শঙ্করাচার্য

ভারতের অন্যতম মহান দার্শনিক ও বেদান্ত দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন শঙ্করাচার্য। তিনি অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত এবং জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে আত্মস্বরূপ জ্ঞান লাভের উপর জোর দেন। অষ্টম শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মের সংস্কারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং অসংখ্য দর্শনমূলক গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য, উপনিষদ ভাষ্য এবং গীতা ভাষ্য। তাঁর শিক্ষা এবং দর্শন আজও বিশ্বজুড়ে হিন্দু দর্শনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

Table of Contents

পন্ডিত শঙ্করাচার্য

ঐতিহাসিক মনীষীশঙ্করাচার্য
জন্মখ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী (প্রায় ৭৮৮ খ্রি)
জন্মস্থানকেরালা, ভারত
দর্শনঅদ্বৈত বেদান্ত
মূল দর্শনব্রহ্ম সত্যম, জগত মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব ন আপর
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থব্রহ্মসুত্র ভাষ্য, ভাগবদগীতা ভাষ্য, উপনিষদ ভাষ্য
প্রতিষ্ঠিত মঠচারধাম মঠ : শ্রিংগেরি, দ্বারকা, পুরী, জোশীমঠ
অবদানহিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ, অদ্বৈত দর্শনের প্রসার, চার মঠ প্রতিষ্ঠা
মৃত্যুআনুমানিক ৮২০ খ্রি, কেদারনাথ, উত্তরাখণ্ড

শঙ্করাচার্য

ভূমিকা :- জীবনের সর্বস্তরে যখন ধর্মের গ্লানি প্রকট হয়ে ওঠে, ধর্মের নামে প্রাধান্য লাভ করে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, অনাচার, অন্যায়, ব্যভিচারে কলুষিত হয়ে ওঠে সমাজজীবন; সেই যুগ সন্ধিক্ষণে পরিত্রাতা রূপে যুগে যুগে দেশে দেশে সত্যের বার্তাবাহক মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে থাকে। আচার্য রূপে আপন কর্ম ও সাধনার দ্বারা তাঁরা অধর্মের গ্লানি দূর করে চিরন্তন সত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। যুগপুরুষ আচার্য শঙ্করের আবির্ভাবও এমনি ভারতবর্ষের এক যুগসংকটকালে হয়েছিল।

বৌদ্ধ ধর্মের মহাবাণী

বর্ণাশ্রমশাসিত ব্রাহ্মণ্য ভারতের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মধ্যে ভগবান বুদ্ধদেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর প্রেম করুণা অহিংসা ও সংস্কারমুক্ত উদার ধর্মমত। ভারতবর্ষের নিপীড়িত সমাজ মানস সাদরে বরণ করে নিয়েছিল তাঁকে। বৌদ্ধ ধর্ম-এর মহাবাণী বৈদিক ভারতকে প্লাবিত করে ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া খণ্ডের অন্যান্য দেশে। কিন্তু বুদ্ধের পরিনির্বাণের কয়েকশো বছরের মধ্যেই নানা আচার কুসংস্কার আর তান্ত্রিকতার অনাবিল অনুপ্রবেশ ঘটে বুদ্ধমত কলুষিত হয়ে ওঠে। শোচনীয় অধঃপতন নেমে আসে ভারতবাসীর জীবনে।

সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক শঙ্করাচার্য

বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রতাপে প্রাচীন মুনি ঋষিদের সাধনালব্ধ অধ্যাত্মজ্ঞান ভুলে গিয়েছিল মানুষ। অবলুপ্তপ্রায় সেই শাশ্বত অদ্বৈতবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়েছিলেন আচার্য শঙ্কর। অদ্বৈতবাদের মূল কথা হল ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, ব্রহ্মা ছাড়া জগতের সব কিছুই মিথ্যা। ব্রহ্ম থেকেই সকল কিছুর উৎপত্তি, ব্রহ্মতেই অবলুপ্তি। এই দার্শনিক মতবাদকে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রথম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক শঙ্করাচার্যের জীবনকাহিনী অতি বিচিত্র।

শঙ্করাচার্যের জন্ম

দক্ষিণ ভারতের কেরালার কালাডি গ্রামে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৈশাখী শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে শঙ্করের জন্ম। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু, মাতা বিশিষ্টা দেবী।

পন্ডিত শঙ্করাচার্যের বাল্যকাল

শ্রুতিধর হয়েই জন্মেছিলেন শঙ্কর। একবার যা শুনতেন তা কখনও ভুলতেন না। বাল্য বয়সেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে সকলে বিস্মিত হয়েছিলেন। পণ্ডিত ব্রাহ্মণের পরিবার। পিতার কাছেই পুত্রের শিক্ষা শুরু হয়। কিন্তু বেশিদিন পিতার সান্নিধ্য পান নি শঙ্কর। তিন বছর বয়সেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। পুত্রের লালনপালনের ভার গ্রহণ করলেন বিশিষ্টা দেবী।

শঙ্করাচার্যের শিক্ষা

পাঁচ বছর বয়সে উপনয়নের পরে তাঁকে পাঠানো হল গুরুগৃহে। সেখানে মাত্র দুবছরের মধ্যেই নানা শাস্ত্র আয়ত্ত করে তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন। মাত্র সাত বছরের বালকের এমন অতিলৌকিক প্রতিভা জগতে বিরল।

পন্ডিত শঙ্করাচার্যের টোল

শিক্ষান্তে গৃহে ফিরে এসে নিজেই টোল খুললেন। প্রথমে সংশয় থাকলেও শঙ্করের পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। টোলের শিক্ষকতাতেও অল্পদিনেই শঙ্করের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।

শঙ্করাচার্যের ভাগ্য গণনা

মাধবাচার্যের বিখ্যাত শঙ্কর-বিজয় গ্রন্থে বলা হয়েছে, শঙ্করের বাল্যকালে একবার কয়েকজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত তাঁদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। সর্বসুলক্ষণযুক্ত বালককে দেখে আকৃষ্ট হয়ে তাঁরা তাঁর ভাগ্য গণনা করতে চান। গণনা শেষ হলে তাঁরা বিশিষ্টা দেবীকে জানান, এই বালক একদিন ভারতের আধ্যাত্ম জগতে দীপ্তিমান সূর্যের মতো নিজেকে প্রকাশ করবে। ভারতবর্ষের মানুষ যুগ যুগ ধরে তাঁকে শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে স্মরণ করবে। পরেই বিষণ্ণ কণ্ঠে পণ্ডিতরা জানালেন, কিন্তু এই বালক স্বল্পায়ু, মাত্র ষোল বৎসর সে ইহলোকে থাকবে।

পন্ডিত শঙ্করাচার্যের মায়ের দুঃখ

বিশিষ্টা দেবী সাশ্রু নয়নে এই দুর্দৈবের প্রতিবিধান জানতে চাইলে, পুনরায় গণনা করে পণ্ডিতরা বললেন, যদি বালক সন্ন্যাস গ্রহণ করে তবেই এই অকাল-মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। তারপর থেকে মায়ের প্রতিটি দিন কেটেছে গভীর শঙ্কায় উদ্বেগে। ব্যাকুল হয়ে তিনি কেবল ভাবছেন, কী করে একমাত্র পুত্রকে সন্ন্যাসের অনুমতি দেবেন। বুকে পাষাণ বেঁধে দিন যাপন হয় মায়ের, পুত্রকে কাছ ছাড়া করার কথা ভাবতে বুক ফেটে যায়।

ধীমান বালক শঙ্করাচার্য

অপর দিকে ধীমান বালক শঙ্করের হৃদয়ে পণ্ডিতদের গণনা নতুন প্রজ্ঞার আলো প্রজ্বলিত করে। জগতে মৃত্যুই পরম সত্য। জীবনের পরিসমাপ্তি কখন আসবে কেউ জানে না। যতক্ষণ জীবন তার মধ্যেই জানতে হবে জগতের স্বরূপ, সুখ-দুঃখময় জীবনের গূঢ়তম রহস্যকে। জানতে হবে মুক্তির পথ। তিনি উপলব্ধি করেন, এক একটি মুহূর্তের সঙ্গে জীবনের পরিধিও সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। বৃথা কালক্ষেপের সময় নেই। মনে মনে সন্ন্যাস গ্রহণে কৃতসংকল্প হয়ে সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকেন।

মায়ের প্রতি শঙ্করাচার্যের সেবা

নিজের টোলে ছাত্রদের শিক্ষা দানের সঙ্গে সঙ্গে প্রগাঢ় মাতৃসেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। এই সময় একদিন তাঁর মা দূরবর্তী পূর্ণা নদী থেকে জল আনতে যান। ফেরার পথে পথশ্রমে ক্লান্তিতে পথের মধ্যেই তিনি মূর্ছিতা হয়ে পড়েন। মায়ের দুঃখ দূর করবার জন্য অভিভূত শঙ্কর শিবের উপাসনা করেন। কিছু দিন পরেই দেখা যায় নদীর স্রোত গতি পরিবর্তন করে তাঁদের গৃহের নিকট দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

রাজা রাজশেখরের সাথে শঙ্করাচার্যের সাক্ষাৎ

এই অলৌকিক ঘটনার কথা প্রচারিত হলে শঙ্করের নাম সমগ্র কেরল দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের তৎকালীন রাজা রাজশেখর স্বয়ং এসে শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে বহুমূল্য রত্নালঙ্কার উপহার দিতে চান। কিন্তু শঙ্কর সবিনয়ে সে সব প্রত্যাখ্যান করেন।

সন্ন্যাস গ্রহণে শঙ্করাচার্যের ইচ্ছা প্রকাশ

শঙ্করের যখন আট বছর বয়স, তৎকালীন সামাজিক রীতি অনুযায়ী তাঁর বিবাহের প্রস্তাব আসে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁর আয়ু মাত্র ষোল বছর। তাছাড়া তিনি জন্মসন্ন্যাসী। এর কিছুদিন পরেই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে মাতার অনুমতি প্রার্থনা করেন। পিতা মাতার অনুমতি ভিন্ন সন্ন্যাস গ্রহণ করা চলে না।

মায়ের অনুমতি লাভ

মাতা বেদনায় অধীর হন, কিছুতেই সম্মতি দিতে চান না। কিন্তু যাঁর জীবন কর্ম দৈব নির্দিষ্ট, দৈবের অনুগ্রহেই তার সমস্ত প্রতিকূলতা অসারিত হয়। একদিন বালক শঙ্কর মায়ের সঙ্গে পূর্ণা নদীতে স্নান করতে গেছেন। এমন সময় এক কুমীর শঙ্করকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। নিরূপায় মাতা এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে চিৎকার করতে থাকেন। শঙ্কর তখন মাতাকে বলেন, মা, তুমি যদি আমাকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দাও তবে আমার প্রাণ রক্ষা হয়। এই কুমীর এখনই আমাকে ছেড়ে দেবে। পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য ব্যাকুল মাতা সেই মুহূর্তে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেন। কুমীরও সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।

শঙ্করাচার্যের সন্ন্যাস গ্রহণ

মায়ের অনুমতি পাবার পর আট বছর বয়সেই গৃহত্যাগ করে পথে বার হলেন শঙ্কর। বিপদসঙ্কুল পথ প্রান্তর অরণ্য অতিক্রম করে প্রস্তরাকীর্ণ পাহাড়ি পথ ধরে দীর্ঘ দুই মাস পরে তিনি উপস্থিত হলেন নর্মদা নদীর তীরে ওঙ্কারনাথ পাহাড়ে।

মহাযোগী গোবিন্দপাদের নিকট শঙ্করাচার্য

গৃহত্যাগের আগেই শঙ্কর জানতে পেরেছিলেন অদ্বৈতবাদী মহাযোগী গোবিন্দপাদ এই পাহাড়েরই নিভৃত গুহায় ধ্যানমগ্ন রয়েছেন। ঈশ্বর উপলব্ধির দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল শঙ্কর সঙ্কীর্ণ গিরিপথ অতিক্রম করে উপস্থিত হলেন ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগীর সমীপে। অন্তরের আর্তি জানিয়ে বলেন, প্রভু, আমাকে ব্রহ্মজ্ঞান ও সন্ন্যাস দিয়ে কৃতার্থ করুন।

কঠোর তপস্যায় ব্রতী শঙ্করাচার্য

দিব্যকান্তি বালকের প্রতি করুণার দৃষ্টি বর্ষণ করে গোবিন্দপাদ শঙ্করকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? এই প্রশ্নের উত্তরে বালক শঙ্কর যে উত্তর দিয়েছিলেন, জগতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই। শঙ্কর বললেন, প্রভু আমি পার্থিব বস্তুনিচয়ের কোনওটিই নই। ইন্দ্রিয় সমষ্টিগত দেহও আমি নই। এই সমস্ত কিছুর অতীত শিব-স্বরূপ নির্লিপ্ত পরমাত্মার একটি অংশ মাত্র। শঙ্করের উত্তরে মুগ্ধ হন গোবিন্দপাদ। তিনি উপলব্ধি করেন, এই বালক সাধক এক মহাশক্তির আধার। তিনি সাগ্রহে তাঁকে অদ্বৈত তত্ত্ব শিক্ষা দেন। সন্ন্যাস দীক্ষাও তাঁর কাছেই পেলেন শঙ্কর। তারপর গুরুর গৃহেই কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন।

পরিব্রাজনে বের হলেন শঙ্করাচার্য

দীর্ঘ তিন বৎসর একাদিক্রমে সুগভীর তপস্যার পর গুরু প্রসাদে সাধনায় সিদ্ধ হলেন শঙ্কর। তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত হল অধ্যাত্ম সাধনার গূঢ় তত্ত্বজ্ঞান। গুরু তাঁকে বললেন, বৎস তুমি তপঃসিদ্ধ হয়েছ। এবার পরিব্রাজনে বার হও। প্রথমে বারাণসীতে যাও, সেখানে অদ্বৈততত্ত্ব প্রচার ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা কর।

কাশীতে শঙ্করাচার্য

গুরুর নির্দেশ পেয়ে শঙ্করাচার্য এলেন কাশীতে। সেইকালে কাশী ছিল ভারতের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মিলন কেন্দ্র। এখানে শাস্ত্রজ্ঞ সাধু পণ্ডিতেরা নিজেদের মধ্যে ধর্ম আলোচনা, হোমযজ্ঞ শাস্ত্র পাঠে নিরত থাকতেন। শঙ্কর এসে তাঁদের মধ্যে স্থান নিলেন। অল্প দিনেই কিশোর সন্ন্যাসীর পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে সকলে মুগ্ধ হলেন।

বিজ্ঞ পন্ডিতদের সাথে শঙ্করাচার্যের শাস্ত্র আলোচনা

শঙ্করের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। শাস্ত্রবিজ্ঞ পণ্ডিতগণ বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁর কাছে শাস্ত্র আলোচনার জন্য সমবেত হতে লাগলেন। শঙ্কর সকলের মতামতই শান্তভাবে শুনতেন। পরে নিজের শাণিত যুক্তিতে তাঁদের অভিমত খন্ডন করে অদ্বৈতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করতেন। এই ভাবে দেশের মহা মহা তত্ত্ববিদ পন্ডিত শাস্ত্রীয় যুক্তি তর্কে তাঁর কাছে পরাজিত হতে লাগলেন এবং অনেকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।

শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মজ্ঞানের শিক্ষা সম্পূর্ণ

  • (১) অপরাজেয় শাস্ত্রবেত্তা পন্ডিত ব্রহ্মবাদী শঙ্করের ব্রহ্মজ্ঞানের শিক্ষা বুঝি তখনো কিছু বাকি ছিল। কাশীতে এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ হল। একদিন তিনি সঙ্কীর্ণ গলি পথে মণিকর্ণিকার ঘাটে চলেছেন দেখলেন একটি মেয়ে তার স্বামীর মৃতদেহ কোলে নিয়ে পথ জুড়ে বসে আছে।
  • (২) নিকটবর্তী হয়ে শঙ্কর মেয়েটিকে বললেন, মা, শবদেহটা পথের পাশে সরিয়ে নিয়ে যাও। শঙ্করের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, সাধকবর, আপনি প্রচার করছেন শক্তিহীন ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই জগতের অধীশ্বর। আপনার কথা যদি সত্য হয় তাহলে শক্তিহীন এই শবদেহকে বলুন, সে নিজেই পাশে সরে যাবে।
  • (৩) এই উক্তি শুনে স্তম্ভিত হন শঙ্কর। মুহূর্তে তাঁর ভ্রম দূর হয়। তিনি উপলব্ধি করলেন, জগৎক্রিয়ায় ব্রহ্ম একা নন তার সঙ্গে ক্রিয়াশীল রয়েছেন আদ্যাশক্তি। তিনিই বিশ্বজগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়কারিণী। তাঁর শক্তিতেই ব্রহ্ম সক্রিয়, জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী। ব্রহ্মের উপস্থিতি রয়েছে সর্বজীবে, সর্বভূতে।
  • (৪) কিন্তু আদ্যাশক্তি মহামায়ার শক্তি ভিন্ন সকলেই অচল অনড়। জগতে প্রতিটি কাজের পেছনেই রয়েছে আদ্যাশক্তিরই শক্তি। শঙ্কর আরও উপলব্ধি করলেন, আদ্যাশক্তিকে বাদ দিয়ে ব্রহ্মের উপদেশ অসম্পূর্ণ।
  • (৫) ঈশ্বর একদিকে যেমন নিরাকার তেমনি সাকারও। জীব ও ব্রহ্ম অভেদ। এই ঘটনার পর থেকে অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা শঙ্কর, দ্বৈত মতবাদও প্রচার করতে লাগলেন।

আচার্য শঙ্করাচার্যের মনে জাতিভেদের কুসংস্কার

  • (১) ব্রহ্মা ও জীব অভেদ এই জ্ঞান লাভ হলেও আচারনিষ্ঠ শঙ্করের মন থেকে জাতিভেদের কুসংস্কার তখনো দূর হয় নি। অস্পৃশ্য নিচ জাতির প্রতি সংস্কার বশেই তিনি ঘৃণা বোধ করতেন। একদিন কাশীর সংকীর্ণ গলিপথ দিয়ে যাচ্ছেন শঙ্কর। এমন সময় সামনে পড়ল এক চণ্ডাল, তার সঙ্গে চারটি কুকুর। ছোঁয়াছুঁয়ির শঙ্কায় স্বভাবতঃই শঙ্কর সেই চণ্ডালকে পথ থেকে সরে দাঁড়াতে বললেন।
  • (২) সঙ্গে সঙ্গে চণ্ডাল উত্তর করল, তুমি কাকে সরে যেতে বলছ, দেহ না আত্মাকে? আত্মা তো, শুদ্ধস্বভাব ও সর্বব্যাপী কিন্তু নিষ্ক্রিয়। আর দেহ জড়, চলনশক্তি বর্জিত; কি করে সরবে? তোমার ব্রহ্মতত্ত্বের এক ও অভিন্ন ধারণা যদি সত্য হয় তাহলে তোমার দেহ আর আমার দেহে পার্থক্য কোথায়? তুমি তো জ্ঞানী, তাহলে ব্রাহ্মণ আর চণ্ডালে ভেদ করছ কেন?
  • (৩) চণ্ডালের জ্ঞানগর্ভ বচনে লজ্জিত হলেন শঙ্কর। তাঁর মনের কুসংস্কারের ভ্রম মুহূর্তে দূর হল। তিনি সবিনয়ে বললেন, তোমার কাছ থেকে আমি সর্বজীবে সমজ্ঞান শিক্ষা লাভ করলাম, তোমাকে প্রণাম। সেই দিন থেকে শঙ্করের মন থেকে অস্পৃশ্যতার কুসংস্কার দূর হল।

শঙ্করাচার্যের প্রথম শিষ্য

এই সময়ে চোলদেশীয় এক ব্রাহ্মণ যুবক সনন্দন শঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনিই আচার্য শঙ্করের প্রথম শিষ্য। পরবর্তীকালে সনন্দনের নাম হয় পদ্মপাদ। শঙ্করাচার্যের অন্যান্য প্রিয় শিষ্য হলেন হস্তামলক, ভোটকাচার্য, সুরেশ্বরাচার্য, সমিৎপাণি, চিদ্বিলাস, জ্ঞানকন্দ, বিষ্ণুগুপ্ত, শুদ্ধকীর্তি, ভানুমরীচি, বুদ্ধিবিরিঞ্চি ও আনন্দগিরি।

পন্ডিত শঙ্করাচার্যের প্রিয়তম শিষ্য

  • (১) একান্ত গুরুভক্ত সনন্দন ছিলেন শঙ্করের প্রিয়তম শিষ্য। তাঁকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করতেন। এ নিয়ে শিষ্যবর্গের অনেকের মনেই ঈর্ষা ছিল। শঙ্কর তা বুঝতে পেরে একদিন সুকৌশলে এক বিস্ময়কর ঘটনার অবতারণা করে সনন্দনের গুরুভক্তির অনন্য নিষ্ঠা প্রমাণ করলেন।
  • (২) সেদিন সনন্দন গঙ্গার অপর পারে দাঁড়িয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এপার থেকে শঙ্কর তাঁকে ডেকে বললেন, সনন্দন, আমার বিশেষ প্রয়োজন, তুমি এখনই এপারে চলে এসো। শুরুর আহ্বান পেয়ে সনন্দন মুহূর্ত মাত্র কালক্ষেপ করলেন না। তাঁর পায়ে ছিল খড়ম। তাই নিয়েই তিনি গুরুরনাম জপ করতে করতে গঙ্গার জলে নেমে পড়লেন।
  • (৩) তারপর এপার লক্ষ্য করে হেঁটে আসতে লাগলেন। তাঁর প্রতি পদক্ষেপেই নদীর বুকে পদ্মফুল ফুটে উঠতে লাগল। এই অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সকলেই অভিভূত হন। শঙ্কর সেই দিন থেকেই সনন্দনের নতুন নামকরণ করলেন পদ্মপাদ।

বদরিকাশ্রমে শঙ্করাচার্য

কাশীতে একবৎসর বাস করার পর শঙ্কর পরিব্রাজনে বের হলেন। প্রথমে উত্তরাপথে নানা তীর্থ পর্যটন করে তিনি উপস্থিত হলেন হিমালয় পর্বতে ব্যাসদেবের পুণ্যাশ্রম বদরিকাশ্রমে। এখানে অবস্থান কালে তিনি সংস্কৃত ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ ও বিভিন্ন ছন্দে স্তবস্তোত্রাদি প্রণয়ন করেন। এ সকলের মধ্যে ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, উপনিষদ ভাষ্য, গীতাভাষ্য, সর্ববেদান্তসিদ্ধান্ত, সনৎসুজাত ভাষ্য অন্যতম। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে শঙ্কর এসকল জগদ্বিখ্যত গ্রন্থ রচনা করেন।

শঙ্করাচার্যের দিগ্বিজয় গ্রন্থে উল্লেখ

উল্লেখ করার বিষয় হল, সুপ্রাচীন কালে হিমালয়েরই সপ্তসিন্ধব নামক স্থানে ব্রহ্মবিদ আর্য ঋষিগণ বেদ রচনা করেছিলেন। শঙ্করের দিগ্বিজয় গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য রচনার পর ব্যাসদেব ছদ্মবেশে উপস্থিত হয়ে তা পাঠ করে আনন্দে অভিভূত হন। পরে শঙ্করকে বর দিয়ে বলেন, বৎস ভারতের সুপ্রাচীন বৈদিক ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার সুমহান দায়িত্বভার তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। তোমার ষোল বৎসরের পরমায়ু বত্রিশ বৎসর হোক।

পন্ডিত শঙ্করাচার্য কর্তৃক সনাতন ধর্মের পুনপ্রতিষ্ঠা

বদরিকাশ্রম থেকে সতের বছর বয়সে শঙ্কর ধর্মবিজয়ে বের হন। দীর্ঘ পনের বৎসরকাল তিনি ভারতের নানা প্রান্তে পর্যটন করেন। এই সময়ে দেশের খ্যাতনামা বৌদ্ধ পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করে বিকৃত বৌদ্ধমতবাদ খন্ডন করেন এবং বেদাশ্রিত সনাতন ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

শাস্ত্রযুদ্ধে সামিল শঙ্করাচার্য

ধর্মবিজয়ে বেরিয়ে শঙ্কর প্রথমে প্রয়াগে গিয়ে মহাপন্ডিত সুমারিল ভট্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তাঁর নির্দেশে যোগবলে আকাশ পথে মিথিলার মাহিস্মতী নগরে উপস্থিত হয়ে কর্মকান্ডী দুর্ধর্ষ পন্ডিত মন্ডন মিশ্রকে শাস্ত্রযুদ্ধে আহ্বান করেন। ছয়দিন ব্যাপী দুজনের যে তর্কযুদ্ধ চলে তার মীমাংসা করেন মন্ডনপত্নী উভয়ভারতী। তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান ছিল সুবিদিত। মন্ডন মিশ্র তর্কে পরাস্ত হন। স্বামীর পরাজয়ের পর উভয়ভারতী শাস্ত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি গৃহস্থাশ্রম সম্বন্ধে শঙ্করকে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। আজন্ম সন্ন্যাসী শঙ্কর গৃহস্থাশ্রম সম্বন্ধে ছিলেন অনভিজ্ঞ। তাই প্রশ্নোত্তর দানের জন্য তিনি কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন।

মগধের রাজার শরীরে শঙ্করাচার্যের অবস্থান

সেই সময় শঙ্কর যোগবলে জানতে পারেন মগধ-এর রাজা অমরক পরলোক গমন করেছেন। তাঁর মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তিনি শিষ্যদের নিয়ে বাইরে এসে পাহাড়ের এক নির্জন গুহায় ধ্যানস্থ হলেন। তারপর সূক্ষ্মশরীরে রাজার দেহে প্রবেশ করলেন। মৃত রাজা জীবিত হয়ে উঠলেন। শবযাত্রীরা ঈশ্বরের অনুগ্রহে রাজা পুনর্জীবন লাভ করেছেন ভেবে মহাউল্লাসে সমারোহ সহকারে তাঁকে রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। রাজার দেহে প্রায় একমাস অবস্থান করে শঙ্কর রানীর কাছ থেকে নারী পুরুষের সম্পর্কের সব বিষয় জেনে নেন। পরে রাজার দেহ ত্যাগ করে নিজের দেহে প্রত্যাবর্তন করলেন।

স্বীয় শরীরে শঙ্করাচার্যের প্রত্যাবর্তন

এই সময় শিষ্যবর্গ তাঁর ধ্যানস্থ দেহ রক্ষা করছিলেন। স্বীয় শরীরে ফিরে আসার পর শঙ্কর শিষ্যদের নিয়ে উভয়ভারতীর সম্মুখীন হন এবং তাঁকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করেন। মন্ডনমিশ্র পরে শঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নামকরণ হয় সুরেশ্বরাচার্য।

মায়ের শয্যাপার্শ্বে শঙ্করাচার্য

সেই সময় কেরলে গ্রামের বাড়িতে শঙ্করের মাতা মৃত্যুশয্যায় পুত্রকে স্মরণ করছিলেন। যোগবলে তা জানতে পেরে শঙ্কর তৎক্ষণাৎ মগধ থেকে মায়ের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি মায়ের যথাসাধ্য সেবাশুশ্রূষা করেন এবং মৃত্যুকালে তাঁকে ইষ্টমূর্তি দর্শন করান।

শঙ্করাচার্যের জনহিতকর কাজ

মাতার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করে শঙ্কর ভারতের অন্যান্য প্রান্তে ভ্রমণ করেন। এই সময় বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম, যাজক, দ্বাইক, কাপালিক, কণাদ প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় পন্ডিত ক্ষপণক, নীলকণ্ঠ, সৌগত, রুচক, বান, ময়ূর, দন্ডী, উগ্র ভৈরব, শ্রীহর্ষ, ভাস্কর পন্ডিত ও অভিণব গুপ্ত প্রমুখকে শাস্ত্রযুদ্ধে পরাস্ত করেন। এঁদের অধিকাংশই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ধর্মবিজয় কালে বিভিন্ন প্রদেশের রাজা ও ধনশালী ব্যক্তি শঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের সহায়তায় তিনি নানা স্থানে বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করেন। পান্থশালা, চিকিৎসালয়, বিদ্যালয়, অন্নসত্র ছাড়াও পথিকদের ও যানবাহনের পশুদের জন্য জলাধার ও বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থা করেন।

ধ্যানমগ্ন শঙ্করাচার্য

কাশ্মীরের সারদামঠে কিছুকাল অবস্থান করার পর শঙ্কর তৎকালীন শিক্ষা সংস্কৃতির পীঠস্থান তক্ষশীলায় উপস্থিত হন। এখানে শাস্ত্রযুদ্ধে দেশ বিখ্যাত অনেক পন্ডিতকে তিনি পরাস্ত করেন। কাশ্মীর থেকে তিনি কেদারনাথে আসেন, এখানে তিনি বেশিরভাগ সময়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন।

হিন্দুধর্মের প্রচার ও প্রসার কল্পে শঙ্করাচার্যের অবদান

ধর্মবিজয়কালে আচার্য শঙ্কর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহু লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার করেন। এছাড়া হিন্দুধর্মের প্রচার ও প্রসার কল্পে মহীশূরে তুঙ্গভদ্রা নদী তীরে শৃঙ্গেরী মঠ, দ্বারকায় গোমতী তীরে সাবদামঠ, পুরীতে সমুদ্রকূলে গোবর্ধনমঠ ও বদ্রীনাথে অলকানন্দা নদী তীরে যোশী বা জ্যোতির্মঠ স্থাপন করেন। এক এক জন শিষ্যকে প্রত্যেক মঠের পরিচালন দায়িত্ব অর্পণ করেন। বর্তমানে এই সকল মঠের প্রধানগণ শঙ্করাচার্য নামেই অভিহিত হয়ে থাকেন।

পন্ডিত শঙ্করাচার্যের কীর্তি দশনামী সম্প্রদায় গঠন

আচার্য শঙ্করের অন্যতম কীর্তি হিন্দু ধর্মের সন্ন্যাসিভেদে দশনামী সম্প্রদায় গঠন। এই সম্প্রদায়গুলির পদবী হল তীর্থ, বন অরণ্য, গিরি, পুরী ভারতী, পর্বত, সাগর, সরস্বতী ও আশ্রম।

শঙ্করাচার্য রচিত গ্রন্থ

পন্ডিত শঙ্করাচার্য রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হল, মোহমুদগর, সাধনপঞ্চক, মান্ডুক্যকারিকা ভাষ্য, আনন্দলহরী, মণিরত্নমালা, বিবেকচূড়ামণি, আত্মবোধ, সাধনপঞ্চক, যতিপঞ্চক, অপরাধভঞ্জন, আত্মবোধ, গোবিন্দাষ্টক, সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্ত, বেদসার, শিবস্তব ইত্যাদি। তাঁর প্রণীত স্তব স্তোত্র শ্লোকের সংখ্যা প্রায় ৭৫ টি।

ধার্মিক শঙ্করাচার্যের দেহত্যাগ

তারপর একদিন শিয্যমন্ডলীকে উপদেশ দানের পর যোগবলে দেহত্যাগ করেন। সেই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল বত্রিশ বছর।

উপসংহার :- শঙ্করাচার্য ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা হিসেবে আত্মা ও ব্রহ্মের ঐক্যের ধারণা প্রচার করেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল গভীর জ্ঞান, যুক্তি এবং ধর্মীয় সংস্কারের প্রতীক। শঙ্করাচার্য ভারতীয় দর্শনকে একটি অভিন্ন ভিত্তি দিয়েছিলেন এবং হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী এবং প্রতিষ্ঠিত চার মঠ আজও ধর্মীয় ও দার্শনিক চর্চার কেন্দ্রে রয়েছে। শঙ্করাচার্যের দর্শন শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, মানবিক মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও অপরিসীম প্রাসঙ্গিক। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ আজও বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন ও চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে চলেছে। শঙ্করাচার্য সত্যিই ভারতের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে সমৃদ্ধ করেছেন।

(FAQ) শঙ্করাচার্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। শঙ্করাচার্য কে ছিলেন?

শঙ্করাচার্য ছিলেন ভারতীয় দার্শনিক, হিন্দুধর্মের সংস্কারক এবং অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা।

২। শঙ্করাচার্যের মূল শিক্ষা কী ছিল?

শঙ্করাচার্যের মূল শিক্ষা ছিল “অদ্বৈত বেদান্ত,” যা বলে ব্রহ্ম (পরমাত্মা) একমাত্র সত্য এবং জগত মায়া বা অস্থায়ী।

৩। শঙ্করাচার্য কেন বিখ্যাত?

তিনি অদ্বৈত বেদান্তের প্রসার ঘটান, হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবিত করেন এবং চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন যা আজও হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

৪। শঙ্করাচার্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কোনটি?

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য, ভাগবদ্গীতা ভাষ্য, এবং প্রধান উপনিষদগুলির ভাষ্য।

৫। শঙ্করাচার্যের মৃত্যু কোথায় হয়েছিল?

শঙ্করাচার্যের মৃত্যু হয় কেদারনাথে, যা হিমালয়ের পবিত্র স্থানগুলির একটি।

৬। শঙ্করাচার্যের দর্শনের মূল উদ্দেশ্য কী?

আত্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন এবং ব্রহ্ম ও জীবের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।

৭। শঙ্করাচার্যের চার মঠ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

চার মঠ ভারতের চার কোণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা হিন্দু ধর্মীয় ঐক্য ও জ্ঞান প্রচারের প্রতীক।

৮. শঙ্করাচার্যের গুরু কে ছিলেন?

তাঁর গুরু ছিলেন গোবিন্দ ভগবৎপদ।

৯। শঙ্করাচার্য কীভাবে হিন্দুধর্মে সংস্কার আনেন?

শঙ্করাচার্য বহুদেবতার পূজার বাইরে গিয়ে অদ্বৈত দর্শনের মাধ্যমে হিন্দুধর্মে একক ঈশ্বরের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন এবং হিন্দু ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করেন।

১০। শঙ্করাচার্য কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

তিনি কেরালার কালাদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

Leave a Comment