ঢাকার সরযূবালা সেন

সরযূবালা সেন ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসী ও দেশপ্রেমিক নারী বিপ্লবী। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে নারী সমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল ত্যাগ, সংগ্রাম ও আদর্শে ভরপুর — যা দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে আজও স্মরণীয়। সরযূবালা সেন সমাজসেবায়ও সক্রিয় ছিলেন এবং নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ভারতীয় নারীর আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন।

বিপ্লবী সরযূবালা সেন

ঐতিহাসিক চরিত্রসরযূবালা সেন
জন্ম১৮৮৯ খ্রি, ঢাকা
পরিচিতিস্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবিকা ও নারী শিক্ষার প্রবক্তা
কার্যক্ষেত্রব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নারী জাগরণ ও সমাজসংগঠন
আন্দোলনে ভূমিকাস্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নারীদের সংগঠিত করা
প্রধান অবদাননারী শিক্ষা, জাতীয় চেতনা ও সমাজ সংস্কারে কাজ করা
আদর্শমহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের চিন্তাধারা
উত্তরাধিকারনারী স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয়

সরযূবালা সেন

ভূমিকা :- সরযূবালা সেন ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক সাহসী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারী ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশ শাসনের দমননীতি ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তুলেছিলেন এবং নারী সমাজকে জাতীয় আন্দোলনে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সমাজে নারী শিক্ষার প্রসার ও রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি জাতীয় জাগরণের একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর জীবন ত্যাগ, আদর্শ ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রমাণ করে যে নারীরা কেবল গৃহজীবনেই নয়, বরং জাতির মুক্তি আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরযূবালা সেনের নাম আজও স্মরণীয়, কারণ তিনি ছিলেন নারীশক্তি, দেশপ্রেম ও মানবকল্যাণের এক উজ্জ্বল প্রতীক।

সরযূবালা সেনের জন্ম

১৮৮৯ সালে সরযূবালা সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পৈতৃকভূমি বিক্রমপুরের মূলচর গ্রামে।

বিপ্লবী সরযূবালা সেনের পিতামাতা

তাঁর পিতার নাম শ্যামাচরণ সেন ও মাতার নাম সরলাসুন্দরী সেন।

সরযূবালা সেনের দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা

সরযূবালা দেবী ১৯১১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হন এবং তাঁর মধ্যে দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। তিনি খদ্দর-প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘গেণ্ডারিয়া শিল্পাশ্রমে’ বয়নকার্য শিক্ষা করেন।

গ্রেপ্তার সরযূবালা দেবী

১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন ‘সত্যাগ্রহী সেবিকা দল’-এর সদস্যরূপে। পুনরায় ১৯৩২ সালের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাতে ঐ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সরযূবালা সেনের কোর্ট পিকেটিং

মুক্তির পর তিনি বিক্রমপুর অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি ‘নশঙ্কর মহিলা শিবির’ থেকে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন দীর্ঘদিন পর্যন্ত। মহিলাগণ ঘরসংসার ছেড়ে এখানে অবস্থান করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। শিবিরে একত্রিত মহিলাদের নিয়ে সরযূবালা সেন ইউনিয়ন বেঞ্চ কোর্টে পিকেটিং করতেন।

শোভাযাত্রা পরিচালনায় সরযূবালা দেবী

তিনি গ্রামে গ্রামে সভা ও বৈঠক, এমনকি জলপথেও নৌকায় শোভাযাত্রা পরিচালিত করতেন। এঁদের কোর্ট-পিকেটিং-এর ফলে কিছুদিনের জন্য কয়েকটি কোর্ট বন্ধ থাকে এবং মদ-গাঁজার দোকানও বন্ধ হয়ে যায়। লাঠি-চার্জ করেও এই সমস্ত মহিলা কর্মীদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয় নি।

মহিলাদের শিবির থেকে বিতাড়ন

চৌকিদারী ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনের ফলে যাঁরা ঐ ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করেন তাঁদের অনেকের মালপত্র ক্রোক করা হয়। এই সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টার ফলে পুলিস বার বার ‘নশঙ্কর শিবির’-এর মহিলাদের বিতাড়িত করে এবং বারবারই তাঁরা শিবির দখল করে বসেন।

সরযূবালা সেনের নেতৃত্বে মহিলা সম্মেলন

১৯৩২ সালে সরযূবালা সেন ও তাঁর সহকর্মী মহিলাদের বিশেষ প্রচেষ্টায় ঘোর বর্ষার সময় পুলিসের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে ‘বিক্রমপুর রাষ্ট্রীয় মহিলা সম্মেলন’-এর প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

নৌকাতেই মহিলাদের রাত্রিযাপন

বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকাযোগে সমাগত মহিলাগণ সম্মেলন-স্থানের কাছাকাছি পৌঁছে রাত্রির অন্ধকারে ঝোপ-ঝাডের ভিতর নৌকা লাগিয়ে, নৌকাতেই রাত্রিযাপন করেন।

জাতীয় পতাকা হাতে উপস্থিত মহিলা মহল

পরদিন প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ধ্বনিসহ হঠাৎ সকলে সম্মেলন-ক্ষেত্রে জাতীয় পতাকা হাতে উপস্থিত হন এবং সম্মেলনের কাজ আরম্ভ করেন। সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেন ক্ষান্তকালী দেবী। তাঁর একমাত্র পুত্র ও পুত্রবধূ যখন আন্দোলনে যোগদান করে কারারুদ্ধ হন তখন এই বয়োবৃদ্ধা মহিলা অগ্রসর হয়ে আসেন কারাবরণ করবার জন্য।

কারাদণ্ডে দণ্ডিত মহিলা সভ্য

সম্মেলন আরম্ভ হবার অল্প পরেই পুলিসবাহিনী সভাস্থল ঘিরে ফেলে এবং সভানেত্রীসহ ১৫ জন মহিলাকে গ্রেপ্তার করে; এঁদের মধ্যে ক্ষান্তকালী দেবী প্রমুখ সাতজনকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

বে-আইনী কংগ্রেসে সরযূবালা সেন

১৯৩৩ সালে কলকাতায় বে-আইনী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় নেলী সেনগুপ্তার সভানেত্রীত্বে। সরযূবালা দেবী ঢাকা কংগ্রেসের প্রতিনিধিরূপে এই বে-আইনী কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং গ্রেপ্তার হন।

গঠনমূলক কাজে সরযূবালা সেন

মুক্তির পর পুনরায় তিনি আইন অমান্য করেন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে বহরমপুর জেলে প্রেরিত হন কারামুক্তির পর তিনি ‘ঢাকা কল্যাণকুটিরে’ অবস্থান করে গঠনমূলক কাজে ব্যাপৃত হন।

স্মরণীয় সরযূবালা সেন

নারী স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন সরযূবালা সেন।

উপসংহার :- সরযূবালা দেবী ছিলেন এমন এক নারী, যিনি সমাজে নারীর অবস্থান ও স্বাধীনতার ধারণাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম, আদর্শ ও আত্মত্যাগ ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি শুধু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ ছিলেন না, বরং নারী শিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ হিসেবেও পরিচিত। সরযূবালা সেন প্রমাণ করেছিলেন যে জাতীয় মুক্তি ও সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রামে নারী শক্তিই হতে পারে সমাজের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাঁর অবদান ও ত্যাগ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায় এবং নারী ক্ষমতায়নের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

(FAQ) সরযূবালা সেন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. সরযূবালা সেন কে ছিলেন?

সরযূবালা সেন ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সাহসী নারী বিপ্লবী ও সমাজসেবিকা, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

২. সরযূবালা সেন কোন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং নারী সমাজকে জাতীয় আন্দোলনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

৩. সরযূবালা সেনের প্রধান অবদান কী ছিল?

তাঁর প্রধান অবদান ছিল নারী শিক্ষা প্রসার, সমাজ সংস্কার, এবং নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।

৪. সরযূবালা সেন কি কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

ঐতিহাসিক সূত্রে তাঁর নির্দিষ্ট সংগঠন সংযুক্তির তথ্য সীমিত, তবে তিনি স্থানীয় দেশপ্রেমিক ও সমাজসংগঠকদের সঙ্গে কাজ করতেন বলে ধারণা করা হয়।

৫. সরযূবালা সেন কেন স্মরণীয়?

তিনি নারী স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয়। তাঁর জীবন ভারতীয় নারীর আত্মমর্যাদা ও সংগ্রামী চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

Leave a Comment