মহিয়ষী সরমা গুপ্তা ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম সাহসী ও সমাজসচেতন নারী, যিনি নারী সমাজকে জাতীয় আন্দোলনের মূলধারায় যুক্ত করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামীই নন, বরং নারী শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের প্রতীকও ছিলেন।
বিপ্লবী সরমা গুপ্তা
| ঐতিহাসিক চরিত্র | সরমা গুপ্তা |
| পরিচিতি | ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজকর্মী ও নারী সংগঠক |
| জন্ম | ১৮৮২ খ্রি, |
| জন্মস্থান | ঢাকা, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) |
| পিতামাতা | গিরীশ চন্দ্র সেন, সরলাসুন্দরী সেন |
| প্রধান ভূমিকা | অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, নারী সংগঠন গঠন, নারী শিক্ষার প্রচার |
| রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ | অসহযোগ আন্দোলন (১৯২১), স্বদেশী আন্দোলন |
| মৃত্যু | ১৯৫০ খ্রি |
সরমা গুপ্তা
ভূমিকা :- ভারতবর্ষ-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়, আর সেই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম হলেন বিপ্লবী সরমা গুপ্তা। তিনি ছিলেন একজন অগ্রণী সমাজকর্মী, নারী শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি নারী সমাজের উন্নয়ন ও জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন সেই সময়ের নারী জাগরণের প্রতীক, যিনি সমাজ ও জাতির মুক্তির স্বপ্নে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, সাহস, শিক্ষা ও দেশপ্রেমের সমন্বয়েই প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব।
সরমা গুপ্তার জন্ম
১৮৮২ সালে ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন মহিয়ষী সরমা গুপ্তা। তাঁর পিতা গিরীশচন্দ্র সেন ও মাতা সরলাসুন্দরী সেন।
স্বামী ও সন্তানহারা সরমা গুপ্তা
বিবাহের কয়েক বৎসর পর সরমা গুপ্তা সন্তান ও স্বামীহারা হয়ে ঢাকায় পিত্রালয়ে চলে আসেন।
গান্ধীজীর ভাবধারায় আকৃষ্ট সরমা গুপ্তা
তিনি দেশের সেবাতেই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি গান্ধীজীর ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হন।
গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সরমা গুপ্তা
১৯২৪ সালে সরমা দেবী আশালতা সেন-এর সঙ্গে ঢাকায় গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি গঠন করেন। এই সমিতি থেকে চরকা ও খদ্দর প্রচার করা, খাদি ও শিল্প-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা, সভা-সমিতি আহ্বান করা এবং নানা গঠনমুলক কাজ করা হত। মহিলাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। দুর্বৃত্তদেব হাত থেকে আত্মরক্ষা শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে সমিতিতে লাঠি-ছোরা খেলা শিক্ষা দেবার ব্যবস্থাও করা হয়। শিক্ষাদান করতেন বিপ্লবী আশুতোষ দাশগুপ্ত।
জুড়ান শিক্ষামন্দির প্রতিষ্ঠায় সরমা গুপ্তা
- (১) ১৯২৯ সালে সরমা গুপ্তা ও আশালতা সেন গেণ্ডারিয়ার দুই মাইল দূরে একটি নিরক্ষর ও নমঃশূদ্রপ্রধান চাষীদের গ্রামে জুড়ান শিক্ষামন্দির নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ঐ গ্রামের কোনো কোনো লোক কংগ্রেস কর্মীদের সেখানে কংগ্রেসের কাজ করতে প্রবল বাধার সৃষ্টি করে।
- (২) তখন সেই গ্রামের একজন বয়োবৃদ্ধ মাতব্বর অমরচাঁদ মিস্ত্রী তাঁদের কাজে আন্তরিকভাবে সহায়তা করতে থাকেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ও সাহায্যে ঐ অনুন্নত সম্প্রদায়ের বিদ্যালয়টি তারা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।
- (৩) এই স্কুলের প্রথম পুরস্কার বিতরণী সভাতে অমরচাঁদ মিস্ত্রীর এক পৌত্র পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পুরস্কারস্বরূপ মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একখানা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পান। সেই সভাতেই সে যখন পিতামহের হাতে রামায়ণখানি দিয়ে প্রণাম করে তখন সেই বৃদ্ধের চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরে পড়তে থাকে।
- (৪) বংশানুক্রমে নিম্নবর্ণের একটি পরিবারের বৃদ্ধ অভিভাবকের শিক্ষাপ্রাপ্ত পৌত্রের কাছ থেকে পাওয়া রামাযণখানা যে কী অমূল্য সম্পদ বলে মনে হয়েছিল তা ভাষা দিয়ে বোঝাবার নয়, চোখের জল দিয়েই বুঝাবার।
- (৫) এই বিদ্যালয়ের কোনো কোনো ছাত্র পরে ম্যাট্রিক পাস করেছেন, কোনো কোনো ছাত্র কলেজেও পড়েছেন। আশেপাশের ৩৩৪টি গামের ছেলেরাও এই জুড়ান গ্রামে এসে শিক্ষা লাভ করত। সরমা দেবী বিদ্যালয়টির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তার মৃত্যুর পর তারই নামে বিদ্যালয়টি আজও চলছে।
লবণ আইন অমান্য করেন সরমা গুপ্তা
১৯৩০ সালে সরমা দেবী সত্যাগ্রহী সেবিকা দলের কর্মীরূপে নোয়াখালি গিবে লবণ আইন অমান্য করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ঢাকা শহর ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন পরিচালনা করেন।
গ্রেপ্তার সরমা দেবী
১৯৩২ সালে আন্দোলন পরিচালনা করে তিনি গেপ্তার হয়ে ঢাকা জেলে প্রেরিত হন। মুক্তির পর তাঁর প্রধান কাজ ছিল ঢাকা জেলে কারাদণ্ডে দণ্ডিত মহিলাদের খোঁজখবর নেওয়া, কারামুক্ত হলে তাদের ঢাকা থেকে নিজ নিজ গ্রামে অথবা কর্মকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া।
বে-আইনী প্রচারপত্র বিলি করার দায়িত্বে সরমা গুপ্তা
বিভিন্ন বে-আইনী প্রচারপত্র সাইক্লোস্টাইল করিয়ে মহিলাদের দিয়ে তিনি বিলির ব্যবস্থা করতেন। সত্যাগ্রহী সেবিকা দলের নিজস্ব সাইক্লোস্টাইল মেশিন ছিল-এই বিষয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার উপর।
কংগ্রেসের প্রচারের কাজে সরমা দেবী
তিনি কংগ্রেসের প্রচারের কাজে ঢাকা জেলার অনেক গ্রামে এবং কুমিল্লা, শ্রীহট্ট প্রভৃতি স্থানে পরিভ্রমণ করেন।
স্নেহশীলা বউদ সরমা গুপ্তা
বিপ্লবী সরমা দেবী ছিলেন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের বহু দেশসেবকেরই স্নেহশীলা ‘বউদি’, এবং বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্রী।
সরমা গুপ্তার মৃত্যু
১৯৪২ সালে তিনি কঠিন রোগে ভগ্নস্বাস্থ্য হন। ১৯৫০ সালে তাঁর দেহাবসান হয়।
উপসংহার :- বিপ্লবী সরমা গুপ্তা ছিলেন এমন এক সাহসী নারী, যিনি শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখেননি—বরং নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই স্বপ্ন পূরণের পথে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ, নারী সংগঠনের নেতৃত্ব এবং শিক্ষার প্রসারে নিরলস প্রচেষ্টা তাঁকে এক অনন্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
(FAQ) সরমা গুপ্তা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
সরমা গুপ্তা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বিশিষ্ট নারী বিপ্লবী, সমাজকর্মী ও নারী সংগঠক। তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ও সমাজে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর পিতা ছিলেন গিরীশ চন্দ্র সেন এবং মাতা সরলাসুন্দরী সেন।
তিনি ১৯২৪ সালে গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল নারী সমাজকে সংগঠিত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার কেন্দ্র।
তিনি ১৯২৯ সালে জুড়ান শিক্ষামন্দির নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারী শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হ্যাঁ, ১৯৩২ সালে ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বিশ্বাস করতেন— দেশের স্বাধীনতা ও নারীর মুক্তি একে অপরের পরিপূরক।
তিনি ছিলেন বঙ্গদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূতদের একজন, যিনি সমাজে নারীর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সরমা গুপ্তাকে আজও স্মরণ করা হয় নারী নেতৃত্ব, দেশপ্রেম এবং শিক্ষার প্রতীক হিসেবে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান ও ভাবধারা নারীর ক্ষমতায়নে অনুপ্রেরণা জোগায়।
আমরা শিখি— সাহস, শিক্ষার মূল্য, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং নারী শক্তির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অনুপ্রেরণা।