ্রীপেরুমবুদুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
আচার্য রামানুজ স্বামীর পিতৃপরিচয়
তোন্ডির মণ্ডলের অন্তর্গত ভূতপুরী নামক স্থানে তিনি বাস করতেন। তাঁর পিতার নাম কেশব ত্রিপাঠী। তিনি একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন।
নানা শাস্ত্রে পন্ডিত রামানুজ স্বামী
রামানুজ বাল্যকালে পিতার নিকট বেদাধ্যয়ন করেন এবং পনের বছর বয়সে মহাপূর্ণাচার্য্যের শিষ্য হয়ে তাঁরই নিকট বেদান্ত প্রভৃতি শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেন।
বিষ্ণুভক্ত রামানুজ স্বামী
তিনি বাল্যকাল থেকেই বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। ক্রমে জ্ঞান ও বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভক্তি আরো গাঢ়তর হতে লাগিল। এমন কি, তিনি ভক্তিবলে সময়ে সময়ে বিষ্ণুপ্রেমে আত্মহারা হয়ে পড়তেন।
বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত রামানুজ স্বামী
শাস্ত্র অধ্যয়ন শেষ করে তিনি ‘মদুরা’ নামক স্থানে এসে বৈষ্ণবদের সাথে মিলিত হলেন এবং সেখানে বৈষ্ণব ধর্ম-এ দীক্ষিত হয়ে ভক্তিমার্গ আশ্রয় করে মুক্তি তত্ত্বের উপদেশ দানে প্রবৃত্ত হলেন।
রামানুজ স্বামীর শিষ্য সংগ্রহ
এরপর গুরুদেবের সাথে কাঞ্চীপুরে এসে বরদরাজ স্বামীর মন্দিরে অবস্থান করেন। এই সময় তিনি বেদান্ত-ভাষ্য, গীতা-ভাষ্য প্রভৃতি ভাষ্য রচনা করে শঙ্কর মত খণ্ডনপূর্বক অদ্বৈতবাদ প্রচার দ্বারা বহুশিষ্য সংগ্রহ করেন।
তিরুপতিতে রামানুজ স্বামী
তারপর তিনি কাঞ্চীপুর থেকে তিরুপতিতে এসে পবিত্র গঙ্গা তীরে কিছুদিন মহানন্দে যোগাভ্যাসে থেকে সিদ্ধ হলে, সেখানকার বেঙ্কটেশদেবের পূর্ব প্রচলিত পূজা পদ্ধতির সংস্কার করেন।
রাজার ক্ষোভের মুখে রামানুজ স্বামী
এই সময়ে ত্রিশিরাপল্লীর রাজা কৃমিকান্ত চোল স্বামীজীর আচার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়। সাধারণকে উত্তেজিত করে পূর্ব ধৰ্মমত পরিবর্তিত করছে দেখে ক্রোধান্ধ হয়ে রাজা তাঁর ধ্বংস সাধনের জন্য় লোক নিযুক্ত করলেন।
মহীশূরে রামানুজ স্বামী
স্বামীজী আত্মরক্ষার জন্য শ্রীরঙ্গ ছেড়ে মহীশূরের অন্তর্গত মেলকোট নামক স্থানে চলে আসেন। সেখানকার অধিপতি বল্লালরাজ জৈন ধর্ম অবলম্বী, উদারচরিত ও পরম সাধু ভক্ত ছিলেন।
রাজার কন্যাকে ব্রহ্মদৈত্যে ভর
কথিত আছে, রামানুজ স্বামী যে সময় মেলকোটে এসে উপস্থিত হন, সেই সময় বল্লালরাজ-এর কন্যাকে ব্রহ্মদৈত্যে ভর করেছিল। বহু দেশ দেশান্তর থেকে অনেক শাস্ত্রজ্ঞ, ব্রাহ্মণ, গুণী প্রমুখ এসে নানারূপ প্রক্রিয়া ও দৈবকার্য্য করেও কেউই তাঁর আরোগ্য সম্পাদনে সমর্থ হলেন না। এমন কি, অবশেষে রাজা কন্যার আশা পরিত্যাগ করেছিলেন।
ব্রহ্মদৈত্য বিতাড়নে রামানুজ স্বামী
স্বামীজী এই সংবাদ শোনা মাত্র স্বয়ং রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং কন্যার বিষয় রাজমুখে সবিশেষ অবগত হয়ে, কন্যাকে দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সাধুভক্ত বল্লালরাজ তৎক্ষণাৎ কন্যাকে সাধুর নিকট আনলেন। স্বামীজী কন্যাকে সম্মুখে দাঁড় করিয়ে মন্ত্র প্রয়োগ দ্বারা ব্রহ্মদৈত্যকে তাড়িয়ে দেন।
বৈষ্ণব ধর্মে রাজার দীক্ষা
রাজা কন্যার আগের মত স্বাস্থ্যলাভ ও স্বামীজীর এরকম অমানুষিক ক্ষমতা দেখে, তাঁকে গুরুত্বে বরণ করলেন এবং বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘বিষ্ণুবর্দ্ধন’ নামে অভিহিত হলেন।
তর্কে বিজয়ী রামানুজ স্বামী
এই ঘটনায় জৈন ধৰ্মাবলম্বীরা নিতান্ত ক্রুদ্ধ হওয়ায় রাজা জৈন গুরু ও পণ্ডিতদের আহ্বান করে স্বামীজীর সাথে শাস্ত্রীয় তর্কযুক্তি করতে বলেন। জৈন পণ্ডিতরা এতে স্বীকৃত হয়। অবশেষে পন্ডিতরা তর্কে পরাস্ত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব স্বীকার করলেন। আবার কেউ কেউ অপমানজনিত ঘৃণায় দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন।
মন্দির প্রতিষ্ঠায় রামানুজ স্বামী
রামানুজ স্বামী যাদবপুরী অবস্থান কালে সেখানে নারায়ণ স্বামীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই নাম অনুযায়ী আজও সেই স্থান “তেজ নারায়ণপুর” নামে বিখ্যাত।
শ্রীরঙ্গে ফিরে আসেন রামানুজ স্বামী
এই সময় কৃমিকান্ত চোলের মৃত্যু হয়। স্বামীজী এই সংবাদ পেয়ে আবার শ্রীরঙ্গে ফিরে এলেন এবং রঙ্গনাথ স্বামীর পূজা পদ্ধতি পরিবর্তন করে সকলকে বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন।
রামানুজ স্বামীর দেশ পরিভ্রমন
তিনি ভারতের সর্বত্র পরিভ্রমণ করে স্বীয় মত প্রচার ও সাধারণকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন। স্বামীজী কাঞ্চীপুর, তিরুপতি, মহারাষ্ট্র, দত্তাত্রেয় ক্ষেত্র, দ্বারকাতীর্থ, প্রয়াগ, মথুরা, বারাণসী, হরিদ্বার, বদরিকাশ্রম, সারদাপীঠ, অযোধ্যা, গয়াধাম, করমণ্ডল, পদ্মনাভ, সিংহাচল প্রভৃতি নানাতীর্থ পরিভ্রমণ করে অবশেষে শ্রীরঙ্গে ফিরে আসেন।
অবতার রামানুজ স্বামী
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে রামানুজ স্বামী শেষ অবতার বলে গণ্য।
রামানুজ স্বামী রচিত গ্রন্থ
তার রচিত অনেক গুলি গ্রন্থ আছে। যেমন – শ্রী ভাষ্য, বেদার্থ সংগ্রহ, গীতা ভাষ্য, নত্নমণি (টীকা ও ব্যাখ্যা) ইত্যাদি।
আধ্যাত্মিক উপদেশ দানে রত রামানুজ স্বামী
তিনি জীবনের অবশিষ্টকাল পরমার্থ সম্বন্ধীয় আধ্যাত্মিক উপদেশ দিয়ে কত শত পাপী তাপীকে উদ্ধার করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
রামানুজ স্বামীর নির্বাণ লাভ
স্বামীজী ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে একশ কুড়ি বছর বয়সে স্ব স্বরূপে নির্বাণ প্রাপ্ত হন।
উপসংহার :- শ্রী রামানুজাচার্য শুধুমাত্র একজন দার্শনিক বা ধর্মগুরু ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক সাম্যের এক মূর্ত প্রতীক। তাঁর প্রচারিত বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শন হিন্দু তত্ত্বচিন্তায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যেখানে ঈশ্বর, আত্মা ও জগতের সম্পর্ক ব্যাখ্যা হয়েছে একাধারে গভীর যুক্তি, শাস্ত্রীয় প্রমাণ ও অটুট ভক্তির আলোকে।
(FAQ) রামানুজ স্বামী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
শ্রী রামানুজাচার্য ছিলেন এক মহান হিন্দু দার্শনিক, বৈষ্ণব আচার্য, ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা এবং শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গুরু। তিনি বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রচারক।
তিনি ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতবাদ হলো বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত—যেখানে ব্রহ্ম এক হলেও জীব ও জগত তাঁর বিশেষ অংশ এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রূপ।
তিনি শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়কে শাস্ত্রীয় ও দার্শনিক ভিত্তিতে সংগঠিত করেন এবং মন্দির পরিচালনা ও ধর্মীয় আচার সংস্কার করেন। ভক্তি ও শরণাগতির গুরুত্বই তাঁর শিক্ষার মূল।
শিক্ষার প্রথম গুরু ছিলেন যাদবপ্রকাশ। পরে তিনি যামুনাচার্য (আলবান্দার)-এর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন, যিনি শ্রীবৈষ্ণব পরম্পরার পূর্বসূরি।
তিনি বলেন—ভক্তি (প্রেমপূর্ণ উপাসনা) ও শরণাগতি (ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ)-এর মাধ্যমেই মোক্ষলাভ সম্ভব, জাত বা জন্ম নয়।
সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো শ্রী ভাষ্য, যা ব্রহ্মসূত্রের বৈষ্ণব ব্যাখ্যা এবং বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের প্রামাণ্য দলিল। এছাড়াও গীতা ভাষ্য, বেদার্থ সংগ্রহ প্রভৃতি রচনা করেছেন।
না, তিনি জাতিভেদ ও সামাজিক বৈষম্যের বিরোধী ছিলেন এবং প্রচার করেন—ঈশ্বরের ভক্তি ও মোক্ষ সকলের অধিকার।
তিনি দীর্ঘ সময় শ্রীরঙ্গম নগরে বসবাস ও ধর্ম প্রচার করেন এবং শ্রীরঙ্গনাথ স্বামী মন্দির সংস্কার ও পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তি, শরণাগতির মাধ্যমে মুক্তি, জাতিভেদহীন মানবিক সমাজ, শাস্ত্র, যুক্তি ও ভক্তির সমন্বয়।
তাঁর প্রধান শিষ্যদের মধ্যে কূরত্তাল্বার (কূরেশ), এম্বার, অনন্তাল্বার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।