মহীয়সী সরলাবালা দেবী ছিলেন ঊনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজসেবিকা, লেখিকা ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত। তিনি ১৮৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং জীবনের বড় অংশ ব্যয় করেন নারী সমাজের উন্নয়নে। ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে ও সমাজ সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা “আমার জীবন” বাংলা ভাষায় নারীদের লিখিত প্রথমদিককার আত্মজীবনীর অন্যতম, যা নারী অভিজ্ঞতা ও আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। তিনি নারীদের অধিকার, শিক্ষা ও আত্মনির্ভরশীলতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং বিভিন্ন নারী সংগঠনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। সরলাবালা দেবীর জীবন ও কর্ম ভারতীয় নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছে।
বিপ্লবী সরলাবালা দেবী
ঐতিহাসিক চরিত্র | সরলাবালা দেবী |
জন্ম | ১৮৯২ খ্রি |
জন্মস্থান | ব্রিটিশ ভারত (সম্ভবত বর্তমান বাংলাদেশ-এর অন্তর্গত) |
পরিচিতি | সমাজসেবিকা, লেখিকা, নারী শিক্ষা ও অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত |
গুরুত্বপূর্ণ রচনা | আমার জীবন (আত্মজীবনী) |
অনুপ্রেরণার উৎস | ব্রাহ্ম সমাজ ও নারী জাগরণ আন্দোলন |
সংশ্লিষ্ট সংগঠন | ব্রাহ্মসমাজ, নারী শিক্ষা প্রসার সমিতি প্রভৃতি |
অবদান | নারী শিক্ষা, নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাহিত্যচর্চা |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব | বাঙালি নারীদের মধ্যে আত্মজীবনী লেখার পথিকৃৎ; নারী জাগরণের অন্যতম মুখ |
মৃত্যু | ১৯৬১ সাল |
সরলাবালা দেবী
ভূমিকা :- উনিশ শতকের বাংলায় নারী জাগরণের এক উজ্জ্বল প্রতীক ছিলেন সরলাবালা দেবী। তিনি শুধু একজন সমাজসেবিকা ও শিক্ষাব্রতী নন, বরং ছিলেন একজন সাহসী লেখিকা যিনি নিজের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে রূপ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে যখন নারী শিক্ষা, স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশ ছিল সমাজে বিরল, তখন তিনি দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে নারীদের জন্য শিক্ষার পথ সুগম করতে চেষ্টা করেন। ব্রাহ্মসমাজের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নারী অধিকার ও আত্মমর্যাদার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী “আমার জীবন” বাংলা সাহিত্যে নারীর লেখা আত্মজীবনীর এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, যা শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। সরলাবালা দেবীর জীবন ও কর্ম বাংলার নারী সমাজের মুক্তি ও অগ্রগতির পথে এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
সরলাবালা দেবীর জন্ম
সরলাবালা দেবী ১৮৯২ সালে শিলচরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতৃভূমি তাঁর সিলেট।
বিপ্লবী সরলাবালা দেবীর পিতামাতা
তাঁর পিতা জগৎ চৌধুরি, মাতা মনোমোহিনী দেবী।
অল্প বয়সে বিধবা সরলাবালা দেবী
সতেরো বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। কিছু একটা কাজে নিজেকে সার্থক করবার জন্য তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠল। পিতামাতাও অসময়ে পরলোকগমন করেন।
চরকা ও খদ্দর প্রচলনে সরলাবালা দেবী
১৯২১ সালে গান্ধীজী সিলেট যান। তাঁর কাছেই তিনি স্বদেশের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রথম প্রেরণা পান। নিজেকে সার্থক করে তুলবার একটা আলোর রেখা তিনি দেখতে পেলেন। মহা উৎসাহে চরকা ও খদ্দর প্রচলনের কাজে তিনি গ্রাম ও শহরের লোকদের নিয়ে নেমে পড়লেন।
বিদ্যাশ্রমের সাথে সরলাবালা দেবীর যোগাযোগ
কিছুদিন পবরে সিলেটে ‘বিদ্যাশ্রম’ নামে গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি গঠনমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সংগঠিত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা। সরলাবালা দেবীর খদ্দর-প্রচারের কাজের সঙ্গে ‘বিদ্যাশ্রম’-এর একটা যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
নারী শিল্পভবন গঠন
১৯২৬ সালে সরলাবালা দেবীর মামা যতীন্দ্রচন্দ্র দত্ত ও মামীমা স্বসঙ্গিনী দত্ত সিলেটে একটি নারী শিল্পভবন গঠন করেন। সরলাবালা দেবী এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। এখানে সূতাকাটা ও খদ্দরের যাবতীয় জামা তৈরীর কাজ করা হত। খদ্দরের জামা ‘বিদ্যাশ্রম-‘এর সহায়তায় বিক্রি হত। তাঁরা এঁদের তৈরি সুতার কাপড়ও বুনে দিতেন।
শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের সম্পাদিকা সরলাবালা দেবী
১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় সিলেটের মহিলাগণ দেশের কাজে যোগ দেবার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। ‘বিদ্যাশ্রম’ তখন সরলাবালা দেবীকে সিলেট শহরে এসে ঐ আন্দোলন পরিচালনা করতে এবং মহিলাদের সংগঠিত করতে আহ্বান করেন। সেই আহ্বানে সরলাবালা দেবী গ্রাম থেকে সিলেট শহরে চলে আসেন এবং সেখানে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’ নামে একটি রাজনৈতিক সংঘ প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ছিলেন তার সম্পাদিকা, সভানেত্রী ছিলেন জোবেদা খাতুন চৌধুরী। মহিলা সংঘের ছাত্রীসংঘ, স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগ ছিল।
কংগ্রেস আন্দোলনে মহিলা সংঘ
১৯৩০ সালের কংগ্রেস আন্দোলনে যখন দলে দলে ছেলেরা কারারুদ্ধ হন তখন ‘বিদ্যাশ্রম’ এর সহায়তায় মহিলা সংঘ রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। গ্রামের শত শত মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সভা ও শোভাযাত্রা করতে লাগলেন এবং আইন অমান্য করতে নেমে পড়লেন।
সরলাবালা দেবীর আহ্বানে আশালতা সেনের শ্রীহট্টে আগমন
১৯৩০ এবং ১৯৩১ সালে সরলাবালা দেবীর আহ্বানে ঢাকার আশালতা সেন শ্রীহট্টে যান এবং তাঁর আন্দোলনমূলক ও গঠনমূলক কাজে সহায়তা করেন।
সরলাবালা দেবীর উদ্যোগে নারীকর্মী শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা
১৯৩১ সালে সরলাবালা দেবীর উদ্যোগে শ্রীহট্টে একটি ‘নারীকর্মী শিক্ষায়তন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে পুরুলিয়ার কংগ্রেস নেতা নিবারণ দাশগুপ্ত প্রায় ৫০টি নারীকর্মীকে কংগ্রেস ও গান্ধীজীর আদর্শ সম্বন্ধে শিক্ষা দেন। এই শিক্ষা মহিলাদের মধ্যে যে প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল তাতে ১৯৩২ সালের আন্দোলনে শ্রীহট্টের মহিলাগণ দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
বিপ্লবী সরলাবালা দেবীর কারাদণ্ড
১৯৩২ সালের আন্দোলনে তাঁরা বিলাতী কাপড় ও বিলাতী দ্রব্যের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পিকেটিং করতেন; একদল জেলে চলে গেলে, আর একদল তৎক্ষণাৎ সামনে এসে দাঁড়াতেন। বে-আইনী সভা ও শোভাযাত্রা তো ছিলই। ১৯৩২ সালের আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে সরলাবালা দেবী দেড় বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ প্রাপ্ত হন। অন্যান্য বহু মহিলা কর্মী কারারুদ্ধ হন।
সরলাবালা দেবীর পরিচালনায় গঠনমূলক কাজ
জেল থেকে ফিরে আসার পর সরলাবালা দেবীর পরিচালনায় মহিলা কর্মীগণ তাঁত, চরকা, স্কুল, শিল্পশিক্ষা, দাতব্য চিকিৎসালয়, নার্সিং ও ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা, হরিজন স্কুল প্রভৃতি গঠনমূলক কাজ করতে থাকেন। কাজ শুধুমাত্র শহরেই আবদ্ধ ছিল না, গ্রামে গ্রামেও তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল।
মণিপুরী কৃষক আন্দোলন
শ্রীহট্টের অন্তর্গত ভানুবিল অঞ্চলে মণিপুরী কৃষক আন্দোলন কংগ্রেসের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। এই আন্দোলনে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’-র মহিলাগণও যোগদান করেন। লীলাবতী দেবী ও সাবিত্রী সিং নামে দুজন মণিপুরী নারীও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেপ্তার হন ও জেলে প্রেরিত হন। অত্যাচারী ও শোষণ পরায়ণ জমিদারের বিরুদ্ধে ছিল মণিপুরী কৃষকদের আন্দোলন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সরলাবালা দেবী
১৯৪১ সালের ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে যোগদান করে সরলাবালা দেবী, শশীপ্রভা দেবী ও নরেশনন্দিনী দত্ত কারারুদ্ধ হন। মুক্তি পাবার পর ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এ সরলাবালা দেবী শ্রীহট্ট জেলা কংগ্রেসের ডিক্টেটার নির্বাচিত হন। দলে দলে মহিলা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এলেন। আন্দোলন পরিচালনা করতে করতে সরলাবালা দেবী কারাবরণ করেন; মুক্তি পান তিনি ১৯৪৫ সালে।
নারীজাগরণে সরলাবালা দেবীর অবদান
শ্রীহট্টের মহিলা আন্দোলন ও নারীজাগরণে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন সরলাবালা দেবী। সুর্মা ভ্যালি-অর্থাৎ শ্রীহট্ট জেলা ও কাছাডা জেলা ছিল তখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত। তাই বাংলার নারী আন্দোলনের সঙ্গে আসে ঐখানকার আন্দোলনের কাহিনী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর সুর্মা ভ্যালির কাছাড় জেলা এবং করিমগঞ্জের একটা অংশ রইল আসামের সঙ্গে যুক্ত, শ্রীহট্ট জেলার অবশিষ্ট অংশ চলে যায় পাকিস্তান-এ।
সরলাবালা দেবীর মৃত্যু
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে সরলাবালা দেবী মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার :- সরলাবালা দেবী ছিলেন সেই সময়ের এক ব্যতিক্রমী নারী, যিনি সমাজের রক্ষণশীলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও নারী জাগরণ ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম, বিশেষত আত্মজীবনী “আমার জীবন”, শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দলিল নয়, বরং সমগ্র নারী সমাজের আত্মবিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, নারীও চিন্তা, চর্চা ও সমাজসেবার মাধ্যমে এক নতুন পথ নির্মাণ করতে সক্ষম। সরলাবালা দেবীর জীবন ও কর্ম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে। তাঁর স্মৃতি নারী আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(FAQ) সরলাবালা দেবী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
সরলাবালা দেবী ছিলেন একজন বাঙালি সমাজসেবিকা, লেখিকা ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত। তিনি উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের প্রথমভাগে নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সরলাবালা দেবী নারী শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। তাঁর আত্মজীবনী “আমার জীবন” বাংলা সাহিত্যে নারীদের লেখা অন্যতম প্রাচীন আত্মজীবনী।
সরলাবালা দেবী ব্রাহ্মসমাজ এবং বিভিন্ন নারী উন্নয়নমূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিশেষত নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে।
এটি সরলাবালা দেবীর আত্মজীবনীমূলক রচনা, যা বাংলা সাহিত্যে নারীর আত্মপ্রকাশ ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হয়।
সরলাবালা দেবীর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় কিভাবে সমাজের বাধা অতিক্রম করে একজন নারী শিক্ষা, সংস্কার ও সচেতনতার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারেন।
সরলাবালা দেবী ১৮৯২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।