নারী বিপ্লবী সাবিত্রী দেবী ছিলেন তমলুকের এক সাধারণ গ্রামীণ নারী, যিনি ১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময় অক্লান্তভাবে মানুষের সেবা করেছেন, সাহসিকতার উদাহরণ স্থাপন করেছেন, এবং পরে কঠোর দরিদ্রতায় মারা গেছেন। তাকে নিয়ে প্রকাশিত খবর ও কবিতা বেশিক্ষণ ধরে স্মৃতিতে থাকার কথা থাকলেও, এখনও পর্যন্ত তাঁর জীবনী ও ত্যাগ অনেকে জানেন না।
বিপ্লবী সাবিত্রী দেবী
ঐতিহাসিক চরিত্র | সাবিত্রী দেবী |
পরিচিতি | ভারত ছাড়ো আন্দোলন-র সময়কার বিপ্লবী, বীরাঙ্গনা |
জন্মস্থান | চাঁদরা গ্রাম, তমলুক, ধেরুয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর |
পিতার নাম | সীতানাথ মাইতি |
মাতার নাম | সুখোদা দেবী |
সময়কাল | আনুমানিক ১৯১২ – ১৯৯২/১৯৯৪ |
প্রধান ভূমিকা | ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে আহত বিপ্লবীদের সেবা ও সাহসী প্রতিবাদ |
ইতিহাসে অবদান | স্বাধীনতা সংগ্রামে অবহেলিত নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতীক |
সাবিত্রী দেবী
ভূমিকা :- সাবিত্রী দেবী ছিলেন ভারত-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অনালোচিত, অথচ অসাধারণ সাহসী নারী সংগ্রামী। তার জীবন আমাদের শেখায়, দেশপ্রেম ও মানবতার জন্য অবদান রাখতে সমাজের প্রচলিত মর্যাদা বা উচ্চ সামাজিক অবস্থানের প্রয়োজন হয় না। তিনি ছিলেন এমন একজন যিনি সমস্ত ভয় ও লজ্জা উপেক্ষা করে বিপ্লবীদের সেবা করেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ঝাঁটা ও বঁটি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন, এবং আহত সংগ্রামীদের আশ্রয় ও শুশ্রূষা দিয়েছেন।
সাবিত্রী দেবীর জন্ম
ভারতের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সাবিত্রী দেবী ১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
সাবিত্রী দেবীর পিতামাতা
তার পিতার নাম সীতানাথ মাইতি ও মায়ের নাম সুখোদা দেবী।
মাস্টারদাকে আশ্রয় দেন সাবিত্রী দেবী
চট্টগ্রামে ধলঘাট নামক গ্রামে নবীন চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রী সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী আশ্রয় দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর নেতা বিপ্লবী সূর্য সেনকে অর্থাৎ মাস্টারদাকে। মাস্টারদার অনুগত কর্মী নির্মল সেন, অপূর্ব সেন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তখন সেখানেই আত্মগোপন ক’রে ছিলেন।
সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মিলিটারী আক্রমণ
১৯৩২ সালের ১২ই জুন রাতে মিলিটারী এসে হঠাৎ সেই বাড়ী ঘিরে ফেলে। মিলিটারী ও বিপ্লবী উভয়পক্ষে বেধেছিল তুমুল সংগ্রাম। বিপ্লবীদের গুলীতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের প্রাণহীন দেহ ভূলুণ্ঠিত হয়। নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন মিলিটারীর গুলীর আঘাতে নিহত হন। সেই দারুণ গোলমালের মধ্যে মাস্টারদা প্রীতিলতাকে নিয়ে অন্তর্ধান হন।
মহীয়সী সাবিত্রী দেবীর কারাদণ্ড
বিপ্লবীবী সূর্য সেন ও তাঁর অনুবর্তীদের আশ্রয় দেবার অপরাধে সাবিত্রী দেবীর এবং তাঁর একমাত্র ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর প্রতি চার বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। তাঁদের তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীরূপে জেলে রেখে দেওয়া হয়।
সুপারিন্টেন্ডেট কাটারিয়ার নিষ্ঠুরতা
তাঁদের নিয়ে গেল মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে। জেলের সুপারিন্টেন্ডেট তখন কাটারিয়া যেন নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার একটা প্রতিমূর্তি। রামকৃষ্ণ যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে জেল হাসপাতালে নাম মাত্র চিকিৎসাধীন রইলেন। তার শীর্ণ দুর্বল পা-দুখানিতে লোহার ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দেওয়া আছে। লোহার ডাণ্ডা বহন করছেন যক্ষ্মারোগী শুয়ে শুয়েও। রোগের অসহ্য যাতনা ও কাশির যন্ত্রণার সঙ্গে বেজে চলেছে পায়ের শৃঙ্খল। বোধকরি ইংরেজ শাসনের চরম বর্বরতার এক পৈশাচিক পরিচয় পেয়েছিল সেদিন মেদিনীপুর জেলের হাসপাতাল।
যক্ষ্মারোগীর নিশ্বাসে কাটারিয়ার নির্যাতনের ছাপ
সুপারিন্টেন্ডেন্ট কাটারিয়া ছিলেন ডাক্তারও। তিনি ডাক্তারি কতখানি করেছেন সে-পরিচয় জানি না, কিন্তু তাঁর নির্যাতনের এক চরম রূপ ছাপ রেখে গেছে হাসপাতালের যক্ষ্মারোগীর প্রতিটি নিশ্বাসে।
জেলের ফিমেল ইয়ার্ডে সাবিত্রী দেবী
মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলেরই ফিমেল-ইয়ার্ডে মা সাবিত্রী দেবী অসুস্থ পুত্রকে একবার দেখবার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বৃথাই মাথা কুটে মরেছেন, অনুমতি মেলে নি।
মৃত পুত্রের সামনে সাবিত্রী দেবী
পুত্র রামকৃষ্ণের দিন ফুরিয়ে এসেছিল। দীপ নিভে গেল কিন্তু ডাণ্ডাবেড়ী তাঁর দেহ থেকে অপসৃত হল না। জীবিতকালে মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা তাঁর হয়নি একই জেলে থাকা সত্ত্বেও। মৃত পুত্রকে দেখাবার জন্য বিধবা মা সাবিত্রী দেবীকে মেয়েদের ‘ডিগ্রী’ থেকে এবার নিয়ে আসা হল। যক্ষ্মারোগাক্রান্ত একমাত্র পুত্রের শবদেহে তখনো বাঁধা রয়েছে ইংরেজের প্রবল পরাক্রমের চিহ্ন ডাণ্ডাবেড়ী।
কবির লেখনী
বুঝি এমনসব দুর্লভ বস্তুদের মনে করেই কবি লিখেছিলেন –
“তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে কেমন করে সইব, বাতাস আলো গেল মরে একি রে দুদৈব!”
মাস্টারদার প্রতি সাবিত্রী দেবীর অটুট শ্রদ্ধা
জেল থেকে মুক্তি পাবার পরও সাবিত্রী দেবীকে পুলিস রেহাই দেয়নি। অনেক কষ্ট ও নির্যাতন তাঁকে প্রতি পদে সইতে হয়। মাস্টারদার প্রতি সাবিত্রী দেবীর অটুট শ্রদ্ধাই ছিল তাঁর মনোবলের পাথেয়। তারই পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি বাকী জীবনে তাঁর অনমনীয় দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে। সমস্ত পীড়ন তিনি নীরবে সহ্য করে গেছেন।
সর্বংসহা সেবিকা সাবিত্রী দেবী
স্বাধীন ভারতের ভিত্তি যাঁরা একদিন আপন জীবন বলি দিয়ে গেঁথে গেছেন তাঁদের পশ্চাতে ছিলেন এই সব সাবিত্রী দেবী ও রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর মতো কত নীরব ও সর্বংসহা সেবিকা ও সেবক। তাঁরাও নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাবেন নি, দুঃখকে চিরজীবনের পাথেয় করে নিয়ে শহীদদের এগিয়ে চলার রাস্তা তৈরী করে চলেছিলেন।
অমূল্য মণিমাণিক্যর একজন সাবিত্রী দেবী
জাতির জীবন সমুদ্রের তলায় কত অমূল্য মণিমাণিক্য এমনি করে ছড়িয়ে আছে, আমরা তার কতটুকু খবর রাখি!
উপসংহার :- সাবিত্রী দেবী ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক ও সংগ্রামী নারী, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শুধু একজন বিপ্লবীই নন, বরং নারীর ক্ষমতায়ন ও সমাজ পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। তাঁর আত্মত্যাগ, আদর্শ ও সংগ্রাম আজও জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। সাবিত্রী দেবীর জীবন আমাদের শেখায় কিভাবে দৃঢ় সংকল্প, সাহস ও দেশপ্রেম দিয়ে একটি জাতির ইতিহাসে পরিবর্তন আনা যায়।
(FAQ) বিপ্লবী সাবিত্রী দেবী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?
সাবিত্রী দেবী ছিলেন একজন সাহসী ভারতীয় নারী বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন।
তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, যা নারীদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করেছিল।
তিনি ব্রিটিশ শাসনামলে, বিশেষত ১৯২০-৪০-এর দশকে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি একজন সংগ্রামী ও আত্মত্যাগী বিপ্লবী নারী হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, যিনি নারী সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
দেশপ্রেম, সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও ন্যায়বোধ—এই গুণগুলো তাঁর জীবন থেকে আমাদের শেখার বিষয়। তাঁর মতো বিপ্লবীরা প্রমাণ করেছেন যে নারী শক্তিও জাতির মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।