মহিয়ষী রাণী চন্দ ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজকর্মী, সাহিত্যিক ও সংগ্রামী নারী, যিনি বিংশ শতাব্দীর বাংলার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাণী চন্দ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সমাজে নারীশিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের প্রচারে বিশেষ অবদান রাখেন।
বিপ্লবী রাণী চন্দ
| ঐতিহাসিক চরিত্র | রাণী চন্দ |
| জন্ম | ১৯১১ খ্রি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
| পরিচিতি | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং শান্তিনিকেতন-এর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম মুখ |
| পেশা | সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, শিল্পী |
| বিশেষ অবদান | সাহিত্য রচনা, সমাজসেবা, নারীশিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা প্রচার |
| প্রধান রচনা | জীবনস্মৃতি, একটুখানি, পথে পথে, শান্তিনিকেতনের দিনগুলি ইত্যাদি |
| উল্লেখযোগ্য দিক | শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যের ধারক ও রবীন্দ্রভাবধারার এক নিবেদিত অনুসারী |
| পুরস্কার ও স্বীকৃতি | সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন সম্মাননা |
| মৃত্যু | ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ |
রাণী চন্দ
ভূমিকা :- সমাজসেবী রাণী চন্দ ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ নারী। তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবতাবোধ ও সংস্কৃতির আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর লেখনী ও সমাজকর্ম নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রাণী চন্দের জীবন এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে সাহিত্য, সেবা ও সংস্কৃতি মিলেমিশে এক মানবিক আদর্শ গঠন করেছে।
রাণী চন্দর জন্ম
১৯১১ সালে (১৩১৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে) পুজোর সময় রাণী চন্দ মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃভূমি তাঁর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। কিন্তু দেশ চোখে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয় নি, কারণ পদ্মানদী সেই তল্লাটই ভেঙে নিয়ে গিয়েছিল।
চিত্রশিল্পের শিক্ষা গ্রহণে রাণী চন্দ
বড় হয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে যান আচার্য নন্দলাল বসুর কাছে চিত্রশিল্পের শিক্ষা গ্রহণ করতে। ধীরে ধীরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলেন তিনি শান্তিনিকেতনের চিত্রশিল্পী ও লেখিকা রূপে।
প্রিয় ছাত্রী রাণী চন্দ
তিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের স্নেহের পাত্রী এবং শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর প্রিয় ছাত্রী।
রাণী চন্দের বিবাহ
১৯৩৩ সালে রাণী চন্দের বিবাহ হয় বিশ্বভারতীর ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ অনিলকুমার চন্দের সঙ্গে।
দেশসেবার কর্মক্ষেত্রে রাণী চন্দ
অমন সাহিত্য ও শিল্পের পরিবেশের মধ্যে থেকেও তাঁর প্রাণ ভরলো না। তিনি শুনতে পেতেন শৃঙ্খলিত দেশমাতার গভীর ক্রন্দন। তখন দেশের যে অবস্থা ছিল তাতে তাঁর মতো হৃদয়ের সাড়া না দিয়ে চুপ করে শুধু শিল্পচর্চা করা অসম্ভব ছিল। আপন অন্তরের তাগিদেই তিনি দেশসেবার কর্মক্ষেত্রে নেমে এলেন। তাঁর মনে হত এই কাজ না করে তাঁর যেন উপায় নেই।
গঠনমূলক কাজে রাণী চন্দ
বরাবরই খদ্দর পরতেন তিনি। দেশের দরিদ্র সন্তানের হাতের কাজ যে! কংগ্রেসের কর্মীরূপে গঠনমূলক কাজ করতেন তিনি গ্রামের মধ্যে। গ্রামে চরকা পরিচালনা করা, স্কুল গঠন করা, হাতের কাজ শেখানো ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দরিদ্র দেশবাসীকে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দেওয়ার কাজ করে চলেছিলেন তিনি বহুদিন থেকেই।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে রাণী চন্দ
- (১) ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এ সমগ্র বীরভূম যেন শিকডসুন্ধ কেঁপে উঠল। গঠনমূলক কাজে তখন আর তাঁর তৃপ্তি রইলো না। একেবারে সংগ্রামের সামনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি।
- (২) তিনি শান্তিনিকেতন থেকে একাই বেরিয়ে পড়লেন আপন হৃদয়ের প্রেরণায়। অন্যরাও অনেকে দ্রুত এগিয়ে এলেন আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। এগিয়ে না এসে তাঁরা সেদিন কেউ ঘরে বসে থাকতে পারেন নি।
- (৩) রাণী চন্দের সঙ্গে এমনি করে একে একে এসে যোগদান করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী নন্দিতা কৃপলানী, শিল্পভনের ছাত্রী এলা দত্ত, শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ভবানী সেন, শ্রীভবনের শান্তি দাশগুপ্ত (বনলতা দাশগুপ্তের দিদি) প্রমুখ।
রাণী চন্দর নেতৃত্বে গভীরতর আন্দোলন
১৯৪২ সালের আন্দোলনের কর্মসূচী অনুযায়ী তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে জনসাধারণকে আন্দোলনে যোগদান করতে আহ্বান করেন। সভা সমিতির অনুষ্ঠান করতে করতে গ্রামবাসীদের নিকট থেকে যতই তাঁরা সাড়া পেলেন ততই আন্দোলন গভীরতর হয়ে দানা বেঁধে উঠল।
কারাদণ্ডে দন্ডিত রাণী চন্দ
গ্রামবাসী সাঁওতালরাও এসে তাঁদের সভায় দলে দলে যোগ দিতে লাগলেন। গভর্নমেন্টের পক্ষে এই দৃশ্য স্থির হয়ে দেখা আর সম্ভব হয় নি। আন্দোলন পরিচালনারত ঐসব কর্মীদের পুলিস একে একে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। রাণী চন্দের কারাদণ্ড হয় ৯ মাসের। নন্দিতা কৃপলানী, এলা দত্ত, ভবানী সেন, শান্তি দাশগুপ্ত প্রমুখও কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
সাহিত্যিক রাণী চন্দ
দেশসেবিকারূপে দেশের লোকে রাণী চন্দকে পেয়েছিল সেদিন জনসাধারণের মধ্যে। সাহিত্যিক রূপে তিনি আজ বাংলার ঘরে ঘরে সমাদৃত ও সুপরিচিত। যে বইগুলি লিখে তিনি অবিসংবাদিত সুনাম অর্জন করেছেন তার মধ্যে প্রধান ‘ঘরোয়া’, ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’, ‘জেনানা ফাটক’, ‘পূর্ণকুম্ভ’, ‘হিমাদ্রি’ প্রভৃতি।
রাণী চন্দর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তি
শুষ্ক জেল জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি শিল্পীমনে কত যে রসসৃষ্টি করেছিল সেকথা লেখা আছে তাঁর ‘জেনানা ফাটক’-এ। ‘পূর্ণকুম্ভ’ নিজের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল যখন ১৯৫৩ সালে বইখানি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ প্রাপ্ত হয়।
বিপ্লবী রাণী চন্দর মৃত্যু
এই মহান সাহিত্যিক, সমাজসেবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন
উপসংহার :- রাণী চন্দ ছিলেন এক অনন্য প্রতিভাধর নারী, যিনি সাহিত্য, সমাজসেবা ও সংস্কৃতিচর্চাকে জীবনের সঙ্গে একাকার করে তুলেছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম রবীন্দ্রভাবধারার গভীর প্রভাব বহন করলেও, তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থানকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। শান্তিনিকেতনের পরিবেশে গড়ে ওঠা রাণী চন্দের মানসিকতা ও সৃষ্টিশীলতা বাংলা সাহিত্যে এক মানবিক ও শিল্পিত স্পর্শ এনেছিল। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি, সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে একজন নারীর ভূমিকা কতটা গভীর ও প্রেরণাদায়ক হতে পারে।
(FAQ) রাণী চন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
রাণী দেবী ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক, সমাজকর্মী ও শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট নারী।
রাণী দেবী ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি জীবনস্মৃতি, একটুখানি, পথে পথে ও শান্তিনিকেতনের দিনগুলি প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
রাণী দেবী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্য ও সমাজসেবায় নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন।
তিনি সাহিত্য, নারীশিক্ষা, সমাজসেবা ও সংস্কৃতিচর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
রাণী দেবী ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
রাণী চন্দের সাহিত্য ও সমাজসেবামূলক কাজ শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করেছে।